img

ব্রিটিশ ভারতে আসামের প্রথম স্পিকার জননেতা এডভোকেট বসন্ত কুমার দাস

প্রকাশিত :  ১৮:৩১, ০২ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৮:৩৯, ০২ অক্টোবর ২০২৫

ব্রিটিশ ভারতে আসামের প্রথম স্পিকার জননেতা এডভোকেট বসন্ত কুমার দাস
সংগ্রাম দত্ত: ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, অনেক মানুষ কেবল রাজনীতিক হিসেবে নন, বরং একজন সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী ও মানবিক নেতা হিসেবেও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তেমনই এক আলোকিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন এডভোকেট বসন্ত কুমার দাস (১৮৮৩–১৯৬৫)। তিনি ছিলেন সিলেটের সন্তান, কিন্তু তাঁর কর্মক্ষেত্র ছড়িয়ে পড়েছিল কলকাতা, আসাম, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন পর্যন্ত।
আইনজীবী থেকে শুরু করে আসামের স্পিকার, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা ও শ্রমমন্ত্রী এবং শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর সভাপতি—এমন বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী মানুষ আমাদের ইতিহাসে বিরল।

শৈশব ও শিক্ষা:
১৮৮৩ সালের ২ নভেম্বর সিলেট জেলার সদর থানার নেগাল গ্রামে জন্ম নেন বসন্ত কুমার দাস। তাঁর পিতার নাম ছিল শরচ্চন্দ্র দাস।
প্রখর মেধাবী এই তরুণ ১৯০৪ সালে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন।
১৯০৬ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ,
১৯০৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক,
এবং ১৯১০ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএল ডিগ্রি অর্জন করেন।

আইন পেশার সূচনা:
শিক্ষাজীবন শেষে ১৯১০ সালে তিনি সিলেট বারে আইন পেশায় যোগ দেন।
১৯১৩ সালে মুন্সেফ পদে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করলেও মাত্র দুই বছর পর ১৯১৫ সালে চাকরি ছেড়ে আইনপেশায় ফিরে আসেন।
তাঁর উজ্জ্বল সুনামের সূচনা হয় ১৯২১ সালে, যখন তিনি কানাইঘাট থানার ভয়াবহ হাঙ্গামা মামলা এবং মাইজগাঁও গ্রামের মামলা পরিচালনা করে মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করেন।
১৯২২ সালে তিনি সিলেট বারের সভাপতি নির্বাচিত হন।

রাজনীতির মঞ্চে পদার্পণ:
১৯২১ সালেই তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন এবং দ্রুত সক্রিয় রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠেন।
১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্বরাজ পার্টিতে যোগ দিয়ে আসাম পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাভোগ করেন দীর্ঘ দুই বছর।

আসামের রাজনীতিতে অবদান:
১৯৩৭ সালের ৭ এপ্রিল গোপীনাথ বরদলৈ আসামের প্রধানমন্ত্রী হলে বসন্ত কুমার দাসকে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার নির্বাচিত করা হয়।
১৯৪৬ সালের ১১ মার্চ তিনি স্পিকারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু খুব শীঘ্রই একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি গোপীনাথ বরদলৈয়ের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে সিলেট গণভোটের সময় তিনি ছিলেন আসামের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
১৯৪৭ সালে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে তিনি কংগ্রেসের ১৬ জন নেতাকে নিয়ে শান্তি মিশন গঠন করে দাঙ্গা প্রশমনে অসাধারণ ভূমিকা রাখেন।

পাকিস্তান পর্ব:
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি হন পূর্ব পাকিস্তান কংগ্রেসের সভাপতি।
১৯৫৪ সালে তিনি কংগ্রেস থেকে পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৫৫ সালের ২০ জুন আবু হোসেন সরকারের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় বসন্তকুমার দাস হন অর্থমন্ত্রী।
১৯৫৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ফিরোজ খান নুনের মন্ত্রিসভায় তিনি নিযুক্ত হন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা ও শ্রমমন্ত্রী।
এই দায়িত্ব পালনের সময় তিনি জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে যোগ দেন।
১৯৫৮ সালে তিনি নির্বাচিত হন আইএলও সভাপতি।
কিন্তু একই বছর ৭ অক্টোবর তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

রাজনৈতিক প্রতিকূলতা:
১৯৫৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এবডো (Elective Bodies Disqualification Order) এর মাধ্যমে বসন্তকুমার দাসসহ ৪৩ জন রাজনৈতিক নেতাকে অযোগ্য ঘোষণা করেন।
তাঁদের মধ্যে ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন, মৌলভি তমিজউদ্দিন খান, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ আরও অনেক নেতা।
রাজনীতিতে দীর্ঘদিন সক্রিয় থাকলেও এ ঘটনার পর বসন্তকুমার দাস কার্যত রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।

জীবনের শেষ অধ্যায়:
১৯৬০ সালের শেষের দিকে চিকিৎসার জন্য তিনি কলকাতা যান। দীর্ঘ অসুস্থতার পর ১৯৬৫ সালের ১৯ জানুয়ারি তিনি কলকাতায় তাঁর পুত্রের বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর মৃত্যুর পর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ চলাকালে শত্রু সম্পত্তি আইনের কারণে তাঁর সিলেট শহরের চালিবন্দরস্থ বাড়িটি বাজেয়াপ্ত হয়। কিন্তু ১৯৮৩ সালে স্থানীয় সমাজসেবীদের উদ্যোগে সেই বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় বসন্ত শিশু একাডেমী (বিশিকা)।
পরে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় চারতলা ভবন নির্মাণ করে বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয়— “বসন্ত মেমোরিয়েল স্কুল”।

উপসংহার:
এডভোকেট বসন্ত কুমার দাসের জীবন একটি ইতিহাস। তিনি ছিলেন বাংলার এক উজ্জ্বল আইনজীবী, কংগ্রেস নেতা, আসামের স্পিকার, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সভাপতি। তাঁর কর্মযজ্ঞ সিলেট থেকে শুরু হয়ে জেনেভা পর্যন্ত বিস্তৃত। দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম, জেল-জুলুম, প্রতিকূলতা—সবকিছুর মধ্য দিয়েও তিনি দেশ, সমাজ ও মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন।

আজ তাঁর নাম হয়তো ইতিহাসের আলোচনায় তত ঘন ঘন উচ্চারিত হয় না, কিন্তু সিলেটের মাটিতে দাঁড়িয়ে এখনও তাঁর উত্তরাধিকার বহন করছে বসন্ত মেমোরিয়েল স্কুল—যা তাঁর আদর্শ ও মানবিকতার স্থায়ী স্মারক।

মতামত এর আরও খবর

img

আসিম মুনিরের লিগ্যাল ইমিউনিটি: পাকিস্তানের অন্ধকার ভবিষ্যৎ

প্রকাশিত :  ১৮:৪১, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৯:১১, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

সাইফুল খান 

জেনারেল আসিম মুনিরকে দেওয়া আজীবন লিগ্যাল ইমিউনিটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভূমিকম্পের মতো একটি ঘটনা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্রে সেনাবাহিনী আগেই ছিল সবল, কিন্তু এবার সামরিক ক্ষমতার ওপর যে “অভিশাপহীনতা” ও “বিচার-বহির্ভূত নিরাপত্তা” দেওয়া হলো। তা শুধু একটি দেশের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; বরং নতুন আঞ্চলিক জটিলতার প্রতিচ্ছবি।অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই ইমিউনিটি শুধু অভ্যন্তরীণ শক্তি‑রাজনীতির ফল নয়; এটি সৌদি আরব‑মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র‑ট্রাম্প অক্ষের নতুন জিওস্ট্র্যাটেজিক সমীকরণের পুরস্কার। যার মূল লক্ষ্য আফগানিস্তান শাসনব্যবস্থাকে চাপের মুখে রাখা, তালেবানের বিপরীতে পাকিস্তানকে ব্যবহার করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন সামরিক খেলা শুরু করা।

১. সৌদি–ট্রাম্প অক্ষ: কেন আসিম মুনিরকে প্রয়োজন

সৌদি আরবের সাম্প্রতিক কৌশল লক্ষ্য করলে দেখা যায়। তারা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সামরিক পার্টনারশিপ গড়ে তুলছে। ইরানের প্রভাব মোকাবিলা, ইয়েমেনের সামরিক প্রতিরোধ এবং ভবিষ্যতের আঞ্চলিক ব্লক তৈরি সব মিলিয়ে সৌদি আরব পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাদের ‘এক্সটেনশন ফোর্স’ হিসেবে বিবেচনা করে আসছে বহুদিন। এখন সেটা নতুন স্ট্র্যাটেজিক চুক্তির কারনে আরো ঘনিষ্ট।

অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য‑কৌশল বরাবরই ছিল দুই স্তরে:

ক ইস্রায়েলের সুরক্ষা, 

খ.আফগানিস্তান‑পাকিস্তান বেল্টে ‘প্রক্সি’ শক্তি তৈরি।

এই দুই উদ্দেশ্যের মিলনস্থল হলো পাকিস্তান আর্মি।

আসিম মুনির সৌদির পছন্দের মানুষ হিসেবে পরিচিত; একই সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকে ওয়াশিংটনের কিছু নিরাপত্তা চক্র তাঁকে “বিশ্বস্ত সামরিক পার্টনার” হিসেবে দেখেছে বলে বহু বিশ্লেষকের ধারনা। তাই তাঁর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে এই অক্ষ লাভবান হবে।

২. কেন লিগ্যাল ইমিউনিটি এই অক্ষের জন্য সুবিধাজনক

লিগ্যাল ইমিউনিটির অর্থ হলো:

ভবিষ্যতে কোনো জবাবদিহিতা নেই।

সামরিক অভিযান বা গোয়েন্দা অপারেশন প্রশ্নহীনভাবে চালানো সম্ভব।বিদেশি শক্তির সাথে সামরিক সহযোগিতায় বাধা কম।দেশের রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে সামরিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ। এই অবস্থায় আসিম মুনির এমন একটি পূর্ণ ক্ষমতাধর সামরিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন, যাঁর সাহায্যে:

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে নতুন স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করতে পারবে

তালেবান সরকারকে চাপে রাখতে পাকিস্তানের ভৌগোলিক সুবিধা ব্যবহারের জন্য এমন সামরিক নেতৃত্ব দরকার। যিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ঝামেলা ছাড়াই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

সৌদি আরব পাকিস্তানকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা পার্টনার হিসেবে আরও দৃঢ়ভাবে ব্যবহার করতে পারবে। বিশেষত ইরানের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সহযোগিতা ও কনফ্লিক্ট থিয়েটার ব্যবস্থাপনায়।

৩. পাকিস্তানের গণতন্ত্রে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব

জেনারেল আসিম মুনিরের আজীবন লিগ্যাল ইমিউনিটি শুধু একজন সেনাপ্রধানকে আইনি সুরক্ষা দিচ্ছে না; এটি পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে তিন স্তরে মারাত্মক আঘাত করছে।

ক. বিচার বিভাগের নির্জীবতা

একজন সেনাবাহিনী প্রধানকে আজীবন মামলাহীন করা মানে:

১. সুপ্রীম কোর্টের ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হওয়া

সুপ্রিম কোর্ট বা নিম্ন আদালত এখন সেনাবাহিনী প্রধানকে তদন্ত বা অভিযুক্ত করতে পারবে না।

দীর্ঘমেয়াদে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নষ্ট হবে এবং বিচারালয় শুধুই প্রশাসনিক কার্য সম্পাদন করবে, ন্যায়বিচারের রক্ষক হিসেবে নয়।

২. আইনের সমতা ধ্বংস

সাধারণ নাগরিক, সাংবাদিক বা রাজনৈতিক নেতা যে আইন অনুসারে দায়ী, সেই সমতার ধারণা সেনাপ্রধানের ক্ষেত্রে আর থাকবে না।

এটি জনগণের মধ্যে আইনের প্রতি আস্থা হ্রাস করবে।

৩. সেনাবাহিনী-আদালত সম্পর্কের আধিপত্য

বিচার বিভাগ এখন সেনাবাহিনীকে সমর্থন বা অনুমোদনের জন্য কাজ করবে।

সেনাবাহিনীকে এক ধরনের “অ্যাডজান্ট বিভাগ” হিসেবে দেখা হবে। যেখানে আদালত সিদ্ধান্তে স্বাধীন নয়, বরং সামরিক প্রভাবের অধীন থাকবে।

খ. সংসদ এবং নির্বাচনী রাজনীতি অচল

লিগ্যাল ইমিউনিটি স্পষ্টভাবে একটি বার্তা দেয়:

 “রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা জনগণের ভোটে নয়, বুটের আওয়াজে।”

১. নির্বাচিত সরকার এবং সংসদের কার্যক্ষমতা সীমিত। রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে সেনাবাহিনীর অনুমোদন নিতে হবে।

সেনা-নেতৃত্বের অগ্রাধিকার সংবিধানগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সংসদকে কার্যত ফর্মালিটি হিসেবে দেখা হবে।

২. রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিকূল পরিবেশ:

