img

ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা : ডিজিটাল যুগে জিহবার বিপদ

প্রকাশিত :  ০৭:৪০, ২৯ জুলাই ২০২৫

ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা :  ডিজিটাল যুগে জিহবার বিপদ

শায়খ সাইয়েদ আনিসুল হক

এই সপ্তাহে, আমি এমন একটি বিষয় নিয়ে সরাসরি কথা বলতে চাই যা নিয়ে আমরা সবাই, আমি নিজেও সংগ্রাম করি। এটি এমন কোনো অঙ্গ বা অভ্যাস নয় যা নিয়ে আমরা সবসময়ই ভাবি, কিন্তু এর প্রভাব সর্বত্র- তা হলো আমাদের জিহবা।

জিহ্বার গুরুত্ব বোঝাতে আমি একটি হাদিস দিয়ে শুরু করছি। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে এসে বললেন: \"হে আল্লাহর রাসূল, একজন নারী রাতে নামায পড়ে, দিনে রোজা রাখে, দান-খয়রাত করে, কিন্তু তার জিহ্বা দ্বারা প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়।\" নবী (সাঃ) বললেন, \"তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। সে জাহান্নামের অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত।\"

এরপর লোকটি অন্য একজন নারীর বর্ণনা দিলেন, যে কেবল ফরয নামায আদায় করে এবং সামান্য কিছু দান করে, কিন্তু কাউকে কখনও কষ্ট দেয় না। তখন নবী (সাঃ) বললেন, \"সে জান্নাতের অধিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত।\"

এটি আমাদেরকে স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দেয় যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে আমাদের কথা বলার ধরনটা কতটা গুরুতর । কারণ এটি দেখায় যে, আমাদের সমস্ত ইবাদত আমাদের অসতর্কতার সাথে বলা কথার দ্বারা বাতিল হয়ে যেতে পারে । এই ছোট, হাড়বিহীন অঙ্গটি কাউকে জান্নাতে পৌছে দিতে পারে বা জাহান্নামে টেনে নামাতে পারে।

আর বর্তমান ডিজিটাল যুগে, এটি শুধু আমাদের মুখ দিয়ে বলা কথা নয় । আমাদের ফোন, আমাদের কীবোর্ড, আমাদের স্ক্রিন – এ সবই আমাদের জিহ্বার অংশ হয়ে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি মন্তব্য, একটি টুইট, একটি ম্যাসেজ, একটি ভয়েস নোট – এগুলোই এখন নতুন ধরনের কথা। আর এদের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতিও ঠিক ততটাই বাস্তব।

নবী (সাঃ) একবার একটি শক্তিশালী স্বপ্নের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির শাস্তির বর্ণনা দিয়েছেন, যার মিথ্যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল: একটি হুক দিয়ে বারবার তার মুখ ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছিল। এটি ভয়ঙ্কর। তবে এটি এমনই হওয়ার কথা। কারণ সত্য হলো, যখন আমরা আমাদের কথার ব্যাপারে অসতর্ক থাকি, তখন ক্ষতি আমাদের মধ্যেই থেমে থাকে না।

এক মুহূর্তের জন্য ভেবে দেখি যখন নবী (সাঃ) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, \"তোমরা কি জানো অভাবী কে?\" সাহাবারা উত্তর দিলেন, \"যার কোনো অর্থ বা সম্পদ নেই।\" কিন্তু নবী (সাঃ) বললেন, \"আমার উম্মতের মধ্যে অভাবী সে, যে কিয়ামতের দিন নামায, রোজা এবং যাকাত নিয়ে আসবে, কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো সম্পদ ভোগ করেছে, কারো রক্ত ঝরিয়েছে এবং অন্যকে মেরেছে। তাদের প্রত্যেককে তার নেক আমল থেকে প্রতিদান দেওয়া হবে। যদি তার নেক আমল শেষ হয়ে যায় ন্যায়বিচার হওয়ার আগেই, তবে তাদের পাপ তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে, এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।\"

