img

৫ আগস্ট

প্রকাশিত :  ১৭:৪০, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৮:৪২, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

৫ আগস্ট

রেজুয়ান আহম্মেদ

নিলয় তৃষ্ণার্ত কণ্ঠে চিৎকার করছিল, "পানি! কেউ কি একটু পানি দেবে?" চারপাশে শুধু ধোঁয়া, আগুনের শিখা আর ছত্রভঙ্গ জনতার স্লোগান। বাড্ডার মোড়ে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় তার চোখ জ্বলে যাচ্ছিল। হাতে ছিল ছেঁড়া জাতীয় পতাকা, শরীর ঢাকা ছিল ধুলো আর ঘামের আস্তরণে। তৃষ্ণায় চিৎকার করেও কোনো সাড়া পেল না সে। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষদের কেউ আহত, কেউ নিথর হয়ে পড়ে আছে। তার পাশেই পড়ে থাকা এক ছেলেটির মাথার কাছে রক্তের ছোট্ট পুকুর জমে আছে। নিলয় দ্রুত তার কপাল ছুঁয়ে দেখল—ঠান্ডা! তার গলা শুকিয়ে এল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সে আর এই বিভীষিকা সহ্য করতে পারবে না।

মাত্র তিন দিন আগেও ক্যাম্পাসে ছিল হাসিখুশি নিলয়। বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনের পরিকল্পনা, পোস্টার লেখা, স্লোগান তৈরি—সব কিছুতেই ছিল তার আগ্রহ। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও দমন-পীড়ন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা রূপ নেয় গণজাগরণে। তার বান্ধবী অনন্যা ছিল আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী—দৃঢ়, প্রতিবাদী। ৩ আগস্ট রাতে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল, "এই আন্দোলন শুধু ছাত্রদের জন্য নয়, এদেশের ভবিষ্যতের লড়াই!" নিলয় অনন্যার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়েছিল। কিন্তু আজ, যখন সে ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, তখন মনে হচ্ছে, ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই।

৫ আগস্ট সকাল। নিলয় ও তার বন্ধুরা শাহবাগের দিকে রওনা দেয়। তাদের বিশ্বাস ছিল, তারা ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছে। কিন্তু পুলিশের গুলির শব্দ যখন বাতাস কাঁপিয়ে দিল, তখন সে বুঝল—ইতিহাস লেখা হচ্ছে রক্ত দিয়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনন্যার দিক থেকে চিৎকার ভেসে এল। পেছন ফিরে দেখল, অনন্যা মাটিতে পড়ে গেছে! তার সাদা জামা রক্তে লাল হয়ে গেছে!

নিলয় পাগলের মতো দৌড়ে গেল। অনন্যার নিঃশ্বাস তখনও চলছে, কিন্তু খুব ধীর।

—"নিলয়... আমি কি বাঁচব?"

—"হ্যাঁ অনন্যা! তুই ঠিক হয়ে যাবি। আমরা হাসপাতালে যাব, সব ঠিক হয়ে যাবে!"

কিন্তু নিলয়ের গড়িয়ে পড়া অশ্রু বলে দিচ্ছিল, সে নিজেও নিজের কথায় বিশ্বাস করে না।

বিকেল ৪টায়, যখন সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন, নিলয় তখন শহীদ মিনারে বসে ছিল। তার পাশে অনন্যার নিথর দেহ। শহরের বাতাসে বারুদের গন্ধ, আর তার কানে বাজছিল অনন্যার শেষ কথা—"আমরা যদি না জিতি, তাহলে এই রক্ত বৃথা যাবে!"

নিলয় জানে, তারা জিতেছে। কিন্তু এই জয়ের মূল্য যে এতটা ভয়ংকর হবে, তা কি কেউ জানত?

৮ আগস্ট।

নতুন সরকার গঠন হয়েছে। সংবাদপত্রের শিরোনাম—"গণঅভ্যুত্থান সফল, নতুন দিগন্তের সূচনা!"

