img

শ্রদ্ধাঞ্জলি: কুঁড়েঘরের মোজাফফর: আপসহীন রাজনীতির প্রতীক

প্রকাশিত :  ০৭:০৪, ২৫ আগষ্ট ২০২৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি: কুঁড়েঘরের মোজাফফর: আপসহীন রাজনীতির প্রতীক

সংগ্রাম দত্ত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে যাদের উচ্চারণ মানেই সততা, আদর্শ আর সংগ্রামের কথা মনে পড়ে। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ঠিক তেমনই একজন মানুষ। তিনি ছিলেন ন্যাপের সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী সরকারের উপদেষ্টা, আবার সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন ‘কুঁড়েঘরের মোজাফফর’ নামেই। ক্ষমতার মোহ বা পদ-পদবির চকচকে দুনিয়া তার মন ছুঁতে পারেনি। সাদামাটা জীবন, আপসহীন নীতি আর অকৃত্রিম নেতৃত্বই তাকে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন দিয়েছে।

ছাত্র থেকে শিক্ষক, শিক্ষক থেকে রাজনীতিক

১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি প্রথমে বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। পরে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনই তার জীবনের বাঁকবদল ঘটায়। আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয়ে তিনি বুঝেছিলেন—এই জাতির মুক্তির পথ রাজনীতির মধ্য দিয়েই। তাই ১৯৫৪ সালে অধ্যাপনার নিরাপদ চাকরি ছেড়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাজনীতিকে বেছে নেন।

রাজনৈতিক উত্থান ও সংগ্রাম

মোজাফফর আহমদের রাজনৈতিক যাত্রা ছিল চড়াই-উতরাই ভরা। ১৯৫৭ সালে ন্যাপের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছিলেন, যা পরবর্তীতে বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের ভিত্তি হয়ে ওঠে। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে, এমনকি ধরিয়ে দিলে পুরস্কার ঘোষণা দেয়। তিনি তখন আত্মগোপনে থেকে আন্দোলন সংগঠিত করেন দীর্ঘ আট বছর।

১৯৬৬ সালে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ বিভক্ত হলে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তিনি নেতৃত্ব দেন, কারাবরণও করেন।

মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ভূমিকা

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল স্মরণীয়। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে গেরিলা বাহিনী সংগঠনে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশিত নতুন বাংলা পত্রিকাও তার নেতৃত্বে বের হয়, যা পরে ন্যাপের মুখপত্রে পরিণত হয়।

শ্রীমঙ্গলে সরল উপস্থিতি, অমলিন স্মৃতি

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন অতি সাধারণ জীবনযাপনের মানুষ। তাঁর রাজনীতি যেমন ছিল নীতিনিষ্ঠ, তেমনি জীবনযাত্রাও ছিল একেবারে সাধারণ।

একটি স্মৃতি আজও মানুষের মনে জ্বলজ্বল করে—জিয়াউর রহমানের আমলে শ্রীমঙ্গলে এক সফরে তিনি পায়ে হেঁটে প্রবেশ করেছিলেন শহরে। পূর্বাশা আবাসিক এলাকার তৎকালীন পৌর কমিশনার মোঃ আহাদ মিয়া সাহেবের বাসার সামনে গাড়ি রেখে লুঙ্গি ও লম্বা শার্ট পরে, ভোরবেলা হেঁটে যাচ্ছিলেন ন্যাপ নেতা রাসেন্দ্র দত্ত চৌধুরীর বাসার দিকে। তাঁর পিছু পিছু অসংখ্য মানুষ। তখনকার দৃশ্য আজও চোখে ভাসে—নেতার এই সাধারণ সাজসজ্জা, মানুষের প্রতি টান, আর রাজনীতিকে জনতার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার অনন্য ধরণ।

১৯৮৩ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আগমুহূর্তে আবারও শ্রীমঙ্গলে আসেন তিনি। এলাকার মানুষ রাসেন্দ্র দত্ত চৌধুরীকে নির্বাচন করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন—“টাকা-পয়সা নেই, কিভাবে নির্বাচন করব?” তখনই প্রফেসর মোজাফফর সোজাসাপ্টা বলেছিলেন—

 “এই টাকার খেলায় দাঁড়িয়ে তুমি কি করবে? নির্বাচন তো এখন অন্য রকমের ব্যাপার, শুধু টাকার খেলা।”

তখন এলাকার অনেকেই তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, রাসেন্দ্র বাবু জিতবেনই। প্রফেসর মোজাফফর হাসিমুখে উত্তর দিয়েছিলেন—

 “ঠিক আছে, নির্বাচনের ফলাফলের পর দেখা হবে। তবে বউয়ের সোনা-গয়না যেন বিক্রি করতে না হয়!”

