img

মুমূর্ষু অবস্থায় শেয়ারবাজার, আজই না জাগলে আগামীকাল কিছুই থাকবে না!

প্রকাশিত :  ০৭:৩৭, ১২ মে ২০২৫

মুমূর্ষু অবস্থায় শেয়ারবাজার, আজই না জাগলে আগামীকাল কিছুই থাকবে না!

রেজুয়ান আহম্মেদ 

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার আজ এক মুমূর্ষু রোগীর নাম, যার শ্বাস-প্রশ্বাস কেবল ভেন্টিলেটরের সহায়তায় চলছে। এক ফোঁটা অক্সিজেন—অর্থাৎ জরুরি তারল্য ছাড়া এই বাজারের প্রাণরক্ষা অসম্ভব। অথচ এই চরম সংকটেও সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ভবিষ্যতের পরিকল্পনার গল্প শুনিয়ে যাচ্ছেন, আর বিনিয়োগকারীরা প্রতিদিন লোকসানে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন।

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ—শ্রমিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা—আজ নিঃস্ব। কেউ সন্তানের পড়াশোনার টাকা নিয়ে এসেছেন, কেউ ভবিষ্যতের আশায় পেনশনের অর্থ খাটিয়েছেন। অথচ আজ বাজারে নেমেছে চরম অন্ধকার। সূচকের প্রতিটি পতন, প্রতিটি শেয়ারের দরভাঙা যেন একেকটি বিনিয়োগকারীর আর্তনাদ।

অবস্থার গভীরতা: আইসিইউতে শেয়ারবাজার

বর্তমানে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার যেন আইসিইউতে থাকা এক রোগী। তাকে বাঁচাতে প্রয়োজন তাৎক্ষণিক চিকিৎসা—তারল্য। অথচ বাজার বিশ্লেষণের নামে গঠিত হচ্ছে কমিটি, আলোচনার নামে ডাকা হচ্ছে সভা, আর প্রতিশ্রুতির নামে দেওয়া হচ্ছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কিন্তু মানুষ বাঁচতে চায় আজ, তারা আজকের মৃত্যুর বিনিময়ে আগামীকালের নিশ্চয়তা চায় না।

মিন্টু রোডের বৈঠক—আশা জাগালেও প্রতিকার দিল না

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মিন্টু রোডের রাষ্ট্রীয় বাসভবন যমুনায়  বিএসইসি চেয়ারম্যান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় বাজারের দুর্দশা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও, কার্যকর কোনো জরুরি ঘোষণা বা সিদ্ধান্ত আসেনি।

যেখানে বিনিয়োগকারীরা আশা করেছিলেন ৫ হাজার কোটি টাকার তাৎক্ষণিক তারল্য সহায়তা, সেখানে তাঁরা পেয়েছেন কেবল পরিকল্পনার আশ্বাস।

বাজারে আতঙ্কের বাতাস, আস্থাহীনতায় নাভিশ্বাস

প্রতিদিন সূচকের পতন, কমছে লেনদেনের পরিমাণ, ভালো শেয়ারগুলো হারাচ্ছে মূল্য, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা নেই। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বলছেন—\"আমরা প্রতিদিনই মরছি, অথচ শীর্ষ মহল বলছে—ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল!\"

একজন বিনিয়োগকারী লিখেছেন, \"যে শেয়ার ৫০ টাকা ছিল, তা এখন ২২ টাকায় নেমেছে। কারও কোনো মাথাব্যথা নেই! অথচ তখন সবাই বলেছিল—‘এই শেয়ার ভালো, ধরে রাখুন।’ এখন কী করব?\"

চেয়ারম্যানের ইতিবাচক চিন্তা বাস্তব রূপ পাচ্ছে না

বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বাজার গঠনের কথা বলছেন। তাঁর ভাবনা নিঃসন্দেহে ভালো, কিন্তু বাজার যখন ভেঙে পড়ছে তখন ভবিষ্যতের আশ্বাস নয়, আজকের কার্যকরী চিকিৎসাই জরুরি।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত: বাজারে নগদ অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করা, বিক্রির চাপ কমানো, এবং ক্রেতা সৃষ্টি করা।

