 
                    
                    
                    
                    কথার ফাঁদে জড়ানো: অতি বাক্যের জটিলতা!
 
                                    রেজুয়ান আহম্মেদ
মানুষের মুখে কথা অবিরাম প্রবাহিত হয়, কিন্তু সেই প্রবাহ যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়, তবে তা শুধু নিজের জন্য নয়, চারপাশের মানুষদের জন্যও সমস্যার কারণ হতে পারে। কথা বলার শক্তিই মানুষকে অনন্য করে তোলে, কিন্তু অতিরিক্ত কথা অনেক সময় সম্পর্কের জট তৈরি করে, যা খুলতে গিয়ে আরও জটিল হয়ে যায়। যেমন, একটি সুতা যদি অগোছালোভাবে রাখা হয়, তবে তাতে প্যাঁচ লেগে যায়। তেমনি মাত্রাতিরিক্ত কথা বলার প্রবণতাও অপ্রয়োজনীয় জটিলতা তৈরি করে।
এই লেখায় আমরা আলোচনা করব, কীভাবে অতিরিক্ত কথা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে এবং সংযমী হওয়া কীভাবে জীবনকে সহজ ও সুন্দর করে তোলে।
অতিরিক্ত কথা বলার প্রবণতা: কেন ঘটে এই সমস্যা?
মানুষের মধ্যে অহেতুক কথা বলার প্রবণতা নতুন কিছু নয়। যুগে যুগে মানুষ কথার মাধ্যমে নিজের গুরুত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছে। কেউ গল্প বলার নেশায় কথা বলে যান, কেউবা নিজের জ্ঞান জাহির করতে চান, আবার কেউ চুপ থাকতে না পারার কারণে অহেতুক কথা বলে ফেলেন। কিন্তু যখন কথার স্রোত মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন তা সমস্যা তৈরি করে।
অতিরিক্ত কথা বলার কিছু সাধারণ কারণ:
✔ নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের চেষ্টা – অনেকে মনে করেন, বেশি কথা বললেই তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ফুটে উঠবে। অথচ বাস্তবতা হলো, সংযত কথাই বেশি মূল্যবান।
✔ শ্রোতার অনুভূতি উপেক্ষা করা – যারা সবসময় কথা বলেন, তারা অনেক সময় অন্যের অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল থাকেন না। ফলে অন্যরা বিরক্ত হন এবং সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
✔ নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনা – বেশি কথা বলার ফলে অনেক সময় গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যায়, যা ভবিষ্যতে সমস্যার কারণ হতে পারে।
অতিরিক্ত কথা বলার বাস্তব সমস্যা
১. কর্মক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি
কর্মক্ষেত্রে এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা কাজের চেয়ে কথা বলতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। তারা ভাবেন, সব বিষয়ে মতামত দিলে বস বা সহকর্মীরা তাদের গুরুত্ব দেবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের বিরক্তিকর মনে করা হয় এবং ধীরে ধীরে তারা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন।
একটি বাস্তব ঘটনা:
রফিক সাহেব একজন অফিস কর্মচারী। তিনি প্রতিটি মিটিংয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে সময় নষ্ট করতেন। অফিসের সবাই তার কথা শুনে ক্লান্ত হয়ে পড়ত এবং ধীরে ধীরে তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তার বসও বুঝতে পারেন, রফিক কাজে যতটা দক্ষ, তার চেয়েও বেশি সময় ব্যয় করেন অহেতুক কথা বলে। শেষ পর্যন্ত অফিসের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় তাকে ডাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২. পারিবারিক জীবনে অশান্তি
সংসারে যদি কেউ মাত্রাতিরিক্ত কথা বলেন এবং অন্যের মতামত শোনার অভ্যাস না রাখেন, তবে তা দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
একটি বাস্তব উদাহরণ:
রিমা নামের এক নারী তার স্বামীর প্রতিটি কাজে হস্তক্ষেপ করেন এবং সব বিষয়ে অতিরিক্ত কথা বলেন। ছোটখাটো বিষয়েও তিনি বিশদ আলোচনা করেন, যা তার স্বামী ও সন্তানদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে কথা বলা কমিয়ে দেন এবং একসময় তার উপস্থিতি এড়িয়ে চলতে শুরু করে। ফলে তিনি একাকীত্বে ভুগতে থাকেন।
৩. সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কমে যাওয়া
অতিরিক্ত কথা বলার ফলে মানুষ ধীরে ধীরে সমাজের কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। সবাই জানে, তারা অহেতুক কথা বলেন, তাই কেউ তাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনে না।
একটি গ্রাম্য ঘটনা:
রফিক মোল্লা নামের এক ব্যক্তি গ্রামে প্রতিটি বিষয়ে মতামত দিতেন। তিনি এত বেশি কথা বলতেন যে, একসময় গ্রামের মানুষ তাকে গুরুত্ব দিতে ছেড়ে দেয়। এমনকি একদিন যখন তিনি সত্যি সত্যি একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর দিলেন, তখনও কেউ তা বিশ্বাস করল না। তার অতিরিক্ত কথা বলার অভ্যাসের কারণে মানুষ মনে করেছিল, এটাও হয়তো তার আরেকটি অপ্রয়োজনীয় কথা!
কথার সংযম: ভালো জীবনের জন্য অপরিহার্য
১. কম কথা বলা মানেই বুদ্ধিমানের লক্ষণ
ইতিহাসের সফল ব্যক্তিদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা বেশি শোনেন, কম বলেন। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, স্টিভ জবস—এরা সকলেই কথার চেয়ে কাজকে বেশি গুরুত্ব দিতেন।
২. কাজের চেয়ে কথাকে বড় করে না তোলা
সফলতা আসে কাজের মাধ্যমে, কথার মাধ্যমে নয়। যারা শুধু কথা বলেন, কিন্তু কাজ করেন না, তারা বেশিদিন মানুষের শ্রদ্ধা পান না।
৩. অন্যের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করা
যদি আমরা সংযতভাবে কথা বলি, তবে অন্যের কথা শোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত করে।
একগোছা সুতা যেমন গোছাতে গিয়ে প্যাঁচ লেগে যায়, তেমনি মানুষের কথাও যদি সীমাহীন হয়, তবে তা সমস্যা তৈরি করে। সমাজে, পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যক্তিগত জীবনে সংযমী বাক্প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের মনে রাখতে হবে—\"কম কথা, বেশি কাজ\" নীতিই সফলতার আসল চাবিকাঠি। তাই, আমাদের উচিত অপ্রয়োজনীয় কথা কমিয়ে কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া। সংযত কথা বললে জীবনের প্রতিটি বাঁক সহজ হবে, জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
 
                             
                    









 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                     
                    