নির্বাচনে জয়ের পর ঢাকায় পার্টির মিটিংয়ে তিনি সবার সামনে সেই ঘটনাটি হেসে হেসে স্মরণ করেছিলেন। এভাবেই তিনি রাজনীতির কঠিন বাস্তবতাকে রসিকতার আড়ালে তুলে ধরতেন।

ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়

৯০-এর পর অনেকবার দেখা হতো কাকরাইলের তার ৫০ নম্বর বাসায় কিংবা কুমিল্লার বাড়িতে। সেখানে বসেই তিনি বলতেন—

“রাজনীতি তো এখন নেই। কিন্তু গরিব যতদিন আছে, গরিবের রাজনীতি থাকবেই। চুপচাপ বসে থাকো। সময় যখন হবে, তখন হাল ধরতে পারবে।”

কথা বলতেন ভীষণ সুন্দর করে, পরিষ্কার যুক্তি দিয়ে। মাঝেমধ্যেই হেসে জিজ্ঞেস করতেন—“কি বলছি, বুঝতে পারছ তো?”

এই সরল অথচ দৃঢ় চরিত্রই তাঁকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল।

পদকের প্রতি অনীহা

স্বাধীনতার পরও অধ্যাপক মোজাফফর গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পথে ছিলেন অবিচল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি আবারও কারারুদ্ধ হন। তাঁর জীবনের এক বড় বৈশিষ্ট্য—নীতির প্রশ্নে আপসহীনতা। এরই প্রকাশ ঘটে ২০১৫ সালে, যখন সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পদক দিতে চাইলেও তিনি তা\' গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।

শিক্ষা ও সামাজিক উদ্যোগ

রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষার প্রসারেও তিনি ছিলেন নিবেদিত। নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে প্রতিষ্ঠা করেন সামাজিক বিজ্ঞান পরিষদ, যেখানে তিনি নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

শেষ প্রস্থান

২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে তাঁর রেখে যাওয়া জীবনদর্শন আজও আলোকিত করে যারা ক্ষমতার প্রলোভন নয়, বরং মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করতে চায়।

কুঁড়েঘরের মোজাফফর হয়তো আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর নাম উচ্চারিত হলেই মনে পড়ে যায়—বাংলাদেশের রাজনীতিতে সততা ও আদর্শের এক আলোকবর্তিকা ছিলেন তিনি।


মতামত এর আরও খবর

img

উন্মুক্ত বিবেক, মুক্ত ফিলিস্তিন!!

প্রকাশিত :  ০৭:৩৬, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:৫২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

নুজহাত নূর সাদিয়া

আহা ! বুকের পাঁজর ভাঙা গগনবিদারী আর্তনাদ , নাহ-কোন নিরব জঠর যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাওয়া গর্ভবতী মায়ের নবজাতক জন্ম দেওয়ার অবিস্মরণীয় ক্ষণটি উদযাপনের আনন্দচ্ছোস নয়, এ যে সহস্র দিনের গ্লানি শেষে এক নিকষ কালো আঁধার পেরিয়ে মাতৃভূমির বুকে নির্ভীক পা রাখা । আবার সেই চিরপরিচিত সবুজ দুর্বা ঘাসে ছুঁটে বেড়ানো , বাড়ন্ত স্কোয়াশের পূর্ণ ঝুঁড়ি, মাংসের রসাল স্যুপ, হাতে বানানো গমের রুটি সহযোগে উদর পূর্তির সেই পারিবারিক সুখস্মৃতি , মায়ায় জড়ানো বছর পার করে দেওয়া সংগ্রামী পরিবারগুলো ফিরে কি পাবে তাদের সেই প্রাণোচ্ছল ফিলিস্তিন । বহু চর্চিত এই প্রশ্নটির উত্তর অজানা আশংকা আর অনিশ্চয়তার অদৃশ্য গেরোতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকলে ও বিপরীত শিবিরে ও বহু দিনের ঘরবন্দী প্রিয়মুখগুলো স্বজনদের বাহুডোরে ফেরার অপেক্ষায় । আগ্রাসী ইসরায়েলের ধূলো উড়ানো পথ ও যে আজ শান্তিকামী মানুষের স্বতস্ফূর্ত হাসিতে ভরপুর। 

আনুষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী, মোট হতাহতের সংখ্যা  ৬৬,০০০ হাজার ছাঁড়িয়ে গেছে, জীবন-ভর পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে ২,৫০,০০০ জন হতভাগ্যকে , বেঁচে যাওয়া অসংখ্য দুরন্ত শৈশব বাকিটা জীবন সম্ভবত এক দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবে, আকাশ ছোঁয়া দালান , সুসজ্জিত স্থাপনা আর পুরাকীর্তির শহর ফিলিস্তিন আজ এক মৃতপ্রায় ভুতুড়ে নগরী ।

এই যে  ক্ষতি , তা সন্দেহাতীতভাবেই অপূরণীয় ক্ষতি । নেতানিয়াহু নামের এক বিকট দানবের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর অপরিণামদর্শী যুদ্ধ কৌশলের খেস ারত দিতে হল ফোরাত নদীর তীরবর্তী নিরীহ প্রাণগুলোর। বিশ্ব মানচিত্র হতে ফিলিস্তিন নামক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটি ( গাজা প্রায়২১ লক্ষ লোকের আবাস) মাত্র মাসখানিক আগে ও নিরবে মুছে যাচ্ছিল ধনী রাষ্ট্রের তাবেদার মুসলিম বিশ্বের অলস শাসনকর্তাদের নির্লিপ্ত আচরণের কারণে । মুসলমান ভাই -ভাই, জুলুমবাজের নিস্তার নাই, বিপন্ন মানবতা বহুল চর্চিত প্রবাদগুলো নিতান্তই খাঁচায় বন্দি তোতাপাখির মুখস্থ বুলির মত আউড়ে চলছিল বিশ্বরাজনীতির মোড়লরা । তবে কি, আমজনতার পরম আরাধ্য পার্থিব জীবনের ও সমাপ্তি আছে, আর সেই সমাপ্তি বরাবরই ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়েছে স্রষ্টার একান্ত ইচ্ছেয়, অসহায়ের পূর্ণ সমর্থনে আর দিনশেষে সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ে ।

গৃহকোণের শান্তি গৃহকর্ত্রীর পরম প্রিয়, আর সেই শান্তির সুশীতল পরশ এ ভূগোলকের পরতে পরতে ছঁড়িয়ে দিতে যে উদ্যোগী মানুষগুলো অনন্য সাধারণ কাজগুলোকে বাস্তবতার আলো দেখান সে মানুষগুলোই কর্মকুশলতায় অর্জন করে নেন সর্ব্বোচ সম্মান -নোবেল । এ নোবেল প্রাপ্তি, কার ও দারিদ্র্য বিমোচনে, চলতি ‘২৫ সালে বিতর্কিত মারিয়া কোরিয়া মাচানো -যার রাষ্ট্রীয় নীতি বহু অসহায় মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে, প্রাক্তন  যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক সহ শান্তিতে নোবেল পাওয়া আলোচিত মানুষগুলো পুরষ্কারের কোঠা না মানদন্ড না তাদের কাজের বিষয় এ সূক্ষèাতিসূক্ষè বিষয়গুলো

রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, আর স্বেচ্ছাচারী কর্তা যখন নিজ খেয়াল-খুশি মত আইন -কানুন তৈরি করে অসহায়দের উপর তা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন তখন তা ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা জায়ানবাদীদের  আধিপত্য আর কতৃর্ত্ববাদের নির্মমতার করুণ পুনরাবৃত্তি বই আর কিছুই নয় । আর ও নির্মম কৌতুক, একদা জায়ানবধের রাজ্য বলে খ্যাত , হিটলারের জার্মান, মাঁখোর  ফ্রান্স , কূটনৈতিক ব্রিটেন সহ দু‘মুখো আরব বিশ্ব সকলে এ নির্মম রসিকতায় সামিল ! দুনিয়া যে ক্ষমতা আর অর্থের পূজারী - পড়ন্ত বেলার প্রাজ্ঞ প্রবীণদের গভীর হতাশার সুরে তা সুস্পষ্ট ।

রুপকথার গল্পের চেয়ে ও বাস্তব জীবনের গল্প অনেকসময় অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠে , হয়ে উঠে প্রকৃত রুপক নতুবা তার চেয়ে ও শক্তিশালী আখ্যান । বিশ টি বছর ধরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর নানা প্রতিকুলতায় অবরুদ্ধ হামাস , ঠিক জিতে গেল সাহস আর দেশের প্রতি ভালবাসাকে হৃদয়ে লালন করে।

