পুঁজিবাজারে ধস অব্যাহত

img

ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের হুঁশিয়ারি— “চেয়ারম্যান পদত্যাগ করুন, না হলে পালানোরও সুযোগ পাবেন না!”

প্রকাশিত :  ০৬:৫০, ১৪ মে ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের হুঁশিয়ারি— “চেয়ারম্যান পদত্যাগ করুন, না হলে পালানোরও সুযোগ পাবেন না!”

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিন ধরে চলমান ধসের ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম হতাশা, ক্ষোভ ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের দুই প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ—ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-এ শেয়ারদরের পতন অব্যাহত থাকায় বহু বিনিয়োগকারী তাদের মূলধনের সিংহভাগ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের পদত্যাগ দাবি করেছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিনিয়োগকারী ফোরাম এবং সরাসরি সমাবেশে একটি হৃদয়বিদারক স্লোগান এখন সর্বত্র প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—

“জনাব খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, এখনো সময় আছে, পদত্যাগ করে সরে যান। না হলে পালানোরও সুযোগ পাবেন না।”

এই স্লোগানে বিনিয়োগকারীদের হতাশা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদের সম্মিলিত প্রতিধ্বনি ফুটে উঠেছে। তাদের মতে, চেয়ারম্যান ও কমিশনের কিছু সদস্যের পক্ষপাতদুষ্ট, অদক্ষ ও অব্যবস্থাপনার কারণে পুঁজিবাজার আজ চরম দুর্দশায় পড়েছে।

বিনিয়োগকারীদের আস্থার ভাঙন

গত কয়েক মাস ধরে দেশের শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক দরপতন চলছে। অনেক কোম্পানির শেয়ারদর ‘ফ্লোর প্রাইস’-এর কাছাকাছি এসে লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে। বাজারে তারল্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। বিনিয়োগকারীরা বারবার নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

তাদের অভিযোগ, একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হওয়া সত্ত্বেও বিএসইসি এখন কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। কমিশনের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা বাজার রক্ষার চেয়ে নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার দিকেই বেশি মনোযোগী।

কেন ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীরা?

বিনিয়োগকারীদের মতে, পুঁজিবাজারের অবস্থা এখন এমন যে, হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঋণ নিয়ে শেয়ার কিনেছেন, কিন্তু এখন তা বিক্রি করেও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। বাজারে বিক্রেতা থাকলেও ক্রেতার অভাব চরম। এর ফলে বহু পরিবার দুঃসহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।

তারা বলছেন, “এই বাজারে না আছে নিয়ম, না আছে নিরপেক্ষতা। কেবলই মুনাফালোভী গোষ্ঠীর আধিপত্য, ইনসাইডার ট্রেডিং এবং ফ্লোর প্রাইস নামক কৃত্রিম ফাঁদ। অথচ এসব বিষয়ে বিএসইসি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”

বিএসইসি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ

বিনিয়োগকারীরা চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনেছেন। তাদের অভিযোগের মধ্যে রয়েছে—

১. বাজার বিপর্যয়ের সময় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা,

২. স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থবোধক সিদ্ধান্ত গ্রহণ,

৩. ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ উপেক্ষা,

৪. লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতা,

৫. ‘ফ্লোর প্রাইস’ ব্যবস্থার অপব্যবহার,

৬. বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অনীহা ও পক্ষপাতমূলক আচরণ।

বিনিয়োগকারীদের দাবিসমূহ

১. বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের অবিলম্বে পদত্যাগ,

২. একজন দক্ষ, নিরপেক্ষ ও বিনিয়োগবান্ধব ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান করে কমিশন পুনর্গঠন,

৩. পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন,

৪. ‘ফ্লোর প্রাইস’ তুলে দিয়ে চাহিদা ও সরবরাহনির্ভর বাজারব্যবস্থা চালু,

৫. ইনসাইডার ট্রেডিং ও প্রাতিষ্ঠানিক দখলদারিত্ব প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা,

৬. সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় একটি বিশেষ সেল গঠন,

৭. শেয়ারবাজারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা,

৮. বিনিয়োগ শিক্ষা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক কার্যক্রম চালু।

বিশ্লেষকদের অভিমত

অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, পুঁজিবাজার একটি দেশের অর্থনীতির আয়না। বিনিয়োগকারীদের আস্থা যত দৃঢ় হয়, দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি তত মজবুত হয়। শেয়ারবাজারে সুশাসনের অভাব বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে, শিল্পায়ন থামিয়ে দেয় এবং কর্মসংস্থান হ্রাস করে।

একজন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ বলেন, “পুঁজিবাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত চাপমুক্ত একটি শক্তিশালী, স্বচ্ছ এবং দায়িত্বশীল কমিশন গঠন জরুরি। যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া বাজার ঘুরে দাঁড়াবে না।”

চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবিতে জনরায়ের প্রতিফলন?

চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে বিনিয়োগকারীদের হুঁশিয়ারিভাষ্য যতই কঠোর মনে হোক, এটি আসলে এক ক্ষুব্ধ, হতাশ ও অসহায় জনগোষ্ঠীর আর্তনাদ। যারা সঞ্চয়, ঋণ ও জীবনের পুঁজি নিয়ে একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজ তারা দিশাহারা। এই প্রতিবাদে হুমকির চেয়ে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও গভীর বেদনার প্রকাশই বেশি।

সরকার যদি বিনিয়োগকারীদের এই দাবিকে উপেক্ষা করে, তাহলে তা কেবল পুঁজিবাজার নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের এই করুণ দশা কেবল অর্থনৈতিক দুর্বলতা নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। একদিকে স্বপ্নভঙ্গ বিনিয়োগকারী, অন্যদিকে দায়িত্বহীন নেতৃত্ব—এই বৈপরীত্য দূর করা না গেলে আস্থার সঙ্কট থেকেই যাবে এবং বিনিয়োগ পরিবেশ আরও নাজুক হয়ে পড়বে।

এই পরিস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একমাত্র প্রত্যাশা— অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ, নিরপেক্ষ নেতৃত্ব এবং শেয়ারবাজারকে রক্ষা করার জন্য একটি সর্বাত্মক জাতীয় উদ্যোগ। অন্যথায়, এই সংকট আরও ঘনীভূত হবে এবং দেশের অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অর্থনীতি এর আরও খবর

img

শেয়ারবাজারে কারসাজি: সাকিবসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

প্রকাশিত :  ১৪:৫০, ১৭ জুন ২০২৫

শেয়ারবাজার থেকে শতকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

আজ মঙ্গলবার (১৭ জুন) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক নিয়মিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন।

মামলার বাদি দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন। 

এ মামলার প্রধান আসামি সমবায় অধিদপ্তরের উপ-নিবন্ধক ও শেয়ার বাজারের আলোচিত ব্যক্তি মো. আবুল খায়ের (হিরু)। দ্বিতীয় আসামি সাকিব আল হাসান। অন্যান্য আসামিরা হলেন- কাজি সাদিয়া হাসান, আবুল কালাম মাদবর, কনিকা আফরোজ, মোহাম্মদ বাশার, সাজেদ মাদবর, আলেয়া বেগম, কাজি ফুয়াদ হাসান, কাজি ফরিদ হাসান, শিরিন আক্তার, জাভেদ এ মতিন, মো. জাহেদ কামাল, মো. হুমায়ূন কবির ও তানভীর নিজাম।

দুদক জানায়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দ্রুত আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে শেয়ারবাজারে প্রচলিত আইন ও বিধি (সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ এর ১৭ ধারা) লঙ্ঘন করেছেন।

তারা নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিও একাউন্টে অবৈধভাবে সিরিজ ট্রানজেকশন,  প্রতারণামূলক একটিভ ট্রাডিং, গেম্বলিং, ও স্পেকুলেশন-এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারে কৃত্রিমভাবে নির্দিষ্ট কিছু শেয়ারের দাম বৃদ্ধি করে বাজারে কারসাজি করেন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হারান।

এই পদ্ধতিতে ২৫৬ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার ৩০৪ টাকা আত্মসাৎ করা হয়, যা ‘অপরাধলব্ধ অর্থ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত। এর মধ্যে আবুল খায়ের (হিরু) তার স্ত্রী কাজি সাদিয়া হাসানের সহায়তায় ২৯ কোটি ৯৪ লাখ ৪২ হাজার ১৮৫ টাকার উৎস গোপন করে বিভিন্ন খাতে স্থানান্তর করেন।

এছাড়া তার নামে পরিচালিত ১৭টি ব্যাংক একাউন্টে মোট ৫৪২ কোটি ৩১ লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ টাকার অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদক জানায়, আসামি মো. আবুল খায়ের (হিরু) কর্তৃক শেয়ার বাজারে কারসাজিকৃত প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স লি., ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স লি. এবং সোনালী পেপারস লি.-এর শেয়ারে সাকিব আল হাসান বিনিয়োগ করেন। এতে সাকিব মার্কেট ম্যানুপুলেশনে সরাসরি সহায়তা করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ২ কোটি ৯৫ লাখ ২ হাজার ৯১৫ টাকা রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইনের নামে শেয়ার বাজার থেকে আত্মসাৎ করেন।

দুদক জানায়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন মর্মে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হওয়ায় কমিশনের অনুমোদনক্রমে আসামিদের বিরুদ্ধে  ২০১২ এর ৪ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/১২০(বি)/১০৯ ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

দুদক জানিয়েছে, তদন্ত শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।