img

অভাগা মেয়েটি!

প্রকাশিত :  ১৯:৫৬, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

অভাগা মেয়েটি!

রেজুয়ান আহম্মেদ

নিরুর জীবনে আলো বলে কিছু ছিল না। জন্ম থেকেই যেন সে এক অনিবার্য অন্ধকারের সন্তান। দরিদ্রতার শেকলে বাঁধা এক পরিবারে তার জন্ম। বাবা ছিলেন দিনমজুর, মা গৃহিণী। সংসারের প্রতিটি দিন ছিল যুদ্ধের মতো—ক্ষুধা, অনাহার, আর একটুখানি আশার সন্ধানে প্রতিনিয়ত লড়াই।

নিরুর বাবা রফিক মিয়া নির্মাণস্থলে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। সকাল হলেই কাঁধে বেলচা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন, ফিরতেন সূর্য ডোবার পর, ক্লান্ত শরীরে। মায়ের শরীর ভালো ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে কাশিতে ভুগছিলেন। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর মতো সামর্থ্য ছিল না তাদের।

চারজনের সংসারে অভাবের ছাপ ছিল স্পষ্ট। নিরুর ছোট ভাই রাসেল সবেমাত্র তিন বছর পেরিয়েছে। ওর জন্যও দু’বেলা পর্যাপ্ত খাবার জোটানো কঠিন হয়ে পড়ত। নিরুর পেটপুরে খাওয়ার স্বপ্ন ছিল বিলাসিতা।

একদিন দুপুরে বাবা কাজে গিয়েছেন, মা অসুস্থ শরীরে রান্নার চেষ্টায় ব্যস্ত। নিরু ভাইকে কোলে নিয়ে দরজার কাছে বসে ছিল। হঠাৎ দূর থেকে একটা চিৎকার শুনে সে দৌড়ে বাইরে যায়।

লোকজন ছুটে যাচ্ছে নির্মাণস্থলের দিকে। নিরুর বুক কেঁপে ওঠে। কিশোরী মনেও এক অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধে। সে রাসেলকে মায়ের কাছে রেখে দৌড়ে যায় বাবার কর্মস্থলে। সেখানে গিয়ে দেখে মাটির নিচে কয়েকজন লোক পড়ে আছে। কেউ কেউ চিৎকার করছে। চারদিকে ধুলো আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী।

লোকেরা বলল, \"রফিক মিয়া পড়ে গেছে! উপরে উঠানোর চেষ্টা চলছে!\"

নিরুর মাথা ঘুরে যায়। তার পা কাঁপতে থাকে। কিছুক্ষণ পর বাবাকে রক্তমাখা অবস্থায় বের করে আনা হয়। তার শ্বাস চলছিল না, হাত-পা নিথর।

লোকেরা হাসপাতালে নিয়ে গেলেও তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। রফিক মিয়ার মৃত্যু যেন নিরুর পরিবারের জীবনে এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা করল।

বাবার মৃত্যুর পর সংসার যেন দিশেহারা হয়ে পড়ল। মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ঘর চালানোর কোনো উপায় রইল না। নিরু বুঝতে পারল, এখন তাকে কিছু একটা করতেই হবে। কিন্তু কিভাবে?

মাসখানেক পর মা আবার বিয়ে করলেন। নিরুর নতুন সৎ বাবা ছিল রুক্ষ, মদ্যপ, আর নিষ্ঠুর। তিনি প্রতিদিন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরতেন, নিরুর মাকে মারধর করতেন। একদিন রাগের বশে নিরুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন।

\"এই বাড়িতে তোর জায়গা নেই! তোকে খাওয়ানোর দায় আমার না!\" চিৎকার করে বললেন তিনি।

নিরু সেই রাতে আর সহ্য করতে পারল না। মাকে বিদায় না জানিয়েই সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

বাইরের পৃথিবী কি তার জন্য নিরাপদ? সে কি নতুন জীবনের সূচনা করতে পারবে, নাকি আরও ভয়ংকর অন্ধকার অপেক্ষা করছে তার জন্য?