এই হাদিসটি সত্যিই আমাদের থামিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। আমরা কত নামায পড়ি বা রোজা রাখি তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যদি আমরা আমাদের কথা এবং অন্যের প্রতি আমাদের আচরণে অসতর্ক থাকি। সবকিছুই গণ্য হয়। তাই আমি নিজেকে বারবার মনে করিয়ে দেই: আমার কথার হেফাজত করা ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা আমার নামাযের হেফাজত করা। এবং আমি আমাদের সবাইকে এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিতে অনুরোধ করছি, ঠিক যেমন আমরা আমাদের অর্থ ও সম্পত্তির সুরক্ষা করি, তেমনি আমাদের জিহ্বারও সুরক্ষা করা প্রয়োজন।

তাহলে কিভাবে আমরা এটি করব?

প্রথমত: মুরাকাবা- সর্বদা সচেতন থাকা যে আল্লাহ সবকিছু দেখেন এবং শোনেন। ইমাম ইবনুল কাইয়ুম (রাহঃ) এটিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, আপনার ভেতরের চিন্তা এবং বাইরের কাজগুলি আল্লাহর নজরে সর্বদা রয়েছে। প্রতিটি কথা, প্রতিটি পোস্ট, প্রতিটি কথোপকথন – সবই রেকর্ড করা হয়।

দ্বিতীয়ত: কাছরাতুস সামত – নীরবতা বৃদ্ধি করা। এর অর্থ হলো, কথা বলার সুস্পষ্ট উপকার না থাকলে নিজেদেরকে চুপ থাকতে প্রশিক্ষণ দেওয়া। নবী (সাঃ) বলেছেন, \"ভালো কথা বলো অথবা চুপ থাকো।\"

আমি এমন একটি ঘটনা বলতে চাই, যা আমার জন্য এটিকে খুব বাস্তব করে তুলেছিল। এক ঈদে, আমরা কয়েকজন মাসজিদের পুরনো একটি ভিডিও দেখছিলাম। প্রথমে আমরা কেবল হাসছিলাম এবং ভালো সময়গুলো স্মরণ করছিলাম, কিন্তু তারপর হাসিটা বদলে গেল। আমরা ভিডিওতে থাকা কিছু লোককে নিয়ে হাসাহাসি করতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই আমাদের এক ভাই, আল্লাহ তাঁর উপর রহমত করুন, হঠাৎ বললেন, \"ভাইয়েরা, আমরা হয়তো গিবত করছি।\" এভাবেই একটি হালকা মুহূর্ত পাপের দিকে মোড় নিয়েছিল।

তৃতীয়ত: জিহ্বাকে উপকারী কাজে ব্যস্ত রাখা – যিকির। নবী  (সাঃ) বলেছেন, \"তোমার জিহ্বাকে আল্লাহর স্মরণে সিক্ত রাখো।\" যদি আমরা এটিকে ভালো কাজে ব্যস্ত রাখি, তবে ক্ষতির সুযোগ কম থাকে।

এই সপ্তাহের খুতবা শেষ করার আগে, আমি এমন একটি দুঃখজনক ঘটনা স্মরণ করতে চাই যা আমাদের কখনও ভোলা উচিত নয় – স্রেব্রেনিকার গণহত্যা। এর ৩০তম বার্ষিকী স্মরণে, আমরা স্মরণ করি কিভাবে ৮ হাজারের  বেশি মুসলিম পুরুষ ও শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল এবং বিশ্ব তাকিয়ে দেখেছিল। ত্রিশ বছর পরেও, ব্যথা ঠিক ততটাই তাজা। আজও তাদের পরিবারগুলি শোক ও অবিচারের বোঝা বহন করছে।

আর আজকের দিনে আমরা চারপাশে তাকিয়ে দেখি, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আমাদের ফিলিস্তিনের ভাই-বোনেরা অকল্পনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে – বোমা হামলা, বাস্তুচ্যুতি, অনাহার এবং দখলদারিত্ব । আবারও বিশ্ব তাকিয়ে আছে।

