img

দক্ষিণ কোরিয়া: অদম্য ঘুরে দাঁড়ানোর এক অনুপ্রেরণার ইতিহাস

প্রকাশিত :  ১৩:১৩, ২২ মে ২০২৫

দক্ষিণ কোরিয়া: অদম্য ঘুরে দাঁড়ানোর এক অনুপ্রেরণার ইতিহাস

সাইফুল খান 

বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত-প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলোর তালিকায় আজ দক্ষিণ কোরিয়ার নাম গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। অথচ মাত্র কয়েক দশক আগেও দেশটি ছিল চরম দারিদ্র্যপীড়িত, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বৈশ্বিক সাহায্যনির্ভর একটি এলাকা। সীমিত আয়তন, প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝেও তারা যেভাবে নিজেদের ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ (Miracle on the Han River) এ রূপান্তর করেছে তা ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।

আয়তন ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যঃ দক্ষিণ কোরিয়ার আয়তন মাত্র ১ লাখ ৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের চেয়েও ছোট (বাংলাদেশ: ১ লাখ ৪৭ হাজার)। এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডটি মূলত পর্বত ও পাহাড়ে ভরা। ফলে কৃষির জন্য উপযোগী জমিও সীমিত। জনসংখ্যা প্রায় ৫ কোটির মতো হলেও, তারা ঘনবসতিপূর্ণ শহর ও আধুনিক নগরায়ণের মাধ্যমে জায়গার সর্বোত্তম ব্যবহার করেছে।

প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতাঃ দক্ষিণ কোরিয়ায় খনিজ সম্পদ প্রায় নেই বললেই চলে। নেই পর্যাপ্ত তেল, গ্যাস কিংবা কয়লার মজুদ। কৃষি ও খনিজ সম্পদের অভাবের কারণে তারা শুরু থেকেই শিল্প, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়। এটি ছিল তাদের \"নেতিবাচক বাস্তবতা থেকে ইতিবাচক কৌশল\" গড়ার দৃষ্টান্ত।

দারিদ্রতার ইতিহাসঃ ১৯৫০-৫৩ সালের কোরিয়ান যুদ্ধ দক্ষিণ কোরিয়ার অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়। লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়, অগণিত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। যুদ্ধশেষে দেশটি ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্যনির্ভর ও দরিদ্র, যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৭০ ডলার।

১৯৬০ সালে তারা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি।বিশ্ব ব্যাংক পর্যন্ত তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে “বাঁচার সম্ভাবনাহীন” তালিকায় রেখেছিল!

ফিরে দেখা-ঐতিহ্য, যুদ্ধ ও অগ্রগতির এক ইতিহাসঃ কোরীয় উপদ্বীপের ইতিহাস একদিকে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষাগত ঐক্যের দলিল, অপরদিকে বিভাজন, রক্তপাত এবং রাজনৈতিক প্রতিকূলতার প্রতিফলন। কোরীয় জাতির প্রাচীন শিকড় খ্রিস্টপূর্ব যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। গোজোসন ছিল উপদ্বীপের প্রথম ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র, যার সূত্র ধরে একের পর এক রাজবংশ যেমন-গোগুরিও, বাকজে, শিলা এবং পরবর্তীতে গোরিও এবং চোসন গড়ে ওঠে। এই দীর্ঘ ধারায় কোরীয় জাতি গড়ে তোলে নিজস্ব ভাষা, হাংগুল লিপি, বৌদ্ধ ও কনফুসিয়ান মূল্যবোধে ভিত্তিক সমাজ এবং অভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিচয়।

এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ২০শ শতকের গোড়ায় এক ভয়াবহ বাঁক নেয়। ১৯১০ সালে জাপান কোরিয়া দখল করে কলোনিতে পরিণত করে। প্রায় ৩৫ বছর ধরে কোরীয় জনগণকে শোষণ, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও জাতিগত অবমাননার শিকার হতে হয়। কোরিয়ান ভাষা, পোশাক, নাম পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ কোরিয়ান নারীকে জাপানি সেনাদের জন্য \'কমফোর্ট উইমেন\' হিসেবে জোরপূর্বক ব্যবহার করা হয়। জাপানিরা চীনের সাথেও একই কাজ করেছে। এই দুঃসময়ের মাঝে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের 