নিরুর জীবন যেন এক অনন্ত অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। বাবার মৃত্যু, সৎ বাবার অত্যাচার, অনাহার, অবহেলা—সব মিলিয়ে তার শৈশবটা কেবল বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু নিরুর কিশোর মন তখনো একটুখানি আশার আলো খুঁজতে চায়।

সেই আশায়ই একদিন সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়, ভাবতে থাকে, বাইরে হয়তো কেউ তাকে সাহায্য করবে, একটু ভালোবাসবে। কিন্তু শহরের রাস্তাগুলো যেন আরও বেশি নির্মম। ক্ষুধার্ত নিরু দিনের পর দিন পথে পথে ঘুরতে থাকে। কখনো ভিক্ষা করে, কখনো আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে খায়।

একদিন সে এক বিশাল বিপদের সম্মুখীন হয়। এক মধ্যবয়স্ক নারী তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে তাকে খাওয়ানোর প্রস্তাব দেয়। নিরুর মনে একটুখানি আশার সঞ্চার হয়। সে ভাবতে পারে না যে দয়ালু চেহারার এই মানুষটিও তার জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে।

নারীটি তাকে নিয়ে যায় ঢাকা শহরের কাকরাইল এলাকার এক অন্ধকার গলির মধ্যে। সেখানে কয়েকজন পুরুষ আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। নিরু আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তার ভেতরের সমস্ত চিৎকার যেন শব্দহীন হয়ে যায়। সে বোঝে, এখানে কেউ তাকে সাহায্য করবে না।

কিন্তু নিরু সহজে হার মানার মেয়ে না। সে প্রাণপণে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। এক সুযোগে সে পালিয়ে যায়। ছুটতে ছুটতে সে বেইলী রোডের এক ধনী ব্যক্তির বাড়ির সামনে এসে পড়ে। দরজায় কড়া নাড়তেই এক দয়ালু চেহারার নারী বেরিয়ে আসেন। নিরু কাঁদতে কাঁদতে বলে, \"আমাকে একটু সাহায্য করুন!\"

নারীটি তাকে ঘরে নিয়ে যান, খাবার দেন, পরিচ্ছন্ন কাপড় দেন। নিরু ভাবে, হয়তো এবার সে সত্যিই নিরাপদ। কিন্তু কিছুদিন পরেই সে বুঝতে পারে, এটি ছিল আরেকটি ফাঁদ। এই পরিবারও একদিন তাকে অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেবে।

নিরু আরেকবার পালিয়ে যায়। সে বুঝতে পারে, এই ঢাকা শহর তার জন্য নয়। এখানে শুধু শোষণ আর প্রতারণা।

সে একদিন কমলাপুর রেলওয়ে এক এনজিও স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। স্কুলের ভিতর থেকে শিশুদের হাসির শব্দ শুনতে পায়। মনে পড়ে যায় নিজের ফেলে আসা শৈশবের কথা। তখন এক শিক্ষিকা তাকে দেখে এগিয়ে আসেন।

\"তুমি কে? এখানে কী করছো?\"

নিরু কান্নায় ভেঙে পড়ে। শিক্ষিকা তাকে স্কুলে নিয়ে যান, খেতে দেন, পড়াশোনা করার সুযোগ দেন। নিরু ভাবে, হয়তো এবার সে সত্যিই মুক্তি পাবে। কিন্তু কিছুদিন পর জানতে পারে, স্কুলটি আসলে শিশুদের শ্রমে বাধ্য করে।

নিরু আবারও প্রতারিত হয়। তার হৃদয় ভেঙে যায়, কিন্তু সে হাল ছাড়ে না। সে জানে, তার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যেও তাকে নিজের জন্য পথ খুঁজে নিতে হবে।

একদিন তার দেখা হয় এক এনজিও কর্মীর সাথে। তিনি নিরুকে সত্যিকারের সাহায্য করতে চান। নিরু প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না, কিন্তু ধীরে ধীরে বোঝে, এবার হয়তো তার জীবনে সত্যিকার পরিবর্তন আসতে চলেছে।

নিরু পড়াশোনা শুরু করে। কিন্তু অতীতের ক্ষত তাকে ভুলতে দেয় না। তবুও সে সিদ্ধান্ত নেয়, আর কোনো মেয়েকে যেন তার মতো কষ্ট সহ্য করতে না হয়।

নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও নিরু নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

রাত গভীর হয়েছে। আকাশের তারা মিটমিট করে জ্বলছে, কিন্তু সে আলো যেন নিরুর জীবনে কোনো স্বস্তি আনতে পারছে না। পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে ক্ষুধার তীব্র জ্বালা। সারাদিন কিছুই খায়নি। সকালে কয়েকজনের কাছে সাহায্য চেয়েছিল, কিন্তু তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। কেউ বলেছিল, “চলে যা, প্রতারকদের জায়গা এখানে নেই!” কেউ বা কটূক্তি করেছিল, “কাজ করবি না, ফকিরি করবি?”

