ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার দুটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে ইউক্রেন
প্রকাশিত :
০৮:৫৮, ১১ নভেম্বর ২০২৩
রাশিয়ার হামলা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ে ক্রিমিয়ায় দুটি উভচর জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছেন ইউক্রেনীয় সেনারা। শুক্রবার ক্রিমিয়ার পশ্চিমে ভুজকা বেতে ইউক্রেনীয় বাহিনী এ হামলাটি চালায় বলে জানা গেছে। খবর রয়টার্সের।
ইউক্রেনের নৌ-ড্রোনগুলো ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার দুটি ছোট উভচর জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে বলে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা দাবি করেছে।
তারা জানায়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দেশটির সেনারা রাশিয়ার আরও হামলা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ে ক্রিমিয়ায় ঘটনাটি ঘটেছে। রাশিয়ার হামলার ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া পূর্বাঞ্চলীয় শহর আভদিইভকায় আবারও হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইউক্রেনের সামরিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, উল্লেখযোগ্য এ হামলায় রাশিয়ার বেশ ক্ষতি হয়েছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা স্বতন্ত্রভাবে এসব দাবি যাচাই করে দেখতে পারেনি। এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রাশিয়ার পক্ষ থেকেও কোনো মন্তব্য আসেনি।
কথিত এক গণভোটের ফলের ভিত্তিতে ইউক্রেনীয় উপদ্বীপ ক্রিমিয়াকে ২০১৪ সালে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয় রাশিয়া। দেশটির কৃষ্ণ সাগরীয় নৌবহরের সদরদপ্তর ক্রিমিয়ার বন্দর শহর সেভাস্তপোলে।
ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রাথমিক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাতে রাশিয়ার দুটি ছোট উভচর জাহাজে আঘাত হানা হয়।
পরবর্তী হালনাগাদ তথ্যে জানানো হয়, নৌড্রোন দিয়ে হামলাটি চালানো হয়েছে। ডুবে যাওয়া উভচর জাহাজ দুটির মধ্যে একটি হল আকুলা শ্রেণির এবং অপরটি সেরনা শ্রেণির অবতরণ জলযান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ নভেম্বর, ২০২৩ ক্রিমিয়ার ভুজকা বের কাছে গোয়েন্দা বাহিনীর পরিচালিত নৌড্রোন হামলায় এই ফল আসে, রাশিয়ার দুটি ছোট অবতরণ জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। হামলার পরিণতিতে উভয় জলযানই ডুবে যায়, আকুলা সরাসরি ডুবে যায় আর সেরনাকে রক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়ার পর (সেটি ডুবে যায়)।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, রাশিয়ার উভচর জাহাজ দুটিতে বেশ কয়েকটি সাঁজোয়া যান উঠানো হয়েছিল এবং সেগুলোতে ক্রুরা ছিলেন।
ইউক্রনের সামরিক বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আন্দ্রি রেইজেনকো রেডিও এনভিকে বলেছেন, এ ধরনের জলযান হারানো উল্লেখযোগ্য ক্ষতি। এসব জাহাজ দিয়ে অনেকটা অলক্ষ্যে কৌশলগত স্থলবাহিনী ও সরঞ্জাম পরিবহণ করা যায়।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, নৌবাহিনীর লক্ষ্যস্থলগুলোর ওপর আক্রমণের কারণে ওই এলাকায় মস্কোর সামরিক শক্তি হ্রাস পেয়েছে।
এ হামলার পর রাশিয়ার কিছু জাহাজ সেভাস্তপোল থেকে চলে গেছে বলে দাবি করেছে ইউক্রেন।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে গোলা-বারুদের মারাত্মক ঘাটতি দেখা দিয়েছে ইউক্রেনের। গোলা-বারুদ ঘাটতির ফলে হুমকির মুখে পড়েছে সেনা সদস্যরা। ভয়েস অব আমেরিকা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, গোলা-বারুদের ঘাটতির ফলে ৬২০-মাইল দীর্ঘ রণাঙ্গনে ইউক্রেনের অবস্থান হুমকির মুখে পড়ছে। পুরো রণাঙ্গন এখন রুশ গোলন্দাজ বাহিনীর মারাত্মক আক্রমণের মুখে।
