ইউরোপে বৃহৎ যুদ্ধের পদধ্বনি
সাইফুল খান
ইউক্রেন যুদ্ধ ১৩০০ দিন অতিক্রম করার পরে ইউরোপ এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে বিপজ্জনক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন যা ছিল 'সতর্কবার্তা', তা এখন 'তাৎক্ষণিক হুমকিতে' রূপ নিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার নতুন ব্যালিস্টিক মিসাইল পরীক্ষা। উত্তর কোরিয়ার সেনা মোতায়েন এবং পশ্চিমাদের দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি; এই তিনটি ঘটনা যুদ্ধের গতিপথ এবং ইউরোপের নিরাপত্তার সমীকরণ বদলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক থিঙ্ক-ট্যাংক (যেমন ISW, RUSI) এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বর্তমান পরিস্থিতির বিস্তারিত বিশ্লেষণ নিচে তুলে ধরা হলো।
বর্তমান পরিস্থিতি: 'রেড লাইন' অতিক্রম ও নতুন বাস্তবতা
যুদ্ধের মাঠ এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা এখন চরমে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা প্রমাণ করে যে সংঘাত আর কেবল ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই:
সংঘাতের আন্তর্জাতিকীকরণ: পিয়ংইয়ং রাশিয়ায় প্রায় ১০,০০০ থেকে ১২,০০০ সেনা পাঠিয়েছে, যারা ইতিমধ্যে রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছে। এটি ইউরোপীয় মাটিতে এশিয়ার কোনো শক্তির সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ, যা সংঘাতকে বৈশ্বিক রূপ দিয়েছে।
ক্ষেপণাস্ত্রের নতুন সমীকরণ: যুক্তরাষ্ট্র (ATACMS) ও যুক্তরাজ্য (Storm Shadow) ইউক্রেনকে রাশিয়ার গভীরে আঘাত হানার অনুমতি দিয়েছে। এর জবাবে রাশিয়া ইউক্রেনের দিনিপ্রোতে পরীক্ষামূলকভাবে 'ওরেশনিক' (Oreshnik) নামক নতুন হাইপারসনিক মধ্যম পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (IRBM) ছুড়েছে। এটি ইউরোপের যেকোনো রাজধানীতে পারমাণবিক আঘাত হানার প্রচ্ছন্ন হুমকি।
হাইব্রিড যুদ্ধের বিস্তার: বাল্টিক সাগরে ফিনল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন ও লিথুয়ানিয়ার সংযোগকারী দুটি সাবমেরিন ডেটা কেবল সম্প্রতি বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ইউরোপীয় নেতারা একে রাশিয়ার "হাইব্রিড সাবোটাজ" বা নাশকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুদ্ধের পরিধি বাড়ার জন্য এখন আর বড় কোনো ঘোষণার প্রয়োজন নেই, বরং নিচের ঘটনাগুলো তাৎক্ষণিক ট্রিগার হিসেবে কাজ করতে পারে:
রাশিয়ার পারমাণবিক ডকট্রিন পরিবর্তন: ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি রাশিয়ার পারমাণবিক নীতিতে স্বাক্ষর করেছেন। নতুন নীতি অনুযায়ী, কোনো পারমাণবিক শক্তিধর দেশের (যেমন যুক্তরাষ্ট্র/যুক্তরাজ্য/ফ্রান্স) সহায়তায় কোনো অপারমাণবিক দেশ (যেমন ইউক্রেন) যদি রাশিয়ায় হামলা চালায়, তবে তাকে "যৌথ আক্রমণ" হিসেবে গণ্য করা হবে এবং রাশিয়া এর জবাবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে।
ন্যাটোর লজিস্টিক হাব টার্গেট: রাশিয়া যদি মনে করে পোল্যান্ড বা রোমানিয়ার বিমানঘাঁটি থেকে এফ-১৬ বিমান বা দূরপাল্লার মিসাইল সরবরাহ করা হচ্ছে, তবে তারা সেগুলোকে "বৈধ লক্ষ্যবস্তু" হিসেবে আক্রমণ করতে পারে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে আর্টিকেল-৫ সক্রিয় হবে।
(আর্টিকেল -৫ হলো, ন্যাটোর কোনো একটি সদস্য দেশের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ মানে সব সদস্য দেশের ওপর আক্রমণ।
অর্থাৎ, এক সদস্য আক্রান্ত হলে সব দেশ মিলিতভাবে প্রতিরক্ষায় নামবে।এটাই যৌথ প্রতিরক্ষা নীতি।)
বাল্টিক সাগরে নৌ-সংঘাত: সাবমেরিন কেবল কাটা বা রাশিয়ার 'ছায়া নৌবহর' (Shadow Fleet) চলাচলের সময় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর সাথে সংঘর্ষ হলে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
কেন সংঘাতের ঝুঁকি এখন সর্বোচ্চ?