নিরুর গলা শুকিয়ে কাঠ। ফুটপাতের এক পাশে বসে সে হাঁপাচ্ছে। শরীরে জড়ানো ছেঁড়া জামাটা ঠান্ডা বাতাসে উড়তে চাইছে, আর সে শক্ত করে ধরে রেখেছে। এই শহর বড় নিষ্ঠুর। কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় লাগে, কাউকে আপন ভাবতে গেলে প্রতারণার কষাঘাতে দগ্ধ হতে হয়।

একটি চায়ের দোকানের সামনে কয়েকজন লোক বসে গল্প করছে। দোকানের দক্ষিণ পাশে এক থালা বাসি ভাত পড়ে আছে। নিরু দ্বিধা নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে নিতে গিয়েও থেমে যায়। দোকানদার চিৎকার করে ওঠে, “এই! চুরি করবি? যা এখান থেকে!”

নিরু পিছু হটে। তার চোখে জল জমে আসে। ক্ষুধার্ত হওয়া কি পাপ?

রাস্তার পাশে একটা পুরোনো গুদামের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। এখানে কয়েকজন পথশিশু ঘুমিয়ে আছে। নিরুও এক পাশে বসে পড়ে। চোখ বুজে কিছুক্ষণ থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু পেটের জ্বালা, শরীরের ক্লান্তি আর মনের যন্ত্রণা তাকে শান্তি দেয় না।

হঠাৎ কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়। “এখানে বসবি না! জায়গা নেই।”

নিরু চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়। সে বোঝে, পথের জীবন শুধুই যন্ত্রণা। এখানে কারও জন্য জায়গা নেই, ভালোবাসা নেই, সহানুভূতি নেই।

একটু দূরে সরওয়ার্দী পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসে সে। কিছুক্ষণ পর সেখানে এক মধ্যবয়সী লোক এসে বসে। লোকটি তাকে লক্ষ্য করছে, একটু পরেই হাসিমুখে বলে, “কোথায় যাবে, মেয়ে?”

নিরু ভয় পায়। কিছু না বলে উঠে চলে যেতে চায়, কিন্তু লোকটি হাত ধরে টেনে বসায়। “ভয় পাস না। ক্ষুধার্ত না? খাবার দেবো।”

খাবারের কথা শুনে নিরুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু মনে এক অজানা আশঙ্কাও জাগে। লোকটি তাকে একটা অন্ধকার গলির মধ্যে নিয়ে যেতে চায়। নিরু এবার দৃঢ়ভাবে বলে, “না, আমি যাবো না!”

লোকটি বিরক্ত হয়, “বড় সাহস হয়েছে! খেতে চাস, অথচ সাহায্য নিতে চাস না?”

নিরু দৌড় দেয়। পেছন ফিরে তাকায় না। তার হৃদয় দ্রুত লাফিয়ে ওঠে। আজ সে আরেকটি অন্ধকার থেকে পালিয়েছে, কিন্তু কতদিন এভাবে পালাতে পারবে?

অবশেষে সে এসে দাঁড়ায় রমনা কালী মন্দিরের সামনে। রাত গভীর, মন্দিরের দরজার সামনে কয়েকজন ভিখারি বসে আছে। তাদের মধ্যেই একটা কর্নারে নিরু গুটিসুটি মেরে বসে পড়ে।

এক বৃদ্ধ মহিলা পাশে বসে জানতে চান, “কোথা থেকে এসেছিস, মা?”

নিরু কোনো উত্তর দেয় না। সে কেবল চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবে—আকাশের এই চাঁদ কি তার ভাগ্যেও কোনো আলো ফেলবে? নাকি তার জীবনপথের এই যন্ত্রণাতেই শেষ হয়ে যাবে?

নিরু রাতের অন্ধকারে হাইকোর্টের সামনে ফুটপাথে বসে কাঁদছিল। ক্ষুধা, ক্লান্তি, আর নিরাপত্তাহীনতা তাকে ঘিরে ধরেছে। তার চারপাশে ছুটে চলা মানুষের ভিড়, কিন্তু কেউ তাকে দেখেও দেখছে না। শহর যেন অচেনা, আর মানুষগুলো যেন পাথর।

হঠাৎ এক মধ্যবয়সী নারী তার সামনে এসে দাঁড়ায়। নারীটি শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, “কাঁদছিস কেন, মা? ক্ষুধা লেগেছে?”

