
৫ আগস্ট

রেজুয়ান আহম্মেদ
নিলয় তৃষ্ণার্ত কণ্ঠে চিৎকার করছিল, "পানি! কেউ কি একটু পানি দেবে?" চারপাশে শুধু ধোঁয়া, আগুনের শিখা আর ছত্রভঙ্গ জনতার স্লোগান। বাড্ডার মোড়ে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় তার চোখ জ্বলে যাচ্ছিল। হাতে ছিল ছেঁড়া জাতীয় পতাকা, শরীর ঢাকা ছিল ধুলো আর ঘামের আস্তরণে। তৃষ্ণায় চিৎকার করেও কোনো সাড়া পেল না সে। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষদের কেউ আহত, কেউ নিথর হয়ে পড়ে আছে। তার পাশেই পড়ে থাকা এক ছেলেটির মাথার কাছে রক্তের ছোট্ট পুকুর জমে আছে। নিলয় দ্রুত তার কপাল ছুঁয়ে দেখল—ঠান্ডা! তার গলা শুকিয়ে এল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সে আর এই বিভীষিকা সহ্য করতে পারবে না।
মাত্র তিন দিন আগেও ক্যাম্পাসে ছিল হাসিখুশি নিলয়। বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনের পরিকল্পনা, পোস্টার লেখা, স্লোগান তৈরি—সব কিছুতেই ছিল তার আগ্রহ। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও দমন-পীড়ন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা রূপ নেয় গণজাগরণে। তার বান্ধবী অনন্যা ছিল আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী—দৃঢ়, প্রতিবাদী। ৩ আগস্ট রাতে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল, "এই আন্দোলন শুধু ছাত্রদের জন্য নয়, এদেশের ভবিষ্যতের লড়াই!" নিলয় অনন্যার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়েছিল। কিন্তু আজ, যখন সে ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, তখন মনে হচ্ছে, ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই।
৫ আগস্ট সকাল। নিলয় ও তার বন্ধুরা শাহবাগের দিকে রওনা দেয়। তাদের বিশ্বাস ছিল, তারা ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে। কিন্তু পুলিশের গুলির শব্দ যখন বাতাস কাঁপিয়ে দিল, তখন সে বুঝল—ইতিহাস লেখা হচ্ছে রক্ত দিয়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনন্যার দিক থেকে চিৎকার ভেসে এল। পেছন ফিরে দেখল, অনন্যা মাটিতে পড়ে গেছে! তার সাদা জামা রক্তে লাল হয়ে গেছে!
নিলয় পাগলের মতো দৌড়ে গেল। অনন্যার নিঃশ্বাস তখনও চলছে, কিন্তু খুব ধীর।
—"নিলয়... আমি কি বাঁচব?"
—"হ্যাঁ অনন্যা! তুই ঠিক হয়ে যাবি। আমরা হাসপাতালে যাব, সব ঠিক হয়ে যাবে!"
কিন্তু নিলয়ের গড়িয়ে পড়া অশ্রু বলে দিচ্ছিল, সে নিজেও নিজের কথায় বিশ্বাস করে না।
বিকেল ৪টায়, যখন সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন, নিলয় তখন শহীদ মিনারে বসে ছিল। তার পাশে অনন্যার নিথর দেহ। শহরের বাতাসে বারুদের গন্ধ, আর তার কানে বাজছিল অনন্যার শেষ কথা—"আমরা যদি না জিতি, তাহলে এই রক্ত বৃথা যাবে!"
নিলয় জানে, তারা জিতেছে। কিন্তু এই জয়ের মূল্য যে এতটা ভয়ংকর হবে, তা কি কেউ জানত?
৮ আগস্ট।
নতুন সরকার গঠন হয়েছে। সংবাদপত্রের শিরোনাম—"গণঅভ্যুত্থান সফল, নতুন দিগন্তের সূচনা!"
কিন্তু নিলয়ের কাছে এই নতুন সূচনা মানে এক শূন্যতা। সে বারবার মনে করতে চায় অনন্যার হাসি, তার উজ্জ্বল চোখ, তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। কিন্তু ৫ আগস্টের সেই রক্তাক্ত দিন, সেই হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর, সেই নিস্তব্ধতা—সবকিছু তার হৃদয়ে কবর হয়ে বসে আছে।
একটি ইতিহাস তৈরি হলো। কিন্তু সেই ইতিহাসের পাতায় কতগুলো স্বপ্ন চিরতরে হারিয়ে গেল, তা কেউ কি মনে রাখবে?