খবরে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ব্যূহ হুমকির মুখে। গত চার মাস ধরে প্রতিদিন তিন দিক থেকে রাশিয়ার আক্রমণের পর ইউক্রেনীয় বাহিনী পূর্বাঞ্চলে দোনেৎস্ক এলাকার আভদিভকা শহর থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।
রুশ সীমান্ত থেকে দূরে, ইউক্রেনের বেশ অভ্যন্তরে আভদিভকায় ইউক্রেনীয় বাহিনী ব্যাপক প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছিল। রাশিয়া ২০১৪ সালে যখন প্রথম আক্রমণ চালায়, তখন থেকে আভদিভকা একটি রণাঙ্গন। আভদিভকার সুরক্ষিত সুরঙ্গ আর ট্রেঞ্চ নেটওয়ার্ক আরও পশ্চিমে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ পথগুলোকে নিরাপত্তা দেয়।
আভদিভকা দখলের ফলে রাশিয়ার মনোবল চাঙ্গা হবে এবং এই যুদ্ধে তাদের সৈন্যরা চালকের আসনে আছে বলে ক্রেমলিনের দাবিকে সমর্থন করবে। অন্যদিকে, শহরের পতন ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য হতাশা নিয়ে আসবে, যারা গত বছরের পাল্টা অভিযানের পর শুধুমাত্র কিছু এলাকা উদ্ধার করেছে।
বাইডেন প্রশাসন আভদিভকার পতনের জন্য ইউক্রেনের জন্য ৬০০ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য অনুমোদন করতে কংগ্রেসের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন জানিয়েছেন যে, তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে শনিবার টেলিফোনে আলাপের সময় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য অবশেষে চলে আসবে। ইউক্রেন আভদিভকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ার পর বাইডেন জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেন।
তবে সাংবাদিকরা যখন জিজ্ঞেস করেন, ইউক্রেন আরও এলাকা হারানোর আগেই কংগ্রেসে সমঝোতা হবে বলে তিনি আত্মবিশ্বাসী কি না, বাইডেন উত্তর দেন, ‘না’।
আভদিভকার পতনের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে রণাঙ্গনের সবচেয়ে সক্রিয় অংশে এসোসিয়েটেড প্রেস গোলন্দাজ ইউনিটের প্রধানসহ এক ডজনের বেশি ইউক্রেনীয় কমান্ডারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তারা বলছেন, অস্ত্র-সরঞ্জামের ঘাটতিগত শরৎকাল থেকে আরও তীব্র হয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই রাশিয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রের ঘাটতির মুখে পড়ে ইউক্রেন।
পশ্চিমাদের দেওয়া দূর-পাল্লার আরটিলারির সরবরাহ অনেক কমে গেছে। এর ফলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর পক্ষে রুশ বাহিনীর গভীরে, যেখানে তাদের ভারী সরঞ্জাম আর সৈন্য সমবেত করা হয়, সেখানে আক্রমণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
কয়েক সপ্তাহ ধরে রণাঙ্গন জুড়ে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা গোলা-বারুদের মারাত্মক অভাবের অভিযোগ করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আরটিলারি ইউনিট তাদের প্রয়োজনের মাত্র ১০ শতাংশ সরবরাহ নিয়ে লড়াই করছে। শেল বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে তারা তাদের ইউনিটগুলোকে শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার নির্দেশ দিচ্ছে।
তবে রণাঙ্গনে কমান্ডাররা বলেন, এই নীতি দিয়ে তাদের শত্রুপক্ষকে থামিয়ে দেয়া সম্ভব না, যাদের অনেক বেশি গোলা-বারুদ সরবরাহ আছে। নতুন সামরিক সাহায্য ছাড়া আভদিভকার পতনের পুনরাবৃত্তি অন্য জায়গায় দেখা যাবে বলে উদ্বেগ এখন বাড়ছে।