পরাজয়ের মাধ্যমে কোরিয়ার স্বাধীনতা আসে। কিন্তু সেই মুক্তি এক নতুন সংকটের জন্ম দেয়। যুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের শীতল যুদ্ধের বাস্তবতায় কোরিয়াকে অস্থায়ীভাবে ৩৮তম অক্ষরেখা ধরে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। উত্তরে সোভিয়েত-সমর্থিত প্রশাসন এবং দক্ষিণে মার্কিন-সমর্থিত প্রশাসনের মাধ্যমে কোরিয়া অনিচ্ছাকৃতভাবে দুই মতাদর্শিক ব্লকে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

১৯৪৮ সালে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। উত্তর অংশে কিম ইল-সুং-এর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়া (DPRK) এবং দক্ষিণে সিনমান রির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দক্ষিণ কোরিয়া (ROK)। এই বিভক্তির পেছনে যে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব কাজ করছিল, তা কয়েক বছরের মধ্যেই রক্তাক্ত সংঘাতে রূপ নেয়।

১৯৫০ সালের ২৫ জুন, উত্তর কোরিয়া হঠাৎ দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়। দ্রুতই তারা সিউলসহ অধিকাংশ দক্ষিণ কোরিয়ান অঞ্চল দখল করে নেয়। এই আগ্রাসন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জাতিসংঘ বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়াকে সহায়তা দেয় এবং যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পাল্টা আক্রমণে দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর দিকে অগ্রসর হলে চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে প্রবেশ করে। ফলাফল হয় ভয়াবহ: তিন বছরের যুদ্ধে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, অগণিত পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, শহর-জনপদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।

১৯৫৩ সালে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে অস্ত্রবিরতি হলেও কোনো শান্তিচুক্তি হয়নি। দুই কোরিয়া আজও আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধরত। সীমান্তে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি অদ্ভুত বাস্তবতা Demilitarized Zone (DMZ), যা বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকভাবে রক্ষিত অঞ্চলগুলোর একটি এবং একইসঙ্গে মানবিক বেদনার প্রতীক।

যেখানে এই যুদ্ধ একটি জাতিকে চিরতরে ভেঙে দিয়েছিল, দক্ষিণ কোরিয়া সেখান থেকে এক বিস্ময়কর ঘুরে দাঁড়ানোর নজির স্থাপন করে। ১৯৬০-৭০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং-হি-এর নেতৃত্বে পরিকল্পিত শিল্পায়ন, রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারিত রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি এবং কৌশলগতভাবে কিছু বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী (Samsung, Hyundai, LG) গড়ে তোলার মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া ‘Asian Miracle’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণা, প্রযুক্তি খাত এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পদক্ষেপ এতটাই সফল হয় যে, মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া এক উন্নয়নশীল কৃষিনির্ভর দেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হয়।

একই সময়ে উত্তর কোরিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হেঁটেছে। একনায়কতন্ত্র, সামরিকীকরণ, তথ্যনিয়ন্ত্রণ এবং পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশটি আজ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র। ১৯৯০-এর দশকে দুর্ভিক্ষে প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, কিন্তু তথাপি দেশের শাসকগোষ্ঠী পরমাণু অস্ত্রে বিনিয়োগ এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে। কিম ইল-সুং থেকে কিম জং-উন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে চলে এসেছে, যা রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে।

আজকের দিনে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্ববাজারে প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী এক শক্তি। K-pop, K-drama, গেমিং ইন্ডাস্ট্রি, হাই-টেক পণ্য ইত্যাদিতে তাদের সাফল্য এক নতুন কূটনৈতিক শক্তিতে রূপ নিয়েছে, যাকে বলা হয় ‘Soft Power’। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া রয়ে গেছে এক রহস্যঘেরা, নিয়ন্ত্রিত ও নিঃসঙ্গ ভূখণ্ড হিসেবে, যার সঙ্গে বাকি বিশ্বের সম্পর্ক শুধুই উদ্বেগ ও কূটনৈতিক উত্তেজনার।

এই ভিন্নমুখী ইতিহাস দেখায়, এক জাতি যদি আলাদা নীতির দ্বারা চালিত হয়।তাদের ভবিষ্যৎ কতটা বিপরীত হতে পারে। কোরিয়ার ইতিহাস আমাদের শেখায়, কেবল জাতিগত ঐক্য নয়, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, নেতৃত্ব, এবং বৈশ্বিক বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা একটি রাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যায়।

ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু: নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

১৯৬১ সালে জেনারেল পার্ক চুং-হি ক্ষমতায় এসে “রপ্তানিনির্ভর শিল্পায়ন” নীতি গ্রহণ করেন।

তিনটি স্তম্ভ ছিল তার পরিকল্পনার মূলভিত্তি:

মানবসম্পদে বিনিয়োগ: শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও উন্নত করে এক নতুন প্রজন্ম তৈরি করা হয় যারা প্রযুক্তি ও শিল্পে দক্ষ।

প্রযুক্তি গ্রহণ ও উদ্ভাবন: বিদেশি প্রযুক্তি আমদানি করে নিজেদের প্রয়োজনে মানিয়ে নেয়া এবং পরে সেগুলোকেই উন্নত করে এক্সপোর্টে ব্যবহার।

রাষ্ট্রীয় কৌশলগত সহায়তা: কিছু নির্দিষ্ট শিল্প খাতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও সাবসিডি দিয়ে বড় বড় চোবল (Chaebol) যেমন Samsung, Hyundai, LG গড়ে তোলা হয়।

“Miracle on the Han River” অর্থনৈতিক বিস্ফোরণঃ ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ মাত্র ৩০ বছরে দক্ষিণ কোরিয়া মাথাপিছু আয় ৭০ ডলার থেকে ১০,০০০ ডলারে উন্নীত করে।শিল্প উৎপাদন, প্রযুক্তি, গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স, শিপ বিল্ডিং প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করে।

আজ দক্ষিণ কোরিয়ার GDP প্রায় ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু আয় প্রায় ৩৫,০০০ ডলার। Samsung, LG, Hyundai এসব শুধু কোম্পানি নয়, বরং তাদের জাতীয় সক্ষমতার প্রতীক।

শিক্ষার বিপ্লবঃ দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত যুবক রয়েছে এই দেশে। তাদের গবেষণায় জিডিপির ৪.৮% বরাদ্দ করা হয়, যা বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ।

সংস্কৃতি ও নরম শক্তির উত্থানঃ ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও “কোরিয়ান ওয়েভ” বা হালিউ (Hallyu) আজ বিশ্বজুড়ে বিস্তার লাভ করেছে—K-pop, K-drama, সিনেমা, বিউটি প্রোডাক্ট সব কিছুতেই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রভাব। এটি তাদের ব্র্যান্ডিং কৌশলের একটি বড় অংশ।

বর্তমান অবস্থান ও আন্তর্জাতিক ভূমিকাঃদক্ষিণ কোরিয়া এখন G20 ভুক্ত একটি শক্তিশালী দেশ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তাদের পাসপোর্ট বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী পাসপোর্টগুলোর একটি।

দক্ষিণ কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য করে

দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চ প্রযুক্তি ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের বিশ্বশক্তি।স্যামসাং, হুন্ডাই, LG-এর মতো কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকট্রনিক্স, গাড়ি, আধুনিক যন্ত্রাংশ রপ্তানি করে।তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য পণ্য তৈরি করে মানে প্রোডাক্ট কাস্টমাইজড, মার্কেট-অরিয়েন্টেড।

মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (KORUS FTA): ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (FTA) হয়। এতে অনেক ট্যারিফ উঠে যায়, ফলে দুই দেশের মধ্যে পণ্য ও সেবা বিনিময় সহজ হয়।

টেকনোলজি ও গবেষণায় বিনিয়োগ: দক্ষিণ কোরিয়া R&D-তে জিডিপির ৪.৫% পর্যন্ত ব্যয় করে (বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে)। ফলে তারা cutting-edge পণ্য তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে সক্ষম হয়

দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে অটোমোবাইল (Hyundai, Kia), সেমিকন্ডাক্টর (Samsung, SK Hynix) টেলিভিশন, স্মার্টফোন,শিপিং ভেসেল ও মেশিনারি। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায়  রপ্তানি করে

বিমান ও সামরিক সরঞ্জাম (Boeing)

কৃষিপণ্য (ভুট্টা, গম, সয়াবিন)

সফটওয়্যার ও সার্ভিস (Microsoft, Amazon)

প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG)

বাংলাদেশ কেন দক্ষিণ কোরিয়ার মত যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাণিজ্যিক অংশীদার হতে পারে না?

