প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের সম্মান ও সুরক্ষায় উদ্যোগ: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে করিম চাচার চিঠি
দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলে পরিচিত প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের অবদানের কথা বলতেই হয়। এদের কঠোর পরিশ্রমের ফসলেই বাংলাদেশ শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তবে, এসব প্রবাসী যোদ্ধাদের অনেকেই যখন দেশে ফেরেন, তখন তাদের প্রতি সঠিক সম্মান ও মানবিক আচরণ না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের গৃহীত কিছু উদ্যোগ প্রবাসী কর্মীদের জন্য আশার আলো নিয়ে এসেছে।
সম্প্রতি, করিম চাচা নামের একজন প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধা, যিনি দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছর ধরে সৌদি আরবে কাজ করছেন, তিনি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠিতে তিনি প্রবাসী শ্রমিকদের বাস্তবতার কথা তুলে ধরেছেন এবং কিভাবে তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেও সম্মানহীনতার শিকার হন, সেই কথা ব্যক্ত করেছেন।
করিম চাচা তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন যে, প্রবাসে কাটানো ৪৫ বছরে তিনি কত যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাদ দিয়ে, তিনি দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু দেশে ফিরে যখন বিমানবন্দরে পৌঁছান, তখন ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস অফিসারদের রুক্ষ আচরণ ও হয়রানির মুখোমুখি হন। তাদের সামান্য জিনিসপত্রকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়, লাগেজ ভেঙে ফেলা হয়, এমনকি অনেক সময় চুরি হয়ে যায়।
প্রবাসীদের প্রতি এই অবমাননাকর আচরণের বিরুদ্ধে তিনি তার চিঠিতে গভীর কষ্ট প্রকাশ করেছেন। তবে, তিনি একইসঙ্গে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার নেওয়া কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন। করিম চাচা উল্লেখ করেছেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো প্রবাসীরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগে বিমানবন্দরে ফ্রি টেলিফোন ও ওয়াইফাই সুবিধা চালু করা হয়েছে, যা প্রবাসীদের পরিবারকে নিরাপদে পৌঁছানোর খবর জানাতে সহায়ক হয়েছে।
এছাড়াও, ড. ইউনূস এয়ারপোর্টে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন যে, কোনো লাগেজ হারিয়ে গেলে বা ভেঙে গেলে, সংশ্লিষ্ট কর্মীদের বেতন কাটা হবে। এই পদক্ষেপগুলো প্রবাসীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে এবং তাদের কষ্টার্জিত টাকার সুরক্ষা দিয়েছে।
করিম চাচার মতো অনেক প্রবাসীই মনে করেন, ড. ইউনূস তাদের সম্মান দিয়েছেন এবং তাদের কষ্টের মূল্য বুঝেছেন। তার এই উদ্যোগগুলোর জন্য প্রবাসী কর্মীরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। তারা আশা করছেন, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষদের জন্য আরও ভালো দিন আসবে।
তবে, করিম চাচা চিঠির শেষে আরও একটি অনুরোধ করেছেন। তিনি চান, এই নির্দেশনাগুলো কঠোরভাবে পালিত হোক এবং প্রবাসীদের সম্মান ও সুরক্ষা নিশ্চিতে আরও উদ্যোগ নেওয়া হোক। তিনি দোয়া করেছেন, আল্লাহ ড. ইউনূসকে দীর্ঘজীবী করুন এবং আরও ভালো কাজ করার শক্তি দিন। তার মতে, ড. ইউনূস সবসময়ই প্রবাসী যোদ্ধাদের পাশে ছিলেন এবং থাকবেন।
করিম চাচার এই চিঠি শুধু তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন নয়, বরং লাখো প্রবাসী কর্মীর মনের কথা। তাদের প্রত্যাশা, প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগে দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদানের যথাযোগ্য স্বীকৃতি ও সম্মান নিশ্চিত হবে। প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধাদের কষ্টার্জিত অর্থের সঠিক মূল্যায়ন এবং তাদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের উদ্যোগ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
\"করিম চাচার খোলা চিঠি\"
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যার,
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। আমার নাম করিম চাচা, বয়স সত্তরের কোঠায়। আজীবন পরিশ্রম করে যাচ্ছি দেশের বাইরে, পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর আশায়। আমি জানি না, আপনি কখনো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা শুনেছেন কিনা। কিন্তু আমি আজ এই চিঠির মাধ্যমে আপনার কাছে কিছু বাস্তবতা তুলে ধরতে চাই, যা হয়তো আপনার মতো একজন মহান ব্যক্তিত্বের কাছেও পৌঁছায় না।
স্যার, আমরা যারা দেশের বাইরে কাজ করতে যাই, তাদের জীবনটা কেমন তা হয়তো আপনারা অনেকেই বুঝতে পারেন না। আমি সৌদি আরবে কাজ করছি প্রায় ৪৫ বছর ধরে। এই বিশ বছরে কত যে ত্যাগ স্বীকার করেছি, তার কোনো হিসাব নেই। নিজের ভালো-মন্দের কথা না ভেবে পরিবারের কথা ভেবেছি। না খেয়ে, খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে দিন কাটিয়েছি। পরিবারের সদস্যদের জন্য, দেশের জন্য পরিশ্রম করেছি। কিন্তু স্যার, যখন দেশে ফিরি, তখন দেখি আমাদের প্রতি কোনো সম্মান নেই। আমরা যেন দেশের কোনো বোঝা, আমাদের কষ্টকে যেন কেউ অনুভব করে না।
আমরা যারা রেমিটেন্স যোদ্ধা, আমরা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। আমাদের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে দেশের রিজার্ভ শক্তিশালী হয়, দেশের অর্থনীতি বেঁচে থাকে। কিন্তু দেশে ফেরার সময় যখন বিমানবন্দরে পৌঁছাই, তখন ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস অফিসারদের আচরণ আমাদের মন ভেঙে দেয়। তারা আমাদেরকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে, যেন আমরা অপরাধী। আমাদের সম্মান তো দূরের কথা, আমাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা একেবারেই অমানবিক।
ইমিগ্রেশন অফিসারদের মুখে রুক্ষ কথাবার্তা, কাস্টমস অফিসারদের অযথা হয়রানি, এসব আমাদের মনে অনেক কষ্ট দেয়। প্রায়ই দেখি, আমাদের কষ্টের টাকায় কেনা সামান্য কিছু জিনিসপত্রকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। আমাদের লাগেজ ভেঙে ফেলা হয়, অনেক সময় জিনিসপত্র চুরি হয়ে যায়। আমাদের যে কোনো অভিযোগ করলে সেটাও উপেক্ষা করা হয়। স্যার, এসব কষ্টের কথা বলার মতো আমাদের কেউ ছিল না।
কিন্তু, স্যার, আপনি আমাদের কথা ভেবেছেন। আপনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা শুনে আমরা কৃতজ্ঞ। আপনার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো আমরা একটু স্বস্তি পেয়েছি। আপনি আমাদের জন্য বিনামূল্যে টেলিফোন করার ব্যবস্থা করেছেন, ফ্রি ওয়াইফাই দিয়েছেন। এর ফলে আমরা দেশে ফিরে পরিবারকে সহজে জানাতে পারব যে আমরা নিরাপদে পৌঁছেছি। এছাড়া, আপনি এয়ারপোর্টে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন—এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা আশার আলো।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, আপনি ঘোষণা দিয়েছেন যে কোনো লাগেজ হারিয়ে গেলে বা ভেঙে গেলে, এয়ারপোর্ট কর্মীদের বেতন কাটা হবে। এই ব্যবস্থা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, আমাদের কষ্টের ফলাফলের সুরক্ষা দেবে।
স্যার, আপনি আমাদের সম্মান দিয়েছেন, আমাদের কষ্টের মূল্য দিয়েছেন। আমরা আজীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আপনার এই উদ্যোগগুলোর জন্য আমরা আশা করছি যে আমাদের জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে। আমরা চাই, আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাক, আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জন্য আরও ভালো দিন আসুক।
স্যার, আমি আরও একটি অনুরোধ করতে চাই। দয়া করে নিশ্চিত করুন যে এই নির্দেশনাগুলো কঠোরভাবে পালন করা হয়। আমরা যেন আর কোনো ধরনের অবমাননার শিকার না হই, আমাদের যেন যথাযথ সম্মান দেয়া হয়।
আপনার জন্য দোয়া করি, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন, আরও অনেক ভালো কাজ করার শক্তি দিন। আপনি আমাদের পাশে ছিলেন, থাকবেন।
ইতি,
আপনার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ,
করিম চাচা
একজন রেমিটেন্স যোদ্ধা,
রিয়াদ, সৌদি আরব।