
নীতিহীন রাজনীতির করুণ পরিণতি: বাংলাদেশের নেতৃত্ব সংকট ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়!

✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ
এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল ত্যাগ, সাহস ও আদর্শের প্রতীক। এই মাটিতে জন্মেছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতো নেতৃত্ব, যিনি কখনো বিলাসিতা কিংবা ক্ষমতার মোহে নিজেকে হারাননি। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে আসা এই রাষ্ট্রে এখন রাজনীতি যেন পরিণত হয়েছে আত্মস্বার্থ, লোভ, প্রতারণা ও দুর্নীতির অপর নাম হিসেবে।
দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের চোখের সামনে ঘটছে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা—জনপ্রতিনিধিরা জনগণের দুঃখের ভাগীদার হওয়ার পরিবর্তে তাদের শোষক হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। রাজনীতি আজ যেন নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হয়ে এক ধরনের ‘স্বার্থনীতি’-তে পরিণত হয়েছে।
রাজনীতি নয়, যেন ক্ষমতার খেলা!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে নৈতিকতার ভয়াবহ অবক্ষয়। যে রাজনীতি একসময় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করত, আজ সেই রাজনীতি জাতিকে বিভক্ত করছে দলীয় স্বার্থ ও ব্যক্তি স্বার্থের কারণে।
নির্বাচনের আগে নেতাদের চেনা যায় না—সবাই তখন ‘জনগণের কথা’ বলেন। কিন্তু একবার ক্ষমতায় গেলে তাদের সুর পাল্টে যায়। চোখে পড়ে না সাধারণ মানুষের মুখ, কানে আসে না তাদের আর্তনাদ।
একজন শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেন, “আমার বাবার সময়ের রাজনীতি ছিল মূল্যবোধের জায়গা। এখনকার রাজনীতি দেখে আমি আমার ছেলেকে রাজনীতিতে আসতে নিষেধ করেছি।”
কথায় এক, কিন্তু কাজে আরেক
রাজনীতিকদের মুখে এখনও শোনা যায়—“জনগণের জন্য কাজ করছি।” কিন্তু মাঠে-ময়দানে তার প্রতিফলন কোথায়? বরং দেখা যাচ্ছে—তাদের প্রাসাদতুল্য বাসভবন, বিলাসবহুল গাড়ি, বিদেশে সন্তানদের শিক্ষা; আর এসবের পেছনের অর্থ কোথা থেকে আসে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্নের শেষ নেই।
প্রতিবার দুর্নীতির তদন্তে উঠে আসে কোনো না কোনো প্রভাবশালী নেতার নাম। কিন্তু বিচারের মুখ দেখে না অধিকাংশই। এসব দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে গড়ে উঠছে গভীর আস্থার সংকট।
তরুণদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া—এক ভয়ংকর সংকেত
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রাজিয়া সুলতানা বলেন, “ছোটবেলায় রাজনীতি মানে ভেবেছি মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এখন দেখি, রাজনীতি মানে টাকা বানানোর হাইওয়ে। এ থেকে দূরে থাকাই ভালো।”
এই ভাবনা কেবল একজন ছাত্রীর নয়, বরং লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীর। তারা এখন রাজনীতিকে দেখছে ভয় ও অনাস্থার জায়গা হিসেবে, যেখানে আদর্শ নয়, বরং সুযোগ সন্ধানীদের দাপট।
এই মানসিকতা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে সৎ, মেধাবী ও জনসম্পৃক্ত মানুষের অভাব হবে নিঃসন্দেহে।
দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠেছে
বর্তমানে প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলে দেখা যায় একটি সাধারণ দৃশ্য—ব্যক্তি পূজা। নীতি, আদর্শ বা কর্মসূচির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে একজন ‘নেতা’র কথা। তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আর যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, তবে তার পরিণতি—বহিষ্কার, অপমান কিংবা গুম।
গণতন্ত্র মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মতভিন্নতা সহ্য করা। কিন্তু বাংলাদেশে এখন তা প্রায় বিলুপ্ত। দলীয় নেতৃত্ব মানেই যেন একজন জবাবদিহিহীন সর্বেসর্বা।
রাজনীতি যেন উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পেশা!
