img

ফেসবুকের ভেতর আমাদের জীবনের ছবি: আসল চিত্র না কেবল সাজানো প্রদর্শনী?

প্রকাশিত :  ১৮:২০, ০৪ জানুয়ারী ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৮:২৫, ০৪ জানুয়ারী ২০২৫

ফেসবুকের ভেতর আমাদের জীবনের ছবি: আসল চিত্র না কেবল সাজানো প্রদর্শনী?

রেজুয়ান আহম্মেদ

আজকের পৃথিবীতে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন আমাদের মুহূর্তগুলো, অনুভূতি কিংবা অভিজ্ঞতাগুলো আমরা শেয়ার করি একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে, যেখানে অন্যরা সেগুলো দেখে, মন্তব্য করে বা লাইক দেয়। কিন্তু, এই প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করা আমাদের জীবন কি সত্যিই আমাদের জীবনের বাস্তবতা প্রতিফলিত করে? নাকি আমরা কেবল আমাদের চিরকালীন সুখী মুহূর্তগুলোই উপস্থাপন করি?

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে যখন আমরা তাকাই, প্রায়শই দেখতে পাই এক ধরনের পরিপাটি, সজ্জিত এবং সাজানো ছবি। সুসজ্জিত প্রোফাইল, হাস্যোজ্জ্বল ছবি, ভ্রমণ বা ভালো সময় কাটানোর মুহূর্ত—এইসব ছবি প্রায়ই আমাদের নিজস্ব ভাবমূর্তি তৈরি করে, যা সবার চোখে আমাদের সুখী, সফল ও পরিপূর্ণ জীবনকেই তুলে ধরে। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, এই ছবিগুলো কি আমাদের জীবনের পুরো চিত্রই প্রতিফলিত করে?

আমরা কখনো কি আমাদের জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলো শেয়ার করি? কখনো কি আমাদের অশ্রু, হতাশা, সংগ্রাম বা অব্যক্ত দুঃখের ছবি পোস্ট করি? আসলে, অধিকাংশ মানুষ কখনো এসব প্রকাশ করে না। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের এমন এক দুনিয়ায় প্রবেশ করিয়েছে যেখানে সবাই নিজের জীবনের সুন্দরতম মুহূর্তগুলোই তুলে ধরে, অথচ তাদের অন্তর্গত বাস্তবতা, অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম বা চ্যালেঞ্জগুলো অদৃশ্য থাকে। এর ফলে, আমরা হয়তো নিজেদের অনুভূতির প্রতি খোলামেলা বা সতর্ক হতে পারি, কারণ আমাদের সবসময় একটা নিখুঁত, আদর্শ চিত্র তৈরি করতে হয় যা সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পায়।

যতটা সুন্দর আমরা নিজেদের দেখতে চাই, ততটা সুন্দর আমাদের জীবনের সকল মুহূর্ত হয়তো নয়। আমরা বাস্তবে যে সংগ্রামের মধ্যে আছি, তা আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইলে কখনোই প্রকাশিত হয় না। তাই এই প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের জীবনের এক ধরনের সাজানো, রঙিন ভ্রমণকে তুলে ধরলেও, এর পেছনে থাকা একাকিত্ব, অস্থিরতা কিংবা যন্ত্রণাগুলো কখনো দেখা যায় না। ফলস্বরূপ, এই ডিজিটাল দুনিয়া আমাদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা তৈরি করে, যেখানে মনে হয় অন্যদের জীবন সবসময় আমাদের চেয়ে ভালো বা সুখী।

ফেসবুক বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যখন আমরা নিজেদের জীবন উপস্থাপন করি, তখন আমরা সচেতনভাবে বা অচেতনভাবে আমাদের জীবনের যেসব খণ্ড অংশ অন্যরা দেখতে চায়, তা তুলে ধরি। এই "দেখানো" জীবন এবং "বাস্তব" জীবনের মধ্যে পার্থক্য যেন দিন দিন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সমাজে এইসব সাজানো মুহূর্তগুলোর প্রতি মানুষের আকর্ষণ এবং এর মাধ্যমে একধরনের পরিচিতি বা সাফল্য পাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, যা মূলত আমাদের আসল জীবনকে আড়াল করে রাখে।

