বিএসইসির মার্জিন রুলস: উন্নতির নামে ধ্বংসের সিঁড়ি?
টানা পতনের অন্ধকার ভেদ করে আশার সূর্যোদয়: ৩০ লক্ষ বিনিয়োগকারীর আর্তনাদ কি এবার নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছাবে?
রেজুয়ান আহম্মেদ
বাংলাদেশের পুঁজিবাজার গত কয়েক মাস ধরে যেন এক গভীর অস্থিতিশীলতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। প্রতিটি লেনদেন সেশন ৩০ লক্ষ বিনিয়োগকারীর বুকের ওপর বাড়তি চাপ হিসেবে নেমে আসছিল। টানা রক্তক্ষরণ, টানা লাল ক্যান্ডেল, টানা ভরাডুবি—সব মিলিয়ে দেশের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক তিন ধরনের সংকটের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছিলেন।
কিন্তু আজ, বহুদিন পর প্রথমবার যখন বাজার শক্তিশালী সবুজে ফিরল, তখনই বড় প্রশ্নটি আবার মাথা তুলে দাঁড়ায়—এতদিন নীতিনির্ধারকরা কোথায় ছিলেন?
আজকের ডিএসই—যেখানে ইনডেক্স এক লাফে ৭১.৯২ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮৪৬.৮৮ পয়েন্টে—এই প্রবৃদ্ধি শুধু একটি সংখ্যা নয়; এটি ৩০ লক্ষ বিনিয়োগকারীর দীর্ঘশ্বাস, কান্না, বাঁচার আকুতি এবং শেষ আশার রং। এটি সেই বহু প্রতীক্ষিত সবুজ, যা হয়তো প্রমাণ করে—অন্ধকার যত গভীরই হোক, আলো তার পথ খুঁজে নেয়।
বিএসইসির মার্জিন রুলস: উন্নতির নামে ধ্বংসের সিঁড়ি?
একটি বিষয় স্পষ্ট—মার্জিন রুলস ভবিষ্যতে নতুন বিনিয়োগকারীদের জন্য নিরাপদ ও উন্নত কাঠামো তৈরি করবে; এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই মুহূর্তটিই কি ছিল এই আইন চাপানোর সঠিক সময়?
বিএসইসির চেয়ারম্যান জনাব খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, আপনি নিঃসন্দেহে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। কিন্তু আপনার নীতিগত অবস্থান কি সত্যিই বাজারের বাস্তবতা বোঝে?
আপনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন—
যদি হাইকোর্ট আপনার পক্ষে রায় দিত,
যদি মার্জিন রুলস তাৎক্ষণিক কার্যকর হতো,
তাহলে কী ঘটত?
৩০ লক্ষ বিনিয়োগকারী মুহূর্তেই পথে বসে যেতেন। একটি পরিবার নয়, লক্ষ লক্ষ পরিবার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ত।
আপনি কি দেখেন না—বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে কারসাজি কোথায় হয়?
বেশিরভাগই হয় জেড গ্রুপের শেয়ারে, আর জেড গ্রুপে তো মার্জিন লোন পাওয়া যায় না!
তাহলে মার্জিন রুলস দিয়ে কারসাজি বন্ধ করার যুক্তি কতটা বাস্তবসম্মত ছিল? এটি কি বাস্তবতা না জেনে নীতির নামে অর্থনীতিকে ধ্বংস করা নয়?
সবচেয়ে বড় সত্য হলো—এই ৩০ লক্ষ বিনিয়োগকারীরাই বাজারকে ধরে রেখেছেন।
এদের হাতেই বাজারের প্রাণ। এদের হারিয়ে গেলে নতুন বিনিয়োগকারী তৈরি করতে ৩০ বছর লাগবে।
নীতিনির্ধারকরা যখন বিনিয়োগকারীদের আবেগকে অবজ্ঞা করেন, তখন বাজারের ওপর অত্যাচার বাড়ে। আর সেই অত্যাচারের ভার বহন করেন মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, বেকার যুবক, অবসরপ্রাপ্ত মানুষ এবং সাধারণ পরিবারগুলো।
আজকের রিবাউন্ড: সময়ের দাবি নাকি বিনিয়োগকারীদের কান্নার জবাব?