অত্যন্ত সুরক্ষিত শহর থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রত্যাহার করা গত বছরের বাখমুতের জন্য লড়াইয়ের পর রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় বিজয় নিয়ে এসেছে। এর ফলে, ক্রেমলিনের বাহিনী আরও পশ্চিমে অগ্রসর হতে পারবে, কম সুরক্ষিত ইউক্রেনীয় এলাকার আরও গভীরে। সামরিক ব্লগারদের মতে, আরও পূর্বে রেলওয়ে জংশন পক্রভস্ক রাশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে।
রাশিয়ার সামরিক কর্মকর্তা এবং ব্লগাররা বলছে, আভদিভকা দখলের ফলে রুশ-দখলকৃত দোনেৎস্ক শহরের উপর হুমকি কমিয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেনের একটি আরটিলারি ইউনিটের কমান্ডার খরব্রাই বলেন, ‘এই মুহূর্তে গোলাবারুদের ঘাটতি বেশ সিরিয়াস। আমাদের সব সময় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে আরও আসছে, কিন্তু আমরা সেটা আসতে দেখি না। ইউনিটের প্রয়োজনের মাত্র ৫-১০ শতাংশ গোলা-বারুদ অবশিষ্ট আছে।
তিনি বলেন, এই অবস্থা তার বাহিনীর কার্যকরভাবে আক্রমণ করে হারানো এলাকা পুনরুদ্ধার করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। আরও মারাত্মক, পদাতিক সৈন্যদের জন্য আরটিলারি সাপোর্ট না থাকায় আরও বেশি সৈন্য হতাহত হচ্ছে।
এই রিপোর্টের জন্য এপি যেসব অফিসারের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পুরো নাম প্রকাশ করা হয়নি। একটি হাউইটযার ইউনিটকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভ্যালেরি। যুদ্ধ করার মত অস্ত্র নেই বলে জানান তিনি। এই বাহিনী ন্যাটো-ব্যবহৃত ১৫৫ মিলিমিটার শেল ব্যবহার করে। কোনো রুশ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাদের প্রতি ইউনিটের প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০টি শেল দরকার। এখন তাদের কাছে প্রয়োজনের ১০ শতাংশ রয়েছে মজুদ রয়েছে।
আভদিভকায় মোতায়েন ইউক্রেনীয় সৈন্যরা বলছে, শহরের পতনের আগে রাশিয়া গোলা-বারুদের ঘাটতি কাজে লাগাতে তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। সাঁজোয়া গাড়ির কলাম দিয়ে আক্রমণ না করে তারা পদাতিক সৈন্যর ছোট ছোট গ্রুপ পাঠিয়ে ইউক্রেন বাহিনীর সাথে আরও কাছ থেকে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এর ফলে, তাদেরকে আটকে রাখতে ইউক্রেন বাহিনীকে পাঁচ গুন বেশি গোলা-বারুদ ব্যবহার করতে হয়েছে।
ইউক্রেনের ১১০ ব্রিগেডের একজন সেনা চাকলুন বলেন, ‘শত্রু বাহিনী আমাদের সক্ষমতা বুঝতে পারে এবং সেটা দিয়ে তারা সফল হতে পেরেছে।’
রণাঙ্গনের অন্যান্য সেক্টরে এই গোলাবারুদের ঘাটতি কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুপিয়ান্সক লাইন বেশ দুর্বল। গত কয়েকমাস ধরে রাশিয়া এই এলাকা লক্ষ্য করে তাদের আক্রমণ জোরদার করছে। তারা চেষ্টা করছে এই গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ কেন্দ্র আবার দখল করতে, যেটা তারা ২০২২ সালের শরৎকালে হারিয়েছিল।
কুপিয়ান্সক-এ ৪৪ ব্রিগেডের কমান্ডার ইউরি বলছেন, তার গোয়েন্দা বিমান ইউনিটগুলো অনেক দূর-পাল্লার লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করে, যাদের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার মর্টার আর গ্রেনেড নিক্ষেপের কামান। কিন্তু যথেষ্ট গোলা-বারুদ তাদের নেই, তাই তারা সেই লক্ষ্যগুলোতে আঘাত হানতে পারছে না। সেটা না করে, তার শত্রু কিভাবে সৈন্য সমবেত করছে, সেটা দূর থেকে দেখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
অলেক্সান্দের বলেন, এই মুহূর্তে তার যথেষ্ট পরিমাণ গোলাবারুদ আছে। তিনি কুপিয়ান্সক-এ ৩২ ব্রিগেডের একটি ব্যাটালিওনের কমান্ডার। তিনি বলেন, ‘কিন্তু সব নির্ভর করছে রাশিয়ার দিক থেকে তীব্রতার উপর। তারা যদি মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে এই লাইন ধরে রাখা সম্ভব হবে না।’