তবে, এসবের মাঝেও একটি সত্যি কথাও আছে। আমরা যেমন আমাদের সুখী মুহূর্তগুলো শেয়ার করি, তেমনি হয়তো আমাদের জীবনের কিছু অংশকে প্রয়োজনীয় ক্ষতি বা অব্যক্ত দুঃখের আড়ালে রাখতে চাই। জীবনের এই অংশগুলো যেহেতু কষ্টকর, তাই হয়তো আমরা আমাদের ভেতরের জগতের এই দিকগুলো অনলাইনে সবার কাছে খুলে ধরতে চাই না। কিন্তু যা কিছু আমরা নিজেদের দেখানোর চেষ্টা করি, তা আসলে আমাদের আসল চিত্রের চেয়ে অনেক দূরে।

অতএব, এটাই পরিষ্কার যে, আমরা সবসময় সবচেয়ে ভালো মুহূর্ত এবং ছবি প্রকাশ করি, তবে আমাদের জীবন অনেক গভীর এবং জটিল। জীবনের প্রতিটি দিক আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও, সোশ্যাল মিডিয়ায় যেটা দেখা যায়, তা স্রেফ একটি সাজানো প্রদর্শনী। তাই, আসল জীবন বা আসল অনুভূতির গভীরে প্রবেশ করতে, আমাদের একে অপরের সামনে আরও খোলামেলা হতে হবে এবং আমরা যা শেয়ার করি তা শুধুমাত্র একটি চিত্র, একে সত্যি হিসেবে নিতে হবে না।


রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম
img

বংশের পরিচয়!

প্রকাশিত :  ১২:০০, ১২ মে ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

আষাঢ়ের এক ভিজে বিকেল। আকাশের গর্জন থেমে গেছে বটে, কিন্তু বাতাসে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ। উঠোনে জমে আছে নিঃশব্দতা। দূরের বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা গান—যেন সময় থেমে গেছে, কিংবা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।  

রতন মাস্টার বসে আছেন পুরোনো আমগাছটার ছায়ায়। হাতে নাইলনের সুতো, বাঁধছেন মাছ ধরার জাল। দেখে মনে হয়, এই জালের ফাঁকেই তিনি বুনে চলেছেন জীবনের গল্প—ভাঙা স্বপ্ন, না বলা কথা, হারিয়ে যাওয়া সময় আর কিছু গোপন কষ্ট।  

ঠিক এমন সময়, গ্রামের পেছনের কাদা-ঢালা পথ বেয়ে এসে দাঁড়াল সজল। আধময়লা ছেঁড়া জিন্স, হাঁটুর কাছ থেকে ঝুলে থাকা ইয়ারফোনের তার, আর চোখজোড়া যেন কিছু হারানোর গ্লানিতে ঘোলাটে।  

সে আমগাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, একটু নিচু গলায় বলল,  

— “মাস্টার চাচা... শহরের বন্ধুরা মজা করে বলে ‘রংপুরের মফিজ’। তাদের পূর্বপুরুষরা কেউ জমিদার, কেউ ব্যারিস্টার। আর আমার শিকড় তো চাষার ঘরে...”

রতন মাস্টার চশমাটা একটু উঁচু করে তাকালেন। চোখের কোণায় বয়সের ভাঁজ হলেও, দৃষ্টিতে ছিল একরাশ কোমলতা। ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বললেন,  

— “চা খাবি সজল? পাতলা লেবু চা, না কি গাঢ় দুধ চা?”

সজলের গলা কেঁপে উঠল, সে ফিসফিস করে বলল,  

— “যে চায়ের কাপে বংশের গরিমার সুবাস থাকে, সেই চা চাই…”

রতন মাস্টার জালটা থামিয়ে পাশে রাখলেন। একটু নীরব হয়ে বললেন,  

— “আয়, আজ তোকে একটা গল্প শোনাই। এক চাষার গল্প, যার হাতে ছিল না জমিদারি দলিল, কিন্তু মুঠোয় ছিল বিশুদ্ধ স্বপ্ন আর সৎ ইচ্ছে।” 

এ গল্প আসলে তাঁর নিজের—রতন মাস্টারের। মাটির ঘরে জন্ম তাঁর, টিনের চাল ভেদ করে বৃষ্টির পানি যে ঘরে প্রতিরাতে বালিশ ভিজিয়ে দিত। বাবা শিবু মণ্ডল, গরিব কৃষক; আধ বিঘা জমি, আর সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি। মা পদ্মা দেবী রোজ ভোরে বলে উঠতেন,  

— “মানুষের উপকার করিস রতন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তো সবচেয়ে বড় ধর্ম।”

রতনের বয়স তখন বারো, সেদিনই তাঁর বাবা না-ফেরার দেশে চলে যান। সেই ছোট্ট কাঁধে সংসারের ভার। গরুর পিঠে চড়ে দুধ বিক্রি করতেন সকালে, আর রাতে স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে পড়তেন। পাড়ার ছেলেরা হাসত, বলত—“দুধওয়ালা পণ্ডিত!” 