ডিএসই আজ যে ১.৫১% ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখিয়েছে, তা শুধু একটি রিবাউন্ড নয়—এটি ছিল আবেগের বিস্ফোরণ।
১,৭০,৩৪৫টি ট্রেড
১৭.২৯ কোটি শেয়ার লেনদেন
৪৭৫.৫৩ কোটি টাকার টার্নওভার
৩১৭ কোম্পানি সবুজ, মাত্র ৩৫ লালে
এ যেন দমবন্ধ করা অন্ধকারের পর প্রথম বাতাসের ছোঁয়া।
ইনট্রাডে চার্টও বলছে—
আজ বাজারের প্রতি বিশ্বাস ফিরেছে।
শুরুর শক্তিশালী বুলিশ মোমেন্টাম, দুপুরে দোলাচল, শেষ ঘণ্টায় তীব্র ক্রয়চাপ—সব মিলিয়ে স্পষ্ট:
➡ বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিনের দমিয়ে রাখা যন্ত্রণা আজ বাজারে উগরে দিয়েছেন।
মার্কেট ম্যাপ: সবুজের পতাকা উড়ল
আজকের মার্কেট ম্যাপ দেখলে একধরনের আবেগ তৈরি হয়। টানা পতনের দিনগুলোর লাল সাগরের জায়গায় আজ ছড়িয়েছে—
✔ টেক্সটাইলের গাঢ় সবুজ
✔ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্থিতিশীল শক্তি
✔ ব্যাংকের বাউন্স
✔ ফার্মাসিউটিক্যালসের দৃঢ়তা
✔ বীমা, পেপার, ফুড অ্যান্ড অ্যালাইড—সবখানে আস্থার আলো
বাজার যেন বলে উঠেছে—
“আমরা এখনো বেঁচে আছি।”
বিশেষ করে—
টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফার্মাসিউটিক্যালস আজকের রিবাউন্ডের মূল নেতৃত্ব দেয়।
টপ গেইনার্স: টেক্সটাইলের জাগরণ
টানা হতাশার পর টেক্সটাইল সেক্টর আজ অন্যতম নায়ক। টপ গেইনার তালিকায় তাদের আধিপত্য প্রমাণ করে—
➡ শিল্পের পুনরুদ্ধার
➡ বিনিয়োগকারীদের আস্থা
➡ সেক্টরভিত্তিক পুনর্গঠন
এরপর ইনস্যুরেন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যাংক, মিউচুয়াল ফান্ড—সবাই যৌথভাবে বার্তা দিয়েছে—
“আমরা লড়াই ছাড়িনি।”
টপ সেক্টরস বাই ভ্যালু: নেতৃত্বে ফার্মাসিউটিক্যালস
লেনদেনে সবচেয়ে বেশি অর্থ এসেছে—
ফার্মাসিউটিক্যালস ও কেমিক্যালস
ইঞ্জিনিয়ারিং
টেক্সটাইল
ফুয়েল অ্যান্ড পাওয়ার
ব্যাংক
এ-ক্যাটাগরির শেয়ারের আধিপত্য বাজারের সুস্থতার প্রতীক। এটি দেখায়—
✔ প্যানিক কমেছে
✔ ফোর্স সেল কমছে
✔ ইনস্টিটিউশনাল অংশগ্রহণ বাড়ছে
✔ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ফিরছে
কিছু লাল ক্যান্ডেল থাকলেও তা স্বাভাবিক বাজার আচরণ।
আজকের সবুজ আধিপত্যই যথেষ্ট ইঙ্গিত দেয়—বাজারের প্রাণ ফিরছে।
৩০ লক্ষ বিনিয়োগকারীর আর্তনাদ: আমরা কি শুনতে পাচ্ছি?
এই বাজারে বিনিয়োগকারীরা শুধু টাকা হারান না—হারান—
মানসিক শান্তি
পরিবারের ভবিষ্যৎ
সামাজিক সম্মান
জীবনের পরিকল্পনা
সন্তানের টিউশন ফি
অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা ব্যয়
ইনডেক্স নিচে নামলে শুধু বাজার পড়ে না—একটি পরিবারও পড়ে যায়।
আজকের সবুজে তাঁদের চোখে হয়তো কিছুটা স্বস্তির জল এসেছে—
স্বস্তির, যন্ত্রণার ও আশার জল।
ভবিষ্যৎ পথ: বাজার কি টেকসইভাবে ফিরবে?
আজকের রিবাউন্ড আনন্দের। তবে টেকসই উত্থান নির্ভর করবে তিন বিষয়ের ওপর—
১. নীতিমালা-স্থিতিশীলতা
হঠাৎ নতুন বিধিমালা বা পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত এলে বাজার আবার ভেঙে পড়বে।
২. বিনিয়োগকারীদের মনোভাব
আস্থা ফিরলে বাজার বাড়ে, আস্থা নষ্ট হলে বাজার ধসে পড়ে।
৩. তারল্য বৃদ্ধি
তারল্য প্রবাহ শক্তিশালী না হলে বাজার টেকসই রিবাউন্ড পাবে না।
পুঁজিবাজার শুধু একটি অর্থনৈতিক সূচক নয়—এটি মানুষের জীবন।
নীতিনির্ধারকরা ভুলে যান—এখানে শুধু শেয়ার ওঠানামা করে না; মানুষের ভাগ্য ওঠানামা করে।
আজকের বাজার দেখিয়েছে—
➡ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখনো হাল ছাড়েননি
➡ বাজার এখনো বাঁচতে চায়
➡ সামান্য আস্থা পেলেই বাজার দৌড়ে ওঠে
➡ ৩০ লক্ষ মানুষ জীবনের জন্য লড়ছেন
আপনি যদি তাদের পাশে না দাঁড়ান, দেশের অর্থনীতি কখনোই স্থিতিশীল হবে না।
এই ৩০ লক্ষ মানুষই বাজারের শক্তি।
তাদের কান্না আর উপেক্ষা করা যাবে না।
আজকের সবুজ যদি নীতিনির্ধারকদের চোখ খুলে দেয়—
তাহলেই পুঁজিবাজার সত্যিকারের পুনর্জন্ম পাবে।


