আর, সেই ছোট্ট গেরিলা সদস্যের দলটি আজ কত বড়! মানচিত্র ছাঁড়িয়ে , সীমানা ছাঁড়িয়ে নব প্রজন্মের অকুতোভয় হামাসরা আজ দুয়ারে দাঁড়ানো দৃঢ় দ্বাররক্ষী । তারাই পারে ,তথাকথিত অজেয় পশ্চিমা শক্তিকে শান্তিচুক্তি নামক সে নাটকীয় ঘটনার অন্যতম যোগানদার করতে। মার্কিন সরকার প্রধান উপযাচক মাত্র-পরিস্থিতি বুঝেই হয়তবা বন্ধুর পথে হাঁটতে চাইছেন, ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বর্মটি যে ভিষণ শক্তপোক্ত ও একরোখা ।

তবে, মধ্যপ্রাচ্যে ছঁড়ি ঘুরানোর দীর্ঘদিনের শক্তলাঠিটি কে যে এবার বাঁকাতেই হয় ।  সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙবে না, হায় বেনিয়ামিন  কি অসম্মানের এক পরাজয় ! কি অপেক্ষা করছে দুর্নীতি মামলায় জর্জরিত বুড়ো নেকড়েটির কপালে -বিধ্বস্ত চেহারায় কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো দীর্ঘতর হচ্ছে বৈকি।

প্রতিরোধ, যুদ্ধের নামে আগ্রাসন আর বসতি স্থানান্তরের নামে বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক শরণার্থী , আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় হয়তবা এখন পর্যন্ত বিজয় উদযাপনে ব্যস্ত । তবে নারীর প্রতি সম্মান রক্ষার্থে ট্রাম্প তার প্রাক্তন রাজনৈতিক প্রতিদন্বী বারাকের উপর সম্ভবত সচেতনভাবেই তার রাষ্ট্র পরিচালনার মেয়াদকালে বিতর্কিত সন্ত্রাসী বনাম ইসলামিক সেনাবাহিনী মতানৈক্যের বিষয়টির উপর  ইঙ্গিত দিয়েছেন । আর , ব্রিটিশ সংসদে চিত্রিত ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে পুরনো বন্ধু ব্লেয়ারের পদাংক অনুসরিত কিনা, তাই আপনমনে যাচাই-বাছাই করে চলেছেন। 

পরিস্থিতির পরিবর্তিত মোড় , কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন লিখিত শান্তি  চুক্তির যে ভিন্ন ভিন্ন ২০টি শর্ত শোভা পাচ্ছে  তার সুচারু বাস্তবায়ন খোদ ট্রাম্পের পক্ষেই যথেষ্ট দুরুহ । পেন্ডুলামের কাঁটা চলমান, হঠকারী ছোটভাই একবার নয় বেশ ক‘বার বড় ভাইয়ের অবাধ্য হয়েছেন , আস্ত উড়োজাহাজ উপহার আর বন্ধুপ্রতীম কাতারের উপর অর্তকিত আক্রমণ । রক্তে যার খুনে নেশা সে পাগলা ঘোড়া কি আদৌ থামবে ? বিলুপ্ত হিজবুল্লা, হুতির হারিয়ে যাওয়া হামাসের নেতৃত্বের শক্তি ক্ষয় , সিরিয়ায় ভাঙ্গন, ইরানের সফল প্রতিরক্ষার ব্যুহ ভেদ- আপাত , দ্বিধাগ্রস্থ ইসরাইল প্রধান সফলতার মাপকাঠিতে আত্নতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন হয়তবা ।  তবে,গাজামুখি সারি সারি ত্রাণবাহী গাড়ির বহরের দী¦প্ত যাত্রা কি তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় নি, নিশ্চিতভাবেই উত্তরটি হ্যা ।