বাবা রাজনীতিক, তাই ছেলে সংসদ সদস্য। স্ত্রী কাউন্সিলর, ভাই মেয়র, ভাগ্নে পৌর চেয়ারম্যান—এ যেন এক বংশানুক্রমিক ব্যবসা। অথচ একসময় রাজনীতিতে আসার জন্য ছিল ত্যাগের ইতিহাস, আন্দোলনের ধারাবাহিকতা, আর জনগণের পাশে দাঁড়ানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা।
এখন অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতি মানে নিজের পরিবারের ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ানোর যন্ত্র। জনগণের কথা শুধু শোভা পায় পোস্টারে, ব্যানারে, বা বক্তৃতার মঞ্চে—বাস্তবে তার খোঁজ নেই।
দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিচারহীনতা
বহু রাজনীতিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও, তেমন কোনো বিচার হয় না। হয়তো কিছুদিন মিডিয়ায় আলোচনায় থাকে, তারপর সব চাপা পড়ে যায়। কারণ বিচার ব্যবস্থাও আজ অনেকাংশে রাজনৈতিক ক্ষমতার ছায়ায় নিয়ন্ত্রিত।
এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করছে এক ভয়ংকর দৃষ্টান্ত—যেখানে একজন সাধারণ মানুষ আর বিশ্বাস করতে পারছে না যে সৎ থাকা বা সত্য বলা কোনো কাজে আসবে।
গণতন্ত্রের মুখোশে দমননীতি!
নেতৃত্বে যারা রয়েছেন, তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় না। সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী কণ্ঠরোধ, নির্বাচনে কারচুপি, প্রশাসনকে দলীয়করণ—সব মিলে এক আতঙ্কের পরিবেশ।
প্রশ্ন হচ্ছে—রাজনীতি কি কেবল দল টিকিয়ে রাখার কৌশল? নাকি দেশের মানুষকে ভালো রাখার ব্রত?
কোথায় মানবিকতা? কোথায় দায়িত্ববোধ?
একজন গার্মেন্টস শ্রমিক মারা যান রাস্তায় চিকিৎসার অভাবে—কিন্তু তার পাশে কোনো রাজনীতিক ছিলেন না। অথচ তিনিই সেই মানুষ, যিনি ভোট দিয়েছেন, কর দিয়েছেন।
অন্যদিকে, কোনো দলীয় নেতা অসুস্থ হলেই তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে বিদেশে পাঠানো হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য। এই ব্যবধানই রাজনীতির নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
পরিবর্তন আসবেই—প্রয়োজন সাহসী ও সৎ নেতৃত্ব
যদিও পরিস্থিতি কঠিন, তবে এখনও দেশে অনেক তরুণ নেতা আছেন, যারা নিরবে-নিভৃতে মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের খুঁজে বের করে সামনে আনতে হবে। দরকার একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে আদর্শবান নেতৃত্ব গড়ে উঠবে।
রাজনীতি হোক মানুষের জন্য। দুর্বৃত্তদের জন্য নয়। সৎ মানুষের জয় হোক, অপরাজনীতির পরাজয় হোক।
সময় এসেছে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর
রাজনীতিকদের সামনে এখন দুটি পথ—এক, নিজেদের শুদ্ধ করে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা; দুই, সেই পুরোনো পথে চলতে থাকা, যার শেষ গন্তব্য ধ্বংস।
রাষ্ট্র শুধু অবকাঠামো নয়, এটি একটি আদর্শ, একটি চেতনা। সেই চেতনার ভেতরেই থাকে জাতির ভবিষ্যৎ, নেতৃত্বের বিবেক।
রাজনীতি যদি সত্যিই হয় মানুষের সেবা, তবে তা প্রমাণ করতে হবে কাজের মাধ্যমে। না হলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে, আর ইতিহাস—যেটি বড় নির্মম বিচারক—তখন আর করুণা করবে না।