১৯৭০-এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ তিন দেশই উন্নয়নশীল, দারিদ্র্যপীড়িত এবং রাজনৈতিকভাবে অস্থির ছিল। কিন্তু আজ দক্ষিণ কোরিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, ভিয়েতনামের প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশ সেখানে মাত্র ১১ বিলিয়ন ডলারে সীমাবদ্ধ। কেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হলে আমাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতা, আন্তর্জাতিক অবস্থান, ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করতে হবে।

উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা ও বহুমুখীকরণের ঘাটতি কেবল গার্মেন্টসে নির্ভরতা:

বাংলাদেশে ৮৪% রপ্তানি আয় আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে (EPB, 2023)। এর বাইরে নতুন পণ্যে প্রবেশ নেই বললেই চলে।

অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া বা ভিয়েতনাম বিভিন্ন খাতে রফতানি বাড়িয়েছে যেমন- ইলেকট্রনিক্স, কৃষিপণ্য, সেমিকন্ডাক্টর, হ্যান্ডসেট, জাহাজ, গাড়ি ইত্যাদি।

ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যের ঘাটতি:গার্মেন্টস পণ্যের অধিকাংশই Low-end (কম দামের)। অথচ ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য যেমন প্রযুক্তিনির্ভর গ্যাজেট, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, বা সফটওয়্যার তৈরিতে আমরা পিছিয়ে।ফলে একদিকে রপ্তানি আয় কম, অন্যদিকে বাজারের পরিধিও সংকুচিত।

রিসার্চ, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি খাতে দুর্বলতা:

R&D-তে শূন্য বিনিয়োগ: বাংলাদেশের গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে জিডিপির মাত্র ০.০৩% ব্যয় হয় (UNESCO, 2022)। যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪.৮%, ইসরায়েলে ৫.৪%, এমনকি ভিয়েতনামেও ০.৫৫%।প্রযুক্তি ছাড়াই হাইটেক পণ্য তৈরি সম্ভব নয়।

আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়া বিচ্ছিন্ন। এখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা শিল্পে ব্যবহার হয় না। আর ইন্ডাস্ট্রি নিজেরাও গবেষণার দিকে আগ্রহী নয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি আর চাঁদাবাজির পথেই হাটে।

উদ্ভাবনে প্রতিবন্ধকতা: স্টার্টআপ পরিবেশ নেই বললেই চলে। তরুণ উদ্ভাবকদের জন্য সরকারি অনুদান, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, আইপি-রক্ষা ব্যবস্থা নেই।

রাষ্ট্রীয় কৌশল, নেতৃত্ব ও নীতিগত ঘাটতি:

টেকসই বাণিজ্য নীতির অভাব: দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সরকার এক্সপোর্টারদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে না। বাংলাদেশে নীতির স্থায়িত্ব নেই, বারবার পরিবর্তন হয়।

উদাহরণ: হঠাৎ কর রপ্তানি বাড়ানো, এলসি খোলা বন্ধ, নগদ সহায়তা বিলম্ব।

ব্যবসায়িক পরিবেশের দুর্বলতা:

“Ease of Doing Business” সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায়ও পিছিয়ে (WB, 2020: Bangladesh ranked 168 out of 190)।

আমলাতন্ত্র, ঘুষ, অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ব্যবসায়ীকে দিশেহারা করে ফেলে।

ব্র্যান্ডিং নেই, ব্র্যান্ড সচেতনতা নেই:

স্যামসাং বা LG-এর মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড তৈরি হয়নি। আমরা বিদেশে বাংলাদেশি পণ্যের পরিচয় দিই না, বরং অন্য দেশের ট্যাগ ব্যবহার করি।

আন্তর্জাতিক কৌশল ও চুক্তির অভাব

FTA বা সামরিক জোটভিত্তিক সুবিধা নেই:

দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মিত্র হওয়ায় বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা পায়।

তারা KORUS FTA করে ৮০% পণ্যের উপর কর তুলে নেয়। বাংলাদেশ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো FTA করেনি, GSP সুবিধাও ২০১৩ সালে হারিয়েছে (Rana Plaza পরবর্তী ঘটনার জন্য)।

কূটনৈতিক দুর্বলতা: যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের জন্য রাজনৈতিক লবিং, অ্যাম্বাসি কার্যক্রম, ট্রেড রোড শো এসব কার্যক্রম দুর্বল।

ব্যবসায়ীদের সফর, মার্কেট স্টাডি, বিদেশি ক্রেতার সাথে সংযোগ এসব উদ্যোগ ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা নেই।

মানবসম্পদ ও দক্ষতা ঘাটতি মৌলিক দক্ষতার অভাব: বাংলাদেশের শ্রমিক কম মজুরিতে কাজ করলেও দক্ষতায় পিছিয়ে। অথচ ভিয়েতনাম দক্ষ শ্রমিকের জোগান দিয়ে টেক্সটাইল থেকে ইলেকট্রনিক অ্যাসেম্বলি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

ইংরেজি ও সফট স্কিল ঘাটতি:

আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা করতে ইংরেজি, যোগাযোগ দক্ষতা, মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি অপরিহার্য এগুলোতেও ঘাটতি রয়েছে।

অবকাঠামো ও লজিস্টিক দুর্বলতা পোর্ট ও কাস্টমস সমস্যা: চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে দেরি, দুর্নীতি, অনিয়ম এইসব কারণে শিপমেন্ট সময়মতো হয় না। দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনাম আধুনিক বন্দর, দ্রুত লজিস্টিক সাপ্লাই তৈরি করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেছে।

বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সমস্যা: শিল্পকারখানায় বারবার লোডশেডিং, কম গতির ইন্টারনেট। এইগুলো নতুন প্রযুক্তি-ভিত্তিক পণ্য তৈরিতে বাধা।

সামাজিক মানসিকতা ও উদ্যোগের ঘাটতি

ঝুঁকি নিতে ভয়: উদ্যোক্তারা নতুন খাতে ঢুকতে চায় না। সরকারেরও সাহস নেই হাইটেক খাতে বড় প্রণোদনা দিতে।

অভ্যন্তরীণ বাজারেই সীমাবদ্ধ দৃষ্টি: আমাদের অনেক কোম্পানি শুধু দেশীয় বাজারে সফল হতে চায়, আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য প্রস্তুতি নেয় না। 

প্রস্তাবনা: কী করলে বাংলাদেশও পারবে-

রপ্তানি বহুমুখীকরণ: হাইটেক, ওষুধ, অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট, সফটওয়্যার এসব খাতে পুঁজি ও নীতি দিতে হবে। বিশ্বমানের ব্র্যান্ড তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার ও বেসরকারি যৌথভাবে ব্র্যান্ডিং ফান্ড তৈরি করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ বৃহৎ অর্থনীতির সাথে FTA ও GSP পুনরুদ্ধার: এর জন্য কূটনৈতিক চাপ ও প্রফেশনাল লবিয়িং দরকার। R&D-তে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো। একাডেমিয়া-ইন্ডাস্ট্রি সংযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

‘Ease of Doing Business’ সংস্কার করতে হবে। এক জানালায় ব্যবসা অনুমোদন, কর ছাড়, দ্রুত LC খোলা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে।

টেকনোলোজি ইনোভেশন হাব তৈরি করতে হবে। দক্ষিন কোরিয়া-ভিয়েতনামের মতো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করে প্রযুক্তি নির্ভর পণ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে।

পরিশেষঃ দক্ষিণ কোরিয়া তাদের উৎপাদন দক্ষতা, প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় কৌশল দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী বাজারে জায়গা করে নিয়েছে।

বাংলাদেশের উচিত দক্ষিন কোরিয়া, ভিয়েতনামের উদাহরনকে সামনে রেখে কাজ শুরু করা। এজন্য বানিজ্য বহুমুখীকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তি বিনিয়োগ এবং মার্কেট অরিয়েন্টেড প্রোডাক্ট তৈরি করা। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় অর্থনীতির সাথে কৌশলগত বাণিজ্য সম্পর্ক গড়া জরুরি। 



সাইফুল খান: লেখক; ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর

img

উন্মুক্ত বিবেক, মুক্ত ফিলিস্তিন!!

প্রকাশিত :  ০৭:৩৬, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:৫২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

নুজহাত নূর সাদিয়া

আহা ! বুকের পাঁজর ভাঙা গগনবিদারী আর্তনাদ , নাহ-কোন নিরব জঠর যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাওয়া গর্ভবতী মায়ের নবজাতক জন্ম দেওয়ার অবিস্মরণীয় ক্ষণটি উদযাপনের আনন্দচ্ছোস নয়, এ যে সহস্র দিনের গ্লানি শেষে এক নিকষ কালো আঁধার পেরিয়ে মাতৃভূমির বুকে নির্ভীক পা রাখা । আবার সেই চিরপরিচিত সবুজ দুর্বা ঘাসে ছুঁটে বেড়ানো , বাড়ন্ত স্কোয়াশের পূর্ণ ঝুঁড়ি, মাংসের রসাল স্যুপ, হাতে বানানো গমের রুটি সহযোগে উদর পূর্তির সেই পারিবারিক সুখস্মৃতি , মায়ায় জড়ানো বছর পার করে দেওয়া সংগ্রামী পরিবারগুলো ফিরে কি পাবে তাদের সেই প্রাণোচ্ছল ফিলিস্তিন । বহু চর্চিত এই প্রশ্নটির উত্তর অজানা আশংকা আর অনিশ্চয়তার অদৃশ্য গেরোতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকলে ও বিপরীত শিবিরে ও বহু দিনের ঘরবন্দী প্রিয়মুখগুলো স্বজনদের বাহুডোরে ফেরার অপেক্ষায় । আগ্রাসী ইসরায়েলের ধূলো উড়ানো পথ ও যে আজ শান্তিকামী মানুষের স্বতস্ফূর্ত হাসিতে ভরপুর। 

আনুষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী, মোট হতাহতের সংখ্যা  ৬৬,০০০ হাজার ছাঁড়িয়ে গেছে, জীবন-ভর পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে ২,৫০,০০০ জন হতভাগ্যকে , বেঁচে যাওয়া অসংখ্য দুরন্ত শৈশব বাকিটা জীবন সম্ভবত এক দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবে, আকাশ ছোঁয়া দালান , সুসজ্জিত স্থাপনা আর পুরাকীর্তির শহর ফিলিস্তিন আজ এক মৃতপ্রায় ভুতুড়ে নগরী ।

এই যে  ক্ষতি , তা সন্দেহাতীতভাবেই অপূরণীয় ক্ষতি । নেতানিয়াহু নামের এক বিকট দানবের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর অপরিণামদর্শী যুদ্ধ কৌশলের খেস ারত দিতে হল ফোরাত নদীর তীরবর্তী নিরীহ প্রাণগুলোর। বিশ্ব মানচিত্র হতে ফিলিস্তিন নামক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটি ( গাজা প্রায়২১ লক্ষ লোকের আবাস) মাত্র মাসখানিক আগে ও নিরবে মুছে যাচ্ছিল ধনী রাষ্ট্রের তাবেদার মুসলিম বিশ্বের অলস শাসনকর্তাদের নির্লিপ্ত আচরণের কারণে । মুসলমান ভাই -ভাই, জুলুমবাজের নিস্তার নাই, বিপন্ন মানবতা বহুল চর্চিত প্রবাদগুলো নিতান্তই খাঁচায় বন্দি তোতাপাখির মুখস্থ বুলির মত আউড়ে চলছিল বিশ্বরাজনীতির মোড়লরা । তবে কি, আমজনতার পরম আরাধ্য পার্থিব জীবনের ও সমাপ্তি আছে, আর সেই সমাপ্তি বরাবরই ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়েছে স্রষ্টার একান্ত ইচ্ছেয়, অসহায়ের পূর্ণ সমর্থনে আর দিনশেষে সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ে ।

গৃহকোণের শান্তি গৃহকর্ত্রীর পরম প্রিয়, আর সেই শান্তির সুশীতল পরশ এ ভূগোলকের পরতে পরতে ছঁড়িয়ে দিতে যে উদ্যোগী মানুষগুলো অনন্য সাধারণ কাজগুলোকে বাস্তবতার আলো দেখান সে মানুষগুলোই কর্মকুশলতায় অর্জন করে নেন সর্ব্বোচ সম্মান -নোবেল । এ নোবেল প্রাপ্তি, কার ও দারিদ্র্য বিমোচনে, চলতি ‘২৫ সালে বিতর্কিত মারিয়া কোরিয়া মাচানো -যার রাষ্ট্রীয় নীতি বহু অসহায় মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে, প্রাক্তন  যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক সহ শান্তিতে নোবেল পাওয়া আলোচিত মানুষগুলো পুরষ্কারের কোঠা না মানদন্ড না তাদের কাজের বিষয় এ সূক্ষèাতিসূক্ষè বিষয়গুলো

রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, আর স্বেচ্ছাচারী কর্তা যখন নিজ খেয়াল-খুশি মত আইন -কানুন তৈরি করে অসহায়দের উপর তা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন তখন তা ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা জায়ানবাদীদের  আধিপত্য আর কতৃর্ত্ববাদের নির্মমতার করুণ পুনরাবৃত্তি বই আর কিছুই নয় । আর ও নির্মম কৌতুক, একদা জায়ানবধের রাজ্য বলে খ্যাত , হিটলারের জার্মান, মাঁখোর  ফ্রান্স , কূটনৈতিক ব্রিটেন সহ দু‘মুখো আরব বিশ্ব সকলে এ নির্মম রসিকতায় সামিল ! দুনিয়া যে ক্ষমতা আর অর্থের পূজারী - পড়ন্ত বেলার প্রাজ্ঞ প্রবীণদের গভীর হতাশার সুরে তা সুস্পষ্ট ।

