
৪০ গাড়ি ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি

সন্ত্রাসীরা চাঁদার দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন গাড়ির শোরুমের সামনে একের পর ককটেল নিক্ষেপ ও ফোনে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। গত ছয় মাসে অন্তত ৪০ গাড়ি ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা চেয়ে ফোন করা হয়েছে। চাঁদা না দিলে তাদের পরিবারের সদস্যদের অপহরণ করার হুমকিও দিয়েছে এ চক্র।
এদিকে গাড়ির শোরুমে চাঁদার প্রতিবাদে রোববার রাস্তায় নেমে প্রতিকার চাইলেন রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীরা। এমনকি ব্যবসায়ীদের মানববন্ধনের পর বিদেশ থেকে ফোন করে চাঁদাবাজ চক্র তাদের শাসিয়েছে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ে পেশাদার চিহ্নিত অপরাধীদের পাশাপাশি নতুন মুখও দেখা যাচ্ছে। দুর্বৃত্তদের অনেকে দেশের বাইরে থেকে ফোন করে চাঁদা দাবি করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে বসে গাড়ি ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছে তারা। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয় ব্যবসায়ী ভাটারা থানায় জিডি করেছেন। যাদের টার্গেট করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশের শোরুম রাজধানীর প্রগতি সরণি, বারিধারা ও আশপাশ এলাকায়।
১৩ অক্টোবর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি বাসায় প্রক্সিমা বায়িং হাউসের মালিক আলী নূর ইসলাম জীবনকে জিম্মি করে একটি চাঁদাবাজ চক্র। মুক্তিপণ হিসেবে তাঁর কাছে প্রথমে ২০ লাখ টাকা দাবি করা হয়। এক পর্যায়ে বলা হয়, ১০ লাখ টাকা পেলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাৎক্ষণিকভাবে এত টাকা দিতে না পারায় আলী নূরের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব নম্বর থেকে ৭৫ হাজার টাকা, নগদ এক লাখ টাকা, তিনটি মোবাইল ফোনসেট, একটি ল্যাপটপ ও টয়োটা ব্র্যান্ডের একটি গাড়ি নিয়ে তিন সদস্যের চক্রটি পালিয়ে যায়। এই ঘটনায় ভাটারা থানায় চাঁদাবাজির মামলার পর গতকাল মঙ্গলবার যশোর থেকে গাড়িটি উদ্ধার করেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে ভাটারা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, চাঁদাবাজ চক্রটির দলনেতাকে নিয়াজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রীকে যশোর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিয়াজুর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। তাঁর স্ত্রী শান্ত-মারিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। প্রায় একই ধরনের ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা রয়েছে। অভিনব উপায়ে ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে চাঁদাবাজি করছে তারা। তাদের সঙ্গে আর কারা রয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত চলছে।
গতকাল রাতে ব্যবসায়ী আলী নূর ইসলাম বলেন, এক বন্ধুর মাধ্যমে নিয়াজুরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তবে কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। স্যাম্পল দেখানোর কথা বলে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় ডেকে নেন নিয়াজুর। এরপর আমাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ছুরির আঘাত লাগে।
এদিকে চাঁদাবাজের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে আছেন রিকন্ডিশন্ড গাড়ি ব্যবসায়ীরা। সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর বারিধারায় বেগ অটোর সামনে চাঁদার দাবিতে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এখন পর্যন্ত ১২টি গাড়ির শোরুমে একই আদলে হামলা হয়েছে। তবে জড়িত একজনকেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
হুমকি পাওয়া চার ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছে সমকাল। তারা বলেছেন, পাঁচ থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে বিদেশি নম্বর থেকে ফোন করা হচ্ছে। ছেলেমেয়ে কোথায় পড়ছে, সেটা জানিয়ে অপহরণের হুমকি দেওয়া হয়। অধিকাংশ ঘটনায় কাশেম দ্বীপ নামে একজন তাঁর পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদা দাবি করছেন। কিছু ঘটনায় দাদা বিনোধ ও পটকা বাবুর নাম আসছে। পুলিশ বলছে, দ্বীপ ও বিনোধ দেশের বাইরে রয়েছে।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আবদুল হক বলেন, এত বছর ধরে গাড়ি ব্যবসা করছি, কখনও ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের হুমকি ব্যবসায়ীরা পাইনি। ছয় মাস ধরে এটা চলছে। প্রথমে ভেবেছিলাম দুষ্টু ছেলেপেলে এমনটা করছে। পরে দেখি শোরুমের সামনে ককটেল মারতে শুরু করল। এখন পর্যন্ত ৪০ জন এমন হুমকি পেয়েছে। দুবাইয়ে বসে মাফিয়া স্টাইলে গাড়ি ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছে দ্বীপ নামে একজন। সে নিজেকে সাবেক যুবলীগ নেতা বলে পরিচয় দেয়। আমরা পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছি। এর পরও চাঁদাবাজদের হুমকি, ভয়ভীতি প্রদর্শন বন্ধ হয়নি। বাধ্য হয়ে আমরা মানববন্ধন করেছি।
ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত চাঁদার দাবিতে যেসব গাড়ি ব্যবসায়ীকে হুমকি ও শোরুমের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে তার মধ্যে আছে– কার সিলেকশন, বেগ অটো, টারবো অটো, হ্যালো কারস, বিসমিল্লাহ কারস, ওশান মোটরস, এলএনবি কার, বিশ্বাস ইম্পোটার্স এবং ওয়ালি কার।
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, যেসব নম্বর থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সবই দেশের বাইরের নম্বর। থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট তদন্তে নেমেছে। এ ছাড়া যে মোটরসাইকেল দিয়ে এসে ককটেল ফাটানো হচ্ছে, তার নম্বরও ভুয়া।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের অপরাধীদের শনাক্ত করতে প্রযুক্তিগত তদন্ত করার সক্ষমতা থানা পুলিশের নেই। তদন্তের একটি পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে তাদের থেমে থাকতে হচ্ছে। তাঁর ভাষ্য, নতুন নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পুলিশকে এখনও যেতে হচ্ছে। পুরোপুরি মনোবল ফেরত আসেনি। অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার মুখেও পড়তে হচ্ছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ যাতে ঝটিকা মিছিল বের করতে না পারে, সেদিকে বাড়তি মনোযোগ রাখতে হচ্ছে। জুলাইয়ের আন্দোলনের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান চালাতে হয়। এর সঙ্গে আছে প্রায় প্রতিদিন নানা দাবিতে সড়ক অবরোধ, ঘেরাও এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। পাশাপাশি অপরাধ চক্রে নতুন মুখ আসায় তাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করে আইনের আওতায় আনতে হচ্ছে।
এদিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও পল্লবী এলাকায় চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। চাঁদার দাবিতে ১১ জুলাই পল্লবীর আলব্দিরটেক এলাকায় এ কে বিল্ডার্স নামের আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়। এ সময় হামলাকারীরা চারটি গুলি করে। দুর্বৃত্তদের গুলিতে শরিফুল ইসলাম নামে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা আহত হন। ২১ মার্চ বছিলার সিটি হাউজিংয়ে ব্যবসায়ী নাজিম খানের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। এই ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
চাঁদা দাবি ও হামলার ঘটনায় আগেই পল্লবী থানায় জিডি করেছিলেন এ কে বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান কাইউম আলী খান। জিডিতে তিনি অভিযোগ করেন, ২৭ জুন তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রথমবার হামলা করা হয়। এর পর ৪ জুলাই আবার হামলা করে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা। তারা ভয়ভীতি ও প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পল্লবীতে চাঁদাবাজির ঘটনায় ঘুরেফিরে তিন ভাইয়ের নামে আসে। বিদেশে অবস্থান করা তিন ভাই হলেন– মফিজুর রহমান মামুন, মজিবুর রহমান জামিল ও মশিউর রহমান। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তারা চিহ্নিত অপরাধী হিসেবে পরিচিত। মিরপুর-পল্লবীর অপরাধ জগতের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। মামুনের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং পল্লবীতে অন্তত ২৭টি মামলা আছে।
গত ২ জানুয়ারি চাঁদা আদায়কে ঘিরে আতঙ্ক তৈরিতে মিরপুরের রূপনগরের একটি তৈরি পোশাক কারখানার সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ ছাড়া মিরপুরে এক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবির অডিও ভাইরাল হয়েছিল। চাঁদার দাবিতে ১৪ ফেব্রুয়ারি রূপনগরের দুয়ারীপাড়ার একটি নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে শ্রমিকদের মারধর করে সন্ত্রাসীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বেশ কয়েকজন শীর্ষ অপরাধী মুক্তি পেয়েছেন। তাদের নাম ব্যবহার করেও বিভিন্ন মার্কেটে চাঁদা দাবি করা হয়। পিচ্চি হেলাল, ইমনসহ অন্তত ছয় আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে বের হন। সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে ফোন পেলেও ভুক্তভোগী অনেকে ভয়ে মুখ খুলতে চান না। এ ছাড়া রাজনৈতিক পরিচয়ে অনেকে চাঁদাবাজি করছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) তালেবুর রহমান বলেন, চাঁদাবাজির ঘটনায় কেউ যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেয়, পুলিশ অবশ্যই তদন্ত করে দেখবে।