রতন হেসে বলত, “এক গরু দিচ্ছে শরীরের শক্তি, আরেকটা মনকে দিচ্ছে জ্ঞানের আলো—দুটোই দরকার মানুষ বাঁচাতে।”

একবার পরীক্ষার হলে সবাই নকল করছে। রতন সাদা খাতা জমা দেয়। শিক্ষক রেগে গিয়ে বললেন, “তুই ফেল করলি!”  

রতনের জবাব ছিল—“খাতায় ফেল, কিন্তু বিবেকের খাতায় তো একশো!” 

দিন গড়াতে গড়াতে তাঁর পাঠশালায় ভিড় বাড়ে। গরিব, অনাথ, পথশিশু—সবাই তাঁর ছাত্র। একদিন গ্রামের চেয়ারম্যান ঠাট্টা করে বললেন, “চাষার ঘরে জন্ম নিয়ে এত পড়া শিখে কী করবি?”

রতনের উত্তর ছিল, “জন্ম তো আমার হাতে ছিল না। কিন্তু আমি মানুষের মতো মানুষ হবো, এটা আমার সিদ্ধান্ত!”

মুসলিম-হিন্দু, জাত-পাত তাঁর কাছে কিছুই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ঈদের সকালে গোপাল কাকার বাড়ি গিয়ে হাতে মিষ্টি তুলে দিতেন, আবার দুর্গাপূজায় মুসলিম ছেলেদের সাথে মিলে মণ্ডপে আলপনা আঁকতেন।  

একবার মন্দিরে আগুন ধরলে, তিনি দৌড়ে ঢুকে যান আগুনে। হাত পুড়ে গেলেও মুখে শুধু বললেন, “মানুষের ধর্মে আগুন লাগলে, পানি ঢালাটাই তো আমার কাজ।”

একদিন এক রাজনীতিবিদ এলেন ভোট চাইতে। রতন জিজ্ঞেস করলেন, “গ্রামের সেই অন্ধ মা যার চোখে অস্ত্রোপচারের টাকা নেই, আপনি কি তাঁর জন্য কিছু করেছেন?”

তিন দিন পর রাজনীতিবিদ এসে প্রণাম করে বললেন, “আপনি শিখিয়ে দিলেন, রাজনীতি মানে পকেট ভরা না, হৃদয় ভরা!”

সজল নীরবে শুনছিল। সেদিন থেকে তার ভেতরটা বদলে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও আর শহরের চাকরির পেছনে ছুটল না। গড়ে তুলল ‘মাটির পাঠশালা’। সেখানে এখন রাস্তার শিশুরা শেখে অক্ষর চিনতে, আর স্বপ্ন দেখতে। রতনের কথা সে লিখে রেখেছে ডায়েরির প্রথম পাতায়—  

“বংশের পরিচয় রক্তে নয়, কর্মে।” 

পঁচিশ বছর কেটে গেছে...  

গ্রামের মেলায় মাইক হাতে সজল দাঁড়িয়ে বলছে,  

— “আমার পেছনে নেই জমিদার বংশ, নেই ইতিহাসের ভারি গরিমা। আছে এক মাটির মানুষ, যিনি আমাকে শিখিয়েছেন—মানুষের পরিচয় তার আদর্শে, তার কাজে।”

মাঠজুড়ে করতালির শব্দ। ছাপড়া ঘর থেকে হেঁটে এলেন এক বৃদ্ধ—রতন মাস্টার। পায়ের জুতা নেই, কিন্তু চোখে জল। গ্রামের মানুষ চিৎকার করে উঠল,  

— “এই তো আমাদের গর্ব, আমাদের বংশ!”  

রতন মাস্টার চোখ মুছে শুধু বললেন,  

— “বংশ মানে জন্ম নয়। বংশ মানে নদীর মতো হওয়া—নিজের পথ নিজেই বানিয়ে, সবার পিপাসা মেটানো।”

তোমার জন্ম হয়তো মাটির ঘরে, কিন্তু কর্ম যদি হয় আকাশ ছোঁয়া, তবে সেই কর্মই তোমার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। কারণ, সত্যিকারের বংশ পরিচয় রক্তে নয়—আদর্শে।