রুপকথার গল্পের চেয়ে ও বাস্তব জীবনের গল্প অনেকসময় অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠে , হয়ে উঠে প্রকৃত রুপক নতুবা তার চেয়ে ও শক্তিশালী আখ্যান । বিশ টি বছর ধরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর নানা প্রতিকুলতায় অবরুদ্ধ হামাস , ঠিক জিতে গেল সাহস আর দেশের প্রতি ভালবাসাকে হৃদয়ে লালন করে।

আর, সেই ছোট্ট গেরিলা সদস্যের দলটি আজ কত বড়! মানচিত্র ছাঁড়িয়ে , সীমানা ছাঁড়িয়ে নব প্রজন্মের অকুতোভয় হামাসরা আজ দুয়ারে দাঁড়ানো দৃঢ় দ্বাররক্ষী । তারাই পারে ,তথাকথিত অজেয় পশ্চিমা শক্তিকে শান্তিচুক্তি নামক সে নাটকীয় ঘটনার অন্যতম যোগানদার করতে। মার্কিন সরকার প্রধান উপযাচক মাত্র-পরিস্থিতি বুঝেই হয়তবা বন্ধুর পথে হাঁটতে চাইছেন, ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বর্মটি যে ভিষণ শক্তপোক্ত ও একরোখা ।

তবে, মধ্যপ্রাচ্যে ছঁড়ি ঘুরানোর দীর্ঘদিনের শক্তলাঠিটি কে যে এবার বাঁকাতেই হয় ।  সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙবে না, হায় বেনিয়ামিন  কি অসম্মানের এক পরাজয় ! কি অপেক্ষা করছে দুর্নীতি মামলায় জর্জরিত বুড়ো নেকড়েটির কপালে -বিধ্বস্ত চেহারায় কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো দীর্ঘতর হচ্ছে বৈকি।

প্রতিরোধ, যুদ্ধের নামে আগ্রাসন আর বসতি স্থানান্তরের নামে বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক শরণার্থী , আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় হয়তবা এখন পর্যন্ত বিজয় উদযাপনে ব্যস্ত । তবে নারীর প্রতি সম্মান রক্ষার্থে ট্রাম্প তার প্রাক্তন রাজনৈতিক প্রতিদন্বী বারাকের উপর সম্ভবত সচেতনভাবেই তার রাষ্ট্র পরিচালনার মেয়াদকালে বিতর্কিত সন্ত্রাসী বনাম ইসলামিক সেনাবাহিনী মতানৈক্যের বিষয়টির উপর  ইঙ্গিত দিয়েছেন । আর , ব্রিটিশ সংসদে চিত্রিত ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে পুরনো বন্ধু ব্লেয়ারের পদাংক অনুসরিত কিনা, তাই আপনমনে যাচাই-বাছাই করে চলেছেন। 

পরিস্থিতির পরিবর্তিত মোড় , কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন লিখিত শান্তি  চুক্তির যে ভিন্ন ভিন্ন ২০টি শর্ত শোভা পাচ্ছে  তার সুচারু বাস্তবায়ন খোদ ট্রাম্পের পক্ষেই যথেষ্ট দুরুহ । পেন্ডুলামের কাঁটা চলমান, হঠকারী ছোটভাই একবার নয় বেশ ক‘বার বড় ভাইয়ের অবাধ্য হয়েছেন , আস্ত উড়োজাহাজ উপহার আর বন্ধুপ্রতীম কাতারের উপর অর্তকিত আক্রমণ । রক্তে যার খুনে নেশা সে পাগলা ঘোড়া কি আদৌ থামবে ? বিলুপ্ত হিজবুল্লা, হুতির হারিয়ে যাওয়া হামাসের নেতৃত্বের শক্তি ক্ষয় , সিরিয়ায় ভাঙ্গন, ইরানের সফল প্রতিরক্ষার ব্যুহ ভেদ- আপাত , দ্বিধাগ্রস্থ ইসরাইল প্রধান সফলতার মাপকাঠিতে আত্নতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন হয়তবা ।  তবে,গাজামুখি সারি সারি ত্রাণবাহী গাড়ির বহরের দী¦প্ত যাত্রা কি তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় নি, নিশ্চিতভাবেই উত্তরটি হ্যা ।

