img

তুরস্কে বিমান দুর্ঘটনায় লিবিয়ার সেনাপ্রধানসহ নিহত ৮

প্রকাশিত :  ০৫:১৭, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫

তুরস্কে বিমান দুর্ঘটনায় লিবিয়ার সেনাপ্রধানসহ নিহত ৮

তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার কাছে একটি বিমান দুর্ঘটনায় লিবিয়ার সেনাপ্রধান মুহাম্মদ আলী আহমেদ আল-হাদ্দাদ নিহত হয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার রাতে আঙ্কারার এসেনবোগা বিমানবন্দর থেকে ত্রিপোলির উদ্দেশে উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বহনকারী প্রাইভেট জেটটি বিধ্বস্ত হয়। এই দুর্ঘটনায় সেনাপ্রধানসহ আরও চারজন উচ্চপদস্থ লিবীয় সামরিক কর্মকর্তা ও তিনজন ক্রু সদস্য নিহত হয়েছেন।

লিবিয়ার জাতিসংঘ–স্বীকৃত সরকারের প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ দবেইবা এক বিবৃতিতে আল-হাদ্দাদের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। তিনি ঘটনাটিকে ‘মহাবিপর্যয়কর’ উল্লেখ করে বলেন, আঙ্কারায় সরকারি সফর শেষে দেশে ফেরার পথেই এই দুর্ঘটনা ঘটে। দবেইবার ভাষায়, ‘এই মহাবিপর্যয় দেশ, সেনাবাহিনী ও জনগণের জন্য এক বিশাল ক্ষতি। আমরা এমন সব মানুষকে হারিয়েছি, যাঁরা আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের সেবা করেছেন এবং শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও জাতীয় অঙ্গীকারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।’

দুর্ঘটনায় নিহত অন্য সেনা কর্মকর্তারা হলেন স্থলবাহিনীর প্রধান আল-ফিতুরি ঘারিবিল, সামরিক বাহিনীর উৎপাদন কর্তৃপক্ষের পরিচালক মাহমুদ আল-কাতাওয়ি, সেনাপ্রধানের উপদেষ্টা মুহাম্মদ আল-আসাওই দিয়াব এবং সামরিক চিত্রগ্রাহক মুহাম্মদ ওমর আহমেদ মাহজুব।

তুরস্কের প্রেসিডেন্টের কমিউনিকেশনস ডিরেক্টরেটের প্রধান বুরহানেত্তিন দুরান জানান, দাসো ফ্যালকন–৫০ মডেলের জেটটি বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে জরুরি অবতরণের অনুরোধ করেছিল। বিমানটি আঙ্কারায় ফেরার প্রস্তুতির সময় অবতরণ পর্যায়ে রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলী ইয়েরলিকায়া জানান, স্থানীয় সময় রাত ৮টা ১০ মিনিটে উড্ডয়নের পর রাত ৮টা ৫২ মিনিটের দিকে নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে বিমানটির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে আঙ্কারার হায়মানা জেলার কেসিককাভাক গ্রামের প্রায় দুই কিলোমিটার দক্ষিণে ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়, যা রাজধানী থেকে প্রায় ৭৪ কিলোমিটার দূরে।

তুরস্কের কর্মকর্তারা আল–জাজিরাকে জানিয়েছেন, প্রাথমিক তদন্তে নাশকতার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। তাদের ভাষায়, দুর্ঘটনার প্রাথমিক কারণ প্রযুক্তিগত ত্রুটি। এ ঘটনায় আঙ্কারার প্রধান প্রসিকিউটর কার্যালয় আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে। লিবিয়ার সরকারও তদন্তে সহযোগিতার জন্য একটি প্রতিনিধি দল আঙ্কারায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার হিসেবে পরিচিত আল-হাদ্দাদ ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফিবিরোধী বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ২০২০ সালের আগস্ট থেকে সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। পশ্চিম লিবিয়ায় তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিল এবং দেশটির বিভক্ত রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

