img

আমেরিকা কেন ইসরায়েলের ত্রাণকর্তা

প্রকাশিত :  ১১:২৭, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

আমেরিকা কেন ইসরায়েলের ত্রাণকর্তা

সাইফুল খান

“নিউ ইসরায়েল” শব্দবন্ধটি আজ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় রূপক নয়। এটি পশ্চিমা সভ্যতার আত্মপরিচয়ের গভীরে প্রোথিত এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দর্শন। এর সূচনা হয় ১৬শ শতকের ইউরোপে, যখন প্রোটেস্ট্যান্ট রিফরমেশন বা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ক্যাথলিক চার্চের একচ্ছত্র কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়। এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন জার্মান ধর্মতাত্ত্বিক মার্টিন লুথার (Martin Luther)। তিনি ঘোষণা করেন যে সত্যিকার বিশ্বাস ঈশ্বর ও মানুষের সরাসরি সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। পোপ বা চার্চের অনুমোদনের ওপর নয়। লুথারের এই বিদ্রোহ ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি এক গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করে। মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় নতুন এক আত্মবিশ্বাস। তারা নিজেরাই “God’s Chosen People,” অর্থাৎ ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি। যাদের ওপর দুনিয়াকে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।

এই ধারণা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ধীরে ধীরে ইউরোপীয় মানসিকতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তাদেরকে ঈশ্বর নিজ হাতে বেছে নিয়েছেন মানবসভ্যতাকে “আলো ও ন্যায়ের পথে” নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই ভাবধারাই পরবর্তী শতকগুলোতে এক নতুন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করে, যা “New Israel” এর বীজ রোপণ করে।

১৭শ শতকে ইউরোপের এই প্রোটেস্ট্যান্ট চিন্তা বাস্তব রূপ পায় আমেরিকার মাটিতে। যখন ইংল্যান্ড থেকে ধর্মীয় স্বাধীনতার সন্ধানে পিউরিটান (Puritans) গোষ্ঠী নতুন ভূমিতে পাড়ি জমায়। তারা নিজেদের ধর্মীয় আদর্শকে নতুন পৃথিবীতে বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেছিল। একটি এমন সমাজ গঠনের, যা পাপমুক্ত, পবিত্র এবং ঈশ্বরের অনুগ্রহে পরিচালিত হবে। সেই সমাজ হবে মানবতার জন্য এক আদর্শ মডেল। একটি “new covenant” বা নতুন চুক্তি ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে।

এই পিউরিটান চিন্তাধারার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রকাশ ঘটে ১৬৩০ সালে। যখন জন উইনথ্রপ (John Winthrop) তার বিখ্যাত ভাষণ “A Model of Christian Charity”–তে বলেন, “We shall be as a city upon a hill; the eyes of all people are upon us.” অর্থাৎ, “আমরা হব পাহাড়ের উপর এক নগরী, যাকে সমগ্র পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করবে।” এই বক্তব্যে লুকিয়ে ছিল এক গভীর প্রতীকবোধ। উইনথ্রপের “City upon a Hill” কেবল ধর্মীয় আদর্শ নয়, বরং রাজনৈতিক ভবিষ্যদ্বাণীও ছিল। তার এই ঘোষণা প্রমাণ করে যে, তারা নিজেদের শুধু ধর্মীয় সমাজ হিসেবে নয়, বরং এক “নির্বাচিত জাতি” হিসেবে দেখছিল। যাদের কর্তব্য ঈশ্বরের নির্দেশে মানবজাতির জন্য নৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শ স্থাপন করা।

এই বিশ্বাসই পরবর্তীকালে আমেরিকার জাতীয় চেতনার কেন্দ্রে জায়গা করে নেয়। নতুন পৃথিবীতে বসতি স্থাপনকারী ইউরোপীয়রা নিজেদের দেখল “ইসরায়েলিদের মতো”। যারা মিশর থেকে মুক্তি পেয়ে প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ করছে। ইংল্যান্ড ছিল তাদের কাছে “Egypt of corruption,” আর আমেরিকা সেই “Promised Land” যেখানে তারা ঈশ্বরের সত্য ধর্ম ও ন্যায়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে। সেই থেকে আমেরিকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও জাতীয় বয়ানে “New Israel” ধারণা এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।

ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তর

১৮ থেকে ১৯শ শতকে, এই ধারণা ধর্মীয় সীমানা ছাড়িয়ে গভীরভাবে সাম্রাজ্যবাদের নীতির ভিত্তিতে পরিণত হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিজেরাকে “chosen empire” মনে করত এবং আমেরিকা দেখল নিজেকে “Manifest Destiny”র বাস্তব দলিল হিসেবে।  ঐ সময় আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে উপনিবেশ স্থাপনকে বলা হতো “God’s Work”  একটি ধর্মীয় ও নৈতিক আবরণে আবৃত শাসনব্যবস্থা। এইসব ভাবনাই রূপ নেয় ভূরাজনৈতিক দর্শনে। যেখানে ধর্মীয় মিশন ও নৈতিক আদর্শই শাসনের ন্যায়সঙ্গত ভিত্তি তৈরি করেছিল।

খ্রিষ্টান জায়োনিজম: ধর্ম ও কৌশলের মিলনবিন্দু

১৯শ শতের মাঝামাঝিকে পৌঁছালে প্রোটেস্ট্যান্ট পশ্চিম “Christian Zionism” এর মাধ্যমে ধর্ম ও রাজনীতিকে একসূত্রে বেঁধে ফেলে। ব্রিটেনে Lord Palmerston ও Arthur Balfour প্রমুখ নেতারা এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ইহুদি জাতির প্যালেস্টাইনে পুনর্বাসনকে বাইবেলীয় ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ হিসেবে দেখেছিলেন। ১৯১৭ সালের Balfour Declaration হলো সেই বিশ্বাসের রাজনৈতিক প্রকাশ।  এইভাবে “New Israel” ধারণা এক নতুন মাত্রা অর্জন করে ধর্মীয় দর্শন রূপ নেয় কূটনৈতিক বাস্তবতায়।

আমেরিকার আত্মপরিচয়: City Upon a Hill থেকে World Policeman

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এই দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ইউরোপ বিধ্বস্ত, উপনিবেশগুলো স্বাধীনতার পথে আর আমেরিকা আত্মপরিচিত হয় “আলোকবর্তিকা” জাতি হিসেবে। যার দায়িত্ব পৃথিবীতে “স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের” আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়া। এই নৈতিকতা আসলে “New Israel” মতবাদের আধুনিক সংস্করণ। কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপকে দেখানো হয় “divine mission” হিসেবে। যেন ঈশ্বরের নামে “অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধ” চলছে।

ইসরায়েল: ধর্মীয় প্রতীকের ভূরাজনৈতিক কেন্দ্র

ইসরায়েল পশ্চিমা বিশ্বের কাছে এক ধর্মীয় প্রতীক। কিন্তু বাস্তবে এটি বহু শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা এক ভূরাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্টদের, বিশেষ করে ইভানজেলিক্যাল গোষ্ঠীর মধ্যে, ইসরায়েলকে ঘিরে যে বিশ্বাস গড়ে উঠেছে, তা শুধু ধর্মীয় আবেগ নয়। এটি একটি রাজনৈতিক নীতিমালা, একটি বিশ্বদর্শন। তারা মনে করে, ইসরায়েল রাষ্ট্রের পুনরুত্থান কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়; বরং এটি বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ, যেখানে ঈশ্বর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ইহুদিরা একদিন আবার “প্রতিশ্রুত ভূমি”তে ফিরে আসবে। সুতরাং ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা ও তার অস্তিত্ব রক্ষা এদের কাছে কেবল কূটনৈতিক বিষয় নয়, বরং ধর্মীয় দায়িত্ব, এমনকি এক ধরনের আধ্যাত্মিক মিশন।

এই বিশ্বাসের শিকড় ১৯শ শতকের ব্রিটেনে প্রোথিত, যখন প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মতাত্ত্বিক ও রাজনীতিকরা “Restorationism” ধারণাকে সমর্থন করেন। এর মূল তত্ত্ব ছিল ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে প্রত্যাবর্তন বাইবেলীয় ভবিষ্যদ্বাণীর পূর্ণতা এবং যীশু খ্রিষ্টের পুনরাগমনের পূর্বশর্ত। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টন থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ের আর্থার বেলফোর পর্যন্ত বহু নেতা এই ধারণায় অনুপ্রাণিত ছিলেন। ১৯১৭ সালের Balfour Declaration যেখানে ব্রিটিশ সরকার ইহুদি জাতির জন্য “national home” প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। সেটা এই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসেরই বাস্তব রূপ। এটি কেবল কূটনৈতিক দলিল নয়, বরং “New Israel” ভাবধারার এক প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি।

