img

প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সম্মান ও সুরক্ষায় উদ্যোগ: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে করিম চাচার চিঠি

প্রকাশিত :  ২১:২৬, ৩০ আগষ্ট ২০২৪

প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সম্মান ও সুরক্ষায় উদ্যোগ: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে করিম চাচার চিঠি

দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলে পরিচিত প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অবদানের কথা বলতেই হয়। এদের কঠোর পরিশ্রমের ফসলেই বাংলাদেশ শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তবে, এসব প্রবাসী যোদ্ধাদের অনেকেই যখন দেশে ফেরেন, তখন তাদের প্রতি সঠিক সম্মান ও মানবিক আচরণ না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গৃহীত কিছু উদ্যোগ প্রবাসী কর্মীদের জন্য আশার আলো নিয়ে এসেছে।

সম্প্রতি, করিম চাচা নামের একজন প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধা, যিনি দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছর ধরে সৌদি আরবে কাজ করছেন, তিনি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠিতে তিনি প্রবাসী শ্রমিকদের বাস্তবতার কথা তুলে ধরেছেন এবং কিভাবে তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেও সম্মানহীনতার শিকার হন, সেই কথা ব্যক্ত করেছেন।

করিম চাচা তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন যে, প্রবাসে কাটানো ৪৫ বছরে তিনি কত যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাদ দিয়ে, তিনি দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু দেশে ফিরে যখন বিমানবন্দরে পৌঁছান, তখন ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস অফিসারদের রুক্ষ আচরণ ও হয়রানির মুখোমুখি হন। তাদের সামান্য জিনিসপত্রকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়, লাগেজ ভেঙে ফেলা হয়, এমনকি অনেক সময় চুরি হয়ে যায়।

প্রবাসীদের প্রতি এই অবমাননাকর আচরণের বিরুদ্ধে তিনি তার চিঠিতে গভীর কষ্ট প্রকাশ করেছেন। তবে, তিনি একইসঙ্গে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার নেওয়া কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন। করিম চাচা উল্লেখ করেছেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো প্রবাসীরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগে বিমানবন্দরে ফ্রি টেলিফোন ও ওয়াইফাই সুবিধা চালু করা হয়েছে, যা প্রবাসীদের পরিবারকে নিরাপদে পৌঁছানোর খবর জানাতে সহায়ক হয়েছে।

এছাড়াও, ড. ইউনূস এয়ারপোর্টে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন যে, কোনো লাগেজ হারিয়ে গেলে বা ভেঙে গেলে, সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বেতন কাটা হবে। এই পদক্ষেপগুলো প্রবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে এবং তাদের কষ্টার্জিত টাকার সুরক্ষা দিয়েছে।

করিম চাচার মতো অনেক প্রবাসীই মনে করেন, ড. ইউনূস তাদের সম্মান দিয়েছেন এবং তাদের কষ্টের মূল্য বুঝেছেন। তার এই উদ্যোগগুলোর জন্য প্রবাসী কর্মীরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। তারা আশা করছেন, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষদের জন্য আরও ভালো দিন আসবে।

তবে, করিম চাচা চিঠির শেষে আরও একটি অনুরোধ করেছেন। তিনি চান, এই নির্দেশনাগুলো কঠোরভাবে পালিত হোক এবং প্রবাসীদের সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিতে আরও উদ্যোগ নেওয়া হোক। তিনি দোয়া করেছেন, আল্লাহ ড. ইউনূসকে দীর্ঘজীবী করুন এবং আরও ভালো কাজ করার শক্তি দিন। তার মতে, ড. ইউনূস সবসময়ই প্রবাসী যোদ্ধাদের পাশে ছিলেন এবং থাকবেন।

করিম চাচার এই চিঠি শুধু তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন নয়, বরং লাখো প্রবাসী কর্মীর মনের কথা। তাদের প্রত্যাশা, প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগে দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি ও সম্মান নিশ্চিত হবে। প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের কষ্টার্জিত অর্থের সঠিক মূল্যায়ন এবং তাদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের উদ্যোগ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।


                                                                                               \"করিম চাচার খোলা চিঠি\"


মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যার,

শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। আমার নাম করিম চাচা, বয়স সত্তরের কোঠায়। আজীবন পরিশ্রম করে যাচ্ছি দেশের বাইরে, পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর আশায়। আমি জানি না, আপনি কখনো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা শুনেছেন কিনা। কিন্তু আমি আজ এই চিঠির মাধ্যমে আপনার কাছে কিছু বাস্তবতা তুলে ধরতে চাই, যা হয়তো আপনার মতো একজন মহান ব্যক্তিত্বের কাছেও পৌঁছায় না।

স্যার, আমরা যারা দেশের বাইরে কাজ করতে যাই, তাদের জীবনটা কেমন তা হয়তো আপনারা অনেকেই বুঝতে পারেন না। আমি সৌদি আরবে কাজ করছি প্রায় ৪৫ বছর ধরে। এই বিশ বছরে কত যে ত্যাগ স্বীকার করেছি, তার কোনো হিসাব নেই। নিজের ভালো-মন্দের কথা না ভেবে পরিবারের কথা ভেবেছি। না খেয়ে, খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে দিন কাটিয়েছি। পরিবারের সদস্যদের জন্য, দেশের জন্য পরিশ্রম করেছি। কিন্তু স্যার, যখন দেশে ফিরি, তখন দেখি আমাদের প্রতি কোনো সম্মান নেই। আমরা যেন দেশের কোনো বোঝা, আমাদের কষ্টকে যেন কেউ অনুভব করে না।

আমরা যারা রেমিটেন্স যোদ্ধা, আমরা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। আমাদের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে দেশের রিজার্ভ শক্তিশালী হয়, দেশের অর্থনীতি বেঁচে থাকে। কিন্তু দেশে ফেরার সময় যখন বিমানবন্দরে পৌঁছাই, তখন ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস অফিসারদের আচরণ আমাদের মন ভেঙে দেয়। তারা আমাদেরকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে, যেন আমরা অপরাধী। আমাদের সম্মান তো দূরের কথা, আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা একেবারেই অমানবিক।

ইমিগ্রেশন অফিসারদের মুখে রুক্ষ কথাবার্তা, কাস্টমস অফিসারদের অযথা হয়রানি, এসব আমাদের মনে অনেক কষ্ট দেয়। প্রায়ই দেখি, আমাদের কষ্টের টাকায় কেনা সামান্য কিছু জিনিসপত্রকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। আমাদের লাগেজ ভেঙে ফেলা হয়, অনেক সময় জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। আমাদের যে কোনো অভিযোগ করলে সেটাও উপেক্ষা করা হয়। স্যার, এসব কষ্টের কথা বলার মতো আমাদের কেউ ছিল না। 

কিন্তু, স্যার, আপনি আমাদের কথা ভেবেছেন। আপনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা শুনে আমরা কৃতজ্ঞ। আপনার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো আমরা একটু স্বস্তি পেয়েছি। আপনি আমাদের জন্য বিনামূল্যে টেলিফোন করার ব্যবস্থা করেছেন, ফ্রি ওয়াইফাই দিয়েছেন। এর ফলে আমরা দেশে ফিরে পরিবারকে সহজে জানাতে পারব যে আমরা নিরাপদে পৌঁছেছি। এছাড়া, আপনি এয়ারপোর্টে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন—এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা আশার আলো।

আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, আপনি ঘোষণা দিয়েছেন যে কোনো লাগেজ হারিয়ে গেলে বা ভেঙে গেলে, এয়ারপোর্ট কর্মীদের বেতন কাটা হবে। এই ব্যবস্থা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, আমাদের কষ্টের ফলাফলের সুরক্ষা দেবে।

স্যার, আপনি আমাদের সম্মান দিয়েছেন, আমাদের কষ্টের মূল্য দিয়েছেন। আমরা আজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আপনার এই উদ্যোগগুলোর জন্য আমরা আশা করছি যে আমাদের জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে। আমরা চাই, আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাক, আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জন্য আরও ভালো দিন আসুক। 

স্যার, আমি আরও একটি অনুরোধ করতে চাই। দয়া করে নিশ্চিত করুন যে এই নির্দেশনাগুলো কঠোরভাবে পালন করা হয়। আমরা যেন আর কোনো ধরনের অবমাননার শিকার না হই, আমাদের যেন যথাযথ সম্মান দেয়া হয়।

আপনার জন্য দোয়া করি, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন, আরও অনেক ভালো কাজ করার শক্তি দিন। আপনি আমাদের পাশে ছিলেন, থাকবেন। 


ইতি,  

আপনার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ,  

করিম চাচা  

একজন রেমিটেন্স যোদ্ধা,

রিয়াদ, সৌদি আরব।

মতামত এর আরও খবর

img

পিআর নির্বাচন পদ্ধতি: গণতন্ত্রের বিকাশ নাকি অস্থিরতার আশঙ্কা?

প্রকাশিত :  ১১:১০, ০৪ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চ সবসময়ই উত্তপ্ত। নানা ঘটনা, বিরোধ, এবং ক্ষমতা দ্বন্দ্বে এই মঞ্চ কখনোই দীর্ঘসময় শান্ত থাকেনি। তবে সম্প্রতি যেটি রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে, সেটি হলো—নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার।

দেশে বহু বছর ধরে ‘একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা-ভিত্তিক’ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে, যেটি First-Past-The-Post (FPTP) নামে পরিচিত। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে—এই পদ্ধতি কি সময়োপযোগী? নাকি এটি বর্তমানে গণতন্ত্রের প্রকৃত চাহিদা পূরণে অক্ষম? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা Proportional Representation (PR) পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন।

কিন্তু এই পদ্ধতি কি সত্যিই বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও গভীর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে, না কি এটি রাজনৈতিক অস্থিরতার নতুন দরজা খুলে দেবে—এই প্রশ্ন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

পিআর পদ্ধতি: এটি আসলে কী?

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি এমন এক নির্বাচন ব্যবস্থা, যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট যে পরিমাণ ভোট পায়, সংসদেও সে অনুযায়ী আসন পায়। সহজভাবে বললে—‘যত ভোট, তত আসন।’

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দল জাতীয় নির্বাচনে ২৫% ভোট পায়, তবে তারা মোট আসনের প্রায় ২৫% দখল করবে।

এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো—ভোটারদের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন যেন সংসদে ঘটে। যেখানে বর্তমান FPTP পদ্ধতিতে কোনো দল ৩৫% ভোট পেয়ে সংসদের ৮০% আসন পেয়ে যেতে পারে, সেখানে পিআর পদ্ধতি সেই বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ফলে ‘জনগণের শাসন’ নামক গণতন্ত্রের মূলনীতির বাস্তবায়নে পিআর পদ্ধতি অধিক ঘনিষ্ঠ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

পিআর পদ্ধতির সম্ভাব্য সুবিধাসমূহ

১. ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা:

FPTP পদ্ধতিতে অনেক সময় এমনও হয়, কোনো দল ১০% ভোট পেয়েও সংসদে একটি আসনও পায় না। অথচ পিআর পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকে, কারণ আসন বণ্টন হয় ভোটের অনুপাতে। এতে ভোটারদের অংশগ্রহণে উৎসাহ বাড়ে, কারণ তারা জানে—তাদের ভোট আর বৃথা যাবে না।

২. ক্ষুদ্র দল ও সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব:

বর্তমান রাজনীতি বড় দুই দলকেন্দ্রিক হওয়ায় ক্ষুদ্র দল, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রায় অনুপস্থিত। পিআর পদ্ধতি কার্যকর হলে তাদের প্রতিনিধিত্ব সংসদে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়, যা সংসদকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।

৩. জোট ও সংলাপের সংস্কৃতি:

একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে দলগুলোকে সরকার গঠনের জন্য জোট গঠন করতে হয়। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার নতুন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে—যা বাংলাদেশের মতো সংঘাতপ্রবণ রাজনীতির দেশে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

৪. নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ:

তালিকাভিত্তিক পদ্ধতিতে দলগুলো নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী হয়। এতে প্রতিনিধিত্বে বৈচিত্র্য আসে, যা সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।

 ৫. সমঝোতাভিত্তিক স্থিতিশীলতা:

যদিও জোট সরকারে ঝুঁকি থাকে, তবে দলগুলো যখন একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে বাধ্য হয়, তখন রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আরও সমন্বিত পদক্ষেপ সম্ভব হয়।

পিআর পদ্ধতির বাস্তব চ্যালেঞ্জ

১. জোট সরকারের অস্থিরতা:

পিআর পদ্ধতিতে জোট সরকার গঠন অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেখানে সংলাপ ও বিশ্বাসের বড় অভাব রয়েছে, সেখানে এই পদ্ধতি কার্যকরভাবে স্থিতিশীল সরকার গঠনে কতটা সক্ষম হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

২. ক্ষুদ্র দলের অতিরিক্ত প্রভাব:

কম ভোট পেয়েও কিছু দল জোট গঠনের সময় বড় দলের ওপর অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা রাজনীতিকে সুবিধাবাদী ও নীতিহীন করে তুলতে পারে।

৩. জটিল ভোট প্রক্রিয়া:

তালিকাভিত্তিক বা STV পদ্ধতিতে ভোটদান অপেক্ষাকৃত জটিল। গ্রামীণ বা কম শিক্ষিত ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, যা ভোটার উপস্থিতি হ্রাসের আশঙ্কা সৃষ্টি করে।

৪. নীতিহীন আপসের সংস্কৃতি:

ক্ষমতায় আসতে বড় দলগুলো ক্ষুদ্র দলের অযৌক্তিক দাবিও মানতে পারে। এর ফলে আদর্শহীন রাজনৈতিক আপস ও সুবিধাবাদ বাড়তে পারে।

৫. প্রশাসনিক ও আইনি চ্যালেঞ্জ:

এই পদ্ধতি চালু করতে হলে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা, আইনি কাঠামো, ও প্রযোজ্য প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক অবকাঠামো কতটা প্রস্তুত, সেটি এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতির সম্ভাবনা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা দুটি প্রধান দলের আধিপত্যে আবদ্ধ। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস ও সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতি কার্যকর করতে হলে প্রয়োজন—ন্যূনতম রাজনৈতিক সমঝোতা, আন্তরিকতা এবং জনগণের সমর্থন। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে, তবুও পিআর পদ্ধতি আমাদের রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।

এতে সংসদে তরুণ, নারী, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে পারে। তবে এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর:

ক. রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমঝোতা,

খ. প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও সক্ষমতা,

গ. ভোটারদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ।

পিআর পদ্ধতির ইতিহাস: সংক্ষিপ্ত রূপরেখা

১৮ শতক:

ফরাসি ও আমেরিকান বিপ্লবের সময় গণতন্ত্রের ধারণা জোরালো হয়। এ সময় থেকেই FPTP পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে।

১৯ শতক:

ব্রিটিশ দার্শনিক থমাস হেয়ার STV পদ্ধতির ধারণা দেন। ১৮৫০-এর দশকে এটি প্রথম আলোচনায় আসে।

২০ শতক:

সুইডেন, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ বহু দেশ পিআর পদ্ধতি গ্রহণ করে। বর্তমানে প্রায় ৮০টির বেশি দেশে পিআরের কোনো না কোনো রূপ চালু রয়েছে।

বিভিন্ন রূপ:

তালিকাভিত্তিক (List PR): যেমন সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকা,

STV: যেমন আয়ারল্যান্ড,

মিশ্র পদ্ধতি (MMP): যেমন জার্মানি, নিউজিল্যান্ড।

আমরা কি প্রস্তুত?

পিআর পদ্ধতি কোনো জাদুকাঠি নয়, যা রাতারাতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধান করে দেবে। আবার, বর্তমান FPTP ব্যবস্থাও নিখুঁত নয়।

সুতরাং, যদি আমরা পিআর পদ্ধতির বাস্তবায়ন চাই, তাহলে প্রয়োজন—রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা, এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

এই পদ্ধতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক করতে পারে। তবে এর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো অস্বীকার করা চলবে না।

পাঠকের প্রতি প্রশ্ন:

আপনার মতে, বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালু হলে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে, না কি অস্থিরতা বাড়বে?

মতামত জানাতে ভুলবেন না।