ইমরান চৌধুরী

img

ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন

প্রকাশিত :  ০১:২৭, ১৫ এপ্রিল ২০২১
সর্বশেষ আপডেট: ০৩:৩১, ১৫ এপ্রিল ২০২১

ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন

ও হে নবীন - ও হে তরুণ - বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম লহ মোর শুভেচ্ছা বাংলাদেশের এই সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের মহাসমারোহে । আজকের তরুণ, তরুণী  যুবক, যুবতী এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে জন্মগ্রহণকারী সকলকে জানাতে চাই আমার অনুধাবিত এবং আমার দেখা শুভক্ষণ ও দুঃসময়ের উপাখ্যান।

আমি ১৯৭১ সালের এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, আমি এক ১৭ বছর বয়সী  শহীদ মুক্তিযোদ্ধার অনুজ এবং আমি  এক ১১ বছর বয়সী শরণার্থী ( রিফুজি) বালক। স্বাধীনতা যুদ্ধ যারা স্বচক্ষে অবলোকন করে নাই তাদের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের বর্বরতা, স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহতা, স্বাধীনতা যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার অসহায়ত্ব, গৃহহীনতা, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার জীবন হারানোর ভয়, মুক্তিযোদ্ধা পিতার জীবন যে কোন সময় হারানোর দুঃস্বপ্ন, বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পরে যাওয়ার সদা সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত থাকা, অনাহারে দিনের পর দিন কাটানোর কথা বলা এবং সেই সময়কার চিত্র অঙ্কন করা সত্যিই একটা অসাধ্য ব্যাপার ।আমি চাই না আমার সবচে’ বড় শত্রুও কোনদিন এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হোক।

স্বাধীনতা যুদ্ধ সেদিন হয়েছিল বলেই আজ আমরা পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে বাংলাদেশি বা বাঙ্গালী হিসেবে পরিচিত - একবার শুধু ভেবে দেখুন সেদিন যদি আমার বা আপনার পূর্ব পুরুষরা ঐ স্বৈরাচারী, বর্বর, পাষন্ড, পাঞ্জাবি মুসলিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়ে নিজেদের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ না করতো  তাহলে আজ আমরা  কোন পরিচয়ে পরিচিত হতাম সারা পৃথিবীর কাছে? এক পরিচয়বিহীন, অস্বীকৃত, ঔপনিবেশিক, বিদেশী, আগ্রাসী, খুনি, নারীর ইজ্জত লুটকারি এবং বর্ণ বৈষম্যপূর্ণ একদল পিশাচের সংস্পর্শের পরিচয়ে পরিচিত হতে হত আমাদেরকেও আজও। আপনারা অতীব ভাগ্যবান কারণ আপনাদের পূর্বপুরুষরা ছিল এক অপরিসীম সাহসী বাংলা মায়ের দামাল ছেলে ওরা - ওঁরা যদি সেদিন ঝাঁপিয়ে না পরত, ঐ পৈশাচিক, লুটেরা, আমাদের মা ও বোনদের সম্ভ্রম - ইজ্জত লুণ্ঠনকারীদের হাত থেকে বাংলাকে না বাঁচাতো তাহলে আজ আমাদের ইতিহাস লেখা হত হয়ত  অন্যভাবে।

তাই, বারবার ফিরে যাই সেই সোনালী অতীতের স্মৃতিগুলোকে মনের সেলুলয়েডের ফ্রেমে অবলোকন করতে আর পুনরুজ্জীবিত হতে চাই নতুন উদ্দীপনায় আজকের প্রজন্মকে জানাতে - কি হয়েছিলো? সেই কালো অমাবস্যার ১৯৭১ সালে। কিভাবে ঐ পিশাচ গুলো নিগৃহীত করেছিল বাংলার সাত কোটি মানুষকে - ওদের কাছে ছিলনা আমাদের  জন্য কোন সম্মান, না ছিল কোন তোয়াক্কা আমাদের ধর্মের, ওরা জানতে চায়নি আমরা কারা - আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীরা সবাই ছিলাম ওদের হত্যাযজ্ঞের বলির পাঠা, ওদের রক্তপিপাসার পানীয়, ওদের যৌন উন্মাদনার পাশবিক অত্যাচারের এক শাবক, ওরা নয় মাস যাবত চালিয়েছিল আমাদের উপর পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম জেনোসাইড, যা কিনা হিটলারের ইহুদি ফাইনাল সল্যুশন থেকেও জঘন্য এবং ঐ পৈশাচিক পাকিস্তানি বর্বর আর্মিও আমাদেরকে বাংলার মাটি থেকে চিরতরে উৎপাটন করার প্রয়াস চালিয়েছিলো। ওরা চেয়েছিল আমাদের সবাইকে হত্যা করে - উৎপাটন করে ওরা বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিহারি, কাশ্মীরি, মুহাজিরদের (করাচী)  দিয়ে নতুন বসতি গড়ে তুলতে যাতে করে কেউ আর  কোনদিন স্বাধিকার, ভাষা, গণতন্ত্র, সমান অধিকার না চাইতে পারে। এই অভিপ্রায়েই ওরা চেয়েছিল বাঙ্গালীদেরকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে।


বাংলার ৪ হাজার বছরের ইতিহাসে সবচে বড় ক্রান্তিকাল, সবচে বড় বিপদ, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আগ্রাসনের কালো থাবা নেমে এসেছিল একাত্তরের ২৫ মার্চের গভীর রাত থেকে পরবর্তী দিনগুলোতে। সেই দিন - লক্ষ কোটি মানুষের আহাজারি, কিংকর্তব্যবিমূর, ভীতি, গৃহহীনতা, আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যাওয়া বাড়ি ঘর, গুদাম, মিল কারখানা, নিজের দেশের বোমারু বিমান দিয়ে আঘাত হেনে উড়িয়ে দেয়া সব অবকাঠামো, প্রাণ নিয়ে পলায়নরত নিরস্ত্র মানুষের ওপর বিমান থেকে গুলি করে হত্যার উৎসব, মায়ের আর্তনাদ, শিশুদের কান্না, বাবার অসহায়ত্ব সব মিলিয়ে সে যে কি এক বিভীষিকাময় সময় শুরু হল সেই কালো রাত ২৫ সে মার্চ থেকে তা প্রকাশ করার মত কোন ভাষা আমার অভিধানে নেই ।

হাস্যকর হলেও সত্যি যে, ঐ সময়ে মধ্যপ্রাচ্য, নিকট প্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, উত্তর ও দক্ষিণ ও পশ্চিম এর সব দেশ এর  সবাই ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে ছিল অন্যদিকে। আবার কেউ কেউ ঐ পিশাচদের বাহবা এবং খোলাখুলি ও গোপনে অস্ত্র, বারুদ, গোলা, গুলি বানানোর ফ্যাক্টরি দিয়ে সাহায্যও করেছিল,  যুদ্ধ জাহাজ দিয়ে ভয় দেখাতেও পিছপা হয় নাই । আজ যদিও অনেকেই নতুন প্রজন্মকে মস্তিষ্ক ভ্রম  করতে যেয়ে কুম্ভীরাশ্রু ফেলে - নতুন গল্পজাল বিস্তার করতে। আর ছিল আরও এক দল যারা ছিল পঞ্চম বাহিনী - হাত মিলিয়েছিল আমাদের চিরশত্রুর সাথে - যারা হাত মিলিয়েছিল ঐ নরপিশাচদের সাথে হত্যাযজ্ঞের সাহায্যকারী হিসেবে, নারী ধর্ষণ করার সহায়তাকারি হয়ে, হত্যাকারীদের চোখ এবং কান হিসেবে গুপ্তচর হিসেবে নিজের মা, বোন ভাই এবং জন্মগ্রহণকারী মাটির সাথে করেছিল জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা - মুক্তিসেনাদের ধরিয়ে দিতে করেছিল ওরা সাহায্য ঐ বিশ্বাসঘাতক নরপিশাচ গোষ্ঠী ।

বাংলার আকাশের ঐ অমনিশা লগ্নে সাধারণ মানুষ জীবন বাঁচাতে, মা ও বোনদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে, ছেলেমেয়েদের জীবন বাঁচাতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশে - যে দেশের সাথে গাঁথা এবং সম্পৃক্ত আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস, আমাদের শিকড়, আমাদের সামাজিকতা,  আমাদের ভাগাভাগি করা ঐতিহ্য সেই ইন্ডিয়াতে। যখন ঐ পিশাচ বর্বর পাকিস্তানি মুসলিম আর্মি - আমাদেরকে মুসলিম  হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও ছিল ওরা নিমরাজি, কলেমা পড়লেও ওরা বিশ্বাস করতো না আমরা আসলেই মসুলমান কিনা! কারন ওদেরকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছিলো পূর্ব পাকিস্তানে ওমুসলিম বাঙ্গালীদের সাথে জেহাদ করার জন্য - তাই ওরা আমাদের ধর্মবিশ্বাসে ওদের আস্থা ছিল না এবং অবস্থাদৃষ্টে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, পশ্চিমের মুসলমানরা ঐ আমলে তাদের থেকে পূর্বে অবস্থিত মুসলমান জনগোষ্ঠীকে একটু নিচু চোখে দেখতো। তাই, ইসলাম ধর্মের প্রতি আমাদের আনগত্য, বিশ্বাসকে ওরা তাচ্ছিল্য করতো।

ঠিক একিভাবে এক বৃষ্টিভেজা কালো সন্ধ্যায় আমি আমার পরিবারসহ আশ্রয় নিলাম ইন্ডিয়াতে  -  ওঁরা আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলো না আমরা কারা? কি আমাদের নাম, কি আমাদের ধর্ম। আমাদের আগে ওঁদের দেশে আশ্রয় নিয়েছিল আমাদের সৈনিক, আমাদের যুবক, আমাদের নেতারা। ওঁদের দেশের মাটি থেকে ওঁদের সাহায্য - ওঁদের প্রশিক্ষণ, ওঁদের হাতিয়ার, ওঁদের গোলা বারুদ, ওঁদের দেওয়া আহার, কাপড়, জুতা, তাঁবু, গ্রেনেড, মাইন দিয়ে বাংলাকে শত্রু মুক্ত করে স্বাধীন করার লড়াইয়ে এক দুঃসাধ্য অভিযানে নেমেছিলো বাংলার দামাল ছেলেরা।
আমরা শরণার্থী - আমাদের জন্য বানালো ওরা রিফুজি ক্যাম্প, আমাদের জন্য রাতারাতি ব্যবস্থা করলো রেশন, চাল, ডাল, আটা, তেল, চিকিৎসা, বাস, ট্রেন সব বিনামূল্যে। এক থেকে দুই কোটি বাঙ্গালী পূর্ব পাকিস্তান থেকে জীবন বাঁচাতে শরণার্থী  হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে । নয় নয়টি মাস শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল ইন্ডিয়া - আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সব ধরনের সাহায্য করার পাশাপাশি ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে ৯ মাসের দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়েছিল।  এ ঋণ মানবতার, এ ঋণ মহানুভতার, এ  ঋণ আমাদের দেশের জন্য ওঁদের দেশের সেনাদের জীবন দানের ঋণ ।

আজ সেই দুঃসময়ের বন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন আমাদের দেশে আসে সেই সোনালি অতীতের শুভক্ষণ উদযাপনের জন্য তখনই দেখতে পাওয়া সেই পুরানো শত্রু আবার ভন্ডুল করতে চায় তাঁর শুভ আগমন। যখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেশুমারে পূর্ব পাকিস্তানি মুসলিমদের নির্মমভাবে হত্যা করলো সেটা নিয়ে তারা পাকিস্তানকে  কিছু বলে না। আমার ১৭ বছর বয়স্ক মুসলিম মুক্তিযোদ্ধা ভাইকে সদলবলে যখন পাকিস্তানি আর্মি আটক করলো এবং ১১ দিন নির্মমভাবে অত্যাচার করলো -  যা কিনা জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী নিষিদ্ধ এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে ঐ পিশাচ পাকিস্তানি মুসলিম আর্মি আমার কিশোর ভাইটিকে ১৯৭১ সালের  ২১ শে  নভেম্বর তারিখে ঈদ উল ফিতর দিন রাত্রে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করলো - এটার কোন প্রতিবাদ তারা করে নাই! করে না! এবং কখনো করবেও না!

