img

শ্রীমঙ্গলে ৫ দিন ব্যাপী শ্রী শ্রী বাসন্তী পূজা শুরু

প্রকাশিত :  ০৬:৩৪, ০৮ এপ্রিল ২০২৫

শ্রীমঙ্গলে ৫ দিন ব্যাপী শ্রী শ্রী বাসন্তী পূজা শুরু
সংগ্রাম দত্ত: মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার শ্রীশ্রী শ্রীমঙ্গলেশ্বরী কালী বাড়ি, শ্রীমঙ্গল পৌর শ্মশান কালীবাড়ি সহ বিভিন্ন এলাকার মন্দিরে পাঁচদিন ব্যাপী  বাসন্তী পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে ।

শ্রীশ্রী বাসন্তী দেবীর গজে গমন, ফল শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। মহাপুরুষগণ বিপদকালে অশুভ শক্তি নাশের উদ্দেশ্যে আদ্যা শক্তির আরাধনা করেছেন। রামায়ণে রামচন্দ্র শরৎকালে অশুভ শক্তি নাশ করার জন্য দেবীর আরাধনা করেছিলেন। পুরাণ অনুযায়ী, চন্দ্র বংশীয় রাজা সুরথ বসন্তকালে দেবীর আরাধনা করেন। কালের পার্থক্য হলেও আরাধনা করা হয় দেবী দুর্গারই। কালের প্রভেদের কারণে পূজা রীতির সামান্য পার্থক্য হলেও উভয় পূজার নিয়ম প্রায় একই। শরৎকালে হয় শারদীয়া দুর্গাপূজা আর বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা হয় দেবী বাসন্তী রূপে। বসন্তকালের দুর্গাপূজা পরিচিত শ্রীশ্রী বাসন্তীপূজা নামে।

ষষ্ঠী ৩ এপ্রিল  দেবী দুর্গার প্রতিমা স্থাপন, সপ্তমী ৪ এপ্রিল নবপত্রিকা স্নান ও পুজোর বাকি আচার পালন, অষ্টমী ৫ এপ্রিল অষ্টমীর পুজো ও সন্ধিপুজো, নবমী ৬ এপ্রিল নবমীর পুজো,বিধি পালন। এ দিন রামনবমীও পালিত হয়,দশমী ৭ এপ্রিল দেবীর বিসর্জন ও উৎসবের সমাপ্তি।

চৈত্র মাসের এই পূজা দেবী দুর্গার আরাধনায় উৎসর্গ করা হয়, যা শারদীয় দুর্গোৎসবের মতোই অত্যন্ত শুভ ও পবিত্র। মহাষষ্ঠী তিথির মাধ্যমে বাসন্তী পূজার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়, যেখানে দেবীর নবপত্রিকা স্থাপন ও বোধন সম্পন্ন করা হয়।

পূজার আনুষ্ঠানিকতা ও ধর্মীয় আচার পুরোহিতদের দ্বারা দেবীর বোধন ও মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে আহ্বান জানানো হয়েছে। নবপত্রিকা (কলাবউ) স্নান করিয়ে দেবীর চরণে স্থাপন করা হয়, যা প্রকৃতির শক্তির প্রতীক। সন্ধ্যায় বিশেষ পূজা, চণ্ডীপাঠ এবং আরতির মাধ্যমে ভক্তরা দেবীর কৃপা লাভের আশায় প্রার্থনা করেন।

ভক্তদের অংশগ্রহণ ও পূজার পরিবেশ
মন্দির চত্বর গুলোতে পরিপূর্ণ ভক্তসমাগমে মুখরিত। ঢাকের বাদ্য, শঙ্খধ্বনি, আরতির জ্যোতি এবং চন্দন-ধূপের সুগন্ধ মিলে এক অপূর্ব আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সকলের অন্তরে ভক্তি ও শ্রদ্ধার সুধারস প্রবাহিত হচ্ছে, যা বাসন্তী পূজার মাহাত্ম্যকে আরও গভীরতা দিচ্ছে।

মহাষষ্ঠী তিথির মাধ্যমে শ্রীমঙ্গল পৌর শ্মশান কালীবাড়ি, শ্রীমঙ্গলেশ্বরী কালী বাড়িসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানের মন্দিরে বাসন্তী পূজা শুভ সূচনা পেল। ভক্তদের মনে নতুন আশা, শক্তি ও ভক্তির অনুভূতি দোলা দিচ্ছে। সবার প্রার্থনা—দেবী দুর্গার কৃপায় যেন সকলের জীবন শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণে পূর্ণ হয়ে ওঠে।