প্রধান উপদেষ্টার দিকে বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা

ড. ইউনূস এই সরকারের আশার প্রতীক। দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান, সাহসী সিদ্ধান্ত, এবং সাধারণ মানুষের পক্ষে থাকা তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস বিনিয়োগকারীদের মনে আশার আলো জ্বেলেছে। তাই তাঁর কাছ থেকেই সবাই প্রত্যাশা করছেন—একটি সাহসী ‘রেসকিউ প্যাকেজ’।

তাঁদের চাওয়া:

১. ৫ হাজার কোটি টাকার জরুরি তারল্য প্যাকেজ ঘোষণা

২. আইসিবিকে বাজেট বরাদ্দ দিয়ে সক্রিয়ভাবে বাজারে নামানো

৩. রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা সাময়িকভাবে বৃদ্ধি

৪. প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ‘পুঁজিবাজার রেসকিউ টাস্কফোর্স’ গঠন

‘যত দেরি, তত ধস’—বাজারের ট্র্যাজেডি অনিবার্য হতে পারে

প্রতিটি দিন বিলম্ব মানেই শেয়ারবাজারে আরও একটি স্তম্ভের পতন। যারা এখনও অবস্থান ধরে রেখেছেন, তারা ভয় ও ধৈর্যের ভারে নুয়ে পড়েছেন। সরকার যদি এখনই এগিয়ে না আসে, তবে বাজারে আস্থা আর ফিরবে না। বরং দেশের অর্থনীতির একটি প্রধান উৎস চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়বে।

একজন জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ যথার্থই বলেছিলেন, “এখন আর কোনো মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সময় নেই, কার্যকর পদক্ষেপই একমাত্র পথ।”

দিনের শেষে বিনিয়োগকারীর চিৎকার: “ভবিষ্যৎ নয়, আজকের বাঁচার সুযোগ দিন”

বিনিয়োগকারীদের এখন একটাই কথা—“আমরা এখনই বাঁচতে চাই। শেয়ারবাজারে আমাদের শেষ সম্বল খাটানো ছিল, এখন যদি সেটাও শেষ হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতের পুনরুদ্ধার আর কোনো কাজে আসবে না।”

কেন আজই সিদ্ধান্ত জরুরি?

একজন মুমূর্ষু রোগীকে যদি কেবল পরীক্ষার রিপোর্ট দেওয়া হয়, ইনজেকশন না দেওয়া হয়, তবে সে মারা যাবে। শেয়ারবাজারেরও অবস্থা এখন তেমনই। রিপোর্ট লেখা হচ্ছে, টিম গঠন হচ্ছে, পরিকল্পনার খসড়া তৈরি হচ্ছে, অথচ অর্থ প্রবাহ নেই।

যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন, সেখানে ‘অপেক্ষা’ মানেই ধ্বংস। বাজারের চিকিৎসা দরকার এখনই—না হলে তার মৃত্যু হবে নিষ্ঠুর, নীরব এবং স্থায়ী।

সরকারের কাছে এক বিনিয়োগকারীর খোলা চিঠি

“আপনারা সভা করেন, আমরা রক্ত দিই।

আপনারা পরিকল্পনা করেন, আমরা টাকা হারাই।

আপনারা ভবিষ্যতের কথা বলেন, আমরা বর্তমান হারাই।

দয়া করে, আর দেরি নয়।

এই দেশ কেবল সরকারি চাকরিজীবীদের নয়, বিনিয়োগকারীদেরও।

আমাদের আকুল আবেদন—আজই সিদ্ধান্ত নিন, বাজার বাঁচান।”

সিদ্ধান্তহীনতা নয়, নেতৃত্বের সময় এখন

শেয়ারবাজারের ইতিহাস বলছে—যখন নেতৃত্ব সাহসী হয়েছে, বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ২০১০ সালের ধসের পর পুনরুদ্ধারে লেগেছিল এক যুগ। এবারও যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে আরেকটি প্রজন্ম হারাবে আস্থা, সাহস।

