সংগ্রাম দত্ত: বাংলাদেশে এখন বিদেশে সেটেল ছেলেদের বিয়ের প্রস্তাব মানেই পরিবারগুলোর চোখে নতুন আশার আলো। কিন্তু এই স্বপ্নের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ানক বাস্তবতা। সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতা বলছে—এই “বিদেশী সেটেল পাত্র” ট্রেন্ড এখন প্রতারণার বড় ফাঁদে পরিণত হয়েছে।
বিদেশে মানেই নিরাপদ ভবিষ্যৎ নয়
অনেকে স্টুডেন্ট ভিসায় অস্ট্রেলিয়া, কানাডা বা ইউরোপে গেছেন। কিন্তু তাদের অনেকেরই স্থায়ী বসবাসের কাগজ (PR বা Citizenship) পেতে লাগে ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত। এর আগে তাদের জীবনযাপন কষ্টকর ও অনিশ্চিত।
ডিপেন্ডেন্ট ভিসায় স্ত্রীকে নিলেও সেই জীবন হয় “দিল্লির লাড্ডু”—খেতে মিষ্টি, কিন্তু গিলতে কষ্টকর। স্টুডেন্ট ভিসায় থাকা মানে পড়াশোনার পাশাপাশি অর্ধেক সময় পরিশ্রমের জীবন, অর্ধেক সময় টেনশন। সংসার চালানোর মতো স্থিতিশীলতা সেখানে থাকে না।
ইউরোপের বাস্তবতা: রঙিন ছবি, ধূসর জীবন
ইউরোপে যারা থাকে, তাদের অনেকের আয় খরচের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। মাসে দেড়-দুই লাখ টাকার সমান ইনকাম করলেও ঘরভাড়া, ট্যাক্স, খাবার—সব মিলিয়ে হাতে থাকে সামান্যই।
অনেকেই ছোট অ্যাপার্টমেন্টে ৬-৮ জন ব্যাচেলরের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকে। এক রুমে স্ত্রীকে নিয়ে থাকা, একটাই বাথরুম ও কিচেন—এটাই বাস্তবতা। কিন্তু দেশে ফিরে তারা সেই কষ্টের গল্প কখনোই শেয়ার করে না।
প্রতারণার গল্প: স্বপ্ন ভাঙার কান্না
ইতালি, ফ্রান্স, স্পেনের “সিটিজেন” ছেলেরা দেশে এসে মিষ্টি কথায় মেয়ের পরিবারকে আশ্বস্ত করে—বিয়ের ছয় মাস পরেই বৌকে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অনেকেই বছর পার করেও স্ত্রীর ভিসা দিতে পারেনি, সংসারের খরচ চালাতে পারেনি। অনেকে তো আজও ঢাকা এয়ারপোর্ট পেরোতে পারেননি।
বিয়ের আগে যাচাই-বাছাইয়ের চেকলিস্ট
বাসস্থান যাচাই করুন: ছেলেটির নিজের অ্যাপার্টমেন্ট আছে কিনা দেখুন। রিয়েল এস্টেট এগ্রিমেন্ট, ছবি, ঠিকানা—সবকিছু যাচাই করুন। প্রয়োজনে স্থানীয় কারও মাধ্যমে নিশ্চিত হন।
চাকরি বা ব্যবসার সত্যতা: চাকরি করলে অফিসের নিয়োগপত্র (Appointment Letter) চাইবেন। রেস্টুরেন্টে কাজ করলে আসল পদটি কী—ম্যানেজার নাকি থালা-বাসন মাজে—সেটা নিশ্চিত করুন।
রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস: PR বা সিটিজেন না হলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। মুখের কথা নয়, অফিসিয়াল ডকুমেন্ট দেখুন। স্টুডেন্ট বা টেম্পোরারি ভিসাধারীরা সংসার চালাতে হিমশিম খায়।
চরিত্র ও অভ্যাস যাচাই: অনেকে বিদেশে গিয়ে কাজ না করে আড্ডা, মাদক, কিংবা অস্থির জীবনে জড়িয়ে পড়ে। তাই পরিচিত মানুষদের মাধ্যমে খোঁজ নেওয়া জরুরি।
বিদেশের নাম শুনেই মেয়েকে বিয়ে দেওয়া এখন এক ধরনের সামাজিক ঝুঁকি। চকচকে ছবির পেছনে লুকিয়ে আছে অনেক দুঃখ, অনিশ্চয়তা আর প্রতারণা।
বিয়ের আগে একটুখানি তদন্ত, যাচাই-বাছাই—এটাই পারে একটি জীবনের সর্বনাশ রুখে দিতে।
দুর্লভ খনিজ উপাদান: কেন যুক্তরাষ্ট্রের এগুলো প্রয়োজন এবং কেন এগুলো যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্যযুদ্ধে কৌশলগত অস্ত্র হয়ে উঠেছে
প্রকাশিত :
১১:২৪, ০৫ নভেম্বর ২০২৫ সর্বশেষ আপডেট: ১১:৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৫
অনুপম সাহা
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ ও ‘রেয়ার আর্থ’-এর গুরুত্ব
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে দুর্লভ খনিজ উপাদানসমূহ (Rare Earth Elements – REEs)। এই ১৭টি রাসায়নিক উপাদান আধুনিক প্রযুক্তির মূলভিত্তি — এগুলো ব্যবহার হয় ইলেকট্রিক গাড়ি, কম্পিউটার চিপ, জেট ইঞ্জিন, উইন্ড টারবাইন, স্মার্টফোন, এমনকি উন্নত সামরিক অস্ত্র তৈরিতে।
যদিও প্রকৃতিতে এগুলো তুলনামূলকভাবে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, কিন্তু বিশুদ্ধভাবে আলাদা করা কঠিন এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দীর্ঘ কয়েক দশকের বিনিয়োগ ও রাষ্ট্রীয় সহায়তায় চীন আজ এই খনিজগুলোর খনন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রায় একচেটিয়া কর্তৃত্ব অর্জন করেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীন রেয়ার আর্থ রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে—যা যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাতে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বেইজিংয়ের সচেতন কৌশল, যাতে তারা এই খনিজ আধিপত্যকে বাণিজ্য আলোচনায় ‘বাঁধা কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
রেয়ার আর্থ কী এবং কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
রেয়ার আর্থ হলো ১৭টি রাসায়নিকভাবে মিল থাকা উপাদান, যা উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পে অপরিহার্য। নামগুলো যেমন— নিওডিমিয়াম (Neodymium), ইট্রিয়াম (Yttrium), ইউরোপিয়াম (Europium)—শুনতে অপরিচিত লাগলেও, এগুলোর ব্যবহারে তৈরি পণ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
•নিওডিমিয়াম: শক্তিশালী চুম্বক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, যা ইলেকট্রিক মোটর, হার্ড ড্রাইভ, স্পিকার ও উইন্ড টারবাইনে অপরিহার্য।
•ইট্রিয়াম ও ইউরোপিয়াম: টেলিভিশন ও কম্পিউটার স্ক্রিনে উজ্জ্বল রঙ তৈরি করে।
•ল্যান্থানাম: ক্যামেরা লেন্স ও আলোক সরঞ্জামে ব্যবহৃত হয়।
•সেরিয়াম: গাড়ির ক্যাটালাইটিক কনভার্টারে ব্যবহৃত হয় যা দূষণ কমায়।
•প্রাসিওডিমিয়াম ও গ্যাডোলিনিয়াম: বিমান ইঞ্জিন, এমআরআই যন্ত্র ও নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়।
জিঞ্জার ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক টমাস ক্রুমার বলেন,
“যে কোনো জিনিস যা অন-অফ করা যায়—সেগুলো কোনো না কোনোভাবে রেয়ার আর্থের ওপর নির্ভরশীল।”
কেন রেয়ার আর্থ চীন–যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় এক বড় ‘বাণিজ্য হাতিয়ার’
•যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখনো “হেভি” রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা নেই, অথচ চীন নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্বের প্রায় ৯০% প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতা। ফলে বেইজিং শক্তিশালী কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে।
•২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর চীন নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করে—এটি আসে ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগে, যখন APEC সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ইচ্ছাকৃত সময়-নির্বাচন—যেন আলোচনায় চীন অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
•রেয়ার আর্থের ব্যবহার সামরিক সরঞ্জাম, সেমিকন্ডাক্টর ও উন্নত প্রযুক্তিতে হওয়ায় এটি কেবল বাণিজ্যিক নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে।
চীনের বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনের নিয়ন্ত্রণ
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (IEA) তথ্য অনুযায়ী, চীন ৬১% রেয়ার আর্থ উৎপাদন এবং ৯২% প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এই আধিপত্য এসেছে বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি, কম উৎপাদন খরচ ও দুর্বল পরিবেশনীতির কারণে।
চীনের সাবেক নেতা দেং শিয়াওপিং ১৯৯২ সালে বলেছিলেন,
“মধ্যপ্রাচ্যের কাছে তেল আছে, আর চীনের কাছে আছে রেয়ার আর্থ।”
