img

শ্রীমঙ্গলের ডা. রমা রঞ্জন দেব: মানবতার চিকিৎসক ও সমাজসেবী এক আলোকবর্তিকা

প্রকাশিত :  ০৮:৫২, ১২ অক্টোবর ২০২৫

শ্রীমঙ্গলের ডা. রমা রঞ্জন দেব: মানবতার চিকিৎসক ও সমাজসেবী এক আলোকবর্তিকা

সংগ্রাম দত্ত: মৌলভীবাজার জেলার ভাতগাঁও গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন ডা. রমা রঞ্জন দেব। কিন্তু তাঁর জীবনকর্ম ও মানবিক অবদান তাঁকে শুধু মৌলভীবাজার কিংবা শ্রীমঙ্গলের নয়, বরং বাংলাদেশের চিকিৎসা ও সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্থান দিয়েছে। পেশায় চিকিৎসক হলেও তিনি ছিলেন সমাজসেবক, সংগঠক, মানবিক রাজনীতিক এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় এক নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক। মৃত্যুর দীর্ঘ বছর পরেও তাঁর অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে চলেছেন শ্রীমঙ্গলবাসী।

শৈশব ও শিক্ষাজীবন:

১৯৪০ সালের ২৭ জুন মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কনকপুর ইউনিয়নের ভাতগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ডা. রমা রঞ্জন দেব। তাঁর পিতা ছিলেন রাম বিহারী দেব। শৈশব থেকেই মেধাবী রমা রঞ্জন শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। তিনি শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫০-এর দশকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর সিলেট এম.সি. কলেজ থেকে আইএসসি এবং পরবর্তীতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করে চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

চিকিৎসা পেশাকে তিনি শুধুমাত্র জীবিকার মাধ্যম হিসেবে দেখেননি; বরং মানবসেবাকে জীবনধারার মূল দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

কর্মজীবনের পথচলা:

ডা. দেবের চাকরিজীবন শুরু হয় জেমস ফিনলে চা-বাগানে চিকিৎসক হিসেবে। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি সেই চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। শ্রীমঙ্গলে এসে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন এবং অচিরেই এলাকার মানুষের আস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন।

পরে তিনি পাথফাইন্ডার এনজিওর ক্লিনিক ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। সেখানে তিনি চা-শ্রমিকদের পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার কার্যক্রম পরিচালনায় অসামান্য ভূমিকা রাখেন। তাঁর প্রচেষ্টায় হাজারো প্রান্তিক শ্রমিক পরিবারের চিকিৎসা সেবা সহজলভ্য হয়ে ওঠে।

মানবিক চিকিৎসক:

চিকিৎসক হিসেবে ডা. দেব ছিলেন একেবারেই ভিন্ন ধাঁচের। অর্থের লোভ তাঁকে কখনো গ্রাস করতে পারেনি। আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিভাজনকে তিনি চিকিৎসাসেবায় স্থান দেননি। ভিন্ন দলের নেতা-কর্মী, এমনকি দরিদ্র সাধারণ মানুষও বিনা খরচে তাঁর কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন।

একটি ঘটনা অনেকের মনে অম্লান হয়ে আছে। ২০০১ সালের দিকে তিনি লেখকের পরিবারকে কুকুরের কামড় প্রতিরোধক ভ্যাকসিন নিতে সতর্ক করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, জলাতঙ্ক হলে আর প্রতিকার থাকবে না। এমন মানবিক সতর্কতাই প্রমাণ করে তিনি কতটা আন্তরিক ও সচেতন চিকিৎসক ছিলেন।

পারিবারিক জীবন:

ব্যক্তিজীবনে ডা. দেব ছিলেন একজন সফল পিতা। তাঁর পরিবারেও শিক্ষার আলো ও কর্মসংস্থানের প্রতিফলন ঘটেছে।

বড় ছেলে জালালাবাদ গ্যাসে উপ-ব্যবস্থাপক, শ্রীমঙ্গল অফিসে কর্মরত।

দ্বিতীয় ছেলে উওম কুমার দেব সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস, শ্রীমঙ্গল শাখায় কর্মরত।

একমাত্র কন্যা মধুমিতা পুরকায়স্থ (জিল্পি) বর্তমানে কানাডা প্রবাসী।

ছোট ছেলে রূপম দেব ডাচ-বাংলা ব্যাংক, মৌলভীবাজার শাখায় কর্মকর্তা।

মুক্তিযুদ্ধে অবদান:

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ডা. রমা রঞ্জন দেব সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে যান। সেখানে তিনি বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিকামী তরুণদের উৎসাহিত করতেন, বক্তব্য দিতেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতেন। শুধু তাই নয়, তিনি শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবাও দিতেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর এই অবদান আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের তালিকায় তাঁর নাম নেই। স্থানীয়দের মতে, এটি এক বড় অবিচার, যা সংশোধন হওয়া উচিত।

সামাজিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম:

ডা. দেব কেবল চিকিৎসক ছিলেন না, ছিলেন বহুমুখী সংগঠকও। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