দুর্ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটল, যখন এর এক দিন আগে তুরস্কের পার্লামেন্ট লিবিয়ায় নিজেদের সেনা মোতায়েনের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৪ সাল থেকে লিবিয়ায় সমান্তরাল দুই সরকার বিদ্যমান। ত্রিপোলিভিত্তিক দবেইবা সরকারের সঙ্গে আঙ্কারার ঘনিষ্ঠ সামরিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০২০ সালে তুরস্ক প্রথমবারের মতো লিবিয়ায় সেনাসদস্য পাঠায় এবং পরবর্তী সময়ে দুই দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ ও জ্বালানি অনুসন্ধান–সংক্রান্ত একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আল-হাদ্দাদের এই সফরে দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা খাতে ‘দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা’ নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার আকস্মিক মৃত্যুতে লিবিয়াজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সরকার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে; সব সরকারি ভবনে অর্ধনমিত রাখা হয়েছে জাতীয় পতাকা এবং স্থগিত করা হয়েছে সব ধরনের আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান।

img

ইরান মানেই স্যাঙ্কশন ; কতটুকু সম্পর্ক সম্ভব!

প্রকাশিত :  ১৭:৪৯, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫

সাইফুল খান 

ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক স্যাঙ্কশন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ–ইরান প্রযুক্তিগত সম্পর্ক পুরোপুরি অসম্ভব, এ ধারণা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। বরং সঠিকভাবে খাত নির্বাচন করলে এবং সামরিক বা ডুয়াল-ইউজ প্রযুক্তি এড়িয়ে চললে বেসামরিক ও মানবিক পরিসরে দুই দেশের মধ্যে আইনসম্মত ও বাস্তবসম্ভব সহযোগিতা গড়ে তোলা যায়। ইরান দীর্ঘদিন ধরে স্যাঙ্কশনের ভেতর টিকে থাকার জন্য যে ধরনের স্বনির্ভর বেসামরিক প্রযুক্তি উন্নয়ন করেছে, সেগুলোর অনেকটাই বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রয়োজনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিলে যায়।

সবচেয়ে নিরাপদ ও স্যাঙ্কশন-সহনশীল ক্ষেত্র হচ্ছে ফার্মাসিউটিক্যাল ও মেডিকেল প্রযুক্তি। ইরান জেনেরিক ও বায়োসিমিলার ওষুধ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সক্ষমতা তৈরি করেছে। যেখানে ফর্মুলেশন টেকনোলজি, কোয়ালিটি কন্ট্রোল সিস্টেম এবং বিকল্প কাঁচামাল ব্যবহারের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের জন্য কার্যকর হতে পারে। পাশাপাশি ডায়ালাইসিস মেশিন, ডায়াগনস্টিক কিট কিংবা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যারের মতো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ও প্রযুক্তি মানবিক পণ্যের আওতায় পড়ে, যা সাধারণত আন্তর্জাতিক স্যাঙ্কশনের বাইরে থাকে।

কৃষি প্রযুক্তি ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও ইরানের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শুষ্ক ও লবণাক্ত জমিতে চাষের জন্য স্যালাইন-রেজিস্ট্যান্ট বীজ, ড্রিপ ইরিগেশন ও স্মার্ট সার ব্যবস্থাপনা; এসব প্রযুক্তি ইরান স্যাঙ্কশনের চাপে নিজস্বভাবে উন্নয়ন করেছে। একই সঙ্গে পোস্ট-হারভেস্ট পর্যায়ে কোল্ড স্টোরেজ নকশা, খাদ্য সংরক্ষণ, কেমিক্যাল ও স্বল্প ব্যয়ের প্যাকেজিং প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে, বিশেষ করে উপকূলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলে।

আইটি ও সফটওয়্যার সহযোগিতাও সম্ভব, যদি তা পুরোপুরি বেসামরিক ও নন-মিলিটারি পরিসরে রাখা হয়। ই-গভর্ন্যান্স সফটওয়্যার, ডেটা সেন্টার ম্যানেজমেন্ট, লোকাল ক্লাউড সল্যুশন কিংবা ওপেন-সোর্স ভিত্তিক সিস্টেমে ইরানের নিজস্ব দক্ষতা রয়েছে। তবে এখানে এনক্রিপশন, সাইবার-ওয়ারফেয়ার বা ব্যাংকিং ও সামরিক কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত সফটওয়্যার থেকে দূরে থাকাই বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ কৌশল।

নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে ইরান স্যাঙ্কশনের বাস্তবতায় নিজস্ব সোলার প্রযুক্তি উন্নয়ন করেছে। সোলার প্যানেল লোকাল অ্যাসেম্বলি, ইনভার্টার ও চার্জ কন্ট্রোলার ডিজাইন কিংবা গ্রামীণ মাইক্রোগ্রিড মডেল ; এসব বেসামরিক প্রযুক্তি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় বাস্তব অবদান রাখতে পারে এবং স্যাঙ্কশন সেনসিটিভও নয়। একইভাবে পানি ব্যবস্থাপনা ও ডেসালিনেশন প্রযুক্তিতে ইরানের অভিজ্ঞতা উপকূলীয় বাংলাদেশের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। লো-কস্ট পানি বিশুদ্ধকরণ ইউনিট, গ্রামীণ ফিল্টারেশন ব্যবস্থা ও ছোট স্কেলের ডেসালিনেশন প্রযুক্তি মানবিক প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের বাইরে থাকে।

একাডেমিক ও গবেষণা সহযোগিতা হচ্ছে স্যাঙ্কশন অতিক্রম করার সবচেয়ে নিরাপদ পথ। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল রিসার্চ, পাবলিক হেলথ ও বায়োটেকনোলজিতে যৌথ গবেষণা, জার্নাল প্রকাশ, কনফারেন্স এবং নন-মিলিটারি বিষয়ে পিএইচডি বা পোস্ট-ডক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি জ্ঞানভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। পাশাপাশি শিল্প ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে প্লাস্টিক ও পলিমার প্রযুক্তি, সিমেন্ট ও সিরামিক প্রসেসিং এবং লাইট ইন্ডাস্ট্রি অটোমেশনের মতো ক্ষেত্রেও সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে।

তবে কিছু সীমা স্পষ্টভাবে মানা জরুরি। ড্রোন, মিসাইল, রাডার, ডুয়াল-ইউজ এআই বা এনক্রিপশন প্রযুক্তি, অস্ত্র সংশ্লিষ্ট ইলেকট্রনিক্স কিংবা ইরানের রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক ; এসব ক্ষেত্র বাংলাদেশকে এড়িয়ে চলতেই হবে। বাস্তব কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ যদি প্রাইভেট সেক্টরনির্ভর সমঝোতা, একাডেমিক–ইন্ডাস্ট্রি সহযোগিতা, মানবিক ও এসডিজি ফ্রেমিং, তৃতীয় দেশের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার এবং ডলারবিহীন বা বার্টারভিত্তিক লেনদেনের পথ অনুসরণ করে, তাহলে স্যাঙ্কশন ভাঙা ছাড়াই ইরানের সঙ্গে প্রযুক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব।

মোদ্দাকথা হলো, ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা অসম্ভব নয়; বরং তা হতে হবে সচেতনভাবে বেছে নেওয়া বেসামরিক, মানবিক, কৃষি, স্বাস্থ্য, আইটি ও নবায়নযোগ্য শক্তিকেন্দ্রিক। এই পথে এগোলে একদিকে আন্তর্জাতিক স্যাঙ্কশন কাঠামোর ভেতর থাকা সম্ভব হবে, অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সংঘাত এড়িয়ে বাংলাদেশ নিজের আত্মনির্ভরতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ধাপে ধাপে বাড়াতে পারবে।

সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইরান যেকোন মুসলিম দেশকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা করতে ভীষন আন্তরিক। বাংলাদেশের সাথে ইরানের সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও মর্যাদাসম্পন্ন। তাই ইরানের সাথে বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পর্ক উভয় জাতির জন্যই কল্যানকর। 

(লেখক-ইতিহাস,রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।)