মাগুরছড়া পুঞ্জিতে রঙিন সমাগম : ঐতিহ্যের টানে 'খাসি সেং কুটস্নেম ২০২৫'
সংগ্রাম দত্ত: মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া পাহাড় এলাকায় অবস্থিত মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি।
সবুজে মোড়া এই পাহাড়ি গ্রামটিতে শনিবার (২২ নভেম্বর ) সকাল থেকেই নেমে আসে এক উৎসবের আমেজ। পাহাড়ি বাতাসে ভেসে আসে ঢোলের ছন্দ, বাঁশির সুর আর হাসির কলতান। বছরজুড়ে অপেক্ষার পর আজ সেই দিন—খাসি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ উৎসব ‘খাসি সেং কুটস্নেম ২০২৫’।
পুঞ্জির সরু পাহাড়ি পথ ধরে সকাল ৯টার পর থেকেই আসতে শুরু করেন বিভিন্ন পুঞ্জি থেকে খাসিয়া পরিবার, প্রবীণরা, যুবক-যুবতী এবং শিশুরা। রঙিন পোশাকে সজ্জিত মানুষের পদচারণায় পাহাড় যেন হয়ে ওঠে উৎসবের মঞ্চ।
সংস্কৃতির রঙে রঙিন এক দিন
উৎসবের সূচনায় ছিল খাসিয়া সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা। প্রবীণরা তুলে ধরলেন তাদের পূর্বপুরুষের জীবনসংগ্রাম ও ঐতিহ্য রক্ষার গল্প। তরুণেরা শোনে মনোযোগ দিয়ে—কারণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধেই তো ঐতিহ্য বহনের দায়িত্ব।
মাঠে তখন রংমেলার উৎসব—খাসিয়া নারীদের পরিচিত রঙিন পোশাক, গলায় অলঙ্কার, আর শিশুদের দৌড়ঝাঁপে ভরে ওঠে পুরো পরিবেশ।
জিং শাদ—ছন্দে ছন্দে উৎসবের প্রাণ
বিকেলের দিকে শুরু হয় খাসিদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য ‘জিং শাদ’। ঢোল, টাল-ডম আর বাঁশির সুরে নৃত্যশিল্পীরা যখন গোল হয়ে তাল মিলিয়ে নাচে, দর্শকের চোখে-মনে জমে ওঠে পাহাড়ি সংস্কৃতির মোহময়তা।
এর পাশাপাশি খাসি লোকগীতি, ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র পরিবেশনা, সেলফ-হেল্প গেমস, লেহকাই প্রতিযোগিতা, লাকি কুপন ড্র—সব মিলিয়ে দিনটি হয়ে ওঠে খাসি সংস্কৃতির বহুমাত্রিক উৎসব।
শুধু উৎসব নয়—অস্তিত্বের প্রকাশ
উৎসবের আয়োজক খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল (KSC) জানায়, ‘সেং কুটস্নেম’ তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম প্রধান প্রতীক।
পুঞ্জির এক প্রবীণ বলেন,
“এই উৎসব আমাদের শেকড়কে মনে করিয়ে দেয়। ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার শক্তি এখান থেকেই আসে।”
সংগ্রামের ভেতর ঐতিহ্য রক্ষার গল্প
মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি বহু বছর ধরে নিজের সংস্কৃতি ও পাহাড়ি পরিবেশ রক্ষায় সংগ্রাম করে আসছে। ভাষা, নৃত্য, গান, পোশাক—এসবের মধ্যেই টিকে আছে তাদের স্বাতন্ত্র্য। তাই ‘খাসি সেং কুটস্নেম’ কেবল আনন্দ নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক অবস্থান, আত্মপরিচয়ের ঘোষণা।
দিনশেষের আলোয় পাহাড়ি শান্তি
বিকেল ৫টা নাগাদ আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও পুঞ্জির ভেতর তখনো রয়ে যায় উৎসবের রঙ। শিশুদের হাসি, ঢোলের প্রতিধ্বনি আর লোকগানের সুর যেন বাতাসে গেঁথে থাকে। একটি ছোট্ট খাসিয়া শিশু উৎসবমুখর মাঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল—
“আগামী বছরও আবার হবে, তাই না?”
এই প্রশ্নেই যেন খাসি সংস্কৃতি টিকে থাকার প্রতিশ্রুতি খুঁজে পায়।



