নিলয়ের জীবন এখন এক অদ্ভুত শূন্যতায় আচ্ছন্ন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে অনন্যার কথা মনে করে—তার হাসি, তার প্রতিবাদী চোখ, তার সাহসী উচ্চারণ। কিন্তু এখন সবই কেবল স্মৃতি। সে প্রতিদিন শহীদ মিনারে যায়, যেখানে অনন্যা শেষবার দাঁড়িয়ে বলেছিল, "এই আন্দোলন শুধু ছাত্রদের নয়, এদেশের ভবিষ্যতের লড়াই!"
নিলয়ের বাবা-মা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন,
—"এখন তোর জীবনটা সামনে এগিয়ে নে। অনন্যা বেঁচে থাকলে কখনোই চাইত না তুই এভাবে শোকে ডুবে থাকিস।"
কিন্তু নিলয় কিছুতেই মানতে পারে না। সে জানে, অনন্যা চাইত না তাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখতে। কিন্তু কিভাবে সামনে এগিয়ে যাবে সে? কিভাবে ভুলবে সেই রক্তাক্ত দিন, সেই চিৎকার, সেই অশ্রু?
একদিন সে অনন্যার বাড়িতে যায়। অনন্যার মা তাকে দেখে কেঁদে ফেলেন। নিলয়কে জড়িয়ে ধরে বলেন,
—"তুই আমার ছেলের মতো। অনন্যা তোকে খুব ভালোবাসত।"
নিলয় চোখের জল আটকে রাখতে পারে না। সে অনন্যার মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। অনন্যার মা তাকে সান্ত্বনা দেন,
—"তুই শক্ত থাক, বাবা। অনন্যা চাইত তুই শক্ত থাকিস।"
নিলয় অনন্যার ঘরে যায়। ঘরটি আগের মতোই আছে—তার বই, তার ডায়েরি, তার ছবি—সবকিছু যেন এখনও তার উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়। সে ডায়েরিটি খোলে। শেষ পাতায় লেখা—
"আমরা যদি না জিতি, তাহলে এই রক্ত বৃথা যাবে!"
নিলয় চোখ বন্ধ করে। সে শুনতে পায় অনন্যার কণ্ঠস্বর—
"নিলয়, তুই শক্ত থাক। আমরা জিতব।"
নিলয় ডায়েরিটি বুকে চেপে ধরে। সে জানে, অনন্যা চাইত না তাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখতে। তাকে শক্ত থাকতে হবে। তাকে সামনে এগোতে হবে।
নিলয় আবার ক্যাম্পাসে যায়। সেখানে ছাত্ররা হাসিখুশি, কেউ ক্লাসে যাচ্ছে, কেউ ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু নিলয়ের চোখে সবকিছু বদলে গেছে।
নিলয় লাইব্রেরিতে যায়। অনন্যার প্রিয় বইগুলো খুঁজে বের করে, পড়তে শুরু করে। সে বুঝতে পারে, অনন্যা শুধু তার জন্য নয়, এই দেশের জন্য লড়াই করেছিল। সে চাইত, দেশটা সুন্দর হোক, মানুষ ভালো থাকুক।
নিলয় আবার আন্দোলনে যোগ দেয়। সে জানে, অনন্যার স্বপ্ন এখন তার স্বপ্ন। অনন্যার সংগ্রাম এখন তার সংগ্রাম। প্রতিদিন শহীদ মিনারে গিয়ে সে অনন্যার কথা মনে করে, তার আদর্শ বুকে ধারণ করে।
একদিন নিলয় ক্যাম্পাসে একটি সভার আয়োজন করে। ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে—
"আমরা যদি না জিতি, তাহলে এই রক্ত বৃথা যাবে!"
ছাত্ররা একসঙ্গে গর্জে ওঠে।
নিলয় বুঝতে পারে, অনন্যার স্বপ্ন এখন শুধু তার একার নয়। এই সব ছাত্রদের স্বপ্ন। তার আত্মত্যাগ এখন শুধু তার ব্যক্তিগত বেদনা নয়—এটি একটি জাতির সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
নিলয় আবার হাসতে শেখে। সে জানে, অনন্যা চাইত না তাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখতে। অনন্যার স্বপ্ন, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ—সবকিছুই এখন নিলয়ের জীবনের অংশ।
নিলয় জানে, তারা জিতেছে।
কিন্তু এই জয়ের মূল্য যে এতটা ভয়ংকর হবে, তা কি কেউ জানত?