
রেজুয়ান আহম্মেদের ‘এক মুঠো গল্প’ জীবনকে স্পর্শ করার এক আন্তরিক প্রয়াস

গ্রন্থের নাম: ‘এক মুঠো গল্প’
জীবন নামক এই বিস্তৃত ক্যানভাসে রং তো লেগেই থাকে—কখনো উজ্জ্বল আনন্দের, কখনো ধূসর বেদনার, আবার কখনো বা রক্তাক্ত ক্ষতের। রেজুয়ান আহম্মেদের গল্পসংকলন "এক মুঠো গল্প" পাঠককে ঠিক এই জীবনের ভেতরেই টেনে নেয়, যেখানে প্রতিটি গল্প একেকটি দর্পণ: সমাজের নিগূঢ় চিত্র, অবহেলিত মানুষের নিঃশব্দ যন্ত্রণা এবং স্বপ্ন-সংগ্রামের বহুচিত্রী রূপ এতে প্রতিফলিত হয়েছে। গল্পগুলোর ভাষা সরল, কিন্তু আবেদন গভীর—যেন লেখক জীবনের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে এনেছেন অমূল্য মুক্তো।
এই সংকলনের প্রতিটি গল্পই সমাজের সেই মানুষদের কথা বলে, যাদের অস্তিত্ব আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পটভূমিতে মিশে আছে, কিন্তু আমরা দেখি না। ক্ষুধার জ্বালা, বেঁচে থাকার লড়াই, স্বপ্নভঙ্গের গ্লানি, নিঃসঙ্গতার ভার—এসবই এখানে মূর্ত হয়ে ওঠে চরিত্রগুলোর মুখে। লেখক কখনো একজন রিকশাচালকের জবানিতে বলেন তার দারিদ্র্যের গল্প, কখনো বা একজন বৃদ্ধ মায়ের অন্তর্নিহিত বেদনা ফুটিয়ে তোলেন, যার সন্তান তাকে ভুলে গেছে শহরের ভিড়ে। গল্পের নায়করা আমাদেরই প্রতিবেশী, কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর সমাজের মূলধারায় কখনোই পৌঁছায় না। রেজুয়ান আহম্মেদ সেই কণ্ঠগুলোকে কাগজে স্থান দিয়েছেন নিপুণ হাতে।
সংকলনটির বিশেষত্ব হলো এর গল্পগুলোর মধ্যে থাকা আবেগের দ্বৈততা। "এক মুঠো গল্প"-এ এমন গল্পও আছে যা হাসির রেশ ছড়ায়, আবার এমন গল্পও রয়েছে যা পাঠ শেষে হৃদয়ে পাথরের মতো চাপ রেখে যায়। উদাহরণস্বরূপ, "আলোর সন্ধানে" গল্পটি একটি দরিদ্র শিশুর আশাবাদী সংগ্রামের কথা বলে, যার চোখে স্বপ্নের জ্যোতি আছে, কিন্তু পরিণতিতে বাস্তবতার নির্মমতা পাঠককে স্তব্ধ করে দেয়। অন্যদিকে, "মাটির গন্ধ" গল্পে প্রেম ও বিচ্ছেদের মিশ্রণে তৈরি হয় এক করুণ সুর, যা হৃদয়ে দাগ কাটে। লেখক এখানে কখনো পাঠককে আশায় বাঁধেন, কখনো বা বাস্তবতার কঠিন মাটিতে নামিয়ে দেন—এই টানাপোড়েনই গল্পগুলোর প্রাণ।
রেজুয়ান আহম্মেদের গল্পগুলো শুধু ঘটনা বর্ণনা করে না, বরং পাঠককে জাগ্রত করে। "নীরব চিৎকার" গল্পটি সমাজের বৈষম্যকে এমন মর্মস্পর্শী ভাষায় উপস্থাপন করে যে, পাঠক নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য হন: "আমরা কি আসলেই মানবিক?" আবার "ফেলে আসা দিনগুলি" গল্পে অতীত ও বর্তমানের দ্বন্দ্বে ব্যক্তির আত্মানুসন্ধানের মাঝে লুকিয়ে থাকে বৃহত্তর সামাজিক দায়বদ্ধতার ইঙ্গিত। গল্পকার এখানে কেবল বর্ণনাকারী নন, তিনি সমাজের দর্পণ ধরিয়ে দেন—যেখানে পাঠক নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পায়।
এই সংকলনের গদ্য প্রাঞ্জল, কিন্তু তাৎপর্যে ভারী। লেখক জটিল শব্দের বাহুল্য এড়িয়ে গেছেন, বরং মাটির গন্ধমাখা ভাষায় জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রকৃতির উপমা, লোকজ অভিব্যক্তি এবং দৈনন্দিন সংলাপের ব্যবহার গল্পগুলোকে করে তোলে প্রাণবন্ত। যেমন, "ক্ষুধার আগুন" গল্পে তিনি লিখেন: "সে ক্ষুধাকে চিনত না, ক্ষুধাই তাকে চিনে ফেলেছিল—হাড়ে হাড়ে।" এই সরল বাক্যগুলোই পাঠকের মনে গেঁথে যায়।
"এক মুঠো গল্প" নিছক গল্পের বই নয়, এটি একটি সমাজ-ইতিহাসের দলিল। যারা মনে করেন সাহিত্য শিল্পের জন্য, তাদের জন্য এই বই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে—কারণ এখানে শিল্প ও বাস্তবতার সীমানা অনন্ত। রেজুয়ান আহম্মেদ দেখিয়েছেন, গল্প বলার শক্তি হলো সমাজকে প্রত্যক্ষ করার হাতিয়ার। এই বই পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দেবে, হয়তো কাঁদাবে, হয়তো ক্ষোভ জাগাবে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে ভাবাবে। জীবনের গভীরে যেতে চাইলে এই সংকলন আপনার হাতের মুঠোয় রাখুন—এক মুঠো গল্প, এক বস্তা অনুভূতি।
রেটিং: ৪.৫/৫
প্রস্তাবনা: যারা জীবন ও মানুষের গল্পে বিশ্বাসী, তাদের জন্য এই বই অবশ্যপাঠ্য।