
ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের হুঁশিয়ারি— “চেয়ারম্যান পদত্যাগ করুন, না হলে পালানোরও সুযোগ পাবেন না!”
নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে চলমান ধসের ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম হতাশা, ক্ষোভ ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের দুই প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ—ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-এ শেয়ারদরের পতন অব্যাহত থাকায় বহু বিনিয়োগকারী তাদের মূলধনের সিংহভাগ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ দাবি করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিনিয়োগকারী ফোরাম এবং সরাসরি সমাবেশে একটি হৃদয়বিদারক স্লোগান এখন সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—
“জনাব খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, এখনো সময় আছে, পদত্যাগ করে সরে যান। না হলে পালানোরও সুযোগ পাবেন না।”
এই স্লোগানে বিনিয়োগকারীদের হতাশা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের সম্মিলিত প্রতিধ্বনি ফুটে উঠেছে। তাদের মতে, চেয়ারম্যান ও কমিশনের কিছু সদস্যের পক্ষপাতদুষ্ট, অদক্ষ ও অব্যবস্থাপনার কারণে পুঁজিবাজার আজ চরম দুর্দশায় পড়েছে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থার ভাঙন
গত কয়েক মাস ধরে দেশের শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক দরপতন চলছে। অনেক কোম্পানির শেয়ারদর ‘ফ্লোর প্রাইস’-এর কাছাকাছি এসে লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারে তারল্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। বিনিয়োগকারীরা বারবার নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
তাদের অভিযোগ, একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও বিএসইসি এখন কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। কমিশনের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা বাজার রক্ষার চেয়ে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার দিকেই বেশি মনোযোগী।
কেন ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা?
বিনিয়োগকারীদের মতে, পুঁজিবাজারের অবস্থা এখন এমন যে, হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনেছেন, কিন্তু এখন তা বিক্রি করেও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। বাজারে বিক্রেতা থাকলেও ক্রেতার অভাব চরম। এর ফলে বহু পরিবার দুঃসহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
তারা বলছেন, “এই বাজারে না আছে নিয়ম, না আছে নিরপেক্ষতা। কেবলই মুনাফালোভী গোষ্ঠীর আধিপত্য, ইনসাইডার ট্রেডিং এবং ফ্লোর প্রাইস নামক কৃত্রিম ফাঁদ। অথচ এসব বিষয়ে বিএসইসি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”
বিএসইসি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ
বিনিয়োগকারীরা চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনেছেন। তাদের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে—
১. বাজার বিপর্যয়ের সময় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা,
২. স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক সিদ্ধান্ত গ্রহণ,
৩. ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা,
৪. লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতা,
৫. ‘ফ্লোর প্রাইস’ ব্যবস্থার অপব্যবহার,
৬. বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অনীহা ও পক্ষপাতমূলক আচরণ।
বিনিয়োগকারীদের দাবিসমূহ
১. বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের অবিলম্বে পদত্যাগ,
২. একজন দক্ষ, নিরপেক্ষ ও বিনিয়োগবান্ধব ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান করে কমিশন পুনর্গঠন,
৩. পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন,
৪. ‘ফ্লোর প্রাইস’ তুলে দিয়ে চাহিদা ও সরবরাহনির্ভর বাজারব্যবস্থা চালু,
৫. ইনসাইডার ট্রেডিং ও প্রাতিষ্ঠানিক দখলদারিত্ব প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা,
৬. সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় একটি বিশেষ সেল গঠন,
৭. শেয়ারবাজারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা,
৮. বিনিয়োগ শিক্ষা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক কার্যক্রম চালু।
বিশ্লেষকদের অভিমত
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, পুঁজিবাজার একটি দেশের অর্থনীতির আয়না। বিনিয়োগকারীদের আস্থা যত দৃঢ় হয়, দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি তত মজবুত হয়। শেয়ারবাজারে সুশাসনের অভাব বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে, শিল্পায়ন থামিয়ে দেয় এবং কর্মসংস্থান হ্রাস করে।
একজন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ বলেন, “পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত চাপমুক্ত একটি শক্তিশালী, স্বচ্ছ এবং দায়িত্বশীল কমিশন গঠন জরুরি। যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া বাজার ঘুরে দাঁড়াবে না।”
চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে জনরায়ের প্রতিফলন?
চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে বিনিয়োগকারীদের হুঁশিয়ারিভাষ্য যতই কঠোর মনে হোক, এটি আসলে এক ক্ষুব্ধ, হতাশ ও অসহায় জনগোষ্ঠীর আর্তনাদ। যারা সঞ্চয়, ঋণ ও জীবনের পুঁজি নিয়ে একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজ তারা দিশাহারা। এই প্রতিবাদে হুমকির চেয়ে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও গভীর বেদনার প্রকাশই বেশি।
সরকার যদি বিনিয়োগকারীদের এই দাবিকে উপেক্ষা করে, তাহলে তা কেবল পুঁজিবাজার নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের এই করুণ দশা কেবল অর্থনৈতিক দুর্বলতা নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। একদিকে স্বপ্নভঙ্গ বিনিয়োগকারী, অন্যদিকে দায়িত্বহীন নেতৃত্ব—এই বৈপরীত্য দূর করা না গেলে আস্থার সঙ্কট থেকেই যাবে এবং বিনিয়োগ পরিবেশ আরও নাজুক হয়ে পড়বে।
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একমাত্র প্রত্যাশা— অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ, নিরপেক্ষ নেতৃত্ব এবং শেয়ারবাজারকে রক্ষা করার জন্য একটি সর্বাত্মক জাতীয় উদ্যোগ। অন্যথায়, এই সংকট আরও ঘনীভূত হবে এবং দেশের অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।