সিলেটের রেলপথে আটকে থাকা প্রতিশ্রুতি: স্বপ্নের ট্রেন কবে চলবে?
সংগ্রাম দত্ত: বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হৃদয় সিলেট—যেখানে প্রবাসী অর্থনীতি, চা শিল্প, হাওরের জীববৈচিত্র্য ও পর্যটনের অফুরন্ত সম্ভাবনা একে জাতীয় উন্নয়নের মূল ধারায় রাখার কথা ছিল। অথচ আজও সিলেটবাসীর কাছে রেল মানেই ‘অপেক্ষা’। ট্রেন আছে, কিন্তু গতি নেই; পরিকল্পনা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই।
২০১৭ সাল থেকে একের পর এক প্রতিশ্রুতি—কখনো নতুন ট্রেন চালুর ঘোষণা, কখনো ডবল লাইন প্রকল্পের অনুমোদন, কখনো উড়ালসড়ক নির্মাণের অঙ্গীকার—সবই কাগজে আছে, বাস্তবে নেই। রেলওয়ে দপ্তরের টেবিলে আটকে থাকা এসব প্রকল্প আজ সিলেটের উন্নয়নকে যেন থামিয়ে দিয়েছে এক স্টেশনে।
ডবল লাইন প্রকল্প স্থগিত: সিলেটের উন্নয়নে প্রথম বড় ধাক্কা
২০১৯ সালে ঘোষিত আখাউড়া–সিলেট ডবল লাইন প্রকল্পটি ছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই লাইন নির্মাণ হলে ঢাকা থেকে সিলেটের যাত্রাপথ হতো দ্রুত, নিরাপদ ও আধুনিক। কিন্তু অর্থ সংকটের অজুহাতে প্রকল্পটি স্থগিত রাখা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত শুধু একটি রেল প্রকল্প নয়, বরং সিলেটের আঞ্চলিক সংযোগ ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনার ওপর সরাসরি আঘাত। কারণ, এই রুটের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ভারতের আগরতলার সঙ্গে সিলেটের সংযোগ আরও শক্তিশালী হতো।
২০১৭ থেকে ২০২১: প্রতিশ্রুতির রেল এখনো স্টেশনে দাঁড়িয়ে
ময়মনসিংহ–সিলেট রেলসংযোগের দাবি নতুন নয়। ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, ময়মনসিংহে এক জনসভায় তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান ঘোষণা দেন—
“ময়মনসিংহ–সিলেট রেলপথে শিগগিরই আন্তঃনগর ট্রেন চালু করা হবে।”
এরপর ২০১৯ সালে রেলওয়ে ঘোষণা দেয় নতুন দুইটি আন্তঃনগর ট্রেন চালুর পরিকল্পনা—সিলেট–চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ–সিলেট রুটে। সেই ঘোষণার পর ইন্দোনেশিয়ার PT INKA থেকে আধুনিক কোচও আমদানি করা হয়েছিল, যেগুলো এই রুটেই ব্যবহারের কথা ছিল।
কিন্তু ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো ট্রেনই রেললাইনে ওঠেনি।
২০২১ সালের ৯ অক্টোবর রাজধানীর বেইলি রোডের অফিসার্স ক্লাবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমন্বয় পরিষদের বার্ষিক সম্মেলনে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান—
“ময়মনসিংহের সঙ্গে সিলেটের সরাসরি রেলযোগাযোগ স্থাপনে জরিপ কার্যক্রম চলছে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলা থেকে নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলা পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার উড়ালসড়ক নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, যাতে হাওরাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগও সহজ হয়।
কিন্তু আজও—২০২৫ সালে এসে—এই সব ঘোষণা কেবল বক্তৃতায়ই সীমাবদ্ধ; মাঠে কাজ শুরু হয়নি।
ময়মনসিংহ–সিলেট: আত্মীয়তার দুই প্রান্ত, বিচ্ছিন্ন রেল
ময়মনসিংহ ও সিলেটের মধ্যে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক গভীর। দুই অঞ্চলের মানুষের আত্মীয়তা, পণ্যবাণিজ্য, এমনকি সংস্কৃতি—সবকিছুই একে অপরের পরিপূরক।
কিন্তু এই দুই বিভাগকে এখনো সংযুক্ত করতে পারেনি রেলপথ। বর্তমানে সিলেট থেকে ময়মনসিংহ যেতে হলে যাত্রীদেরকে বিভিন্ন স্থান ঘুরে যেতে হয়—কখনো ঢাকা, কখনো ভৈরব হয়ে। এতে সময় লাগে প্রায় ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা। অথচ সরাসরি রেলপথ চালু হলে এই যাত্রা মাত্র ৭ ঘণ্টায় শেষ করা সম্ভব হতো।
টাঙ্গুয়ার এক্সপ্রেস: নাম আছে, ট্রেন নেই
২০২৩ সালে অনুমোদন পাওয়া টাঙ্গুয়ার এক্সপ্রেস ছিল সিলেটের জন্য এক নতুন আশার প্রতীক। আধুনিক, ননস্টপ, আন্তর্জাতিক মানের এই ট্রেনটি ঢাকাকে সিলেটের সঙ্গে দ্রুতগতির রেল সংযোগে যুক্ত করার কথা ছিল।
কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা, ইঞ্জিনের স্বল্পতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে ট্রেনটি আজও চালু হয়নি। নাম আছে, কিন্তু ট্রেন নেই—যেন সিলেটের রেলের বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
ইন্টারসিটি ট্রেনের স্টপেজ সমস্যা: সিলেটবাসীর মানববন্ধন