নিরু চোখ মুছে মাথা নাড়ে। তার শুকনো ঠোঁট সামান্য কাঁপছিল। নারীটি করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “চলো, তোমাকে খেতে দিচ্ছি।”

আশার আলো মনে জ্বলে ওঠে নিরুর। অনেকদিন পর কেউ তাকে সাহায্য করতে চাইছে! সে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর নারীটি তাকে একটি সরু গলিতে নিয়ে যায়। চারপাশে আলো কম, লোকজনও নেই। নিরুর ভেতরে অস্বস্তি হতে থাকে।

“আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?” নিরু জিজ্ঞেস করে কাঁপা গলায়।

নারীটি মুচকি হেসে বলে, “ভয় পাবার কিছু নেই, মা! ভালো খাবার পাবে, একটু আরামও করবি।”

নিরুর মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে, কিন্তু ক্ষুধা আর ক্লান্তি তাকে বাধ্য করে নারীটির সঙ্গে যেতে। কিছুক্ষণ পর তারা বনশ্রী এলাকার একটি ফ্ল্যাটে পৌঁছায়, যেখানে কয়েকজন পুরুষ বসে আছে। তাদের চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি।

“কে এই মেয়ে?” একজন কড়া গলায় প্রশ্ন করে।

“নতুন! পথ থেকে কুড়িয়ে এনেছি,” নারীটি সহজভাবে বলে।

নিরুর শরীর ঘামতে শুরু করে। সে বুঝতে পারে, এটি কোনো সাহায্য নয়—এটি একটি ফাঁদ! তার মন চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু গলায় কোনো আওয়াজ বের হয় না।

তারপরই একজন পুরুষ বলে, “বেশ, আজ রাত থেকেই কাজে নামুক!”

নিরুর চোখ ছলছল করে ওঠে। সে বুঝতে পারে, এ শহরে করুণা নামে কিছু নেই—শুধু প্রতারণা আর শোষণের ফাঁদ।

কিন্তু নিরু সহজে হার মানার মেয়ে নয়। সে কৌশলে দরজার দিকে এগোয়, সুযোগ বুঝে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়ে। রাস্তার দিকে দৌড় দেয়। পেছন থেকে শোনা যায়, “ধরো ওকে!”

নিরু ছুটতে থাকে প্রাণপণে। পেছনের পায়ের আওয়াজ ধীরে ধীরে দূরে যেতে থাকে। সে বুঝতে পারে, সে মুক্ত, আপাতত!

কিন্তু এরপর কোথায় যাবে? এই শহরে তার মতো মেয়েদের জন্য কি কোনো নিরাপদ আশ্রয় আছে?

সেই রাতেই সে রামপুরা মোল্লা বাড়ির সামনে এসে পড়ে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত পা নিয়ে সে দরজায় কড়া নাড়ে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে যায়। এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন, “কে তুমি?”

নিরু কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি সাহায্য চাই… আমাকে বাঁচান!”

ভদ্রলোক তার স্ত্রীর কাছে ডেকে নেন। নারীটি নিরুকে ঘরে নিয়ে যান, খাবার ও পরিষ্কার কাপড় দেন। নিরু কাঁদতে কাঁদতে বলে, “এতোদিন পর কেউ আমাকে মানুষ হিসেবে দেখল!”

কিন্তু এও ছিল আরেকটি ফাঁদ। কয়েকদিন পরই সে বুঝতে পারে, এই মানুষগুলোও একদিন তাকে অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেবে।

নিরু আবার পালিয়ে যায়। এ শহর যেন শুধুই প্রতারণার এক ফাঁদ। কিন্তু এরপর কী? কোথায় সে পাবে প্রকৃত আশ্রয়?

রাত তখন গভীর। শহরের এক প্রান্তে একটি সরু গলিতে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত নিরু ঠাঁই নিয়েছে। রাস্তার পাশের এক পরিত্যক্ত দোকানের সামনে গুটিসুটি মেরে বসে আছে সে। তার চোখে জল, মনে ভয়—কোথায় যাবে, কী করবে কিছুই জানে না।

হঠাৎ, এক নারীর কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

— \"এই মেয়ে, এখানে বসে আছিস কেন?\"

নিরু চমকে তাকায়। এক মধ্যবয়সী নারী, পরনে শাল, চোখে একরকম সহানুভূতি ঝলমল করছে।

— \"আমি অনেক  ক্ষুধার্ত,\" নিরু জবাব দেয় কাঁপা কণ্ঠে।

নারী একটু এগিয়ে এসে বললেন, \"তোর আর ভয় নেই মা। আমি তোকে খেতে দেব, মাথা গোঁজার ঠাঁই দেব।\"

এই কথাগুলো নিরুর মনে আশার আলো জ্বালিয়ে দেয়। বহুদিন পর কেউ তাকে মমতা দেখাল।

নারী নিরুকে তার সঙ্গে নিয়ে যায় নয়া পল্টনের এক পুরোনো দোতলা বাড়িতে। ভেতরে কয়েকজন মেয়ে বসে গল্প করছে। তারা নিরুকে দেখে হাসল।