কাঁকচক্ষু দৃষ্টিতে , দৃঢ়তা আর ন্যায়ের বিজয় তবে, অসম এ যুদ্ধে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের চড়া মূল্য দিতে হল  হামাসকে। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়  হামাস , নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক , প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। এই যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ সেই জীবননাশের মূল্য দিতে হল চরমভাবে-গত দু‘বছরে ৬৭,০০০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত । শক্তিশালী শত্রুর সাথে টক্কর লাগানো  কি এত সোজা!  লোকবল আর সামরিক শক্তিতে তুলনামূলক ভাবে পিঁছিয়ে, তবে কিনা নীতি আর ঈমানের শক্তিতে বরাবরি বলীয়ান হামাসিয়ানরা । তাই , এ ক্রান্তিকালে ও ধাপে ধাপে অধিকাংশ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল তারা, সর্বশেষ গাজায় ৪৮ জন বন্দী ছিলেন , বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবান ২০ জন। আর্ন্তজাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে দু‘ধাপে জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় হামাস গত ১৩ই অক্টোবর । মৃতদের মাঝে চার জনের মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা ও জানিয়েছে তারা।অপরদিকে, প্রতিপক্ষ ইসরাইলের আচরণ রুঢ়তার সীমা আকাশ  ছুঁয়েছে  বহু আগেই-কারাগারে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা এবং নিপীড়ন করা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যৌন হয়রানির খবর ও পাওয়া গেছে । আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আল-রিমায়ি বলেন- এ দু‘টি বছরে তার ওজন কমেছে ৫০ কেজি ! হাড় সর্বস্ব শরীর জড়িয়ে কন্যার ব্যাকুল আর্তি, বাবা আমি ব্যাথা পাই ।

এখন আবার ট্রাম্পের নতুন চমক, ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপনাস্ত্র উপহার দিবেন এই পাগলাটে রাষ্ট্রপতি রাশান যুদ্ধ থামাতে ।  শুরু হওয়া আফগান -পাকিস্তান সংঘাতে ও তালেবান দের ভূমিকা নিয়ে এক নতুন চেহারার ব্যবসায়ীকে দেখা গেছে -জামাতা কুশনারের ব্যবসায়িক বুদ্ধির জুড়ি নেই রাজনৈতিক বুদ্ধিতে ও যে  শ্বশুরকে ভবিষ্যতে টেক্কা দিতে সমর্থ  হবেন  তা তার সাম্প্রতিক স্রোত বুঝে চলার ই পরিপক্ক রুপ ।

আজকের এই পার্থিব পৃথিবীতে  স্রোতস্বিনী টেমস নদী ব্যবহারের মাসকাবারি বিল পরিশোধের সময় ও যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি মগজে নিত্য গেঁথে থাকে -প্রতিটি পানিবিন্দু পরিশোধে পাওনা প্রাপ্য ! অর্থাৎ, জীবনের অপর নাম পানি ও বাতাস সেবনে ও মূল্য চুকাতে হয়, তা যদি হয় কেনসিংটন নামক অভিজাত এলাকার মনোরম ব্যালকনির মুক্ত হাওয়া । বিনামূল্যে    সেবা, সে তো অতীতের গাল গল্প । অথচ, নিঠুর ইসরাইলী বাহিনী    গাজায় ৩০০০ জলপাই গাছ  কেটে , অগণিত বন্য ও পোষা  প্রাণী মেরে আক্ষরিক অর্থেই প্রকৃতিকে বিপন্ন করে  তুলতে চাইছিল  । সেই প্রকৃতিই কিনা আপন মহিমায়  নতুন বোনা জলপাই গাছের পাশ দিয়ে ছুটন্ত শিশুদের  সাদরে বরণ করছে যাদের খাঁচা ভর্তি প্রিয় পোষা  পাখিটির  গুঞ্জন।   

ফিলিস্তিন বাসীদের প্রিয় ম্যান্ডেলা ‘ আল ফাত্তাহ ‘ এখন ও জায়ানবাদীদের জিম্মায় ,  ইসরাইলী সেনাবাহিনী তাকে যমের মত ভয় পায় -যার মুক্তির আলো দেখা এখন ও সংশয়ে ভরা । সন্দেহাতীতভাবেই, তিনিই প্যালেস্টাইনি জনগণের অবিস্বরণীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী আন্দোলনের দিকপাল ।

আজকের দিনের ফ্রি পত্রিকাগুলোর অন্যতম স্লোগান-মুক্ত খবর, মুক্ত চিন্তা । আর বিশ্বজুঁড়ে এই প্রবল বিজয় উদযাপনে মানবতাবাদীদের একটাই আশা মুক্ত হোক মানবতা , জয় হোক শুভ বুদ্ধির।



নুজহাত নূর সাদিয়া,
এলবিপিসি, লন্ডন ১৪ই অক্টোবর‘ ২৫ সাল ।

মতামত এর আরও খবর