সিলেট থেকে ঢাকা গামী ইন্টারসিটি ট্রেনগুলো আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন বা ঢাকা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সরাসরি আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত সরাসরি কোনো স্টপেজ ছাড়া বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছানোর দাবিতে সম্প্রতি সিলেটবাসী মানববন্ধন করেছেন।
তাদের অভিযোগ, আশুগঞ্জ, ভৈরব বাজার, নরসিংদীসহ বিভিন্ন স্টেশন থেকে ব্যাপক যাত্রী ওঠানামার ফলে ট্রেনের ভেতরে চলাচলের পথ থাকে না; যাত্রীদের জন্য পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে পড়ে। তাই তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, আজমপুরের পর থেকে ইন্টারসিটি ট্রেনগুলো যেন ন্যূনতম থামার ব্যবস্থা রাখে না, যাতে সিলেটবাসী নির্বিঘ্নে যাত্রা করতে পারেন।
শ্রীমঙ্গল: সিলেট বিভাগের প্রাণকেন্দ্র
সিলেট বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা শ্রীমঙ্গল—যা শুধু সিলেট নয়, সমগ্র বাংলাদেশের একটি পর্যটন ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র। এখানে রয়েছে চা-বাগান, পাহাড়, বনাঞ্চল, হাওর ও নান্দনিক টুরিস্ট স্পট, যেখানে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি শত শত পর্যটক ভ্রমণ করেন।
শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যবাহী রাধানগর গ্রাম আজ আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এখানে রয়েছে ফাইভ-স্টার হোটেল ও রিসোর্ট, পাশাপাশি লেবু, আনারস, কাঁঠাল ও চা-বাগানের বিস্তৃত চাষাবাদ। এসব প্রতিষ্ঠানে শত শত মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে।
ইতিহাস বলছে, ১৭৮ বিঘা জমির ডলুছড়া পাহাড় ব্রিটিশ শাসনামলে ক্রয় করেছিলেন শ্রীমঙ্গলের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দানবীর রাধা নাথ দেব চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে তিনি জমিটি তাঁর চার সন্তানের মধ্যে বণ্টন করেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কিছু জমি বিক্রি করেন, আর বাকিগুলো সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন কারণে তাদের হাত থেকে বেহাত হয়ে যায়। তবুও তাঁর নামেই গড়ে ওঠে ‘রাধানগর’—আজ এটি সিলেট বিভাগের অন্যতম উন্নত ও সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রেও আধুনিক রেলসেবা আজও অধরা। উন্নত অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও পর্যটন ও ব্যবসায়িক গতিশীলতায় রেলের সীমাবদ্ধতা শ্রীমঙ্গলের বিকাশে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে আছে।
অর্থনীতি ও পর্যটন: রেল উন্নয়নহীনতার শিকার
সিলেট বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিক ও প্রবাসী কেন্দ্র—বিদেশি রেমিট্যান্স, চা শিল্প, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পর্যটনের বিশাল সম্ভাবনা এখানে নিহিত।
কিন্তু শ্রীমঙ্গল, জাফলং, রাতারগুল, বিছানাকান্দি কিংবা লালাখান থাকা সত্ত্বেও সিলেটে রেলের আধুনিক সেবা অনুপস্থিত। ঢাকা থেকে সিলেটগামী ট্রেনগুলো এখনো পুরনো ইঞ্জিনে চলে, অনেক স্থানে গতিবেগ ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারের নিচে নেমে যায়। অথচ পর্যটন ও অর্থনীতির সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলে রেলই হতে পারত উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি।
উপসংহার: প্রতিশ্রুতির রেল যেন আর না থামে
২০১৭ থেকে ২০২৫—আট বছর কেটে গেছে, তবুও ময়মনসিংহ–সিলেট রেলপথের ট্রেন এখনো স্টেশনে দাঁড়িয়ে। একটি ট্রেন কেবল যাত্রার প্রতীক নয়—এটি অঞ্চলের উন্নয়ন, মানুষের সংযোগ এবং অর্থনৈতিক প্রবাহের প্রতীক।
আজ দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে রেল প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে, কিন্তু সিলেটের রেল যোগাযোগ এখনো আশার অপেক্ষায়।
সিলেট বিভাগের প্রায় প্রতিটি স্থানে সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন, মিছিল, সভা ও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন—আর ঘোষণা নয়, এবার চাই কার্যকর বাস্তবায়ন। বক্তৃতার নয়, দরকার ট্রেনের হুইসেল। প্রতিশ্রুতির নয়, দরকার জনগণের হাতে ছোঁয়া উন্নয়নের।
সিলেটের রেললাইন কেবল ইস্পাতের নয়—এটি সম্ভাবনার শিকল। সেই শিকল খুলে দিতে পারলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি, পর্যটন ও মানুষের জীবন ছুটে চলবে এক নতুন গতিতে।



