সিলেটের খবর এর আরও খবর

img

আজ ঐতিহাসিক চা শ্রমিক দিবস বা মুল্লুকে চলো দিবস

প্রকাশিত :  ১০:৩৩, ২০ মে ২০২৫

সংগ্রাম দত্ত: আজ ২০ মে ঐতিহাসিক চা শ্রমিক দিবস বা মুল্লুকে চলো দিবস । তৎকালীন ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব চা-শ্রমিকদেরও স্পর্শ করেছিল। চা শ্রমিকদের মাঝে আওয়াজ উঠে ‘মুল্লুকে ফিরে চল’  মানে তারা যেসব স্থান থেকে এসেছিলেন সে জায়গায় ফিরে যাওয়া।

১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক সিলেট থেকে পায়ে হেটে চাঁদপুরে মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছান। তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে ব্রিটিশ গোর্খা বাহিনীর সৈনিকরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে চা শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। যারা পালিয়ে এসেছিলেন তাদেরকেও আন্দোলন করার অপরাধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পায়নি তারা ভূমির অধিকার। এরপর থেকেই প্রতি বছর ২০ মে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটি পালন করে আসছেন নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত শোষণ বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার চা শ্রমিকরা।

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না।

১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ভারতবর্ষের আসাম প্রদেশের সিলেটের মালিনীছড়া বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই সময় বৃহত্তর  সিলেট জেলায় চা বাগান তৈরির জন্য ভারতবর্ষের উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের আনা হয়। 

‘গাছ হিলেগা, রুপিয়া মিলেগা’ এমন প্রলোভনে শ্রমিকরা বৃহত্তর সিলেট জেলায় আগমন ঘটলেও তাদের ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। বিশাল পাহাড় পরিষ্কার করতে গিয়ে এবং চা বাগান করতে গিয়ে কত শ্রমিকের জীবন গেছে তার কোনো হিসেব নেই। তাছাড়াও বৃটিশদের অসহনীয় অত্যাচার ছিল চা শ্রমিকদের উপর।

শ্রমিকদের অব্যাহত নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেওসরন \'মুল্লুক চল অর্থাৎ নিজ দেশে চল\' আন্দোলনের ডাক দেন। 

১৯২১ সালের ১ মে ধলাই ভ্যালির বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার  আদমপুরে এক সভা অনুষ্টিত হয়। গোপনে কয়েকজন শ্রমিক যোগদান করে। মে দিবসের এই সভায় পুরুষ শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক আট আনা ও মহিলা শ্রমিকের মজুরি ছয় আনার করার দাবী ওঠে। অর্থাৎ ভেতরে ভেতরে বাগানগুলো অগ্নিগর্ভ হয়ে যায়।

১৯২১ সালের ৩ মার্চ আনিপুর চা-বাগান থেকে ৭৫০ জন শ্রমিক স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ‘গান্ধী কা জয়’ বলে স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। তাদের সাথে যোগ দেয় আশপাশের চাবাগানের শ্রমিকরা। ‘মুল্লুকে চল\' খবরটি ঘন বন-পাহাড় ভেদ করে আশপাশের বাগানে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকরা বাঁধা উপেক্ষা করে বাগান ছাড়তে শুরু করে। বাগান কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের সহায়তায় পথে পথে সর্দার ও পুলিশ বসায়। চা বাগানের অনেক জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বাগানের রাস্তায় শ্রমিক চলাচল বন্ধ করা হয়। পুলিশ শ্রমিকদেরকে  ধরতে শুরু করে। চা-বাগানের বাইরে থেকে অসহযোগ কর্মীরা শ্রমিকদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। শ্রমিকরা চা বাগানের আইন অমান্য করে নিজ জন্মভূমির দিকে রওয়ানা দেওয়াকে বলা হয় \"মুল্লুকে চল\"।

চা বাগানগুলোর  প্রায় ত্রিশ হাজার শ্রমিক মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রওয়ানা দেয়। এই প্রথম চা-বাগান একসাথে আগুন জ্বলে ওঠে। তবে সকল চা বাগানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লেগে যায়। চা-বাগান ছেড়ে শ্রমিকরা অনিশ্চিত ও অচিনপথে প্রথমে তৎকালীন আসামের করিমগঞ্জ  রেল স্টেশনে জড়ো হয়।  আসাম-বেঙ্গল রেল পথে চাঁদপুর-গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটে যাওয়ার চেষ্টা চালায়।

আসাম-বেঙ্গল \"উপরওয়ালার\" নির্দেশে রেল শ্রমিকদের পরিবহন করতে অপারগতা প্রকাশ করে। ভারতবর্ষের প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা এডভোকেট কামিনী কুমার চন্দ ও  রাজনীতিবিদ শ্রীশ চন্দ্র দত্তের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

চা শ্রমিকদের হাতে কোন টাকা ছিল না। এই বিপর্যয়ে অভুক্ত চা-শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায় কংগ্রেস নেতা  রাজনীতিবিদ শ্রীশ চন্দ্র দত্ত।  মানুষের কাছ থেকে চাউল-টাকা সংগ্রহ করে শ্রমিকদের খিচুড়ি খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। নিরুপায় শ্রমিকরা করিমগঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে সিলেট রেল স্টেশনে চলে আসে।  রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা হয় নব গঠিত জাতীয় বিদ্যালয়ে।

শ্রীশ চন্দ্র দত্তসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পুনরায় সিলেট রেলস্টেশন থেকে চা শ্রমিকদের রেলপথে হেঁটে চাঁদপুর যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। 

চা শ্রমিকদের উস্কানীর অভিযোগে আসাম প্রাদেশিক সরকার কয়েকজন শ্রমিক ও কংগ্রেস কর্মীকে গ্রেফতার করে।চা বাগানের শ্রমিকরা মরিয়া হয়ে ওঠে স্বদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রায় অনড় থাকে।

শ্রমিকদের পদযাত্রা সহায়তার জন্য দ্রুত রেল-লাইন ভিত্তিক থানা ও মহকুমা কংগ্রেস সাহায্য কমিটি গঠিত হয়। রেল লাইন যে সমস্ত থানার উপর দিয়ে গেছে সেই থানা,মহকুমা,জেলা চা-শ্রমিকদের সাথে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিবিদ এডভোকেট কামিনী কুমার চন্দ, শ্রীশচন্দ্র দত্ত, পূর্ণেন্দু কিশোর সেন, যতীন্দ্র চন্দ্র দত্ত, যতীন্দ্রনাথ দে, নীরোদকুমার গুপ্ত, অবলাকান্ত গুপ্ত, সতীন্দ্রনাথ দেব, কুলাউড়ার শিরিশ চন্দ্র দেব, শ্যামাচরণ দেব, মৌলভীবাজারের রমণীমোহন রায়, বানিয়াচঙ্গের শিবেন্দ্রচন্দ্র বিশ্বাস।  চা-শ্রমিকদের রাত্রী যাপন, ঔষধ ও খাবারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।

কুমিল্লার ব্যারিষ্টার অখিল চন্দ্র দত্ত, চাঁদপুরের হরদয়াল নাগ, চট্টগ্রামের যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত চা শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেন। 

১৯২১ সালের ২০ মে চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য চাঁদপুর ছিল ভয়ঙ্কর মৃত্যুর দিন। 

সবচেয়ে পাশবিক ঘটনাটি ঘটে চাঁদপুর রেলস্টেশনে। রেলইয়ার্ডে তিন থেকে চার হাজার শ্রমিক জড়ো হয়েছিল। জাহাজ ঘাটে পৌঁছনোর কথা। রাতের অন্ধকারে গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যরা রেলওয়ে ইয়ার্ড ঘিরে ফেলে। সরকার পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ এলাকায় কোন লোকজনকে যেতে নিষেধ করা হয়। সরলপ্রাণ ক্লান্ত চা বাগানের শ্রমিকরা রহস্যটা বুঝতে পারেনি। গভীর রাতে সবাই  ঘুমে অচেতন ।কমিশনার কেসি দে এর নির্দেশে গুর্খা সৈন্যরা ঘুমন্ত শ্রমিকদের উপর গুলি করতে থাকে। চা শ্রমিকদের আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। রাতের অন্ধকারে অনেক লাশ গুম করে ফেলে গুর্খা বাহিনী।

চাঁদপুরে শতশত চা বাগানের শ্রমিকদেরকে বৃটিশ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। লাশ  মেঘনা নদীর পানিতে ফেলে দেয়।  শ্রীশ চন্দ্র দত্ত চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের হত্যার প্রতিবাদ ও শোক সভা  করেন। চা শ্রমিকেরা যারা বেঁচে ছিলেন তারা নিরুপায় হয়ে পুনরায় আসামের করিমগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ চা বাগানে চলে আসেন। চা শ্রমিকরা যাতে ট্রেনে না চলতে পারেন তার জন্য সহজ-সরল শ্রমিকদের বাগানের নামাঙ্কিত একটি করে ট্যাগ দেওয়া হয়। সেই ট্যাগ দেখলেই শ্রমিকদেরকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হতো।

বৃটিশ গেল,পাকিস্তান গেল,বাংলাদেশ আসলো।বাংলাদেশে এখনো চা শ্রমিকরা ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত। চা শ্রমিকদের জীবনমানের তেমন কোন উন্নয়ন ঘটেনি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার কোন উন্নতি হয়নি।

২০ মে শতশত চা শ্রমিক হত্যা  দিবসটি এখনো অবহেলিত হয়ে আছে। এই দিবসটি পালন করা রাষ্টের একান্ত দায়িত্ব।