img

মোহাম্মদ ইলিয়াস: একজন জাতীয় নেতা ও ভাষাসেনানী

প্রকাশিত :  ০৬:০৮, ২৮ নভেম্বর ২০২৫

সততা, ত্যাগ ও মানবিক রাজনীতির এক অনন্য প্রতীক

মোহাম্মদ ইলিয়াস: একজন জাতীয় নেতা ও ভাষাসেনানী

সংগ্রাম দত্ত: বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার ইতিহাসে অসংখ্য বীরের নাম উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকলেও আলোচনার বাইরে থেকে যান অনেক নীরব সংগ্রামী। তেমনি এক বিস্মৃত নায়ক মোহাম্মদ ইলিয়াস—ভাষা আন্দোলনের অন্তরালের সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সমন্বয়কারী, তিনবারের এমপি, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মূল্যবোধে অটল এক কিংবদন্তি নেতা। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল সংগ্রাম, সাহস, সততা ও নীতির অনন্য সমন্বয়—আর ব্যক্তিজীবন ছিল অবিশ্বাস্য রকমের সাদামাটা ও আড়ম্বরহীন।

ধলাই নদীর পাড়ে জন্ম নেওয়া আলোকিত শিশু

১ অক্টোবর ১৯২৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা (বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার) খুশালপুর গ্রামে শিক্ষিত ও সম্মানিত এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

চা–বাগান, ধলাই নদী, লাউয়াছড়া বনের সবুজ–সতেজ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এই মেধাবী শিশুটি শৈশবেই দেখিয়েছিলেন বুদ্ধিমত্তার দীপ্তি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত মেট্রিক পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত আইএসসি পরীক্ষায় নবম স্থান অর্জন করেন।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত ও সংখ্যাতত্ত্বে অনার্স করে তিনি গড়ে তোলেন এক উজ্জ্বল শিক্ষাজীবনের ইতিহাস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তরালের ভাষাসৈনিক

ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচির বাইরে তাঁর নাম যতটা না শোনা যায়, অন্তরালে তিনি ছিলেন ততটাই সক্রিয়।

কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশনায় মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ৬ নম্বর কক্ষে বসেই তিনি আন্দোলনের নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন।

তিনি ছিলেন প্রচার–বিমুখ; শোরগোল নয়—বিশ্বাস করতেন নীরব ও কার্যকর সংগঠনে।

এ কারণেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর অবদান আজও যথার্থ মূল্যায়নের অপেক্ষায়।

পরবর্তীতে তিনি জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হন—তাঁর নেতৃত্বে ছাত্ররাজনীতি পায় সংগঠিত ও শক্তিশালী ভিত্তি।

শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপসহীন যোদ্ধা

পাকিস্তানি শাসনের সময় তিনি ছিলেন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নির্ভীক কণ্ঠ।

হুলিয়া, গ্রেফতারি পরোয়ানা, নিষেধাজ্ঞা—কিছুই তাঁর নীতি ও দৃঢ়তা টলাতে পারেনি।

শ্রীমঙ্গল–কমলগঞ্জ অঞ্চলে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ত্যাগী ও চিন্তাশীল রাজনৈতিক কর্মীবাহিনী।

তিনি ছিলেন গভীর অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী।

সমাজে কারো দ্বারা ঘৃণা, বিভেদ বা বিদ্বেষের সৃষ্টি হলে তিনি স্পষ্ট ও দৃঢ় ভাষায় প্রতিবাদ করতেন।

শান্তি, সহিষ্ণুতা ও মানুষের কল্যাণ ছিল তাঁর নীতি–দর্শনের ভিত্তি।

ছাত্রনেতা থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা

ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), পরে আওয়ামী লীগ—এভাবেই তাঁর রাজনৈতিক পথচলায় যুক্ত হয়েছে নানা অধ্যায়।

১৯৬৯ সালের উত্তাল সময়ে তিনি শ্রীমঙ্গল শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের জনপ্রিয় নেতা ডাঃ আব্দুল আলী এবং ফুলছড়া চা–বাগানের হেডলার্ক মোঃ আলতাফুর রহমান চৌধুরী (এনডিএফ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী)–এর সঙ্গে মিলে শ্রীমঙ্গলে আওয়ামী লীগের থানা কমিটি গঠন করেন।

এই তিনজনের নেতৃত্বেই শ্রীমঙ্গলে আওয়ামী লীগের সংগঠিত রাজনীতির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়—যা এলাকার রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

১৯৭০ সালে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে এমএনএ নির্বাচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ৪ নম্বর সেক্টরের রাজনৈতিক সমন্বয়কারী হিসেবে পালন করেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নের আলোচনাতেও তিনি ছিলেন সক্রিয়।

চা–শিল্পের সংকটকালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে BTIMC–এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেন।

মৌলভীবাজারে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতেও তাঁর অবদান ছিল অনন্য।

নির্বাচন রাজনীতিতে তাঁর বিজয়গাথা

১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ (মিজান)–গ্রুপের প্রার্থী সত্যেন্দ্রকুমার রায় (এস কে রায়)–এর সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিয়ে সুস্পষ্ট ব্যবধানে বিজয়ী হন।

পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তাঁর পুরনো রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিপ্লবী মফিজ আলীর বিরুদ্ধেও লড়াই করেন।

উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও আবারও বিজয়ী হন তিনি।

তৃণমূলের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এবং সততার প্রতি মানুষের আস্থাই তাঁর বিজয়ের প্রধান শক্তি ছিল।

অসাধারণ সততার প্রতীক—‘গরিব এমপি’র বিরল উদাহরণ

এলাকার প্রবীণদের মতে, শ্রীমঙ্গল–কমলগঞ্জে তাঁর মতো সৎ, নীতিবান, গরিব–ঘনিষ্ঠ এমপি আর দেখা যায়নি।

তিনবারের এমপি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ছিল না কোনো ব্যক্তিগত বাড়ি, জমিজমা বা ব্যক্তিগত গাড়ি—রাজনীতিতে যা আজ বিরল।

তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্য সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত।

সাধারণ একটি শার্ট ও লুঙ্গিই ছিল তাঁর প্রতিদিনের পোশাক—এই পোশাকেই তাঁকে দেখা যেত হাটে, বাজারে, মানুষের মাঝে কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে।

বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে তিনি পায়ে হেঁটে বাজার করতেন, আবার পায়ে হেঁটেই ব্যাগ হাতে বাড়ি ফিরে যেতেন—ক্ষমতার রাজনীতিতে যা আজ সত্যিই বিস্ময়কর।

তাঁর মতো সততা, মানবিকতা ও নিষ্ঠার উদাহরণ আজকের রাজনীতিতে বিরল—এবং ভবিষ্যতে তা পাওয়া যাবে কিনা, অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন।

শ্রীমঙ্গলের আরও দুই সৎ, নির্ভীক ও আদর্শবান নেতার উল্লেখ

এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসে মোহাম্মদ ইলিয়াসের সততার সঙ্গে আরও দুটি নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

ন্যাপ ( মোজাফফর) এর রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক রাসেন্দ্র দত্ত চৌধুরী যিনি শ্রীমঙ্গল উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, আর অপরজন প্রখ্যাত চা–শ্রমিক নেতা সুরেন্দ্র চন্দ্র বুনার্জী, যিনি ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত একটানা কালীঘাট ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন।

তারা উভয়েই কোনো অর্থব্যয় বা প্রচারের বাহুল্য ছাড়াই—শুধু সততা, আদর্শ, নৈতিকতা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার শক্তিতে—সর্বাধিক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। যা\'  বর্তমান

ভোটের রাজনীতির এ যুগে এমন উদাহরণ সত্যিই বিরল ও গল্পের মত মনে হয় ।

চা–শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে পথিকৃৎ

চা–বাগান কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও উপদেষ্টা হিসেবে তিনি আজীবন শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করেছেন।

স্কপ আন্দোলনে চা–শ্রমিকদের সম্পৃক্ত করায় তাঁর ভূমিকা এখনো স্মরণীয়।

১৯৯৬ ও ২০০৮—দুবারই উপেক্ষিত স্বীকৃতি

দীর্ঘ সংগ্রাম ও অবদানের পরও দলীয় স্বীকৃতি তাঁকে ঘিরে উপেক্ষিতই থেকেছে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাঁর স্ত্রীকে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।

২০০৮ সালেও তাঁর অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন হয়নি।

দুঃখজনকভাবে, তাঁর রাজনৈতিক দল বা সংগঠনগুলো তাঁর স্মরণে কোনো জাতীয় বা স্থানীয় পর্যায়ের শোকসভাও আয়োজন করেনি।

সংস্কৃতি ও প্রতিরোধ—যোগীবিল উৎসব

১৯৮৩ সালে তাঁর উদ্যোগে যোগীবিলে অনুষ্ঠিত গণসংস্কৃতি উৎসব ছিল স্বৈরাচারবিরোধী সাংস্কৃতিক সংগ্রামের এক অনন্য মঞ্চ।

পুঁথিপাঠ, সারি–জারি, গণনাটক—সব মিলিয়ে এটি শোষণবিরোধী লোকসংস্কৃতির জাগরণ ঘটায়।

পরিবার—শক্তি ও বেদনাবিধুর অধ্যায়

স্ত্রী মনোয়ারা ইলিয়াস ছিলেন তাঁর নীরব ও ধৈর্যশীল সহযাত্রী।

ছয় কন্যা ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে গড়ে ওঠে তাঁদের পরিবার।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁদের একমাত্র ছেলে ও এক কন্যা মৃত্যুবরণ করেছেন।

বর্তমানে শতবর্ষের প্রান্তে থাকা মনোয়ারা ইলিয়াস বার্ধক্যজনিত রোগে শয্যাশায়ী।

মাত্র ৫৮ বছরেই অবসান এক আলোকিত জীবনের

২১ নভেম্বর ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

মাত্র ৫৮ বছর বয়সেই থেমে যায় এক আলোকিত, সৎ ও প্রেরণাদায়ক নেতার পথচলা।

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি—এখনো কেন নেই?

ভাষা আন্দোলনের অন্তরালের সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সমন্বয়কারী, সংবিধান প্রণয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, চা–শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ, সৎ সংসদ সদস্য ও মানবিক নেতা—সব মিলিয়ে মোহাম্মদ ইলিয়াসের অবদান অপরিমেয়।

তাঁর স্মৃতির প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি—বিশেষ করে একুশে পদক—এখনই সময়ের দাবি।

মোহাম্মদ ইলিয়াস ছিলেন ক্ষমতার রাজনীতির বাইরে একজন আদর্শ মানুষের প্রতিচ্ছবি।

রাজনীতি তাঁর কাছে ছিল মানুষের সেবা—স্বার্থ, লোভ কিংবা সুবিধা নয়।

তাঁর সততা, সাদামাটা জীবন, সাহস ও নীতিনিষ্ঠ চিন্তা আজও রাজনীতির জন্য বিরল প্রেরণা।

সিলেটের খবর এর আরও খবর

img

কোম্পানীগঞ্জে ঘর থেকে ধরে নিয়ে ৬ বছরের শিশুকে যৌন নির্যাতন

প্রকাশিত :  ১৫:৩৯, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে ছয় বছরের এক শিশু যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠেছে। আক্রান্ত শিশুর চিৎকারে এলাকাবাসী অভিযুক্ত যুবককে আটক করে পুলিশে হস্তান্তর করেছে। আক্রান্ত শিশুকে কোম্পানীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

এলাকাবাসী জনানা, বুধবার দুপুরে ওই শিশু (৬) কে নিজ বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় প্রতিবেশি আব্দুর মছাব্বির ওরফে মনা। এর পর নির্জন স্থানে যৌন নির্যাতনের চেষ্টা করে। শিশুটি চিৎকার শুরু করলে এলাকাবাসী সেখানে চলে আসে। ঘটনার পরপরই শিশুকে উদ্ধার হয়।

অভিযুক্ত আব্দুর মছাব্বির ওরফে মনা (২১) কে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। কোম্পানীগঞ্জের ডাকঘর গ্রামের বাসিন্দা।

কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রতন শেখ জানান, অভিযোগ পাওয়ার পরই পুলিশ শিশুকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও হেফাজতে রাখা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে তিনি জানান।