বিরোধী দলগুলো সেনাবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা নীতিগত চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। ভোট ও জনমতের প্রভাব কমে যাবে, কারণ সামরিক ক্ষমতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপরে দখল করবে।

৩. রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধ্বংস:

দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আত্মসংশয় তৈরি হবে। সরকার শুধু “সামরিক স্বার্থ রক্ষা করে টিকে থাকা”র ওপর নির্ভরশীল হবে।

গ. বেসামরিক প্রশাসনের ‘সিস্টেমিক দাসত্ব’

লিগ্যাল ইমিউনিটি বেসামরিক প্রশাসনকে বাধ্য করে সামরিক স্বার্থ রক্ষা করতে। এর ফলে:

১. স্বাধীন নীতিনির্ধারণের সীমাবদ্ধতা

অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কূটনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসন সেনাবাহিনীর দিকনির্দেশনা মেনে চলবে। সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা নেই, সবকিছু সামরিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে।

২. গণতান্ত্রিক কাঠামোর ফরমালিটি

সরকার এবং সংসদ এখন কেবল প্রশাসনিক ফর্মালিটি। আসলে দেশের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, সেনাবাহিনী ও তার নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করে।

৩. দীর্ঘমেয়াদী সংস্কৃতিগত প্রভাব

সাধারণ নাগরিক ও সরকারি কর্মকর্তা অনুপ্রেরণা হারাবে। সামাজিক ও প্রশাসনিক মানসিকতা হবে “সেনার নির্দেশ পালনের ওপর নির্ভরশীল”।

৪. পাকিস্তানে সামরিকতন্ত্রের নতুন অধ্যায়

লিগ্যাল ইমিউনিটি দিয়ে এমন একজন সামরিক প্রধানকে “অতিমানবিক আইনি ক্ষমতা” প্রদান করা হলো, যার প্রভাব সরাসরি তিন ভাবে দেখা যাবে:

১. সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সর্বশক্তি

এখন আর তারা পর্দার আড়ালে নয় সংবিধানে, আইনে, বাস্তবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।

২. ভবিষ্যতের সামরিক শাসকদের প্রণোদনা

আজ আসিম মুনির; কাল অন্য কেউ।

এই নজির ভবিষ্যতের যে কোনো সামরিক প্রধানকে “অভিযুক্তহীন রাজা” বানিয়ে দিতে পারে।

৩. রাষ্ট্রের ভেতরে দ্বিতীয় রাষ্ট্র

সামরিক গোয়েন্দা, সাইবার, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, কূটনীতি সবকিছুতেই সেনাবাহিনীর আলাদা সিস্টেম তৈরি হবে।

৪. ভারতের জন্য কেন উদ্বেগজনক

ভারতের জন্য এটি তিন কারণে দুশ্চিন্তার বিষয়:

ক. পাকিস্তানে ক্ষমতা সম্পূর্ণ সামরিক হাতে গেলে সীমান্ত পরিস্থিতি অনিশ্চিত হবে।সেনাবাহিনী রাজনৈতিক হিসাব কম করে মাঠের সিদ্ধান্ত বেশি নেবে।

খ.আফগানিস্তানে মার্কিন‑পাকিস্তানি অপারেশন হলে আঞ্চলিক ব্যালান্স বদলে যাবে। এর প্রভাব ভারতের উত্তর সীমান্তেও পড়বে।

গ.চীন–পাকিস্তান–সৌদি–আমেরিকা চতুর্মুখী জটিলতা নতুন আঞ্চলিক জোট তৈরি করবে। যা ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থানকে চাপে ফেলতে পারে।

উপসংহার:  আসিম মুনিরের লিগ্যাল ইমিউনিটি শুধু পাকিস্তানের আইনগত সিদ্ধান্ত নয়।এটি একটি নতুন আঞ্চলিক শক্তি বিন্যাসের সিগন্যাল।সৌদি আরব একটি নিরাপত্তা‑অক্ষ তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান নীতিতে পুনরায় প্রবেশের চেষ্টা করছে।ট্রাম্প–ইস্রায়েল–গালফ অক্ষ আবার সক্রিয় হচ্ছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই অক্ষের “নতুন গিয়ার” হিসেবে প্রস্তুত হচ্ছে। এর মাশুল দেবে পাকিস্তানের জনগণ। গণতন্ত্র, রাজনীতি, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা সবকিছু আরো দুর্বল হবে। আর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি প্রবেশ করবে এক অনিশ্চিত, অস্থিতিশীল, সামরিকতান্ত্রিক ভবিষ্যতে।


লেখক- ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর