img

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ কেন শেষ হচ্ছে না

প্রকাশিত :  ১২:২২, ০৩ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৬:০০, ০৩ নভেম্বর ২০২৫

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ কেন শেষ হচ্ছে না

সাইফুল খান 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আজ শুধু দুটি দেশের সংঘাত নয়। এটি হয়ে উঠেছে ২১ শতকের ভূরাজনীতির সবচেয়ে জটিল, বহুমাত্রিক ও কৌশলগত সংঘর্ষ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রুশ আগ্রাসনের পর তিন বছর পার হয়ে গেলেও যুদ্ধের কোনো সুস্পষ্ট সমাপ্তির ইঙ্গিত নেই। মস্কো ও কিয়েভের যুদ্ধক্ষেত্র সীমিত ভূখণ্ডের হলেও, এর প্রতিধ্বনি এখন ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামো থেকে শুরু করে আমেরিকার বৈদেশিক নীতি, ন্যাটোর ঐক্য, চীনের ভূরাজনৈতিক কৌশল ও বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠছে এই যুদ্ধ কেন শেষ হচ্ছে না? এর জবাব খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হয় রাশিয়া, ইউক্রেন, পশ্চিমা জোট ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার ভেতরে।

প্রথমত, রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধের লক্ষ্য কেবল ইউক্রেন দখল নয়, বরং একটি নতুন ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। মস্কোর কাছে এটি ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধ যুদ্ধ। ভ্লাদিমির পুতিন বারবার বলেছেন, ইউক্রেনকে পশ্চিমা সামরিক ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত রাখা রাশিয়ার “অস্তিত্বগত নিরাপত্তা”র প্রশ্ন। আমেরিকার ‘Rand Corporation’-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পুতিন এমন এক যুদ্ধ চান যা দীর্ঘস্থায়ী হবে, যাতে ইউরোপ ক্লান্ত হয়, ন্যাটোর ঐক্য দুর্বল হয় এবং ইউক্রেন অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়ে। তাদের মতে, রাশিয়া জানে সরাসরি সামরিক জয়ে ইউক্রেন পুরোপুরি দখল সম্ভব নয়। কিন্তু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করে পশ্চিমা বিশ্বের আর্থিক ও রাজনৈতিক মনোযোগকে ক্লান্ত করে ফেলা ; এই কৌশলই এখন মস্কোর লক্ষ্য।

অন্যদিকে, ইউক্রেনের অবস্থান সম্পূর্ণ প্রতিরোধমূলক ও নৈতিক কাঠামোয় দাঁড়িয়ে আছে। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যুদ্ধকে ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও পরিচয়ের লড়াই হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, যুদ্ধ থামলে ইউক্রেন তার সার্বভৌমত্ব হারাবে, তাই “যে কোনো মূল্যে প্রতিরোধ” এই মুহূর্তে দেশের একমাত্র পথ। ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমা সহায়তা টিকে থাকা মানে অস্তিত্ব রক্ষা। কিন্তু যুদ্ধের দীর্ঘায়ন ইউক্রেনের অর্থনীতি ও জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের জিডিপি ৩০% এরও বেশি কমেছে এবং দেশটির জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস্তুচ্যুত। তবুও, কিয়েভ মনে করে যুদ্ধ থামালে মস্কোর কূটনৈতিক নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে দেশটি। তাই তারা কূটনৈতিক সমঝোতার চেয়ে সামরিক প্রতিরোধকেই বেছে নিচ্ছে।

ইউরোপের অবস্থানও দ্বিধাগ্রস্ত। একদিকে তারা ইউক্রেনকে অর্থ, অস্ত্র ও রাজনৈতিক সহায়তা দিচ্ছে, অন্যদিকে জ্বালানি নির্ভরতা ও অর্থনৈতিক চাপ তাদের উদ্বিগ্ন করছে। জার্মানি, ফ্রান্সসহ অনেক ইউরোপীয় দেশ যুদ্ধের আর্থিক খরচে ক্লান্ত। ‘European Council on Foreign Relations (ECFR)’–এর এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ ইউরোপীয় নাগরিক এখন “শান্তির জন্য সমঝোতা”র পক্ষপাতী, “বিজয়ের জন্য যুদ্ধ” নয়। কিন্তু ইউরোপ জানে, যদি এখন ইউক্রেনকে ছাড় দেওয়া হয়, তবে এটি রাশিয়ার পরবর্তী আগ্রাসনের দরজা খুলে দেবে। তাই তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও যুদ্ধের সহায়তায় যুক্ত রয়েছে।