বাংলাদেশ অন্ধকল্যাণ সমিতি, মৌলভীবাজার শাখার সভাপতি

বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ), মৌলভীবাজারের সভাপতি

NATAB (জাতীয় শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশন) সভাপতি

ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ (বেসরকারি থাকাকালীন) গভর্নিং বডির সভাপতি

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, শ্রীমঙ্গল উপজেলা শাখার সভাপতি

এছাড়াও তিনি বহু ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা:

ডা. দেব জীবনের শুরু থেকেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। \'৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের শ্রীমঙ্গল থানা কমিটির সভাপতি পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে তিনি কখনো স্বার্থের রাজনীতি করেননি। তাঁর কাছে রাজনীতি ছিল মানুষের সেবা করার আরেকটি মাধ্যম। তাই আওয়ামী লীগের কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ ভোটার— সবাই তাঁকে মানবিক চিকিৎসক হিসেবেই বেশি মনে রেখেছেন।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার:

২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ডা. রমা রঞ্জন দেব শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি তিন পুত্র ও এক কন্যা রেখে যান। তবে তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার শুধু পরিবার নয়— পুরো শ্রীমঙ্গলবাসীর কাছে অমূল্য সম্পদ।

আজও শ্রীমঙ্গলের মানুষ তাঁকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। তাঁর নাম শুনলেই মানুষ মানবিকতা, সৎ চিকিৎসা ও সমাজসেবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।

উপসংহার-

ডা. রমা রঞ্জন দেব ছিলেন চিকিৎসা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি সমাজসেবার প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। পেশাগত দায়িত্ববোধ, মুক্তিযুদ্ধকালীন ত্যাগ, রাজনৈতিক নিষ্ঠা এবং মানবিক চরিত্র তাঁকে অসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

যদিও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের অবদান স্বীকৃত হয়নি, তবুও ইতিহাস ও মানুষের স্মৃতিতে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। বলা যায়, ডা. দেব ছিলেন শ্রীমঙ্গলবাসীর নির্ভরতার প্রতীক, মানবিক চিকিৎসক এবং সমাজের আলোকবর্তিকা।

সিলেটের খবর এর আরও খবর

img

সিলেট নগরীর রাস্তায় আজ থেকে হকার বসতে পারবে না

প্রকাশিত :  ১৮:৩৫, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

দীর্ঘদিন ধরে সিলেট নগরীর প্রধান সড়কগুলোতে হকারদের দখলদারিত্বের কারণে নাগরিকরা যে দুর্ভোগে ভুগছেন, সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় অবশেষে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে জেলা প্রশাসন। নগরীর ব্যস্ততম এলাকায় হকার বসা ও অস্থায়ী দোকান স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

আজ রোববার (১৯ অক্টোবর) থেকে এই নির্দেশনা কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে জানানো হয়েছে: বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, লামাবাজার, তালতলা, আম্বরখানা ও চৌহাট্টাসহ নগরীর সব গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল এলাকায় দিন বা রাতের যেকোনো সময় হকারি বা অস্থায়ী দোকান বসানো যাবে না।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে, নির্দেশ অমান্য করে কেউ যদি নির্ধারিত এলাকায় হকারি কার্যক্রম চালান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে প্রযোজ্য আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দীর্ঘদিন ধরে সিলেট নগরীর ফুটপাত ও সড়কের পাশে হকারদের অনিয়ন্ত্রিত দখলদারিত্বে যানজট ও জনদুর্ভোগ নিত্যদিনের চিত্রে পরিণত হয়েছিল। এবার সেই বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে প্রশাসন মাঠে নামছে বলে জানা গেছে।

জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, নগরবাসীর নির্বিঘ্ন চলাচল, শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং পরিচ্ছন্ন নগর পরিবেশ গড়ে তুলতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করে বলেন, প্রশাসনের এ প্রচেষ্টায় যদি সবাই অংশ নেন, তাহলে সিলেট আরও বাসযোগ্য ও সৌন্দর্যমণ্ডিত শহরে রূপ নিতে পারবে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম বলেন, লালদিঘির পাড় মাঠে হকারদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সবাইকে সেখানে চলে যেতে হবে। নগরের ব্যস্ততম এলাকার সড়কে হকারদের বসতে দেওয়া হবে না। বসলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর আগে এসএমপির পক্ষ থেকেও রাস্তা ও ফুটপাতে চলাচলে বিঘ্ন ঘটে এমন কোন কর্মকাণ্ড ঘটলে তাদের বিরুদ্ধ ট্রাফিক আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে রাখা হয়েছে।

রোববার সকাল থেকে জলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন ও এসএমপি মিলে ফুটপাত মুক্ত রাখতে নগরীতে অভিযানে থাকবে। তাদের সহায়তায় র‌্যাব-৯ এর পক্ষ থেকে একটি ইউনিট নগরীতে মোতায়েন থাকবে।

সিলেটের খবর এর আরও খবর