রাশিয়ার 'ওয়ার ইকোনমি' বা যুদ্ধ অর্থনীতি: রাশিয়া তার জিডিপির প্রায় ৬-৭% এখন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করছে। ক্রেমলিন জানে, যুদ্ধ থামালে তাদের অর্থনীতি ধসে পড়তে পারে। তাই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করা তাদের টিকে থাকার কৌশল।
ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনের দুর্বলতা: জনবল ও অস্ত্র সংকটে দনবাসে (বিশেষ করে পকরভস্ক এবং কুরাখোভ অঞ্চলে) ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। রাশিয়া এখন দ্রুতগতিতে গ্রাম ও শহর দখল করছে।
কীভাবে সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে:
থিঙ্ক-ট্যাংকগুলোর সিমুলেশন অনুযায়ী দুটি পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক:
(ক) ট্যাকটিক্যাল এস্কেলেশনঃ ইউক্রেন দূরপাল্লার মিসাইল দিয়ে রাশিয়ার কোনো বড় অস্ত্রাগার বা কমান্ড সেন্টার ধ্বংস করল। রাশিয়া পাল্টা জবাবে ইউক্রেনে বা ন্যাটোর সীমান্তে কৌশলগত (Tactical) পারমাণবিক অস্ত্র বা বড় আকারের হাইপারসনিক হামলা চালালে। ন্যাটো সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না কি পিছু হটবে।এই দ্বিধায় ইউরোপে বড় বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
(খ) গ্রে জোন ওয়ারফেয়ারঃ রাশিয়া ইউরোপের জিপিএস জ্যামিং বাড়াবে, আরো আন্ডার-সি কেবল কাটবে এবং ইউরোপীয় নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবে। একই সাথে পোল্যান্ড বা বাল্টিক সীমান্তে বেলারুশ ও রাশিয়ার সেনারা মহড়ার নামে উত্তেজনা ছড়াবে। একটি ছোট ভুল বোঝাবুঝি বা দুর্ঘটনাবশত গুলিবিনিময় এমনকি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
প্রতিপক্ষের শক্তি: রাশিয়া কি একা?
না, রাশিয়া এখন আর একা নয়। একটি "অক্ষশক্তি" (Axis of Authoritarians) গড়ে উঠেছে:
উত্তর কোরিয়া: কামানের গোলা এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল (KN-23) সরবরাহের পাশাপাশি এখন সরাসরি সেনা ও জেনারেলদের মাঠে নামিয়েছে।
ইরান: রাশিয়াকে হাজার হাজার শাহেদ ড্রোন এবং সম্প্রতি স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল (Fath-360) সরবরাহ করেছে।
চীন: সরাসরি অস্ত্র না দিলেও স্যাটেলাইট ইমেজ, মাইক্রোইলেকট্রনিক্স এবং মেশিন টুলস সরবরাহ করে রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্র সচল রেখেছে।
বেলারুশ: রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র নিজেদের ভূখণ্ডে মোতায়েন করতে দিয়েছে এবং ন্যাটো সীমান্তে (পোল্যান্ড) নিয়মিত মহড়া চালাচ্ছে।
ইউরোপের প্রস্তুতি: সক্ষমতা বনাম বাস্তবতা
ইতিবাচক দিক:
প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি: পোল্যান্ড তার জিডিপির ৪.৭% প্রতিরক্ষায় ব্যয় করছে, যা ন্যাটোর মধ্যে সর্বোচ্চ। জার্মানি এবং ফ্রান্সও বাজেট বাড়িয়েছে।
নতুন উদ্যোগ: ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলার জন্য জরুরি তহবিল গঠন করছে।
দুর্বলতা ও চ্যালেঞ্জ:
অস্ত্রের অভাব: ইউরোপের গুদামে কামানের গোলার তীব্র সংকট রয়েছে। রাশিয়ার উৎপাদন ক্ষমতার তুলনায় ইউরোপ এখনও অনেক পিছিয়ে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা: জার্মানিতে জোট সরকারের পতন এবং ফ্রান্সে রাজনৈতিক বিভাজন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে ধীর করে দিয়েছে।
নেতৃত্বের সংকট: যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ইউরোপকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো একক কোনো শক্তিশালী নেতা বা দেশ এই মুহূর্তে দৃশ্যমান নয়।
বিশেষজ্ঞ সুপারিশ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
Atlantic Council, CSIS এবং European Council on Foreign Relations (ECFR)-এর সাম্প্রতিক সুপারিশগুলো হলো:
স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি (কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন): যুক্তরাষ্ট্রের দিকে না তাকিয়ে ইউরোপকে এখনই নিজস্ব পারমাণবিক ও প্রচলিত প্রতিরক্ষা ছাতা তৈরি করতে হবে।
রাশিয়ার 'হাইব্রিড' জবাব: কেবল সামরিক নয়, সাইবার ও অবকাঠামোগত সুরক্ষায় 'আর্টিকেল-৫'-এর মতো যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।
উপসংহার
ইউরোপে বড় সংঘাতের ঝুঁকি এখন আর "ভবিষ্যতের আশঙ্কা" নয়, বরং "বর্তমান সংকট"। রাশিয়ার 'ওরেশনিক' মিসাইল এবং উত্তর কোরিয়ার সেনা উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, মস্কো পিছু হটবে না। ইউরোপের জন্য আগামী কয়েক মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি পশ্চিমা বিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে রাশিয়াকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়, তবে ইউরোপের মানচিত্র পুনর্বিন্যাস হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।



