আমেরিকার ভূমিকাই এই যুদ্ধের সবচেয়ে বিতর্কিত উপাদান। ওয়াশিংটন যুদ্ধকে “গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের সংঘাত” হিসেবে চিত্রিত করছে। তবে বাস্তবে এটি একটি প্রক্সি ওয়ার। যেখানে আমেরিকা রাশিয়াকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করতে চায়, সরাসরি যুদ্ধে না গিয়েই। আমেরিকান থিংকট্যাংক ‘Brookings Institution’ ও ‘Council on Foreign Relations (CFR)’ বিশ্লেষণ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে দীর্ঘমেয়াদে “রাশিয়ার আফগানিস্তান” বানাতে চায়। অর্থাৎ এমন এক স্থায়ী সংঘাত, যা রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে রক্তক্ষরণ ঘটাবে। মার্কিন কংগ্রেসে সাহায্য প্যাকেজ নিয়ে বিতর্ক, বিশেষ করে রিপাবলিকানদের আপত্তি, দেখিয়ে দিয়েছে যে ওয়াশিংটনের মধ্যেও যুদ্ধ নিয়ে ঐক্য নেই। তবুও, রাশিয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন রাখতে আমেরিকা ইউক্রেনকে ছাড়ছে না।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চীন, ভারত, তুরস্ক ও আরব দেশগুলো এই সংঘাতে “কৌশলগত নিরপেক্ষতা” বজায় রেখেছে। চীন প্রকাশ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে না গেলেও “শান্তি পরিকল্পনা”র নামে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিচ্ছে, যা পশ্চিমা দেশগুলো অবিশ্বাসের চোখে দেখে। ভারতও রাশিয়ার জ্বালানি ও অস্ত্র আমদানি বজায় রেখে “স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি” নীতি অনুসরণ করছে। এভাবে যুদ্ধটি এক ধরনের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার খেলায় পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রত্যেকে নিজের কৌশলগত লাভের হিসাব করছে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যুদ্ধ এখন কৌশলগতভাবে অচলাবস্থায় (stalemate) পৌঁছেছে। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ (counteroffensive) ব্যর্থ হয়েছে, আর রাশিয়াও তার প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন, স্যাটেলাইট, আর্টিলারি এবং ট্রেঞ্চ যুদ্ধের এক মিশ্র রূপ তৈরি হয়েছে। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে প্রযুক্তিনির্ভর কিন্তু স্থবির যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।

অর্থনৈতিকভাবে এই যুদ্ধের দীর্ঘায়ন বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১%। কিন্তু মস্কো তার তেল রপ্তানির নতুন বাজার চীন, ভারত, তুরস্ক পেয়ে গেছে। ফলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সীমিত রাশিয়ার উপর ।

সবশেষে বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আসলে এক “কৌশলগত অচলাবস্থা”র দুনিয়া তৈরি করেছে। যেখানে কেউ পুরোপুরি জয়ী নয়, আবার পরাজয়ও স্বীকার করছে না। যুদ্ধ এখন হয়ে উঠেছে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক ক্লান্তির প্রতিযোগিতা। পশ্চিমা বিশ্ব চায় রাশিয়াকে দুর্বল করতে, রাশিয়া চায় নতুন বৈশ্বিক ভারসাম্য তৈরি করতে, আর ইউক্রেন লড়ছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য।

ফলে যুদ্ধের শেষ নেই, কারণ এটি আর কেবল ইউক্রেনের মাটিতে সীমাবদ্ধ নেই।এটি আজ বৈশ্বিক শক্তির পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্র এবং যতদিন এই ভারসাম্যের খেলা চলবে, ততদিন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও চলবে। কখনো যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনো কূটনীতির টেবিলে আর কখনো বিশ্ব জনমতের প্রেক্ষাপটে।