হে আল্লাহ, আমাদের গুনাহ মাফ করুন এবং আমাদেরকে ভালো কথা বলার তাওফিক দিন । হে আল্লাহ, বসনিয়া ও ফিলিস্তিনের ভাই-বোনদের ওপর রহমত করুন । তাদের ন্যায়বিচার, শান্তি এবং বিজয় দান করুন । তাদের সম্মানের সাথে তাদের ঘরে ফিরিয়ে দিন । আমাদের ঈমানকে শক্তিশালী করুন এবং আমাদের জিহ্বাকে আপনার যিকিরে সিক্ত রাখুন। আমিন।

শায়খ সাইয়েদ আনিসুল হক : সিনিয়র ইমাম, ইস্ট লন্ডন মস্ক এন্ড লন্ডন মুসলিম সেন্টার। ১১ জুলাই ২০২৫


img

ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা : জীবন কোনো রঙ-তামাশা নয়

প্রকাশিত :  ০৮:০৭, ১৮ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৮:১২, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

শাইখ রাশিদ খান

ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো—এই ধর্ম দুনিয়াবী কর্মকাণ্ডকে নিরুত‍সাহিত করে না। ইসলাম আমাদের বলে না যে, আমরা ধন-সম্পদ, পরিবার, আরাম বা সৌন্দর্য পছন্দ না করি। বরং কুরআনে আল্লাহ নিজেই এগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন—এই জিনিসগুলো আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নয়।

কুরআনে বলা হয়েছে, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার শোভা। আর সৎকর্মসমূহ, যা চিরস্থায়ী, তা আপনার প্রতিপালকের নিকট অধিক প্রতিদানযোগ্য এবং প্রত্যাশার দিক দিয়ে উত্তম। (সূরা কাহাফ, আয়াত ৪৬)

এই আয়াত আমাদের শিখায় যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ধন-সম্পদ, মর্যাদা, পরিবার—সবই জীবনের সৌন্দর্য, কিন্তু এগুলো ভিত্তি নয় । এগুলো আমাদের আল্লাহর পথে সহায়তা করার জন্য, পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য নয়।

কুরআনের একটি বাস্তব উদাহরণ

সুরা কাহাফে এই আয়াতের আগেই আল্লাহ তায়ালা দুই ব্যক্তির একটি গল্প তুলে ধরেছেন, যাদের একজনের ছিল বিশাল বাগান, ফল-ফলাদি, নদী—সবই ছিল। কিন্তু সে অহংকারী হয়ে পড়ল। বলল, "আমি মনে করি না যে এটা কখনো শেষ হবে। " এমনকি সে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, যদি কেয়ামত আসে, তাহলেও সে আরও ভালো কিছু পাবে। এখানে তার সম্পদে সমস্যা ছিল না—সমস্যা ছিল তার অহংকারে, তার আত্মতুষ্টিতে এবং আল্লাহকে ভুলে যাওয়ায়।

ইসলাম দুনিয়াকে পরিত্যাগ করতে বলে না

ইসলাম কখনোই ইহ জীবনকে পরিত্যাগ করতে বলে না। বরং বলে- অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে । দুনিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করো, কিন্তু আল্লাহর দায়িত্ব ভুলে যেও না। উম্মাহর দুঃখ-কষ্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।

আজ আমরা দেখছি একটা আশার আলো—অনেক সন্তান পবিত্র কুরআন হিফজ করছে, তরুণেরা মসজিদে ফিরছে, বড়রাও ইসলাম শিখছে । আলহামদুলিল্লাহ, এটি একটি বড় নিয়ামত, বিশেষ করে মুসলিম জাহান নানা কষ্টে আছে । কিন্তু এই ফিরে আসা যেন শুধু কোনো সংকট বা আবেগের প্রতিক্রিয়া না হয় । এটা হতে হবে স্থায়ী পরিবর্তন।

