img

ডলারের মান বৃদ্ধি ও টাকার মান হ্রাস: কারণ ও বিশ্লেষণ -রেজুয়ান আহম্মেদ

প্রকাশিত :  ১২:০২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৪, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ডলারের মান বৃদ্ধি ও টাকার মান হ্রাস: কারণ ও বিশ্লেষণ -রেজুয়ান আহম্মেদ

আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ডলারের মান বৃদ্ধি এবং টাকার মান কমে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ কাজ করে। এই বিষয়টি বুঝতে হলে বৈশ্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক এবং স্থানীয় অর্থনীতির প্রভাবগুলির বিশদ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এখানে আমরা ডলারের মান বৃদ্ধির এবং টাকার মান হ্রাসের পেছনের কারণগুলো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করব।

ডলারের মান বৃদ্ধির কারণ

১. অর্থনৈতিক শক্তি ও স্থিতিশীলতা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ডলার বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা। অর্থনৈতিক শক্তি এবং স্থিতিশীলতা ডলারের শক্তি বাড়াতে সহায়ক। মার্কিন অর্থনীতি শক্তিশালী থাকলে, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, যা ডলারের মান বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে।

২. বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ: আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রক্রিয়ায় ডলারের ব্যবহার ব্যাপক। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য লেনদেনে ডলার ব্যবহৃত হয়। এই কারণে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চাহিদার জন্য ডলার প্রয়োজনীয়, যা ডলারের মান বৃদ্ধি করে।

৩. মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি: মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ফেডারেল রিজার্ভ) এর সুদের হার নির্ধারণের নীতি ডলারের মানে প্রভাব ফেলতে পারে। সুদের হার বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগকারীরা বেশি লাভের প্রত্যাশায় ডলার কেনে, যা ডলারের মূল্য বাড়িয়ে দেয়।

৪. আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা: বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, যেমন যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং অর্থনৈতিক সংকট, ডলারের নিরাপত্তার প্রতি বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। ফলস্বরূপ, এই ধরনের পরিস্থিতিতে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

৫. মার্কিন অর্থনীতির বৃদ্ধি: মার্কিন অর্থনীতি দ্রুত প্রবৃদ্ধি হলে, এটি বৈশ্বিক বাজারে ডলারের চাহিদা বাড়িয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সূচক যেমন উচ্চ জিডিপি বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান ডলারের মান বাড়াতে সহায়তা করে।

টাকার মান হ্রাসের কারণ

১. বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি: বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি একটি প্রধান সমস্যা। আমদানি বাড়লেও রপ্তানি কম থাকলে, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি সৃষ্টি হয়। এই ঘাটতি টাকার মান কমিয়ে দেয়, কারণ বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন বেশি হলেও টাকার সরবরাহ কম থাকে।

২. মুদ্রাস্ফীতি: উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি টাকার মান কমিয়ে দেয়। যখন মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায় এবং টাকার বাস্তব মূল্য হ্রাস পায়। মুদ্রাস্ফীতির কারণে পণ্য ও সেবার দাম বাড়ে, যা টাকার মানকে প্রভাবিত করে।

৩. অর্থনৈতিক অস্থিরতা: বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুর্বলতা, ও প্রশাসনিক সমস্যাগুলি টাকার মানে প্রভাব ফেলে। এই ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস কমিয়ে দেয় এবং টাকার মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

৪. বৈদেশিক ঋণ ও সুদের চাপ: বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং ঋণের সুদের চাপ টাকার মান কমিয়ে দিতে পারে। ঋণ পরিশোধে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন বেড়ে গেলে, এটি দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করে।

৫. আন্তর্জাতিক বাজারে তুলনা: আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় টাকার মান কমে গেলে, এটি একটি সমস্যা সৃষ্টি করে। অন্যান্য শক্তিশালী অর্থনীতির মুদ্রার তুলনায় টাকার মান কম হলে, এটি বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস কমিয়ে দেয়।

ডলারের মান বৃদ্ধি ও টাকার মান হ্রাস: প্রতিকার ও সুপারিশ

ডলারের মান বৃদ্ধি এবং টাকার মান হ্রাসের সমস্যার মোকাবিলায় একটি সুষম অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের কিছু সুপারিশ নিম্নরূপ:

১. রপ্তানি বৃদ্ধি: রপ্তানি বৃদ্ধি করে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে। নতুন বাজার খোঁজা এবং রপ্তানি উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক নীতির উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ।

২. মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর monetary policy গ্রহণ করা প্রয়োজন। সুদের হার বাড়ানো এবং বেতন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সাহায্য করতে পারে।

৩. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।

৪. বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা: বৈদেশিক ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং পুনঃঅর্থায়নের ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ঋণের বোঝা কমানো যায়।

৫. বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানো: আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন।

উপসংহার

ডলারের মান বৃদ্ধির এবং টাকার মান হ্রাসের পেছনে বিভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ও বৈশ্বিক কারণ কাজ করে। এই সমস্যাগুলির মোকাবিলা করতে হলে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা পর্যালোচনা এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সুষম অর্থনৈতিক নীতি এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা টাকার মানের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে একটি শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করবে।


রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম

অর্থনীতি এর আরও খবর

img

১২ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত :  ১৫:৪৩, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৯৮ কোটি ৬৬ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ১১ হাজার ৮৩৯ কোটি ২০ লাখ টাকা।

সোমবার (১৪ অক্টোবর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য বলছে, চলতি মাস অক্টোবরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি ২২ লাখ ডলার বা ৯৮৬ কোটি টাকার রেমিট্যান্স আসছে। এভাবে রেমিট্যান্স আসার ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে আড়াই বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে প্রবাসী আয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, এই সময়ে রাষ্ট্র-মালিকানাধীন ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪ কোটি ৫৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মধ্যে একটি ব্যাংকের (কৃষি ব্যাংক) মাধ্যমে এসেছে ৪ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার, বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৬৯ কোটি ৩৫ লাখ ৭০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ২৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার।

এই সময়ে ১১ ব্যাংকের মাধ্যমে কোনো রেমিট্যান্স পাঠাননি প্রবাসীরা। ব্যাংকগুলো হলো- রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা বিডিবিএল, বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বা রাবাক। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে কমিউনিটি ব্যাংক, সিটিজেন্স ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। আর বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে রয়েছে হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং উরি ব্যাংক।

উল্লেখ্য, গত জুন মাসে ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ ডলার প্রবাসী আয় আসার পর চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় ১৯১ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত ১০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম আয় ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় গত আগস্টে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার প্রবাসী আয় দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। আর গত সেপ্টেম্বরে দেশে এসেছে চলতি অর্থবছরের সর্বোচ্চ ২৪০ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার।


অর্থনীতি এর আরও খবর