লেখক- ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর

img

দুর্লভ খনিজ উপাদান: কেন যুক্তরাষ্ট্রের এগুলো প্রয়োজন এবং কেন এগুলো যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্যযুদ্ধে কৌশলগত অস্ত্র হয়ে উঠেছে

প্রকাশিত :  ১১:২৪, ০৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

অনুপম সাহা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ ও ‘রেয়ার আর্থ’-এর গুরুত্ব

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে দুর্লভ খনিজ উপাদানসমূহ (Rare Earth Elements – REEs)। এই ১৭টি রাসায়নিক উপাদান আধুনিক প্রযুক্তির মূলভিত্তি — এগুলো ব্যবহার হয় ইলেকট্রিক গাড়ি, কম্পিউটার চিপ, জেট ইঞ্জিন, উইন্ড টারবাইন, স্মার্টফোন, এমনকি উন্নত সামরিক অস্ত্র তৈরিতে।

যদিও প্রকৃতিতে এগুলো তুলনামূলকভাবে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, কিন্তু বিশুদ্ধভাবে আলাদা করা কঠিন এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দীর্ঘ কয়েক দশকের বিনিয়োগ ও রাষ্ট্রীয় সহায়তায় চীন আজ এই খনিজগুলোর খনন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রায় একচেটিয়া কর্তৃত্ব অর্জন করেছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীন রেয়ার আর্থ রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে—যা যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাতে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বেইজিংয়ের সচেতন কৌশল, যাতে তারা এই খনিজ আধিপত্যকে বাণিজ্য আলোচনায় ‘বাঁধা কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

রেয়ার আর্থ কী এবং কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

রেয়ার আর্থ হলো ১৭টি রাসায়নিকভাবে মিল থাকা উপাদান, যা উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পে অপরিহার্য। নামগুলো যেমন— নিওডিমিয়াম (Neodymium), ইট্রিয়াম (Yttrium), ইউরোপিয়াম (Europium)—শুনতে অপরিচিত লাগলেও, এগুলোর ব্যবহারে তৈরি পণ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

নিওডিমিয়াম: শক্তিশালী চুম্বক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, যা ইলেকট্রিক মোটর, হার্ড ড্রাইভ, স্পিকার ও উইন্ড টারবাইনে অপরিহার্য।

ইট্রিয়াম ও ইউরোপিয়াম: টেলিভিশন ও কম্পিউটার স্ক্রিনে উজ্জ্বল রঙ তৈরি করে।

ল্যান্থানাম: ক্যামেরা লেন্স ও আলোক সরঞ্জামে ব্যবহৃত হয়।

সেরিয়াম: গাড়ির ক্যাটালাইটিক কনভার্টারে ব্যবহৃত হয় যা দূষণ কমায়।

প্রাসিওডিমিয়াম ও গ্যাডোলিনিয়াম: বিমান ইঞ্জিন, এমআরআই যন্ত্র ও নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়।

জিঞ্জার ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক টমাস ক্রুমার বলেন,

“যে কোনো জিনিস যা অন-অফ করা যায়—সেগুলো কোনো না কোনোভাবে রেয়ার আর্থের ওপর নির্ভরশীল।”

 কেন রেয়ার আর্থ চীন–যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় এক বড় ‘বাণিজ্য হাতিয়ার’

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখনো “হেভি” রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা নেই, অথচ চীন নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্বের প্রায় ৯০% প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতা। ফলে বেইজিং শক্তিশালী কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। 

২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর চীন নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করে—এটি আসে ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগে, যখন APEC সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ইচ্ছাকৃত সময়-নির্বাচন—যেন আলোচনায় চীন অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। 

রেয়ার আর্থের ব্যবহার সামরিক সরঞ্জাম, সেমিকন্ডাক্টর ও উন্নত প্রযুক্তিতে হওয়ায় এটি কেবল বাণিজ্যিক নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে।

চীনের বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনের নিয়ন্ত্রণ

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (IEA) তথ্য অনুযায়ী, চীন ৬১% রেয়ার আর্থ উৎপাদন এবং ৯২% প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এই আধিপত্য এসেছে বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি, কম উৎপাদন খরচ ও দুর্বল পরিবেশনীতির কারণে।