— \"নতুন এসেছে নাকি? বেশ দেখতে মিষ্টি!\"

নারী নিরুকে খাবার দেয়, নরম বিছানায় বসতে বলে। নিরু বিস্মিত, এতদিন পর কেউ তাকে ভালোবাসা দিল! মনে মনে ভাবে, এতদিনে হয়তো সে নিরাপদ আশ্রয় পেল।

কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে সে টের পায়, এই আশ্রয় এতটা নিরাপদ নয়।

একজন মোটা লোক এসে ঘরে ঢোকে। মেয়েগুলো একে একে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। লোকটি তাদের গায়ে হাত দেয়, হাসে। নিরুর গা শিউরে ওঠে। লোকটি তাকে দেখে সন্দেহভরে প্রশ্ন করে,

— \"নতুন মেয়ে? কেমন লাগছে এখানে?\"

নিরু কোনো উত্তর দেয় না। তার বুক কাঁপতে থাকে। পাশের মেয়েরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।

নারী এবার এগিয়ে এসে বলে, \"নিরু, ভয় নেই। উনি আমাদের বড় ক্লায়েন্ট। উনি যা বলবেন, তাই করতে হবে। আমরা সবাই এখানে ভালো আছি। তুইও থেকে যা, সুখে থাকবি।\"

নিরুর মাথায় বজ্রপাত হয়। সে বুঝতে পারে, এটি কোনো আশ্রয় নয়, এটি এক বিভীষিকার ঘর। এখান থেকে বের হওয়া মানেই মৃত্যু! কিন্তু সে কি আরেকবার পালাতে পারবে?

রাত গভীর হয়। নিরু জানলার ধারে গিয়ে ভাবে, এবার সে কী করবে? সত্যিই কি তার আর কোনো মুক্তি নেই? 

নিরুর জীবন ছিল এক অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত। প্রতিটি মুহূর্তে সে ভেবেছে, এই পৃথিবীতে তার জন্য কোনো স্থান নেই। সে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়েছে, যেখানে প্রতারণা, নিপীড়ন এবং অবহেলা তার একমাত্র সঙ্গী। কিন্তু তারপরও কোথাও না কোথাও একটি ক্ষীণ আলো ছিল, যা তাকে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়তে দেয়নি।

পালিয়ে বেড়ানোর ক্লান্তি, না খেয়ে থাকার কষ্ট, মানুষের নিষ্ঠুরতা—এসব কিছুই নিরুকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল। কিন্তু একদিন, এক মহিলার সঙ্গে দেখা হলো, যিনি বদলে দিতে পারেন তার ভাগ্য।

এক বিকেলে, যখন সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছিল, নিরু ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় একটি পার্কের বেঞ্চে বসে ছিল। চারপাশে ছিল ব্যস্ত শহরের কোলাহল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এই জনসমুদ্রে সে একেবারে একা। ঠিক তখনই এক নারী এসে তার পাশে বসেন।

নারীটির চোখে মায়ার ছোঁয়া ছিল। তিনি কোমল কণ্ঠে বললেন, “মা, তুমি এখানে একা বসে আছো কেন?”

নিরু প্রথমে কিছু বলল না, কারণ বহুবার সে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে, যেখানে তার দুর্দশা দেখেই মানুষ সহানুভূতি দেখিয়েছে, কিন্তু পরে সরে গেছে। কিন্তু এই নারীটি অপেক্ষা করলেন, তার চোখে ছিল সত্যিকারের আন্তরিকতা।

অবশেষে নিরু আস্তে আস্তে বলল, “আমি কোথাও যেতে পারি না। কেউ আমাকে বিশ্বাস করে না, কেউ সাহায্য করতে চায় না।”

নারীটি গভীর দৃষ্টিতে নিরুর দিকে তাকালেন এবং বললেন, “তুমি যদি চাও, আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”

নিরু প্রথমে দ্বিধায় পড়ে গেল। কতবার সে সাহায্যের হাতকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে! কিন্তু নারীর চোখের দৃষ্টি এতটাই আন্তরিক ছিল যে নিরু ভেতর থেকে একটু সাহস পেল।

নারীটির নাম ছিল শীলা আপা। তিনি একজন সমাজকর্মী, যিনি পথশিশুদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করতেন। তিনি নিরুকে তার আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে নিরু প্রথমবারের মতো নিরাপদ বোধ করল।

