
পাইকারি বাজারে কমলেও খুচরায় কমেনি চালের দাম

দেশের পাইকারী বাজারে কমতে শুরু করেছে চালের দাম। এরই মধ্যে রাজধানীর বাজারগুলোতে পাইকারি পর্যায়ে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বস্তাপ্রতি সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। আমদানির প্রভাবে চালের দামে ঊর্ধ্বমুখী গতি দিক বদলে নিম্নগামী হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে খুচরা পর্যায়ে চালের দাম এখনো কমেনি বলে দাবি করেছেন ভোক্তারা।
দেশে ভোগ্যপণ্যের অন্যতম প্রধান পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত এক সপ্তাহে সেখানকার চালের বাজার কিছুটা নিম্নমুখী। তবে, খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে সেখানে চালের বর্ধিত দামে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ান বাজার এলাকার ভোগ্যপণ্য বিক্রির প্রতিষ্ঠান নাসির গ্রোসারি শপে গত শনিবার প্রতি কেজি ভারতীয় কাটারি চাল বিক্রি হচ্ছিল ৮৮ থেকে ৯০ টাকায়। এছাড়া, নাজিরশাইল চাল প্রতি কেজি ৮৮ টাকা, মিনিকেট ৭৫ টাকা এবং মোটা চাল প্রতি কেজি ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী নাসির উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এক মাস ধরে আড়ত থেকে বাড়তি দামে চাল কিনে আনতে হচ্ছে। এক মাসের ব্যবধানে মানভেদে চালের দাম প্রতি বস্তায় ২০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকদিন ধরে পাইকারিতে চালের দাম কমার কথা বলা হলেও সেটা বর্ধিত দামের তুলনায় কিছুই নয়। তাছাড়া বর্তমানে খুচরা বাজারে যে চাল বিক্রি হচ্ছে সেগুলো বেশি দামেই কেনা। কাজেই এক মাস আগে চালের যে কেনা দাম ছিল তাতে ফিরে আসা পর্যন্ত খুচরা বাজারে দাম কমার লক্ষণ নেই।’
নগরীর পাহাড়তলী চালের বাজারের ব্যবসায়ী আবুল হাশেম বলেন, গত এক মাসে চালের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে এখনো সে পরিমাণ কমেনি। গত এক সপ্তাহে বস্তায় ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। কিন্তু বেসরকারি উদ্যোগে চাল আমদানি ও ফেব্রুয়ারিতে টিসিবির মাধ্যমে সরকারের ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রির খবর পেয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা আড়ত থেকে একসঙ্গে বেশি চাল কিনছেন না।
পাইকারিতে দাম কমলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা খুব সহজে দাম কমাতে চান না বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম। তিনি বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে ভারত থেকে কম বুকিং রেটে আমদানি করা চাল বাজারে আসায় পাইকারিতে চালের দাম এখন কিছুটা নিম্নমুখী। সব ধরনের চালের দাম এক সপ্তাহ আগের তুলনায় কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা কমেছে।’
এই ব্যবসায়ী নেতা জানান, স্বর্ণা-৫ স্টিম চালের ২৫ কেজির বস্তা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১৩৫০ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৩০০ টাকায়। ভারতীয় কাটারি চালের দাম এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৮৫০ টাকা। এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৭৫০ টাকা বস্তা। মিনিকেট চাল ৫০ কেজির বস্তার দাম ছিল ২৭৫০ টাকা। এখন প্রতি বস্তা মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ২৬০০ টাকায়। ইরি (মোটা) চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ২১৫০ টাকা দরে। এক সপ্তাহ আগে এর দাম ছিল ২৩০০ টাকা।
দাম নিম্নমুখী হওয়ার কারণ বর্ণনা করে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমদানিকারকরা ভারত থেকে যে চাল আমদানি করেছেন সেগুলোর বুকিং রেট আগের তুলনায় কম ছিল। তাই পাইকারিতে দাম কমছে। তবে, খুচরা ব্যবসায়ীরা একবার দাম বাড়ানোর পর সহজে তা কমাতে চান না মন্তব্য করে চাল ব্যবসায়ী সমিতির এই নেতা বলেন, ‘আগের কেনা চাল বিক্রি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কম দামে কেনা চালও তারা আগের দামে বিক্রি করতে চান। যে কারণে পাইকারিতে দাম কমার প্রভাব খুচরা বাজারে পড়তে সময় লাগে।’
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে চাল ব্যবসায় জড়িত এমন একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, দেশে চালের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি। তারপরও বাজারে চালের সরবরাহ সংকট সৃষ্টির পেছনে রয়েছে করপোরেট ব্যবসায়ী গ্রুপের অতিরিক্ত মজুদদারি। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চাল থেকে তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য বিপণন করে থাকে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত চাল ও চালের গুঁড়াকে প্রধানতম পণ্য হিসেবে বাজারজাত করে থাকে। এজন্য তারা কৃষকদের কাছ থেকে মাঠপর্যায়ে বিপুল পরিমাণ ধান এবং মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনে মজুদ করে ফেলে। এর ফলে মূলত দেশে উৎপাদিত চালের বড় একটি অংশ তাদের কব্জায় চলে যায়। যে কারণে বাজারে সরবরাহ সংকট দেখা দেয়।
চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ধান-চাল মজুদের বিষয়ে করপোরেট হাউজগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। কোনো নীতিমালা না থাকার কারণে তারা ইচ্ছেমতো মজুদ করে বাজারে সংকট সৃষ্টি করার সুযোগ পায়। আর বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে সব মিলিয়ে সাড়ে তিন কোটি মেট্রিক টন চালের চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে দেশে আউশ, আমন ও বোরো মিলে মোট ৪২০ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এরপরও প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, গত ১১ জানুয়ারি থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত ও মিয়ানমার থেকে মোট চারটি চালানে ৮৮ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছে সরকার। পাশাপাশি বেসরকারিভাবে আমদানি করা চালও বন্দরে আসছে।