কাঁকচক্ষু দৃষ্টিতে , দৃঢ়তা আর ন্যায়ের বিজয় তবে, অসম এ যুদ্ধে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের চড়া মূল্য দিতে হল  হামাসকে। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়  হামাস , নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক , প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। এই যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ সেই জীবননাশের মূল্য দিতে হল চরমভাবে-গত দু‘বছরে ৬৭,০০০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত । শক্তিশালী শত্রুর সাথে টক্কর লাগানো  কি এত সোজা!  লোকবল আর সামরিক শক্তিতে তুলনামূলক ভাবে পিঁছিয়ে, তবে কিনা নীতি আর ঈমানের শক্তিতে বরাবরি বলীয়ান হামাসিয়ানরা । তাই , এ ক্রান্তিকালে ও ধাপে ধাপে অধিকাংশ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল তারা, সর্বশেষ গাজায় ৪৮ জন বন্দী ছিলেন , বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবান ২০ জন। আর্ন্তজাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে দু‘ধাপে জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় হামাস গত ১৩ই অক্টোবর । মৃতদের মাঝে চার জনের মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা ও জানিয়েছে তারা।অপরদিকে, প্রতিপক্ষ ইসরাইলের আচরণ রুঢ়তার সীমা আকাশ  ছুঁয়েছে  বহু আগেই-কারাগারে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা এবং নিপীড়ন করা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যৌন হয়রানির খবর ও পাওয়া গেছে । আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আল-রিমায়ি বলেন- এ দু‘টি বছরে তার ওজন কমেছে ৫০ কেজি ! হাড় সর্বস্ব শরীর জড়িয়ে কন্যার ব্যাকুল আর্তি, বাবা আমি ব্যাথা পাই ।

এখন আবার ট্রাম্পের নতুন চমক, ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপনাস্ত্র উপহার দিবেন এই পাগলাটে রাষ্ট্রপতি রাশান যুদ্ধ থামাতে ।  শুরু হওয়া আফগান -পাকিস্তান সংঘাতে ও তালেবান দের ভূমিকা নিয়ে এক নতুন চেহারার ব্যবসায়ীকে দেখা গেছে -জামাতা কুশনারের ব্যবসায়িক বুদ্ধির জুড়ি নেই রাজনৈতিক বুদ্ধিতে ও যে  শ্বশুরকে ভবিষ্যতে টেক্কা দিতে সমর্থ  হবেন  তা তার সাম্প্রতিক স্রোত বুঝে চলার ই পরিপক্ক রুপ ।

আজকের এই পার্থিব পৃথিবীতে  স্রোতস্বিনী টেমস নদী ব্যবহারের মাসকাবারি বিল পরিশোধের সময় ও যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি মগজে নিত্য গেঁথে থাকে -প্রতিটি পানিবিন্দু পরিশোধে পাওনা প্রাপ্য ! অর্থাৎ, জীবনের অপর নাম পানি ও বাতাস সেবনে ও মূল্য চুকাতে হয়, তা যদি হয় কেনসিংটন নামক অভিজাত এলাকার মনোরম ব্যালকনির মুক্ত হাওয়া । বিনামূল্যে    সেবা, সে তো অতীতের গাল গল্প । অথচ, নিঠুর ইসরাইলী বাহিনী    গাজায় ৩০০০ জলপাই গাছ  কেটে , অগণিত বন্য ও পোষা  প্রাণী মেরে আক্ষরিক অর্থেই প্রকৃতিকে বিপন্ন করে  তুলতে চাইছিল  । সেই প্রকৃতিই কিনা আপন মহিমায়  নতুন বোনা জলপাই গাছের পাশ দিয়ে ছুটন্ত শিশুদের  সাদরে বরণ করছে যাদের খাঁচা ভর্তি প্রিয় পোষা  পাখিটির  গুঞ্জন।   

ফিলিস্তিন বাসীদের প্রিয় ম্যান্ডেলা ‘ আল ফাত্তাহ ‘ এখন ও জায়ানবাদীদের জিম্মায় ,  ইসরাইলী সেনাবাহিনী তাকে যমের মত ভয় পায় -যার মুক্তির আলো দেখা এখন ও সংশয়ে ভরা । সন্দেহাতীতভাবেই, তিনিই প্যালেস্টাইনি জনগণের অবিস্বরণীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী আন্দোলনের দিকপাল ।

আজকের দিনের ফ্রি পত্রিকাগুলোর অন্যতম স্লোগান-মুক্ত খবর, মুক্ত চিন্তা । আর বিশ্বজুঁড়ে এই প্রবল বিজয় উদযাপনে মানবতাবাদীদের একটাই আশা মুক্ত হোক মানবতা , জয় হোক শুভ বুদ্ধির।



নুজহাত নূর সাদিয়া,
এলবিপিসি, লন্ডন ১৪ই অক্টোবর‘ ২৫ সাল ।

মতামত এর আরও খবর