শুধু আবেগ দিয়ে ইসলাম চলে না

আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে নাড়া দেয় তখনই, যখন কোনো বড় ঘটনা ঘটে—যেমন গাজার কোনো খবর, অথবা কোনো হৃদয়বিদারক ভাষণ । আমরা তখন দান করি, দোয়া করি, কাঁদি। তারপর… ভুলে যাই।

ইসলাম এমন অস্থায়ী আবেগ চায় না। আল্লাহ চান নিয়মিত করা। তিনি চান গম্ভীরতা। শুধু মুহূর্তে নয়, মুহূর্ত পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আমরা যেন আন্তরিক থাকি।

ইসলাম চায় ত্যাগ—আবশ্যক নয়, প্রয়োজনীয়

সত্যিকার ঈমান মানে কিছু না কিছু ত্যাগ করা—সময়, সম্পদ, আরামপ্রদ জীবন । ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার বদলানো বা র‍্যালিতে অংশ নেওয়া সহজ, কিন্তু প্রকৃত সহমর্মিতার বহি:প্রকাশ হলো, রাতের বেলা উঠে দোয়া করা, নিয়মিত ও গোপনে দান করা, যখন কোনো খবর আর মিডিয়ার শিরানাম থাকেনা, তখনও কষ্ট অনুভব করা। যদি আমরা ১০ মিনিট সময় বের করে দোয়া করতে পারিনা, তাহলে ভাবা দরকার—আমরা আসলেই কতটা আন্তরিক?

আমরা আমাদের সন্তানদের কী শিখাচ্ছি?

যদি আমরা নিজেদের না বদলাই, তাহলে আমাদের সন্তানেরা ইসলামকে মনে করবে শুধু কোনো মজার অনুষ্ঠান বা অনলাইন কনটেন্ট । তারা বুঝবে না কষ্ট কীভাবে সহ্য করতে হয়। ইসলাম তাদের কাছে শুধু সুখের ধর্ম হয়ে উঠবে—উদ্দেশ্য, ইবাদত, দায়িত্বের ধর্ম নয়।

আল্লাহ বলেন, হে বিশ্বাসীগণ, ইসলাম পূর্ণরূপে গ্রহণ করো। (সূরা বাকারা, আয়াত ২০৮)

মানে, আধা-আধা নয়, সম্পূর্ণভাবে। শুধু আবেগে নয়, দায়িত্বেও।

রাসুল (সা:) বলেছেন “যে ব্যক্তি দুনিয়াকেই তার প্রধান চিন্তা বানায়, আল্লাহ তার সব কাজ বিখণ্ডিত করে দেন। কিন্তু যে ব্যক্তি আখিরাতকে তার চিন্তা বানায়, আল্লাহ তাকে পরিপূর্ণ করেন এবং দুনিয়াও তার কাছে আসে, যদিও সে সেটা চায় না।” আল্লাহকে আগে রাখলে, দুনিয়া আমাদের পেছনে আসে । দুনিয়াকে আগে রাখলে, নিজের মধ্যে শুধু শুন্যতা অনুভব হবে।

হে আল্লাহ, আমাদের আন্তরিক বানাও। আমাদের সাহায্য করো যেন আমরা সব কাজে তোমাকে অগ্রাধিকার দিই । তোমার জন্য ত্যাগ করতে শিখি। দুনিয়ার সৌন্দর্যে বিভোর না হই। উম্মাহর কষ্টে যেন আমাদের কষ্ট হয়, এমন অন্তর দাও। এবং আমাদের সন্তানদের শেখাও—ইসলাম শুধু আনন্দ নয়, দায়িত্ব, ত্যাগ আর পরিপূর্ণতা।


(ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা । তারিখ: ১০ অক্টোবর ২০২৫ ।
শায়েখ রাশিদ খান : অতিথি খাতিব ।)

ধর্ম এর আরও খবর