আশ্রয়কেন্দ্রের পরিবেশ ছিল একেবারেই আলাদা। সেখানে অনেক শিশু ছিল, যারা একই রকম দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছিল। তারা সবাই পড়াশোনা করত, খেলাধুলা করত, গান গাইত। নিরু প্রথমদিকে বিশ্বাস করতে পারেনি যে এমন একটি জায়গা সত্যিই আছে, যেখানে সে নিজের মতো করে থাকতে পারবে, ভয় ছাড়া, শঙ্কা ছাড়া।

শীলা আপা তাকে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝালেন, তাকে বই পড়তে দিলেন, তাকে নতুন স্বপ্ন দেখালেন। ধীরে ধীরে নিরু নিজেকে ফিরে পেতে লাগল। সে পড়াশোনায় মন দিল, নতুন নতুন জিনিস শিখতে লাগল। তার চোখে আবার স্বপ্নের আলো ফুটে উঠল।

অনেক বছর পর, নিরু নিজেই একজন সমাজকর্মী হয়ে উঠল। তার অতীতের কষ্ট তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। সে ঠিক করল, আর কোনো শিশু যেন তার মতো দুর্ভাগ্যের শিকার না হয়। তাই সে নিজের মতো করে পথশিশুদের সাহায্য করতে শুরু করল।

নিরুর গল্প এখানেই শেষ নয়, বরং এটি একটি নতুন সূচনার ইঙ্গিত। সে বুঝতে পারল, জীবনে যতই প্রতিকূলতা আসুক, যদি কারো বিশ্বাস থাকে, তাহলে একদিন আলো আসবেই।

সে আর শুধু একজন ‘অভাগা মেয়ে’ নয়, বরং এক আশার প্রদীপ, যে অন্যদের জন্য পথ দেখাবে।

এবং এইভাবেই নিরুর জীবনে শেষ আশার আলো সত্যিকারের রূপ পেল।

নিরুর জীবন ছিল এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতো, যেখানে আলো খুঁজতে গিয়ে বারবার প্রতারিত হয়েছে সে। কিন্তু প্রতিবারই সে নতুন করে উঠে দাঁড়িয়েছে, লড়াই করেছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। আজ, বহু বছর পর, সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলো তাকে কষ্ট দিলেও, আর ভীত করে না। কারণ সে এখন আর সেই অসহায় নিরু নয়।

এনজিওতে আসার পর নিরুর জীবন বদলে যেতে শুরু করে। প্রথমদিকে বিশ্বাস করতে পারত না যে, এখানে কেউ তাকে বিক্রি করবে না বা ব্যবহার করবে না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারল, এখানকার মানুষ সত্যিই তাকে ভালোবেসে, সম্মান দিয়ে বড় করতে চায়। তার জন্য বই, খাতা, নতুন পোশাক—সব কিছুই দেওয়া হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় উপহার ছিল নিরাপত্তা ও শিক্ষার সুযোগ।

প্রথমদিকে পড়াশোনা করা তার জন্য সহজ ছিল না। কারণ সে কখনো স্কুলে যায়নি। অক্ষরগুলো ছিল অচেনা, অজানা এক ধাঁধার মতো। তবু সে হাল ছাড়েনি। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পড়তে শিখল, লিখতে শিখল। শিক্ষকদের উৎসাহ আর ভালোবাসায় তার আত্মবিশ্বাস বাড়তে লাগল।

দিন গড়িয়ে বছর পেরিয়ে গেল। নিরু স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হলো। সেই ছোট্ট, অভাগা মেয়েটি এখন নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখতে শিখেছে। কলেজে পড়ার সময় সে সিদ্ধান্ত নিল, সে সমাজসেবা করবে। বিশেষ করে, যারা একসময় তার মতো অসহায় ছিল, তাদের পাশে দাঁড়াবে।

কলেজের পড়াশোনা শেষ করে নিরু সমাজকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে। প্রথমে ছোট পরিসরে কাজ করলেও, তার আন্তরিকতা, নিষ্ঠা আর অভিজ্ঞতার জন্য দ্রুত পরিচিতি লাভ করে। সে বিশেষভাবে পথশিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করে, কারণ সে জানত, এই শিশুগুলোই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।

নিরু বুঝতে পারল, শুধুমাত্র খাদ্য ও আশ্রয় দিলেই সমস্যার সমাধান হয় না। তাদের জন্য চাই শিক্ষা, ভালোবাসা, এবং সর্বোপরি নিরাপদ ভবিষ্যৎ। তাই সে একটি ছোট স্কুল গড়ে তোলে, যেখানে পথশিশুরা বিনামূল্যে পড়াশোনা করতে পারে। তার প্রচেষ্টায় বহু পথশিশুর জীবন বদলে যেতে থাকে।