চীনের সাবেক নেতা দেং শিয়াওপিং ১৯৯২ সালে বলেছিলেন,

“মধ্যপ্রাচ্যের কাছে তেল আছে, আর চীনের কাছে আছে রেয়ার আর্থ।”

আজ তার সেই ভবিষ্যদ্বাণীই বিশ্ব অর্থনীতির বাস্তব চিত্রে রূপ নিয়েছে।

রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও উত্তেজনার বৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্র নতুন শুল্ক আরোপের পর চীন সাতটি “হেভি” রেয়ার আর্থে রপ্তানি সীমাবদ্ধতা জারি করে। এখন এই খনিজ বা সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি রপ্তানিতে বিশেষ অনুমতি লাগে।

অক্টোবর ২০২৫-এ চীন আরও পাঁচটি উপাদান ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ তালিকায় যোগ করে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে এটি “অর্থনৈতিক জবরদস্তি” এবং “বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খল দখলের চেষ্টা।”

এই উপাদানগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পে — যেমন F-35 যুদ্ধবিমান, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র, ও রাডার সিস্টেম তৈরিতে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জ

২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭০% রেয়ার আর্থ আমদানি এসেছে চীন থেকে। দেশে একটি খনি থাকলেও এর আকরিক এখনো চীনে পাঠাতে হয় প্রক্রিয়াকরণের জন্য।

ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেন ও গ্রীনল্যান্ডের সঙ্গে খনিজ সরবরাহ চুক্তির চেষ্টা করছে, কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পরিবেশগত বাধা অগ্রগতিকে ধীর করছে।

ব্রিটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. গ্যাভিন হার্পার সতর্ক করেছেন,

“এই ঘাটতি অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপ্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা শিল্পে উৎপাদন বিলম্ব ও খরচ বৃদ্ধি পাবে।”

সাম্প্রতিক অগ্রগতি: এক বছরের অস্থায়ী সমঝোতা

রয়টার্স জানিয়েছে, ২০২৫ সালের ৩০ অক্টোবর চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এক বছরের একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে—চীন রপ্তানি অব্যাহত রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কিছু শুল্ক কমাবে।

দ্য গার্ডিয়ান এটিকে চীনের “শক্তিশালী বাণিজ্য অস্ত্র” বলে উল্লেখ করেছে, আর পলিটিকো জানায়, কানাডা নেতৃত্বাধীন জি৭ দেশগুলো এখন চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।

তবে আল জাজিরার মতে, চীনের নতুন রপ্তানি নিয়ম—যা ট্রাম্প–শি বৈঠকের ঠিক আগে কার্যকর হয়—ইঙ্গিত দেয় যে বেইজিং ভবিষ্যতেও এই খনিজ আধিপত্যকে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে।

শি–ট্রাম্প বৈঠকের তাৎপর্য

বিশ্ব অর্থনীতির দৃষ্টি ছিল এই বৈঠকের দিকে। ট্রাম্প বলেছিলেন, “চীনের আর কোনো বাধা নেই”, কিন্তু বেইজিং এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। যেহেতু বিশ্বে রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াজাতকরণের ৯০% চীনের হাতে, তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক বাজারে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।

যদি এই চুক্তি স্থায়ী হয়, তাহলে তা বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনকে কিছুটা স্থিতিশীল করতে পারে। কিন্তু ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিকল্প উৎস তৈরির চেষ্টা ত্বরান্বিত করবে—যা ভবিষ্যতে বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা কাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে।

সারসংক্ষেপ

রেয়ার আর্থ কেবল খনিজ নয় — এটি আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি এবং এখন এক নতুন ভূরাজনৈতিক মুদ্রা। চীনের এই খনিজ নিয়ন্ত্রণ তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অসাধারণ প্রভাবশালী করেছে। ফলে, এই উপাদানগুলো কেবল শিল্প বা বাণিজ্যের বিষয় নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য নির্ধারণের অন্যতম উপাদান হয়ে উঠেছে।


অনুপম সাহা: একাউন্টেন্ট, কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর