
ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা : জীবন কোনো রঙ-তামাশা নয়

শাইখ রাশিদ খান
ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো—এই ধর্ম দুনিয়াবী কর্মকাণ্ডকে নিরুতসাহিত করে না। ইসলাম আমাদের বলে না যে, আমরা ধন-সম্পদ, পরিবার, আরাম বা সৌন্দর্য পছন্দ না করি। বরং কুরআনে আল্লাহ নিজেই এগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন—এই জিনিসগুলো আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নয়।
কুরআনে বলা হয়েছে, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার শোভা। আর সৎকর্মসমূহ, যা চিরস্থায়ী, তা আপনার প্রতিপালকের নিকট অধিক প্রতিদানযোগ্য এবং প্রত্যাশার দিক দিয়ে উত্তম। (সূরা কাহাফ, আয়াত ৪৬)
এই আয়াত আমাদের শিখায় যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ধন-সম্পদ, মর্যাদা, পরিবার—সবই জীবনের সৌন্দর্য, কিন্তু এগুলো ভিত্তি নয় । এগুলো আমাদের আল্লাহর পথে সহায়তা করার জন্য, পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য নয়।
কুরআনের একটি বাস্তব উদাহরণ
সুরা কাহাফে এই আয়াতের আগেই আল্লাহ তায়ালা দুই ব্যক্তির একটি গল্প তুলে ধরেছেন, যাদের একজনের ছিল বিশাল বাগান, ফল-ফলাদি, নদী—সবই ছিল। কিন্তু সে অহংকারী হয়ে পড়ল। বলল, "আমি মনে করি না যে এটা কখনো শেষ হবে। " এমনকি সে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, যদি কেয়ামত আসে, তাহলেও সে আরও ভালো কিছু পাবে। এখানে তার সম্পদে সমস্যা ছিল না—সমস্যা ছিল তার অহংকারে, তার আত্মতুষ্টিতে এবং আল্লাহকে ভুলে যাওয়ায়।
ইসলাম দুনিয়াকে পরিত্যাগ করতে বলে না
ইসলাম কখনোই ইহ জীবনকে পরিত্যাগ করতে বলে না। বরং বলে- অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে । দুনিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করো, কিন্তু আল্লাহর দায়িত্ব ভুলে যেও না। উম্মাহর দুঃখ-কষ্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।
আজ আমরা দেখছি একটা আশার আলো—অনেক সন্তান পবিত্র কুরআন হিফজ করছে, তরুণেরা মসজিদে ফিরছে, বড়রাও ইসলাম শিখছে । আলহামদুলিল্লাহ, এটি একটি বড় নিয়ামত, বিশেষ করে মুসলিম জাহান নানা কষ্টে আছে । কিন্তু এই ফিরে আসা যেন শুধু কোনো সংকট বা আবেগের প্রতিক্রিয়া না হয় । এটা হতে হবে স্থায়ী পরিবর্তন।
শুধু আবেগ দিয়ে ইসলাম চলে না
আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে নাড়া দেয় তখনই, যখন কোনো বড় ঘটনা ঘটে—যেমন গাজার কোনো খবর, অথবা কোনো হৃদয়বিদারক ভাষণ । আমরা তখন দান করি, দোয়া করি, কাঁদি। তারপর… ভুলে যাই।
ইসলাম এমন অস্থায়ী আবেগ চায় না। আল্লাহ চান নিয়মিত করা। তিনি চান গম্ভীরতা। শুধু মুহূর্তে নয়, মুহূর্ত পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আমরা যেন আন্তরিক থাকি।
ইসলাম চায় ত্যাগ—আবশ্যক নয়, প্রয়োজনীয়
সত্যিকার ঈমান মানে কিছু না কিছু ত্যাগ করা—সময়, সম্পদ, আরামপ্রদ জীবন । ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার বদলানো বা র্যালিতে অংশ নেওয়া সহজ, কিন্তু প্রকৃত সহমর্মিতার বহি:প্রকাশ হলো, রাতের বেলা উঠে দোয়া করা, নিয়মিত ও গোপনে দান করা, যখন কোনো খবর আর মিডিয়ার শিরানাম থাকেনা, তখনও কষ্ট অনুভব করা। যদি আমরা ১০ মিনিট সময় বের করে দোয়া করতে পারিনা, তাহলে ভাবা দরকার—আমরা আসলেই কতটা আন্তরিক?
আমরা আমাদের সন্তানদের কী শিখাচ্ছি?
যদি আমরা নিজেদের না বদলাই, তাহলে আমাদের সন্তানেরা ইসলামকে মনে করবে শুধু কোনো মজার অনুষ্ঠান বা অনলাইন কনটেন্ট । তারা বুঝবে না কষ্ট কীভাবে সহ্য করতে হয়। ইসলাম তাদের কাছে শুধু সুখের ধর্ম হয়ে উঠবে—উদ্দেশ্য, ইবাদত, দায়িত্বের ধর্ম নয়।
আল্লাহ বলেন, হে বিশ্বাসীগণ, ইসলাম পূর্ণরূপে গ্রহণ করো। (সূরা বাকারা, আয়াত ২০৮)
মানে, আধা-আধা নয়, সম্পূর্ণভাবে। শুধু আবেগে নয়, দায়িত্বেও।
রাসুল (সা:) বলেছেন “যে ব্যক্তি দুনিয়াকেই তার প্রধান চিন্তা বানায়, আল্লাহ তার সব কাজ বিখণ্ডিত করে দেন। কিন্তু যে ব্যক্তি আখিরাতকে তার চিন্তা বানায়, আল্লাহ তাকে পরিপূর্ণ করেন এবং দুনিয়াও তার কাছে আসে, যদিও সে সেটা চায় না।” আল্লাহকে আগে রাখলে, দুনিয়া আমাদের পেছনে আসে । দুনিয়াকে আগে রাখলে, নিজের মধ্যে শুধু শুন্যতা অনুভব হবে।
হে আল্লাহ, আমাদের আন্তরিক বানাও। আমাদের সাহায্য করো যেন আমরা সব কাজে তোমাকে অগ্রাধিকার দিই । তোমার জন্য ত্যাগ করতে শিখি। দুনিয়ার সৌন্দর্যে বিভোর না হই। উম্মাহর কষ্টে যেন আমাদের কষ্ট হয়, এমন অন্তর দাও। এবং আমাদের সন্তানদের শেখাও—ইসলাম শুধু আনন্দ নয়, দায়িত্ব, ত্যাগ আর পরিপূর্ণতা।