প্রকাশিত :
০৭:২৯, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৮:২৪, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫
সংগ্রাম দত্ত
মানুষের জন্য মানুষ হওয়া—একটি সহজ বাক্যের মধ্যে যে গভীরতা, যে মহিমা, যে আত্মত্যাগের দর্প আছে, তা অনেকেই উচ্চারণ করেন; কিন্তু বাস্তব জীবনে তার প্রতিফলন খুব কম মানুষই রেখে যেতে পারেন।
শ্রীমঙ্গলের ইতিহাস, রাজনীতি, জনজীবন ও মানবিক সেবার অন্তঃসলিলা ধারায় এক আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলে থাকা নাম—ডাক্তার মোঃ আব্দুল আলী। তাঁর মৃত্যু চার দশক আগে হলেও আজও মানুষের স্মৃতিতে তিনি জীবন্ত একজন সৎ, মানবতাবাদী ও আদর্শনিষ্ঠ চিকিৎসক; এবং একইসঙ্গে সংগ্রামী রাজনৈতিক কর্মী, জননেতা ও দেশপ্রেমিক।
শৈশবের গ্রাম, পারিবারিক পরিমণ্ডল এবং শিক্ষার সূচনা
১৯৩৬ সালের ১১ এপ্রিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা ( বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলা) শ্রীমঙ্গল থানার তৎকালীন শ্রীমঙ্গল বস্তী—বর্তমানে পরিচিত লালবাগ আবাসিক এলাকা—এই শান্ত, সাধারণ পরিবেশেই আলোর পথের এক যাত্রা শুরু হয়। পিতা মরহুম হাজী বাহারাম আলী ও মাতা মরহুম গুলশানারা বেগমের ঘরে দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রজ। শৈশব থেকেই তিনি দায়িত্বশীল, আত্মপ্রত্যয়ী ও পরোপকারপ্রবণ ছিলেন—যা' পরবর্তীকালে তাঁর সার্বিক জীবনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৫২ সালে ভিক্টোরিয়া হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সহিত মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ফলাফল প্রকাশের পর তিনি চিকিৎসা শিক্ষা গ্রহণে সংকল্পবদ্ধ হন এবং পরে ভর্তি হন কুমিল্লা মেডিকেল ইনস্টিটিউটে এলএমএফ কোর্সে।
১৯৫৯ সালে উত্তীর্ণ হয়ে শ্রীমঙ্গলে ফিরে শুরু করেন মানবিক চিকিৎসা সেবা—যা' তাঁকে অচিরেই জনমানুষের আস্থার প্রতীক করে তোলে।
ভাষা আন্দোলনে তরুণ আলীর দৃপ্ত ভূমিকা
১৯৫২ সাল—বাংলার আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের বছর। ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলের ছাত্র আলী তখনো কৈশোরে, কিন্তু ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মন তাঁকে রাজপথে নামিয়ে আনে। যোগেন্দ্র দত্ত, রাসেন্দ্র দত্ত, বিরাজ কুসুম চৌধুরী চুনী, অখিল চন্দ্র ধর, শ্যামল সেনগুপ্ত, অচ্যুত কুমার দেব, ডাঃ ফজলুল হক, মোঃ মছদ্দর আলী ও সৈয়দ মহিবুর রহমান চৌধুরীসহ শ্রীমঙ্গলের তরুণ ছাত্রদের সাথে তিনিও জ্বলে ওঠেন প্রতিবাদের আগুনে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সালাম-বরকত-রফিকদের রক্ত ঝরার পর শ্রীমঙ্গল পৌরসভা মাঠে যে বিশাল গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়—সেখানে ডাঃ আব্দুল আলী স্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ। সেই বক্তৃতা তাঁকে প্রথমবারের মতো গণমানুষের একজন দৃঢ়চেতা কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত করে।
চিকিৎসা পেশা: মানবতার অবিচল তপস্যা
চিকিৎসা জীবনে তাঁর পরিচিতি ছিল অন্যসব চিকিৎসকের তুলনায় আলাদা। চিকিৎসাকে তিনি কখনো বাণিজ্যে পরিণত করেননি। যে দরিদ্র রোগীরা চিকিৎসার খরচ দিতে পারতেন না—তাদের তিনি হাসিমুখে ফ্রি চিকিৎসা দিতেন। সচ্ছল রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া ভিজিটের অর্থ থেকে ওষুধ কিনে দিতেন গরিবদের জন্য।
এই নিঃস্বার্থতা তাঁকে শ্রীমঙ্গলে ‘মানুষের ডাক্তার’ এবং ‘গরিবের ভরসা’ হিসেবে অমর পরিচিতি দেয়। বর্তমান সমাজে যেখানে চিকিৎসার ব্যয় বাড়ছে, মানুষের বিশ্বাস কমছে—সেখানে ডাক্তার আব্দুল আলীর জীবনের উদাহরণ এক অমূল্য শিক্ষা।
রাজনীতিতে প্রবেশ ও প্রতিটি আন্দোলনে সক্রিয়তা
তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু। পরবর্তীতে তিনি যুক্ত হন আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১১ দফা আন্দোলনসহ সব গণ-আন্দোলনে।
১৯৬৫ সালে ফাতেমা জিন্নাহ এর নেতৃত্বে পরিচালিত সম্মিলিত বিরোধী দলে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
১৯৬৯ সালে মোহাম্মদ ইলিয়াস ( ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও কমিউনিস্ট নেতা) ও মোঃ আলতাফুর রহমান চৌধুরী (এনডিএফ ছেড়ে আওয়ামী লীগে) এর সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগের শ্রীমঙ্গল থানা কমিটি গঠন করেন—যা' স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের যাত্রার মূল ভিত্তি হিসেবে আজও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুর আস্থা ও সংগঠনে তাঁর ভূমিকা