আজ যদি আমরা বাজারে ৫ হাজার কোটি টাকা ঢুকাতে পারি, তাহলে আগামীতে এই বাজার ৫০ হাজার কোটি টাকার ভিত্তি গড়ে তুলতে পারবে।

তাই বলছি—আর এক মুহূর্তও নয়। বিনিয়োগকারীদের বাঁচাতে এখনই চাই সিদ্ধান্ত। এখনই সাহস। এখনই অক্সিজেন!

অর্থনীতি এর আরও খবর

img

শেয়ারবাজারে কারসাজি: সাকিবসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

প্রকাশিত :  ১৪:৫০, ১৭ জুন ২০২৫

শেয়ারবাজার থেকে শতকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

আজ মঙ্গলবার (১৭ জুন) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক নিয়মিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন।

মামলার বাদি দুদক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন। 

এ মামলার প্রধান আসামি সমবায় অধিদপ্তরের উপ-নিবন্ধক ও শেয়ার বাজারের আলোচিত ব্যক্তি মো. আবুল খায়ের (হিরু)। দ্বিতীয় আসামি সাকিব আল হাসান। অন্যান্য আসামিরা হলেন- কাজি সাদিয়া হাসান, আবুল কালাম মাদবর, কনিকা আফরোজ, মোহাম্মদ বাশার, সাজেদ মাদবর, আলেয়া বেগম, কাজি ফুয়াদ হাসান, কাজি ফরিদ হাসান, শিরিন আক্তার, জাভেদ এ মতিন, মো. জাহেদ কামাল, মো. হুমায়ূন কবির ও তানভীর নিজাম।

দুদক জানায়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দ্রুত আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে শেয়ারবাজারে প্রচলিত আইন ও বিধি (সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ এর ১৭ ধারা) লঙ্ঘন করেছেন।

তারা নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিও একাউন্টে অবৈধভাবে সিরিজ ট্রানজেকশন,  প্রতারণামূলক একটিভ ট্রাডিং, গেম্বলিং, ও স্পেকুলেশন-এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারে কৃত্রিমভাবে নির্দিষ্ট কিছু শেয়ারের দাম বৃদ্ধি করে বাজারে কারসাজি করেন। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হারান।

এই পদ্ধতিতে ২৫৬ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার ৩০৪ টাকা আত্মসাৎ করা হয়, যা ‘অপরাধলব্ধ অর্থ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত। এর মধ্যে আবুল খায়ের (হিরু) তার স্ত্রী কাজি সাদিয়া হাসানের সহায়তায় ২৯ কোটি ৯৪ লাখ ৪২ হাজার ১৮৫ টাকার উৎস গোপন করে বিভিন্ন খাতে স্থানান্তর করেন।

এছাড়া তার নামে পরিচালিত ১৭টি ব্যাংক একাউন্টে মোট ৫৪২ কোটি ৩১ লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ টাকার অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদক জানায়, আসামি মো. আবুল খায়ের (হিরু) কর্তৃক শেয়ার বাজারে কারসাজিকৃত প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স লি., ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স লি. এবং সোনালী পেপারস লি.-এর শেয়ারে সাকিব আল হাসান বিনিয়োগ করেন। এতে সাকিব মার্কেট ম্যানুপুলেশনে সরাসরি সহায়তা করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ২ কোটি ৯৫ লাখ ২ হাজার ৯১৫ টাকা রিয়ালাইজড ক্যাপিটাল গেইনের নামে শেয়ার বাজার থেকে আত্মসাৎ করেন।

দুদক জানায়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন মর্মে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হওয়ায় কমিশনের অনুমোদনক্রমে আসামিদের বিরুদ্ধে  ২০১২ এর ৪ ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/১২০(বি)/১০৯ ধারায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

দুদক জানিয়েছে, তদন্ত শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।