কিন্তু নিলয়ের কাছে এই নতুন সূচনা মানে এক শূন্যতা। সে বারবার মনে করতে চায় অনন্যার হাসি, তার উজ্জ্বল চোখ, তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। কিন্তু ৫ আগস্টের সেই রক্তাক্ত দিন, সেই হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর, সেই নিস্তব্ধতা—সবকিছু তার হৃদয়ে কবর হয়ে বসে আছে।

একটি ইতিহাস তৈরি হলো। কিন্তু সেই ইতিহাসের পাতায় কতগুলো স্বপ্ন চিরতরে হারিয়ে গেল, তা কেউ কি মনে রাখবে?

নিলয়ের জীবন এখন এক অদ্ভুত শূন্যতায় আচ্ছন্ন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সে অনন্যার কথা মনে করে—তার হাসি, তার প্রতিবাদী চোখ, তার সাহসী উচ্চারণ। কিন্তু এখন সবই কেবল স্মৃতি। সে প্রতিদিন শহীদ মিনারে যায়, যেখানে অনন্যা শেষবার দাঁড়িয়ে বলেছিল, "এই আন্দোলন শুধু ছাত্রদের নয়, এদেশের ভবিষ্যতের লড়াই!"

নিলয়ের বাবা-মা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন,

—"এখন তোর জীবনটা সামনে এগিয়ে নে। অনন্যা বেঁচে থাকলে কখনোই চাইত না তুই এভাবে শোকে ডুবে থাকিস।"

কিন্তু নিলয় কিছুতেই মানতে পারে না। সে জানে, অনন্যা চাইত না তাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখতে। কিন্তু কিভাবে সামনে এগিয়ে যাবে সে? কিভাবে ভুলবে সেই রক্তাক্ত দিন, সেই চিৎকার, সেই অশ্রু?

একদিন সে অনন্যার বাড়িতে যায়। অনন্যার মা তাকে দেখে কেঁদে ফেলেন। নিলয়কে জড়িয়ে ধরে বলেন,

—"তুই আমার ছেলের মতো। অনন্যা তোকে খুব ভালোবাসত।"

নিলয় চোখের জল আটকে রাখতে পারে না। সে অনন্যার মায়ের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। অনন্যার মা তাকে সান্ত্বনা দেন,

—"তুই শক্ত থাক, বাবা। অনন্যা চাইত তুই শক্ত থাকিস।"

নিলয় অনন্যার ঘরে যায়। ঘরটি আগের মতোই আছে—তার বই, তার ডায়েরি, তার ছবি—সবকিছু যেন এখনও তার উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়। সে ডায়েরিটি খোলে। শেষ পাতায় লেখা—

"আমরা যদি না জিতি, তাহলে এই রক্ত বৃথা যাবে!"

নিলয় চোখ বন্ধ করে। সে শুনতে পায় অনন্যার কণ্ঠস্বর—

"নিলয়, তুই শক্ত থাক। আমরা জিতব।"

নিলয় ডায়েরিটি বুকে চেপে ধরে। সে জানে, অনন্যা চাইত না তাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখতে। তাকে শক্ত থাকতে হবে। তাকে সামনে এগোতে হবে।

নিলয় আবার ক্যাম্পাসে যায়। সেখানে ছাত্ররা হাসিখুশি, কেউ ক্লাসে যাচ্ছে, কেউ ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু নিলয়ের চোখে সবকিছু বদলে গেছে।

নিলয় লাইব্রেরিতে যায়। অনন্যার প্রিয় বইগুলো খুঁজে বের করে, পড়তে শুরু করে। সে বুঝতে পারে, অনন্যা শুধু তার জন্য নয়, এই দেশের জন্য লড়াই করেছিল। সে চাইত, দেশটা সুন্দর হোক, মানুষ ভালো থাকুক।

নিলয় আবার আন্দোলনে যোগ দেয়। সে জানে, অনন্যার স্বপ্ন এখন তার স্বপ্ন। অনন্যার সংগ্রাম এখন তার সংগ্রাম। প্রতিদিন শহীদ মিনারে গিয়ে সে অনন্যার কথা মনে করে, তার আদর্শ বুকে ধারণ করে।

একদিন নিলয় ক্যাম্পাসে একটি সভার আয়োজন করে। ছাত্রদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে—

"আমরা যদি না জিতি, তাহলে এই রক্ত বৃথা যাবে!"

ছাত্ররা একসঙ্গে গর্জে ওঠে।

নিলয় বুঝতে পারে, অনন্যার স্বপ্ন এখন শুধু তার একার নয়। এই সব ছাত্রদের স্বপ্ন। তার আত্মত্যাগ এখন শুধু তার ব্যক্তিগত বেদনা নয়—এটি একটি জাতির সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।

নিলয় আবার হাসতে শেখে। সে জানে, অনন্যা চাইত না তাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখতে। অনন্যার স্বপ্ন, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ—সবকিছুই এখন নিলয়ের জীবনের অংশ।

নিলয় জানে, তারা জিতেছে।

কিন্তু এই জয়ের মূল্য যে এতটা ভয়ংকর হবে, তা কি কেউ জানত?

img

ঈদ যখন কাঁদে অভাবের কাছে: উৎসবের আলো আর অন্ধকারের গল্প

প্রকাশিত :  ০৫:৩০, ০৮ জুন ২০২৫

ঈদের নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট ছোট শিশুর হাসিমাখা মুখ, নতুন জামার রঙ, বাজারের কোলাহল, সুগন্ধে ভরা রান্নাঘর আর পরিবারজুড়ে ভালোবাসার উষ্ণতা। মনে হয়, এ যেন এক মিলনের উৎসব, ভালোবাসার উৎসব—মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এক মহা-উপলক্ষ।

কিন্তু একটু ভাবুন—এই উৎসব কি সবার জন্য একই রকম আনন্দ বয়ে আনে?

ঈদের পেছনের সেই নিঃশব্দ কান্না

আমরা অনেকেই ঈদের আগে বাজারে যাই, জামাকাপড় কিনি, খাবারদাবারে ঘর সাজাই, ছবি তুলে পোস্ট দিই—সবই স্বাভাবিক আনন্দের অংশ। কিন্তু আমাদের আশপাশেই এমন অনেক পরিবার আছে, যারা ঈদের আগের রাতে জানে না, পরদিন সকালে তাদের শিশুটি আদৌ কিছু খেতে পাবে কি না।

তারা ফেসবুকে অন্যদের ছবিতে ঈদের রঙ দেখে, ছেলেমেয়েদের হাসিমুখ দেখে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের আমেজটা গায়ে মাখার চেষ্টা করে—কিন্তু মনে মনে ভেঙে পড়ে।

একজন মা যখন সন্তানের নতুন জামার আবদার শুনে চুপ করে থাকেন, চোখের জল আড়াল করতে রান্নাঘরে চলে যান—তখন ঈদের আনন্দ তার কাছে হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য বোঝা।

তিনি বলেন, “কাল পাবে বাবা, কাল পাবে”—এই ‘কাল’ যে কবে আসবে, তিনি নিজেও জানেন না। তবু সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করাটাই যেন তার ঈদের একমাত্র প্রস্তুতি।

রিকশাচালক বাবার সন্ধ্যা

রিকশা চালানো মানুষটি ঈদের দিনেও রাস্তায় থাকেন—কারণ এই দিনটিতে একটু বেশি উপার্জনের সম্ভাবনা থাকে। সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফেরেন ক্লান্ত শরীরে, পকেট ফাঁকা, মুখে নিঃশব্দ বিষণ্ণতা।

বাচ্চা জিজ্ঞাসা করে, “বাবা, আমার জামা কই?”

তিনি মাথা নিচু করে বলেন, “এইবার না, পরেরবার।”

এই কথাটি বলার সময় তার বুকের ভেতর যে ঝড় বয়ে যায়—তা কেউ দেখে না, কেউ বোঝেও না।

শিশুর চোখে ঈদের রংহীনতা

ঈদ তো শিশুদের আনন্দের দিন—এমনটাই শুনে বড় হয় তারা। কিন্তু যেসব শিশু নতুন জামা পায় না, খেলনা পায় না, পেট ভরে খেতে পায় না—তারা কেমন করে ঈদ উদযাপন করে?

তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদ দেখে। এক ধরনের ঈর্ষা, অপমান আর অক্ষমতা মিশে তৈরি হয় তাদের জীবনের প্রথম ঈদের শিক্ষা—“ঈদ সবার জন্য নয়।”

এই শিক্ষা একটি শিশুকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় অভিমান, সমাজব্যবস্থার প্রতি রাগ, ঈদের প্রতি ঘৃণা।

ঈদের আসল পাঠ—কোথায় হারিয়ে গেল?

ঈদের মূল শিক্ষা ছিল সহমর্মিতা, সমতা ও ভালোবাসা। কিন্তু আজকাল এই শিক্ষা অনেক সময় ফেসবুক পোস্ট আর ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যাকাত-সদকা অনেকটাই লোক দেখানো কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।

আসলে, একটি দরিদ্র শিশুকে জামা কিনে দেওয়া কোনো দয়া নয়—এটা তার ন্যায্য প্রাপ্য। একজন রিকশাচালককে ঈদের দিনে এক প্যাকেট বিরিয়ানি দেওয়া সহানুভূতি নয়, বরং ন্যূনতম মানবিক দায়িত্ব পালন।

হাজার টাকায় ফিরতে পারে একটি ঈদ

আপনার ঈদের খরচ যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়, তার মধ্যে মাত্র এক হাজার টাকা ব্যয় করলেই একটি পরিবারের মুখে ঈদের হাসি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

একটা জামা, একজোড়া জুতো, এক প্লেট বিরিয়ানি—এগুলো কোনো বিলাসিতা নয়। সামান্য সদিচ্ছা থাকলেই এই ছোট ছোট উপহারগুলো বহু মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে।

ঈদ সবার হোক—তবেই পূর্ণতা

আমরা চাই না সবাই সমাজবিপ্লবী হোক। শুধু চাই—আপনার পাশের দরিদ্র শিশুটির জন্য একটি জামা কিনে দিন। রাস্তার সেই বৃদ্ধ মায়ের হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি তুলে দিন।

এই ছোট ছোট ভালোবাসার কাজগুলোই ঈদকে সত্যিকার অর্থে সবার করে তোলে।

রাষ্ট্র কি পারত না পাশে দাঁড়াতে?

একটি রাষ্ট্র চাইলে ঈদের দিনে কোনো পরিবার না খেয়ে থাকবে না—এটা নিশ্চিত করা কঠিন কিছু নয়। ঈদের সময় একটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি চালু করে দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া যেত—এটা হতে পারত এক নতুন দৃষ্টান্ত।

সরকারি খাদ্য সহায়তা, জামা বিতরণ, শিশুবান্ধব উপহার কার্যক্রম—এসব শুরু হলে ঈদ আর কারো জন্য অন্ধকার হয়ে থাকত না।

ঈদ হোক ভালোবাসার নাম

আমরা যতই বলি ঈদ মানে আনন্দ, ততদিন তা খালি বুলি হিসেবেই থাকবে—যতদিন না আমরা সেই আনন্দ সবার মাঝে ভাগ করে নিতে শিখি।

এই ঈদে আসুন আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিই—একটি মুখে হাসি ফোটাব, একটি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে বলব: “তোমরা একা নও।”

এই ছোট ছোট ভালোবাসার স্পর্শগুলোই ঈদকে ঈদ বানায়। নামাজ শেষে কোলাকুলি করার আগে যদি একটু ভাবি—আমার চারপাশে কেউ কি আজও না খেয়ে আছে? কারো সন্তানের মুখ কি আজও শুকনো?

কারণ ঈদ শুধু নামাজের উৎসব নয়। ঈদ হলো হৃদয়ের উৎসব—যেখানে সকল শ্রেণি, সকল মানুষ একসাথে বলে, “আমরা একসাথে।”

ঈদ হোক সেই ভালোবাসার গল্প—যা শুরু হয় একজন মানুষের হাসি দিয়ে, আর ছড়িয়ে পড়ে হাজারো হৃদয়ে।