১৯৭০ সালে বৃহত্তর সিলেটের আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনকল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সুনামগঞ্জের আব্দুস সামাদ আজাদ, হবিগঞ্জের দেওয়ান ফরিদ গাজী ও বাহুবলের কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁর বাড়িতে আসেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জনপ্রিয়তা, সততা ও সাংগঠনিক দক্ষতা দেখে তাঁকে ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে মনোনয়ন দেওয়ার আশ্বাস দিলেও পরবর্তীতে রহস্যজনকভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।
১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক, চিকিৎসক ও দেশপ্রেমিক
১ মার্চ ইয়াহিয়ার ঘোষণার পর শ্রীমঙ্গলে ন্যাপ ও আওয়ামী লীগের বিশাল প্রতিবাদ মিছিলে তিনিও ছিলেন অন্যতম নেতা।
২৭ মার্চ শ্রীমঙ্গল পৌরসভাকে কন্ট্রোল রুম করে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী ও ব্রিগেডিয়ার পান্ডে আসেন। সেখানে ডাক্তার আব্দুল আলী মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার দায়িত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২৮ মার্চ গঠিত ৫ সদস্যের সংগ্রাম কমিটিতে তিনি ছিলেন সদস্য—যা' শ্রীমঙ্গলের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মূল সংগঠন। সংগ্রাম পরিচালনা কমিটির সদস্যরা হলেন যথাক্রমে ফরিদ আহমেদ চৌধুরী আহ্বায়ক, সদস্য পদে মহিবুর রহমান, কমলেশ ভট্টাচার্য, সাইয়িদ মুজিবুর রহমান ও ডাঃ আব্দুল আলী ।
৩১ মার্চ তিনি কর্নেল আব্দুর রব, মোঃ ইসমাইল হোসেনসহ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ইপিআর জওয়ানদের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত করেন।
পাকবাহিনীর সাঁড়াশি হামলার মুখে তিনি সীমান্ত দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন এবং পুরো নয় মাস কমান্ডার মানিক চৌধুরীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ কাজে নিবেদিত থাকেন।
স্বাধীনতার পর শ্রমিক অধিকার ও রাজনৈতিক সংগ্রাম
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে চা শ্রমিকদের আন্দোলনে তিনি শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের পক্ষে দাঁড়ান।
উপ
১৯৭৩ সালে সাধারণ জনগণের চাপে তিনি ঘড়ি মার্কা নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন এবং অল্প ভোটে পরাজিত হন।
পরে এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত থানা সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পারিবারিক জীবন
১৯৬৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার সদর থানার কাগাবলা ইউনিয়নের মিলনপুর গ্রামের মরহুম জহির উদ্দিনের দ্বিতীয় কন্যা আখলাতুন নাহারের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন । তাঁদের চার কন্যা—সামিউন নাহার, জামিলুন নাহার, আমেনা বেগম, ডাঃ আবেদা বেগম—এবং একমাত্র পুত্র আবুল ফজল মোঃ আব্দুল হাই ডন।
মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা এবং অবসান
১৯৮১ সালের ১ ডিসেম্বর আলিয়াছড়া পান পুঞ্জিতে রোগী দেখতে যাওয়ার পথে ঢাকা -সিলেট মহাসড়কে শ্রীমঙ্গল থানার সাতগাঁও চা-বাগান এলাকায় দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। মুমূর্ষ অবস্থায় তাঁকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার অবস্থা অবনতি দেখা দিলে পরদিন ২ ডিসেম্বর তাঁকে বিমান যোগে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ ডিসেম্বর বিকাল চারটায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এক জীবনের আলো বহু প্রজন্মের অনুপ্রেরণা
ডাক্তার মোঃ আব্দুল আলীর জীবন ছিল আদর্শ, ত্যাগ, সততা ও মানবতার এক দীপ্ত মহাকাব্য। সারা জীবন তিনি মানুষের সেবা করেছেন, রাজনীতিতে সততার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ না করেও অগণিত যোদ্ধার জীবন বাঁচিয়েছেন।
আজকের সমাজ, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক অঙ্গন—সবখানেই তাঁর মতো মানুষদের প্রয়োজন ছিল, আছে এবং থাকবে। তাঁর কর্ম, তাঁর ত্যাগ এবং তাঁর অনড় আদর্শ আগামী প্রজন্মের কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাতে থাকবে।