পক্ষান্তরে, মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে আমাদের দেশের, আমাদের বাঙ্গালীদের সবচেয়ে দুঃসময়ের বন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যে প্রলয় তারা চালানোর চেষ্টা করেছে তা’ কি বলার অপেক্ষা রাখে এরা কারা? কি তাদের বর্ণ পরিচয় ? কেন তাদের এত গাত্রদাহ? কেন তাদের ক্ষোব, কেন তাদের এত প্রতিহিংসা? কি প্রমাণ করতে চাইল তারা? তাদের অনিচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট বাংলাদেশ তারা আজও মেনে নিতে পারে নাই। তারা বাংলাদেশকে  তালেবান জাতীয় একটা সন্ত্রাসী অকার্যকর, অরাজকতার রাজ্যে পর্যবসিত করতে চায়। তারা মানতে পারছে না তাদের পূর্বপুরুষদের সেই পরাজয় । তারা চায় বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষ, অনাহারের, সংকটময় জনপদ বানাতে - এবারের এই প্রলয়ঙ্কর তান্ডব কি তাই প্রমাণ করে না?

নতুন প্রজন্ম! আপনারাই উপলব্ধি করুন বুঝতে চেষ্টা করুন আসল সত্যটা কী? একটা কথা সবাই কে মনে রাখতে হবে - একদা যে বিশ্বাসঘাতক, সে সর্বদাই  বিশ্বাসঘাতক, একদা যে শত্রু, সে সর্বদাই শত্রু !

ইমরান চৌধুরী: লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কমিউনিটি একটিভিস্ট

মতামত এর আরও খবর

img

উন্মুক্ত বিবেক, মুক্ত ফিলিস্তিন!!

প্রকাশিত :  ০৭:৩৬, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:৫২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

নুজহাত নূর সাদিয়া

আহা ! বুকের পাঁজর ভাঙা গগনবিদারী আর্তনাদ , নাহ-কোন নিরব জঠর যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাওয়া গর্ভবতী মায়ের নবজাতক জন্ম দেওয়ার অবিস্মরণীয় ক্ষণটি উদযাপনের আনন্দচ্ছোস নয়, এ যে সহস্র দিনের গ্লানি শেষে এক নিকষ কালো আঁধার পেরিয়ে মাতৃভূমির বুকে নির্ভীক পা রাখা । আবার সেই চিরপরিচিত সবুজ দুর্বা ঘাসে ছুঁটে বেড়ানো , বাড়ন্ত স্কোয়াশের পূর্ণ ঝুঁড়ি, মাংসের রসাল স্যুপ, হাতে বানানো গমের রুটি সহযোগে উদর পূর্তির সেই পারিবারিক সুখস্মৃতি , মায়ায় জড়ানো বছর পার করে দেওয়া সংগ্রামী পরিবারগুলো ফিরে কি পাবে তাদের সেই প্রাণোচ্ছল ফিলিস্তিন । বহু চর্চিত এই প্রশ্নটির উত্তর অজানা আশংকা আর অনিশ্চয়তার অদৃশ্য গেরোতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকলে ও বিপরীত শিবিরে ও বহু দিনের ঘরবন্দী প্রিয়মুখগুলো স্বজনদের বাহুডোরে ফেরার অপেক্ষায় । আগ্রাসী ইসরায়েলের ধূলো উড়ানো পথ ও যে আজ শান্তিকামী মানুষের স্বতস্ফূর্ত হাসিতে ভরপুর। 

আনুষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী, মোট হতাহতের সংখ্যা  ৬৬,০০০ হাজার ছাঁড়িয়ে গেছে, জীবন-ভর পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে ২,৫০,০০০ জন হতভাগ্যকে , বেঁচে যাওয়া অসংখ্য দুরন্ত শৈশব বাকিটা জীবন সম্ভবত এক দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবে, আকাশ ছোঁয়া দালান , সুসজ্জিত স্থাপনা আর পুরাকীর্তির শহর ফিলিস্তিন আজ এক মৃতপ্রায় ভুতুড়ে নগরী ।

এই যে  ক্ষতি , তা সন্দেহাতীতভাবেই অপূরণীয় ক্ষতি । নেতানিয়াহু নামের এক বিকট দানবের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর অপরিণামদর্শী যুদ্ধ কৌশলের খেস ারত দিতে হল ফোরাত নদীর তীরবর্তী নিরীহ প্রাণগুলোর। বিশ্ব মানচিত্র হতে ফিলিস্তিন নামক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটি ( গাজা প্রায়২১ লক্ষ লোকের আবাস) মাত্র মাসখানিক আগে ও নিরবে মুছে যাচ্ছিল ধনী রাষ্ট্রের তাবেদার মুসলিম বিশ্বের অলস শাসনকর্তাদের নির্লিপ্ত আচরণের কারণে । মুসলমান ভাই -ভাই, জুলুমবাজের নিস্তার নাই, বিপন্ন মানবতা বহুল চর্চিত প্রবাদগুলো নিতান্তই খাঁচায় বন্দি তোতাপাখির মুখস্থ বুলির মত আউড়ে চলছিল বিশ্বরাজনীতির মোড়লরা । তবে কি, আমজনতার পরম আরাধ্য পার্থিব জীবনের ও সমাপ্তি আছে, আর সেই সমাপ্তি বরাবরই ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়েছে স্রষ্টার একান্ত ইচ্ছেয়, অসহায়ের পূর্ণ সমর্থনে আর দিনশেষে সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ে ।

গৃহকোণের শান্তি গৃহকর্ত্রীর পরম প্রিয়, আর সেই শান্তির সুশীতল পরশ এ ভূগোলকের পরতে পরতে ছঁড়িয়ে দিতে যে উদ্যোগী মানুষগুলো অনন্য সাধারণ কাজগুলোকে বাস্তবতার আলো দেখান সে মানুষগুলোই কর্মকুশলতায় অর্জন করে নেন সর্ব্বোচ সম্মান -নোবেল । এ নোবেল প্রাপ্তি, কার ও দারিদ্র্য বিমোচনে, চলতি ‘২৫ সালে বিতর্কিত মারিয়া কোরিয়া মাচানো -যার রাষ্ট্রীয় নীতি বহু অসহায় মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে, প্রাক্তন  যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক সহ শান্তিতে নোবেল পাওয়া আলোচিত মানুষগুলো পুরষ্কারের কোঠা না মানদন্ড না তাদের কাজের বিষয় এ সূক্ষèাতিসূক্ষè বিষয়গুলো

রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, আর স্বেচ্ছাচারী কর্তা যখন নিজ খেয়াল-খুশি মত আইন -কানুন তৈরি করে অসহায়দের উপর তা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন তখন তা ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা জায়ানবাদীদের  আধিপত্য আর কতৃর্ত্ববাদের নির্মমতার করুণ পুনরাবৃত্তি বই আর কিছুই নয় । আর ও নির্মম কৌতুক, একদা জায়ানবধের রাজ্য বলে খ্যাত , হিটলারের জার্মান, মাঁখোর  ফ্রান্স , কূটনৈতিক ব্রিটেন সহ দু‘মুখো আরব বিশ্ব সকলে এ নির্মম রসিকতায় সামিল ! দুনিয়া যে ক্ষমতা আর অর্থের পূজারী - পড়ন্ত বেলার প্রাজ্ঞ প্রবীণদের গভীর হতাশার সুরে তা সুস্পষ্ট ।

রুপকথার গল্পের চেয়ে ও বাস্তব জীবনের গল্প অনেকসময় অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠে , হয়ে উঠে প্রকৃত রুপক নতুবা তার চেয়ে ও শক্তিশালী আখ্যান । বিশ টি বছর ধরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর নানা প্রতিকুলতায় অবরুদ্ধ হামাস , ঠিক জিতে গেল সাহস আর দেশের প্রতি ভালবাসাকে হৃদয়ে লালন করে।

আর, সেই ছোট্ট গেরিলা সদস্যের দলটি আজ কত বড়! মানচিত্র ছাঁড়িয়ে , সীমানা ছাঁড়িয়ে নব প্রজন্মের অকুতোভয় হামাসরা আজ দুয়ারে দাঁড়ানো দৃঢ় দ্বাররক্ষী । তারাই পারে ,তথাকথিত অজেয় পশ্চিমা শক্তিকে শান্তিচুক্তি নামক সে নাটকীয় ঘটনার অন্যতম যোগানদার করতে। মার্কিন সরকার প্রধান উপযাচক মাত্র-পরিস্থিতি বুঝেই হয়তবা বন্ধুর পথে হাঁটতে চাইছেন, ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বর্মটি যে ভিষণ শক্তপোক্ত ও একরোখা ।

তবে, মধ্যপ্রাচ্যে ছঁড়ি ঘুরানোর দীর্ঘদিনের শক্তলাঠিটি কে যে এবার বাঁকাতেই হয় ।  সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙবে না, হায় বেনিয়ামিন  কি অসম্মানের এক পরাজয় ! কি অপেক্ষা করছে দুর্নীতি মামলায় জর্জরিত বুড়ো নেকড়েটির কপালে -বিধ্বস্ত চেহারায় কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো দীর্ঘতর হচ্ছে বৈকি।

প্রতিরোধ, যুদ্ধের নামে আগ্রাসন আর বসতি স্থানান্তরের নামে বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক শরণার্থী , আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় হয়তবা এখন পর্যন্ত বিজয় উদযাপনে ব্যস্ত । তবে নারীর প্রতি সম্মান রক্ষার্থে ট্রাম্প তার প্রাক্তন রাজনৈতিক প্রতিদন্বী বারাকের উপর সম্ভবত সচেতনভাবেই তার রাষ্ট্র পরিচালনার মেয়াদকালে বিতর্কিত সন্ত্রাসী বনাম ইসলামিক সেনাবাহিনী মতানৈক্যের বিষয়টির উপর  ইঙ্গিত দিয়েছেন । আর , ব্রিটিশ সংসদে চিত্রিত ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে পুরনো বন্ধু ব্লেয়ারের পদাংক অনুসরিত কিনা, তাই আপনমনে যাচাই-বাছাই করে চলেছেন। 

পরিস্থিতির পরিবর্তিত মোড় , কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন লিখিত শান্তি  চুক্তির যে ভিন্ন ভিন্ন ২০টি শর্ত শোভা পাচ্ছে  তার সুচারু বাস্তবায়ন খোদ ট্রাম্পের পক্ষেই যথেষ্ট দুরুহ । পেন্ডুলামের কাঁটা চলমান, হঠকারী ছোটভাই একবার নয় বেশ ক‘বার বড় ভাইয়ের অবাধ্য হয়েছেন , আস্ত উড়োজাহাজ উপহার আর বন্ধুপ্রতীম কাতারের উপর অর্তকিত আক্রমণ । রক্তে যার খুনে নেশা সে পাগলা ঘোড়া কি আদৌ থামবে ? বিলুপ্ত হিজবুল্লা, হুতির হারিয়ে যাওয়া হামাসের নেতৃত্বের শক্তি ক্ষয় , সিরিয়ায় ভাঙ্গন, ইরানের সফল প্রতিরক্ষার ব্যুহ ভেদ- আপাত , দ্বিধাগ্রস্থ ইসরাইল প্রধান সফলতার মাপকাঠিতে আত্নতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন হয়তবা ।  তবে,গাজামুখি সারি সারি ত্রাণবাহী গাড়ির বহরের দী¦প্ত যাত্রা কি তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় নি, নিশ্চিতভাবেই উত্তরটি হ্যা ।

কাঁকচক্ষু দৃষ্টিতে , দৃঢ়তা আর ন্যায়ের বিজয় তবে, অসম এ যুদ্ধে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের চড়া মূল্য দিতে হল  হামাসকে। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়  হামাস , নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক , প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। এই যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ সেই জীবননাশের মূল্য দিতে হল চরমভাবে-গত দু‘বছরে ৬৭,০০০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত । শক্তিশালী শত্রুর সাথে টক্কর লাগানো  কি এত সোজা!  লোকবল আর সামরিক শক্তিতে তুলনামূলক ভাবে পিঁছিয়ে, তবে কিনা নীতি আর ঈমানের শক্তিতে বরাবরি বলীয়ান হামাসিয়ানরা । তাই , এ ক্রান্তিকালে ও ধাপে ধাপে অধিকাংশ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল তারা, সর্বশেষ গাজায় ৪৮ জন বন্দী ছিলেন , বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবান ২০ জন। আর্ন্তজাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে দু‘ধাপে জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় হামাস গত ১৩ই অক্টোবর । মৃতদের মাঝে চার জনের মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা ও জানিয়েছে তারা।অপরদিকে, প্রতিপক্ষ ইসরাইলের আচরণ রুঢ়তার সীমা আকাশ  ছুঁয়েছে  বহু আগেই-কারাগারে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা এবং নিপীড়ন করা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যৌন হয়রানির খবর ও পাওয়া গেছে । আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আল-রিমায়ি বলেন- এ দু‘টি বছরে তার ওজন কমেছে ৫০ কেজি ! হাড় সর্বস্ব শরীর জড়িয়ে কন্যার ব্যাকুল আর্তি, বাবা আমি ব্যাথা পাই ।

এখন আবার ট্রাম্পের নতুন চমক, ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপনাস্ত্র উপহার দিবেন এই পাগলাটে রাষ্ট্রপতি রাশান যুদ্ধ থামাতে ।  শুরু হওয়া আফগান -পাকিস্তান সংঘাতে ও তালেবান দের ভূমিকা নিয়ে এক নতুন চেহারার ব্যবসায়ীকে দেখা গেছে -জামাতা কুশনারের ব্যবসায়িক বুদ্ধির জুড়ি নেই রাজনৈতিক বুদ্ধিতে ও যে  শ্বশুরকে ভবিষ্যতে টেক্কা দিতে সমর্থ  হবেন  তা তার সাম্প্রতিক স্রোত বুঝে চলার ই পরিপক্ক রুপ ।

আজকের এই পার্থিব পৃথিবীতে  স্রোতস্বিনী টেমস নদী ব্যবহারের মাসকাবারি বিল পরিশোধের সময় ও যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি মগজে নিত্য গেঁথে থাকে -প্রতিটি পানিবিন্দু পরিশোধে পাওনা প্রাপ্য ! অর্থাৎ, জীবনের অপর নাম পানি ও বাতাস সেবনে ও মূল্য চুকাতে হয়, তা যদি হয় কেনসিংটন নামক অভিজাত এলাকার মনোরম ব্যালকনির মুক্ত হাওয়া । বিনামূল্যে    সেবা, সে তো অতীতের গাল গল্প । অথচ, নিঠুর ইসরাইলী বাহিনী    গাজায় ৩০০০ জলপাই গাছ  কেটে , অগণিত বন্য ও পোষা  প্রাণী মেরে আক্ষরিক অর্থেই প্রকৃতিকে বিপন্ন করে  তুলতে চাইছিল  । সেই প্রকৃতিই কিনা আপন মহিমায়  নতুন বোনা জলপাই গাছের পাশ দিয়ে ছুটন্ত শিশুদের  সাদরে বরণ করছে যাদের খাঁচা ভর্তি প্রিয় পোষা  পাখিটির  গুঞ্জন।   

ফিলিস্তিন বাসীদের প্রিয় ম্যান্ডেলা ‘ আল ফাত্তাহ ‘ এখন ও জায়ানবাদীদের জিম্মায় ,  ইসরাইলী সেনাবাহিনী তাকে যমের মত ভয় পায় -যার মুক্তির আলো দেখা এখন ও সংশয়ে ভরা । সন্দেহাতীতভাবেই, তিনিই প্যালেস্টাইনি জনগণের অবিস্বরণীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী আন্দোলনের দিকপাল ।

আজকের দিনের ফ্রি পত্রিকাগুলোর অন্যতম স্লোগান-মুক্ত খবর, মুক্ত চিন্তা । আর বিশ্বজুঁড়ে এই প্রবল বিজয় উদযাপনে মানবতাবাদীদের একটাই আশা মুক্ত হোক মানবতা , জয় হোক শুভ বুদ্ধির।



নুজহাত নূর সাদিয়া,
এলবিপিসি, লন্ডন ১৪ই অক্টোবর‘ ২৫ সাল ।

মতামত এর আরও খবর