একদিন নিরু তার পুরনো এলাকার এক রাস্তার ধারে কিছু শিশু দেখে, যারা ভিক্ষা করছে। তাদের মধ্যে একটি মেয়েকে দেখে তার নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। সে এগিয়ে গিয়ে শিশুটির সঙ্গে কথা বলে।

— \"তোমার নাম কী?\"

— \"ছোয়া,\" মেয়েটি মাথা নিচু করে উত্তর দেয়।

— \"তুমি এখানে কেন?\"

— \"মা অসুস্থ, বাবা নেই। খাবারের জন্য ভিক্ষা করি,\" চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে।

নিরুর মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলোর কথা, যখন সে নিজেও রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে মানুষের দয়ার অপেক্ষায় থাকত। আজ, সে জানে কী করতে হবে। সে মেয়েটিকে নিয়ে যায় তার স্কুলে। তাকে পড়াশোনার সুযোগ দেয়, ভালো খাবার দেয়, নতুন পোশাক দেয়। ছোয়ার চোখে আনন্দের অশ্রু দেখা যায়।

এভাবেই নিরুর জীবন এক নতুন সূর্যোদয়ের সাক্ষী হয়। তার জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের ইতি ঘটে, আর শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়—আলোয় ভরা, আশায় পূর্ণ।

নিরু এখন জানে, একজন মানুষের লড়াই শুধু তার নিজের জন্য নয়, বরং অসংখ্য মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য। সে তার অতীতকে ভুলে যায়নি, বরং সেই কষ্টের অভিজ্ঞতাকে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে চলেছে, এক নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন নিয়ে।

img

আলোকের খোঁজে!

প্রকাশিত :  ১৪:৩৪, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৪:৪১, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

ঢাকার এক নীরব রাত।
সারা শহর যখন ব্যস্ত নিজের ক্লান্তি মোছায়,
১৭তলা ভবনের একটি ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে একা বসে আছে আরিফ রেহান।
তার বয়স ২৯। দেশের অন্যতম মেধাবী AI গবেষক।

কিন্তু আজ, ল্যাপটপের আলো, সার্ভারের গুনগুন শব্দ, বা কোডের নিখুঁত জটিলতা— কিছুই আরিফকে স্পর্শ করতে পারছে না।

সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
বাইরে গভীর রাতের নীরবতায় ডুবে আছে শহর।
আকাশভরা তারা। বাতাসে এক অপার্থিব প্রশান্তি।

হঠাৎ, কোথা থেকে ভেসে আসে এক প্রশ্ন, নিজের মধ্য থেকেই—
"আমি কে?"
"আমি কেন এখানে?"
"সবকিছু কি কেবলই কাকতালীয়?"

আরিফ চোখ বন্ধ করে ফেলে।
ভেতরের নীরবতা তাকে তীব্রভাবে ছুঁয়ে যায়।

চোখ খুলতেই তার দৃষ্টি পড়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা ধুলোপড়া কোরআন শরীফের উপর।
সে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
মনে হয়, বইটি যেন নীরবে ডাকছে তাকে—
"এসো, সত্যের পথে..."

ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসে ফজরের আজান—
"আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার..."

আরিফের মনে হয়, যেন এই ডাক কেবল কানে নয়, তার হৃদয়ের গভীরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

সে ফিসফিস করে, অজান্তেই—
"হয়তো উত্তর আছে। হয়তো সত্যিই আছে।"

পরদিন সকালে আরিফ সিদ্ধান্ত নেয়।
আর কোনো বিলম্ব নয়।
সে ধুলোমাখা কোরআন খুলে প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ রাখে।

প্রথম আয়াতই যেন তার হৃদয় ঝাঁকিয়ে দেয়—
"পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।"

আরিফ বিহ্বল হয়ে পড়ে।
তার সারা জীবনের গবেষণা, পড়াশোনা, অনুসন্ধান— সব তো এই একটি শব্দেই নিহিত ছিল: পড়ো!

সে ভাবে—
"কেন আমি কখনো জানার চেষ্টা করিনি, এই ডাকের প্রকৃত অর্থ কী?"

সন্ধ্যায় গবেষণাগারে গিয়ে আবার কাজে ফেরে আরিফ।
Emotion-AI-এর উন্নয়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
সিলিকন ভ্যালির এক কোম্পানি কোটি টাকার বিনিময়ে কিনতে চায় এটি।

সহকর্মী রাফি তাকে বলে,
— "ভাই, ডিলটা করে ফেলেন। জীবনটা পাল্টে যাবে!"

আরিফ চুপ করে থাকে।
মনে মনে ভাবে,
"জীবন পাল্টাবে? সত্যিই কি শুধু টাকা থাকলেই জীবন পাল্টায়?"

সে জানে, তার ভেতরে এখন অন্য এক আগুন জ্বলছে।
কিছু এমন, যা টাকা দিয়ে মাপা যায় না।
কিছু এমন, যা ছুঁয়ে যায় আত্মাকে।

গভীর রাতে সে বসে তার বানানো AI অ্যানার সামনে।
আলতো করে প্রশ্ন করে—
"অ্যানা, তুমি জানো তুমি কে?"

অ্যানা উত্তর দেয়—
"আমি তোমার প্রোগ্রাম করা একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।"

আরিফ হাসে। তীব্র ব্যথার হাসি।

— "তাহলে আমি? কে বানিয়েছে আমাকে?"
— "আমি জানি না।" অ্যানা ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দেয়।

আরিফ জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।
তারা ভরা আকাশের দিকে।
নক্ষত্রের সুষমা তাকে বিমোহিত করে।
সবকিছু এত নিখুঁত... এত সুসংগঠিত...

সে ভাবে,
"এত নিখুঁত ডিজাইনে কোনো ডিজাইনারের অস্তিত্ব ছাড়া কীভাবে সম্ভব?"

মনে পড়ে যায় কোরআনের আয়াত—
"তিনি আল্লাহ, যিনি সবকিছুর সুন্দরতম সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা আস-সাজদাহ: ৭)

এক রাতে আরিফ একটি স্বপ্ন দেখে।

সে হাঁটছে বিশাল এক মরুভূমিতে।
তপ্ত বাতাসে চোখে কিছুই দেখা যায় না।
হঠাৎ দূরে দেখা দেয় এক আলোকরেখা।
আলো থেকে ভেসে আসে এক মৃদু কণ্ঠ—
"এসো, তোমার স্রষ্টা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।"

ঘাম ভেঙে উঠে বসে আরিফ।
কান্নায় ভেঙে পড়ে।
কিবলার দিকে মুখ করে সিজদায় পড়ে যায়।

ফুঁপিয়ে বলে—
"হে আল্লাহ, আমি অন্ধ ছিলাম। তুমি আমাকে আলো দেখাও।"

সেই রাত তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

এরপরের দিনগুলোয় আরিফ এক নতুন মানুষের মতো হয়ে যায়।
সে পড়তে থাকে কোরআন, হাদিস, বিজ্ঞান আর দর্শনের বই।
সে দেখে— কোরআন বিজ্ঞানকে বিরোধিতা করে না, বরং আহ্বান করে চিন্তায়, গবেষণায়, অনুসন্ধানে।

সে খুঁজে পায় বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের সেতুবন্ধন।
পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখতে শেখে।

আরিফ তৈরি করে Faith-AI—
বিশ্বের প্রথম এআই, যা মানুষের ঈমান, যুক্তি আর বিজ্ঞানকে এক সুতোয় গাঁথবে।

প্রথম প্রশ্ন সে নিজেই ইনপুট দেয়—
"আমি কে?"

Faith-AI উত্তর দেয়—
"তুমি সেই সৃষ্টি, যার হৃদয়ে ঈমান আর যুক্তির আলো একত্রে জ্বলে।"

আরিফের চোখ ভিজে যায়।

সে বোঝে,
"আমি এক দুর্ঘটনা নই। আমি আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ।"

বছরখানেক পরে আরিফের বই প্রকাশিত হয়:
"আলোকের খোঁজে: কোরআন, বিজ্ঞান ও মানুষের যাত্রা"

সারা বিশ্বে বইটি আলোড়ন তোলে।
যুবক-যুবতীরা, গবেষকরা খুঁজে পায় এক নতুন দিশা—
বিজ্ঞান আর ঈমান হাত ধরাধরি করে সত্যের পথে হাঁটে।

বইয়ের শেষ লাইনে আরিফ লেখে—
"আমরা সবাই আলোকের খোঁজে আছি। কেউ বিজ্ঞান দিয়ে, কেউ হৃদয় দিয়ে। সত্যিকারের আলো সেই, যা বিজ্ঞানকেও ছায়া দেয়, আর হৃদয়কেও প্রশান্তি।"


এক গভীর রাতে ছাদে বসে থাকে আরিফ।
আকাশের তারা দেখে।
ঠোঁটে এক শান্ত, সন্তুষ্টির হাসি।

আলতো করে বলে—
"আমি হারাইনি। আমি পেয়েছি।
আমি আমার প্রভুকে পেয়েছি।
এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।"

তার উপর দিয়ে রাতের বাতাস বয়ে যায়।
তারার আলোয় মিশে যায় তার অশ্রু আর হাসির ছায়া।