২০শ শতকের মাঝামাঝি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন যুক্তরাষ্ট্র এই “নতুন প্রতিশ্রুত ভূমি”-র অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যান, যিনি প্রথম বিশ্বনেতা হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেন। প্রকাশ্যে বলেন যে তিনি এটি করেছেন “as a Christian duty।” এই বক্তব্যে প্রতিফলিত হয় আমেরিকান ধর্মচেতনা যেখানে ইসরায়েল রক্ষাকে দেখা হয় খ্রিষ্টীয় বিশ্বাস রক্ষার অংশ হিসেবে। এরপর থেকে প্রায় প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগান, বুশ, ওবামা, এমনকি ট্রাম্প পর্যন্ত—

 ইসরায়েলকে “God’s chosen nation” বলে উল্লেখ করেছেন। ট্রাম্পের সময় যুক্তরাষ্ট্র যখন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তখন এটি কেবল কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না; এটি ছিল এক ধর্মীয় ঘোষণার পুনর্নির্মাণ, যেন বাইবেলীয় প্রতিশ্রুতি আধুনিক ভূরাজনীতির মাধ্যমে পূর্ণতা পায়।

আমেরিকার অভ্যন্তরেও ইভানজেলিক্যাল গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রভাব এই নীতিকে আরও দৃঢ় করেছে। আজও মার্কিন কংগ্রেসে ইসরায়েল-বান্ধব আইনগুলো পাস হয় বিশাল দ্বিদলীয় সমর্থনে, যার পেছনে কাজ করে “Christian Zionism” নামক ধর্মীয় আন্দোলন। এই আন্দোলন বিশ্বাস করে, ইসরায়েলকে সমর্থন করা মানেই ঈশ্বরের পরিকল্পনাকে সহায়তা করা এবং যারা ইসরায়েলের বিরোধিতা করে, তারা ঈশ্বরের বিরোধিতা করছে। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য, গোয়েন্দা সহযোগিতা, এমনকি জাতিসংঘে ইসরায়েলের পক্ষে ভেটো প্রয়োগ। সবকিছুই এই ধর্মীয়-রাজনৈতিক বিশ্বাসের কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়।

আজকের “West–Israel Axis” আসলে এই দীর্ঘ ঐতিহাসিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বন্ধনের পরিণতি। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা, ইসরায়েলকে কেবল মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং নিজেদের ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের প্রতিফলন হিসেবে দেখে। এই সম্পর্ককে শুধুমাত্র ভূরাজনৈতিক জোট বলে বোঝা যায় না; এটি এক গভীর “geopolitical theology,” যেখানে ধর্ম, নৈতিকতা ও শক্তির রাজনীতি একত্রে কাজ করে।

ফলে, ইসরায়েল আজ পশ্চিমা সভ্যতার জন্য একটি “living symbol” যেখানে প্রাচীন বাইবেলীয় প্রতিশ্রুতি, আধুনিক সামরিক কৌশল ও বৈশ্বিক ক্ষমতার রাজনীতি একে অপরের সাথে জড়িয়ে গেছে। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি, অস্ত্রনীতি ও মিডিয়া আখ্যান সবকিছুতেই ইসরায়েলকে “divine ally” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। “New Israel” ধারণার এই পরিণতি শুধু একটি ধর্মীয় বিশ্বাসের বাস্তব রূপ নয়। এটি হলো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের নৈতিক বৈধতা, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের বিশ্বনেতৃত্বকে ঈশ্বরনির্ধারিত দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

২১শ শতকের বাস্তবতায় “New Israel”

বর্তমানে “New Israel” শুধু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি অদৃশ্য মতাদর্শ, যা বিশ্বনীতি, সামরিক কৌশল ও সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

War on Terror–এর সময় ইসলামী বিশ্বকে প্রায়ই উপস্থাপন করা হয় “Dark Axis” হিসেবে। 

পশ্চিমা হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, এমনকি মানবাধিকার প্রচারণাও প্রাঙ্গণে আসে “divine justice” এর আড়ালে।