আজ তার সেই ভবিষ্যদ্বাণীই বিশ্ব অর্থনীতির বাস্তব চিত্রে রূপ নিয়েছে।
রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও উত্তেজনার বৃদ্ধি
যুক্তরাষ্ট্র নতুন শুল্ক আরোপের পর চীন সাতটি “হেভি” রেয়ার আর্থে রপ্তানি সীমাবদ্ধতা জারি করে। এখন এই খনিজ বা সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি রপ্তানিতে বিশেষ অনুমতি লাগে।
অক্টোবর ২০২৫-এ চীন আরও পাঁচটি উপাদান ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ তালিকায় যোগ করে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে এটি “অর্থনৈতিক জবরদস্তি” এবং “বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খল দখলের চেষ্টা।”
এই উপাদানগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পে — যেমন F-35 যুদ্ধবিমান, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র, ও রাডার সিস্টেম তৈরিতে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জ
২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭০% রেয়ার আর্থ আমদানি এসেছে চীন থেকে। দেশে একটি খনি থাকলেও এর আকরিক এখনো চীনে পাঠাতে হয় প্রক্রিয়াকরণের জন্য।
ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেন ও গ্রীনল্যান্ডের সঙ্গে খনিজ সরবরাহ চুক্তির চেষ্টা করছে, কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পরিবেশগত বাধা অগ্রগতিকে ধীর করছে।
“এই ঘাটতি অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপ্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা শিল্পে উৎপাদন বিলম্ব ও খরচ বৃদ্ধি পাবে।”
সাম্প্রতিক অগ্রগতি: এক বছরের অস্থায়ী সমঝোতা
রয়টার্স জানিয়েছে, ২০২৫ সালের ৩০ অক্টোবর চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এক বছরের একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে—চীন রপ্তানি অব্যাহত রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কিছু শুল্ক কমাবে।
দ্য গার্ডিয়ান এটিকে চীনের “শক্তিশালী বাণিজ্য অস্ত্র” বলে উল্লেখ করেছে, আর পলিটিকো জানায়, কানাডা নেতৃত্বাধীন জি৭ দেশগুলো এখন চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।
তবে আল জাজিরার মতে, চীনের নতুন রপ্তানি নিয়ম—যা ট্রাম্প–শি বৈঠকের ঠিক আগে কার্যকর হয়—ইঙ্গিত দেয় যে বেইজিং ভবিষ্যতেও এই খনিজ আধিপত্যকে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে।
শি–ট্রাম্প বৈঠকের তাৎপর্য
বিশ্ব অর্থনীতির দৃষ্টি ছিল এই বৈঠকের দিকে। ট্রাম্প বলেছিলেন, “চীনের আর কোনো বাধা নেই”, কিন্তু বেইজিং এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। যেহেতু বিশ্বে রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াজাতকরণের ৯০% চীনের হাতে, তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক বাজারে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।
যদি এই চুক্তি স্থায়ী হয়, তাহলে তা বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনকে কিছুটা স্থিতিশীল করতে পারে। কিন্তু ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিকল্প উৎস তৈরির চেষ্টা ত্বরান্বিত করবে—যা ভবিষ্যতে বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা কাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে।
সারসংক্ষেপ
রেয়ার আর্থ কেবল খনিজ নয় — এটি আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি এবং এখন এক নতুন ভূরাজনৈতিক মুদ্রা। চীনের এই খনিজ নিয়ন্ত্রণ তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অসাধারণ প্রভাবশালী করেছে। ফলে, এই উপাদানগুলো কেবল শিল্প বা বাণিজ্যের বিষয় নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য নির্ধারণের অন্যতম উপাদান হয়ে উঠেছে।