
সিলেটে ভেঙে ফেলা হচ্ছে জিন্নাহর স্মৃতিবিজড়িত 'মিনিস্টার বাড়ি'

ভেঙে ফেলা হচ্ছে সিলেটের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি। সিলেট জুড়ে শতাব্দীর আভিজাত্য ও ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাড়িটি।
জেলার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর তালিকায় যে বাড়িটির নাম একসময় গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হতো, সেটিই আজ ভেঙে পড়ছে বুলডোজারের নিচে। ইট-সিমেন্টের স্তূপে পরিণত হচ্ছে শতবর্ষের গল্প, হারিয়ে যাচ্ছে এক নগর-ঐতিহ্যের মূল্যবান অধ্যায়।
সিলেট নগরের মধ্য পশ্চিমে অবস্থিত ঐতিহাসিক জনপদ পাঠানটুলা। এই এলাকায় নিঃশব্দে ভেঙে ফেলা হচ্ছে প্রায় ১১৫ বছরের স্থাপনা—সাবেক মন্ত্রী আবদুল হামিদের পুরনো বাড়ি। সময়ের সাক্ষী এই বাড়িটি কেবল একটি স্থাপনা নয়, বরং সিলেটের নগর জীবন স্থাপত্য ঐতিহ্যের এক জীবন্ত দলিল। আবদুল হামিদ পাকিস্তানের সরকারের প্রভাবশালী শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। আসামের প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী ও পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন। তাদের পরিবারের নির্মিত এই বাড়ি গত ১০০ বছর ধরে
'মিনিস্টার বাড়ি ' হিসেবে সিলেট জুড়ে সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল। এই বাড়িতে অতিথি হয়েছেন পাকিস্তানের কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ ব্রিটিশ ভারতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আবদুর রহমান হিরা সোমবার ( ২০ অক্টোবর) দুপুরে জানতে পারেন মিনিস্টার বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। তিনি দৌড়ে ছুটে চলেন পাঠানটুলায়। সেখানে গিয়ে বুলডোজারের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত প্রাচীন এই স্থাপনা ভাঙার কয়েকটি ছবি নিয়ে তিনি জালাবাবাদ আবাসিক এলাকায় তার বন্ধু একজন সিনিয়র সাংবাদিকের সাথে বিষয়টি শেয়ার করেন। এরপর তিনি মিনিস্টার বাড়ি ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলার ছবি তার আইডিতে শেয়ার করেন। বিষয়টি
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় মুহূর্তে।
আবদুর রহমান হীরা মিনিস্টার বাড়ির উত্তরাধিকারের একজনের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কথা বলেন।
বাড়ির মালিকপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, স্থাপনাটি ‘ব্যবহার অনুপযোগী’ হয়ে পড়েছিল। বাড়ির ছাদে ফাটল দেখা দেয়ায় নিরাপত্তার স্বার্থে ভেঙে ফেলা ছাড়া উপায় ছিল না। তাদের দাবি—‘আমাদেরও মন খারাপ হচ্ছে, কিন্তু ছাদ ড্যামেজ হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই ভাঙতে হচ্ছে।’
তবে সিলেট শহরের সচেতন নাগরিকদের অনেকেই এই সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
অনেকের আক্ষেপ দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবদুর রহমান হীরার সহপাঠী রেজাউল করিম আলো লিখেছেন, ‘শুধু ছাদ ড্যামেজ হওয়ার কারণে শতবর্ষী স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না। যদিও এটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি, কিন্তু এমন একটি শৈল্পিক ইমারত এখন আর নির্মাণ করা সম্ভব নয়। এরকম ঐতিহ্য ধ্বংস করা যতটা সহজ, সৃষ্টি করা তার চেয়ে বহু গুণ কঠিন। ব্যথিত হলাম, মর্মাহত হলাম।’
কামরুজ্জামান রনি’ নামের একজন মন্তব্যে লিখেন, এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি বিক্রয়ের জন্য ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখেছি।
জালাল আহমেদ জালাল নামের আরেকজন লিখেন, সিলেট থেকে বাসে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে এই বাড়িটি দেখতাম। এ বাড়িতে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বিশ্রাম নিয়েছেন।
সিলেট শহরের পুরনো স্থাপত্যগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার দৌড়ে। কিন্তু প্রতিটি ধ্বংসের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শহরের ইতিহাসের টুকরো। হারিয়ে যাচ্ছে সেই কারুকাজ, সেই নান্দনিক ছোঁয়া যা একসময় সিলেটকে আলাদা করে জানান দিতো বাংলাদেশ ও বিশ্বের মানুষের মধ্যে।
স্থাপত্যবিদদের মতে, শতবর্ষী ভবনগুলো কেবল ইট-পাথরের দেয়াল নয়—এগুলো একটি সময়ের সংস্কৃতি, জীবনধারা ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন। এমন স্থাপনা ভাঙার আগে সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেয়া দুঃখজনক।