খ্রিষ্টান জায়োনিস্ট আন্দোলন ও সামাজিক মাধ্যমের প্রচারে বাইবেলীয় ভাষায় ইসরায়েল সমর্থনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে “পবিত্র যুদ্ধ”-এর মনোভাব তৈরি করে।

সমসাময়িক বিশ্লেষণ

আজকের পশ্চিমা রাজনীতি, বিশেষ করে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, এখনও “New Israel” মতবাদের ছায়ায় পরিচালিত। উদাহরণস্বরূপ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বা ইউক্রেন সংঘাত হোক, প্রতিটি নীতির পেছনে কাজ করে এক ধরনের নৈতিক আত্মবিশ্বাস “আমরা আলোর পক্ষ।” এই বিশ্বাসই “Western Exceptionalism”-এর ভিত্তি। যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদেরকে নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ ও ঈশ্বরনির্বাচিত জাতি হিসেবে দেখে। 

ফলে, “New Israel” এখন আর শুধুই একটি ধর্মীয় ধারণা নয়; এটি একটি ভূরাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব (geopolitical theology)।  যার মাধ্যমে পশ্চিম নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে ধর্মীয় বৈধতা দেয়।

উপসংহার

“নিউ ইসরায়েল” মূলত একটি মানসিক মানচিত্র।যেখানে ধর্ম, রাজনীতি ও শক্তি একে অপরের প্রতিচ্ছবি। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মচেতনার সেই বিশ্বাস, যে তারা ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতি, আজও আমেরিকা ও পশ্চিমা সভ্যতার কূটনৈতিক আত্মপরিচয়ের মূলে কাজ করছে। এই মতবাদ যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন মধ্যপ্রাচ্য, মুসলিম বিশ্ব ও বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপথ নির্ধারিত হবে “New Israel”-এর ছায়ায়। 


লেখক-ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর

img

আসিম মুনিরের লিগ্যাল ইমিউনিটি: পাকিস্তানের অন্ধকার ভবিষ্যৎ

প্রকাশিত :  ১৮:৪১, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৯:১১, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

সাইফুল খান 

জেনারেল আসিম মুনিরকে দেওয়া আজীবন লিগ্যাল ইমিউনিটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভূমিকম্পের মতো একটি ঘটনা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্রে সেনাবাহিনী আগেই ছিল সবল, কিন্তু এবার সামরিক ক্ষমতার ওপর যে “অভিশাপহীনতা” ও “বিচার-বহির্ভূত নিরাপত্তা” দেওয়া হলো। তা শুধু একটি দেশের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; বরং নতুন আঞ্চলিক জটিলতার প্রতিচ্ছবি।অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই ইমিউনিটি শুধু অভ্যন্তরীণ শক্তি‑রাজনীতির ফল নয়; এটি সৌদি আরব‑মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র‑ট্রাম্প অক্ষের নতুন জিওস্ট্র্যাটেজিক সমীকরণের পুরস্কার। যার মূল লক্ষ্য আফগানিস্তান শাসনব্যবস্থাকে চাপের মুখে রাখা, তালেবানের বিপরীতে পাকিস্তানকে ব্যবহার করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন সামরিক খেলা শুরু করা।

১. সৌদি–ট্রাম্প অক্ষ: কেন আসিম মুনিরকে প্রয়োজন

সৌদি আরবের সাম্প্রতিক কৌশল লক্ষ্য করলে দেখা যায়। তারা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সামরিক পার্টনারশিপ গড়ে তুলছে। ইরানের প্রভাব মোকাবিলা, ইয়েমেনের সামরিক প্রতিরোধ এবং ভবিষ্যতের আঞ্চলিক ব্লক তৈরি সব মিলিয়ে সৌদি আরব পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাদের ‘এক্সটেনশন ফোর্স’ হিসেবে বিবেচনা করে আসছে বহুদিন। এখন সেটা নতুন স্ট্র্যাটেজিক চুক্তির কারনে আরো ঘনিষ্ট।

অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য‑কৌশল বরাবরই ছিল দুই স্তরে:

ক ইস্রায়েলের সুরক্ষা, 

খ.আফগানিস্তান‑পাকিস্তান বেল্টে ‘প্রক্সি’ শক্তি তৈরি।

এই দুই উদ্দেশ্যের মিলনস্থল হলো পাকিস্তান আর্মি।

আসিম মুনির সৌদির পছন্দের মানুষ হিসেবে পরিচিত; একই সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকে ওয়াশিংটনের কিছু নিরাপত্তা চক্র তাঁকে “বিশ্বস্ত সামরিক পার্টনার” হিসেবে দেখেছে বলে বহু বিশ্লেষকের ধারনা। তাই তাঁর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে এই অক্ষ লাভবান হবে।

২. কেন লিগ্যাল ইমিউনিটি এই অক্ষের জন্য সুবিধাজনক

লিগ্যাল ইমিউনিটির অর্থ হলো:

ভবিষ্যতে কোনো জবাবদিহিতা নেই।

সামরিক অভিযান বা গোয়েন্দা অপারেশন প্রশ্নহীনভাবে চালানো সম্ভব।বিদেশি শক্তির সাথে সামরিক সহযোগিতায় বাধা কম।দেশের রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে সামরিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ। এই অবস্থায় আসিম মুনির এমন একটি পূর্ণ ক্ষমতাধর সামরিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন, যাঁর সাহায্যে:

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে নতুন স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করতে পারবে

তালেবান সরকারকে চাপে রাখতে পাকিস্তানের ভৌগোলিক সুবিধা ব্যবহারের জন্য এমন সামরিক নেতৃত্ব দরকার। যিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ঝামেলা ছাড়াই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

সৌদি আরব পাকিস্তানকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা পার্টনার হিসেবে আরও দৃঢ়ভাবে ব্যবহার করতে পারবে। বিশেষত ইরানের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সহযোগিতা ও কনফ্লিক্ট থিয়েটার ব্যবস্থাপনায়।

৩. পাকিস্তানের গণতন্ত্রে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব

জেনারেল আসিম মুনিরের আজীবন লিগ্যাল ইমিউনিটি শুধু একজন সেনাপ্রধানকে আইনি সুরক্ষা দিচ্ছে না; এটি পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে তিন স্তরে মারাত্মক আঘাত করছে।

ক. বিচার বিভাগের নির্জীবতা

একজন সেনাবাহিনী প্রধানকে আজীবন মামলাহীন করা মানে:

১. সুপ্রীম কোর্টের ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হওয়া

সুপ্রিম কোর্ট বা নিম্ন আদালত এখন সেনাবাহিনী প্রধানকে তদন্ত বা অভিযুক্ত করতে পারবে না।

দীর্ঘমেয়াদে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নষ্ট হবে এবং বিচারালয় শুধুই প্রশাসনিক কার্য সম্পাদন করবে, ন্যায়বিচারের রক্ষক হিসেবে নয়।

২. আইনের সমতা ধ্বংস

সাধারণ নাগরিক, সাংবাদিক বা রাজনৈতিক নেতা যে আইন অনুসারে দায়ী, সেই সমতার ধারণা সেনাপ্রধানের ক্ষেত্রে আর থাকবে না।

এটি জনগণের মধ্যে আইনের প্রতি আস্থা হ্রাস করবে।

৩. সেনাবাহিনী-আদালত সম্পর্কের আধিপত্য

বিচার বিভাগ এখন সেনাবাহিনীকে সমর্থন বা অনুমোদনের জন্য কাজ করবে।

সেনাবাহিনীকে এক ধরনের “অ্যাডজান্ট বিভাগ” হিসেবে দেখা হবে। যেখানে আদালত সিদ্ধান্তে স্বাধীন নয়, বরং সামরিক প্রভাবের অধীন থাকবে।

খ. সংসদ এবং নির্বাচনী রাজনীতি অচল

লিগ্যাল ইমিউনিটি স্পষ্টভাবে একটি বার্তা দেয়:

 “রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা জনগণের ভোটে নয়, বুটের আওয়াজে।”

১. নির্বাচিত সরকার এবং সংসদের কার্যক্ষমতা সীমিত। রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে সেনাবাহিনীর অনুমোদন নিতে হবে।

সেনা-নেতৃত্বের অগ্রাধিকার সংবিধানগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সংসদকে কার্যত ফর্মালিটি হিসেবে দেখা হবে।

২. রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিকূল পরিবেশ:

বিরোধী দলগুলো সেনাবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা নীতিগত চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। ভোট ও জনমতের প্রভাব কমে যাবে, কারণ সামরিক ক্ষমতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপরে দখল করবে।

৩. রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধ্বংস:

দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আত্মসংশয় তৈরি হবে। সরকার শুধু “সামরিক স্বার্থ রক্ষা করে টিকে থাকা”র ওপর নির্ভরশীল হবে।

গ. বেসামরিক প্রশাসনের ‘সিস্টেমিক দাসত্ব’

লিগ্যাল ইমিউনিটি বেসামরিক প্রশাসনকে বাধ্য করে সামরিক স্বার্থ রক্ষা করতে। এর ফলে:

১. স্বাধীন নীতিনির্ধারণের সীমাবদ্ধতা

অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কূটনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসন সেনাবাহিনীর দিকনির্দেশনা মেনে চলবে। সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা নেই, সবকিছু সামরিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে।

২. গণতান্ত্রিক কাঠামোর ফরমালিটি

সরকার এবং সংসদ এখন কেবল প্রশাসনিক ফর্মালিটি। আসলে দেশের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, সেনাবাহিনী ও তার নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করে।

৩. দীর্ঘমেয়াদী সংস্কৃতিগত প্রভাব

সাধারণ নাগরিক ও সরকারি কর্মকর্তা অনুপ্রেরণা হারাবে। সামাজিক ও প্রশাসনিক মানসিকতা হবে “সেনার নির্দেশ পালনের ওপর নির্ভরশীল”।

৪. পাকিস্তানে সামরিকতন্ত্রের নতুন অধ্যায়

লিগ্যাল ইমিউনিটি দিয়ে এমন একজন সামরিক প্রধানকে “অতিমানবিক আইনি ক্ষমতা” প্রদান করা হলো, যার প্রভাব সরাসরি তিন ভাবে দেখা যাবে:

১. সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সর্বশক্তি

এখন আর তারা পর্দার আড়ালে নয় সংবিধানে, আইনে, বাস্তবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।

২. ভবিষ্যতের সামরিক শাসকদের প্রণোদনা

আজ আসিম মুনির; কাল অন্য কেউ।

এই নজির ভবিষ্যতের যে কোনো সামরিক প্রধানকে “অভিযুক্তহীন রাজা” বানিয়ে দিতে পারে।

৩. রাষ্ট্রের ভেতরে দ্বিতীয় রাষ্ট্র

সামরিক গোয়েন্দা, সাইবার, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, কূটনীতি সবকিছুতেই সেনাবাহিনীর আলাদা সিস্টেম তৈরি হবে।

৪. ভারতের জন্য কেন উদ্বেগজনক

ভারতের জন্য এটি তিন কারণে দুশ্চিন্তার বিষয়:

ক. পাকিস্তানে ক্ষমতা সম্পূর্ণ সামরিক হাতে গেলে সীমান্ত পরিস্থিতি অনিশ্চিত হবে।সেনাবাহিনী রাজনৈতিক হিসাব কম করে মাঠের সিদ্ধান্ত বেশি নেবে।

খ.আফগানিস্তানে মার্কিন‑পাকিস্তানি অপারেশন হলে আঞ্চলিক ব্যালান্স বদলে যাবে। এর প্রভাব ভারতের উত্তর সীমান্তেও পড়বে।

গ.চীন–পাকিস্তান–সৌদি–আমেরিকা চতুর্মুখী জটিলতা নতুন আঞ্চলিক জোট তৈরি করবে। যা ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থানকে চাপে ফেলতে পারে।

উপসংহার:  আসিম মুনিরের লিগ্যাল ইমিউনিটি শুধু পাকিস্তানের আইনগত সিদ্ধান্ত নয়।এটি একটি নতুন আঞ্চলিক শক্তি বিন্যাসের সিগন্যাল।সৌদি আরব একটি নিরাপত্তা‑অক্ষ তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান নীতিতে পুনরায় প্রবেশের চেষ্টা করছে।ট্রাম্প–ইস্রায়েল–গালফ অক্ষ আবার সক্রিয় হচ্ছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই অক্ষের “নতুন গিয়ার” হিসেবে প্রস্তুত হচ্ছে। এর মাশুল দেবে পাকিস্তানের জনগণ। গণতন্ত্র, রাজনীতি, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা সবকিছু আরো দুর্বল হবে। আর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি প্রবেশ করবে এক অনিশ্চিত, অস্থিতিশীল, সামরিকতান্ত্রিক ভবিষ্যতে।


লেখক- ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর