img

ন্যাপ (মোজাফ্ফর): একসময়কার শক্তিশালী বিরোধীদলের উত্থান, অবদান ও হারিয়ে যাওয়া

প্রকাশিত :  ০৮:৪৬, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ন্যাপ (মোজাফ্ফর): একসময়কার শক্তিশালী বিরোধীদলের উত্থান, অবদান ও হারিয়ে যাওয়া

সংগ্রাম দত্ত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ–মোজাফ্ফর) একসময় প্রধান বিরোধীদলের মর্যাদা রাখত। বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ নেতৃত্বে দলটি ছিল অসাম্প্রদায়িক, সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক স্বতন্ত্র শক্তি। তবে স্বাধীনতার পর পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশলগত ব্যর্থতা, সহযোগী দলের প্রভাব, ছাত্র সংগঠনের বিভাজন এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ন্যাপ ধীরে ধীরে রাজনীতির মঞ্চ থেকে হারিয়ে যায়। বিশিষ্ট লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও সোহরাব হাসান–এর প্রবন্ধের আলোকে ঐতিহ্যবাহী এ দল ও তার নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করা হলো।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ: এক মহানায়ক

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু ১৯৫৪ সালের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং শিক্ষকতার জীবন ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা হন।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার প্রবন্ধ “ইতিহাসের ক্রান্তিকালের এক মহানায়ক”–এ উল্লেখ করেছেন, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ রাজনৈতিক ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণের কোনো প্রলোভন মানেননি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান তাঁকে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একই প্রস্তাব দেন। কিন্তু অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ নীতির প্রশ্নে দু’বারই সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গাফ্ফার চৌধুরীর মতে, এ এক বিরল দৃষ্টান্ত, যা প্রমাণ করে তিনি ছিলেন ক্ষমতালোভী নন, বরং নীতিনিষ্ঠ ও আদর্শবান নেতা।

সোহরাব হাসান তার প্রবন্ধ “কুঁড়েঘরের মোজাফ্ফর আহমদ”–এ লিখেছেন, সাধারণ মানুষের কাছে তিনি কুঁড়েঘরের মোজাফ্ফর নামে পরিচিত ছিলেন। সরল জীবন, নৈতিক সততা এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস তাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।

ন্যাপের উত্থান

ষাটের দশকে ন্যাপ সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ছিল। বাম-মধ্যপন্থী রাজনীতির মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে তরুণ মেধাবীরা দলের প্রতি আকৃষ্ট হন। সোহরাব হাসান লিখেছেন, মণি সিংহ ও খোকা রায়ের মতো কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বাম চিন্তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে মেলাতে সক্ষম হন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ সমর্থন প্রদান করে। অন্যদিকে ভাসানীর চীনপন্থী দল ছয় দফার বিরোধিতা করে। এতে ন্যাপ জনগণের মধ্যে দৃঢ় অবস্থান লাভ করে এবং আওয়ামী লীগকেও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথে প্রভাবিত করে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপের অবদান

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ন্যাপের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

সোহরাব হাসান লিখেছেন, একাত্তরের সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে যান। মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি স্বাধীনতার প্রথম জাতীয় সরকারের দাবি তুলেছিলেন—সব মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণকারী দলকে মিলিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা। কিন্তু রাজনৈতিক জটিলতার কারণে এটি সম্ভব হয়নি।

স্বাধীনতার পর ন্যাপের সংকট

স্বাধীনতার পর ন্যাপ রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় অবস্থানে থাকলেও কিছু কারণে তা দুর্বল হয়ে পড়ে:

১৯৭৩ সালের ভিয়েতনাম দিবস মিছিল: পুলিশের গুলিতে দু’জন কর্মী নিহত হন।  ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আক্রমণ ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। ন্যাপ মোজাফফর সারাদেশে আন্দোলনের আহ্বান জানালেও সহযোগী দলগুলোর আলাদা সিদ্ধান্তের কারণে তাদের উদ্যোগ সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে । পরবর্তীতে সিপিবি নীতি পরিবর্তন করে সরকারকে সহযোগিতা করতে থাকে। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বেও ন্যাপ স্বাধীন বিরোধী শক্তি হিসেবে শত চেষ্টা করেও দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়।

ছাত্র সংগঠন বিভাজন: স্বাধীনতার পর ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপ থেকে সরে গিয়ে সিপিবির সঙ্গে যুক্ত হয়। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি গড়ে তোলেন, কিন্তু তিনি সারাদেশে সফর করে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে তাঁর ছাত্র সংগঠন সর্বোপরি ন্যাপকে কার্যকরী গণতান্ত্রিক প্রধান বিরোধী দলে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হন।

আদর্শিক বিতর্ক: ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি “ধর্ম–কর্ম সমাজতন্ত্র” তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এতে বামপন্থী মহলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের লক্ষ্য ছিল ধর্ম এবং সমাজতন্ত্রকে সমন্বিত করা—একটি দূরদর্শী চিন্তা, যা পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক মূলধারায় প্রভাব ফেলে।

হারিয়ে যাওয়ার কারণ

ন্যাপ–মোজাফ্ফর রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণগুলো হলো:

বাম রাজনীতির অনৈক্য ও বিভাজন: সোভিয়েত–চীন দ্বন্দ্ব দলকে দুর্বল করে।

ছাত্রভিত্তির ক্ষতি: ছাত্র ইউনিয়নের বিচ্ছিন্নতা সংগঠনকে শক্তিশালীভাবে ধরে রাখতে ব্যর্থ করে।

বিরোধী শক্তি হিসেবে স্থিত হতে ব্যর্থতা: আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমর্থন গ্রহণে ন্যাপ স্বাধীন বিরোধী শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারেনি।

ক্ষমতার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করা: মন্ত্রীত্ব ও রাষ্ট্রীয় পদ প্রত্যাখ্যান রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগকে সীমিত করেছে।

উত্তরসূরি সংকট: অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের পরে কোনো যোগ্য নেতা দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেনি।

রুগ্ন রাজনীতি: স্বাধীনতার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধীরে ধীরে অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রবণতা দেখা দিতে শুরু করে। বিশেষত বিপুল অর্থের প্রভাব, নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ভোট ক্রয়ের প্রবণতা এবং শক্তি নির্ভর অপসংস্কৃতির বিস্তারের কারণে ন্যাপের মতো আদর্শনিষ্ঠ ও সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দল জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। গরিব ও মেহনতী মানুষের স্বার্থরক্ষায় গড়ে ওঠা এই দলে কোটিপতি, পুঁজিপতি কিংবা শিল্পপতির উপস্থিতি ছিল না। অর্থের প্রভাব কিংবা ক্ষমতার প্রদর্শনীকে অবলম্বন না করায় সাধারণ মানুষও ক্রমে তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর ন্যাপের যে আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল, তা কার্যকরভাবে দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের উত্তরাধিকার

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন রাজনৈতিক আদর্শ ও নৈতিকতার এক অনন্য উদাহরণ। তিনি কখনও ক্ষমতার লোভে বিভ্রান্ত হননি। ২০১৫ সালে স্বাধীনতা পদক গ্রহণের প্রস্তাবও তিনি গ্রহণ করেননি। বিশিষ্ট লেখক গাফফার চৌধুরী ও সোহরাব হাসান উভয়েই উল্লেখ করেছেন, এমন নেতৃত্ব আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল।

তবে ন্যাপ–মোজাফ্ফরের পতনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদকে দায়ী করা যায় না।  সহযোগী দলের প্রভাব,  সাংগঠনিক দুর্বলতা, সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ফলাফল।

সমাপ্তি

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে ন্যাপ (মোজাফ্ফর) স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখে, সমাজতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রচার করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর দলটি সাংগঠনিক ও কৌশলগত কারণে রাজনীতির মঞ্চ থেকে হারিয়ে যায়।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদকে ইতিহাসের মহানায়ক এবং আদর্শনিষ্ঠ রাজনীতির দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণ করেছেন। সোহরাব হাসান বলেন, তিনি সাধারণ মানুষের কাছে “কুঁড়েঘরের মোজাফ্ফর”, যে রাজনীতির জন্য ব্যক্তিগত সুবিধা ছাড়েও সমাজের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন।

ন্যাপ (মোজাফ্ফর) হয়তো হারিয়ে গেছে, কিন্তু অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা ও সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিরকাল প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।


মতামত এর আরও খবর

img

উন্মুক্ত বিবেক, মুক্ত ফিলিস্তিন!!

প্রকাশিত :  ০৭:৩৬, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:৫২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

নুজহাত নূর সাদিয়া

আহা ! বুকের পাঁজর ভাঙা গগনবিদারী আর্তনাদ , নাহ-কোন নিরব জঠর যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাওয়া গর্ভবতী মায়ের নবজাতক জন্ম দেওয়ার অবিস্মরণীয় ক্ষণটি উদযাপনের আনন্দচ্ছোস নয়, এ যে সহস্র দিনের গ্লানি শেষে এক নিকষ কালো আঁধার পেরিয়ে মাতৃভূমির বুকে নির্ভীক পা রাখা । আবার সেই চিরপরিচিত সবুজ দুর্বা ঘাসে ছুঁটে বেড়ানো , বাড়ন্ত স্কোয়াশের পূর্ণ ঝুঁড়ি, মাংসের রসাল স্যুপ, হাতে বানানো গমের রুটি সহযোগে উদর পূর্তির সেই পারিবারিক সুখস্মৃতি , মায়ায় জড়ানো বছর পার করে দেওয়া সংগ্রামী পরিবারগুলো ফিরে কি পাবে তাদের সেই প্রাণোচ্ছল ফিলিস্তিন । বহু চর্চিত এই প্রশ্নটির উত্তর অজানা আশংকা আর অনিশ্চয়তার অদৃশ্য গেরোতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকলে ও বিপরীত শিবিরে ও বহু দিনের ঘরবন্দী প্রিয়মুখগুলো স্বজনদের বাহুডোরে ফেরার অপেক্ষায় । আগ্রাসী ইসরায়েলের ধূলো উড়ানো পথ ও যে আজ শান্তিকামী মানুষের স্বতস্ফূর্ত হাসিতে ভরপুর। 

আনুষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী, মোট হতাহতের সংখ্যা  ৬৬,০০০ হাজার ছাঁড়িয়ে গেছে, জীবন-ভর পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে ২,৫০,০০০ জন হতভাগ্যকে , বেঁচে যাওয়া অসংখ্য দুরন্ত শৈশব বাকিটা জীবন সম্ভবত এক দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবে, আকাশ ছোঁয়া দালান , সুসজ্জিত স্থাপনা আর পুরাকীর্তির শহর ফিলিস্তিন আজ এক মৃতপ্রায় ভুতুড়ে নগরী ।

এই যে  ক্ষতি , তা সন্দেহাতীতভাবেই অপূরণীয় ক্ষতি । নেতানিয়াহু নামের এক বিকট দানবের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর অপরিণামদর্শী যুদ্ধ কৌশলের খেস ারত দিতে হল ফোরাত নদীর তীরবর্তী নিরীহ প্রাণগুলোর। বিশ্ব মানচিত্র হতে ফিলিস্তিন নামক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটি ( গাজা প্রায়২১ লক্ষ লোকের আবাস) মাত্র মাসখানিক আগে ও নিরবে মুছে যাচ্ছিল ধনী রাষ্ট্রের তাবেদার মুসলিম বিশ্বের অলস শাসনকর্তাদের নির্লিপ্ত আচরণের কারণে । মুসলমান ভাই -ভাই, জুলুমবাজের নিস্তার নাই, বিপন্ন মানবতা বহুল চর্চিত প্রবাদগুলো নিতান্তই খাঁচায় বন্দি তোতাপাখির মুখস্থ বুলির মত আউড়ে চলছিল বিশ্বরাজনীতির মোড়লরা । তবে কি, আমজনতার পরম আরাধ্য পার্থিব জীবনের ও সমাপ্তি আছে, আর সেই সমাপ্তি বরাবরই ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়েছে স্রষ্টার একান্ত ইচ্ছেয়, অসহায়ের পূর্ণ সমর্থনে আর দিনশেষে সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ে ।

গৃহকোণের শান্তি গৃহকর্ত্রীর পরম প্রিয়, আর সেই শান্তির সুশীতল পরশ এ ভূগোলকের পরতে পরতে ছঁড়িয়ে দিতে যে উদ্যোগী মানুষগুলো অনন্য সাধারণ কাজগুলোকে বাস্তবতার আলো দেখান সে মানুষগুলোই কর্মকুশলতায় অর্জন করে নেন সর্ব্বোচ সম্মান -নোবেল । এ নোবেল প্রাপ্তি, কার ও দারিদ্র্য বিমোচনে, চলতি ‘২৫ সালে বিতর্কিত মারিয়া কোরিয়া মাচানো -যার রাষ্ট্রীয় নীতি বহু অসহায় মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে, প্রাক্তন  যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক সহ শান্তিতে নোবেল পাওয়া আলোচিত মানুষগুলো পুরষ্কারের কোঠা না মানদন্ড না তাদের কাজের বিষয় এ সূক্ষèাতিসূক্ষè বিষয়গুলো

রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, আর স্বেচ্ছাচারী কর্তা যখন নিজ খেয়াল-খুশি মত আইন -কানুন তৈরি করে অসহায়দের উপর তা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন তখন তা ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা জায়ানবাদীদের  আধিপত্য আর কতৃর্ত্ববাদের নির্মমতার করুণ পুনরাবৃত্তি বই আর কিছুই নয় । আর ও নির্মম কৌতুক, একদা জায়ানবধের রাজ্য বলে খ্যাত , হিটলারের জার্মান, মাঁখোর  ফ্রান্স , কূটনৈতিক ব্রিটেন সহ দু‘মুখো আরব বিশ্ব সকলে এ নির্মম রসিকতায় সামিল ! দুনিয়া যে ক্ষমতা আর অর্থের পূজারী - পড়ন্ত বেলার প্রাজ্ঞ প্রবীণদের গভীর হতাশার সুরে তা সুস্পষ্ট ।

রুপকথার গল্পের চেয়ে ও বাস্তব জীবনের গল্প অনেকসময় অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠে , হয়ে উঠে প্রকৃত রুপক নতুবা তার চেয়ে ও শক্তিশালী আখ্যান । বিশ টি বছর ধরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর নানা প্রতিকুলতায় অবরুদ্ধ হামাস , ঠিক জিতে গেল সাহস আর দেশের প্রতি ভালবাসাকে হৃদয়ে লালন করে।

আর, সেই ছোট্ট গেরিলা সদস্যের দলটি আজ কত বড়! মানচিত্র ছাঁড়িয়ে , সীমানা ছাঁড়িয়ে নব প্রজন্মের অকুতোভয় হামাসরা আজ দুয়ারে দাঁড়ানো দৃঢ় দ্বাররক্ষী । তারাই পারে ,তথাকথিত অজেয় পশ্চিমা শক্তিকে শান্তিচুক্তি নামক সে নাটকীয় ঘটনার অন্যতম যোগানদার করতে। মার্কিন সরকার প্রধান উপযাচক মাত্র-পরিস্থিতি বুঝেই হয়তবা বন্ধুর পথে হাঁটতে চাইছেন, ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বর্মটি যে ভিষণ শক্তপোক্ত ও একরোখা ।

তবে, মধ্যপ্রাচ্যে ছঁড়ি ঘুরানোর দীর্ঘদিনের শক্তলাঠিটি কে যে এবার বাঁকাতেই হয় ।  সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙবে না, হায় বেনিয়ামিন  কি অসম্মানের এক পরাজয় ! কি অপেক্ষা করছে দুর্নীতি মামলায় জর্জরিত বুড়ো নেকড়েটির কপালে -বিধ্বস্ত চেহারায় কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো দীর্ঘতর হচ্ছে বৈকি।

প্রতিরোধ, যুদ্ধের নামে আগ্রাসন আর বসতি স্থানান্তরের নামে বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক শরণার্থী , আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় হয়তবা এখন পর্যন্ত বিজয় উদযাপনে ব্যস্ত । তবে নারীর প্রতি সম্মান রক্ষার্থে ট্রাম্প তার প্রাক্তন রাজনৈতিক প্রতিদন্বী বারাকের উপর সম্ভবত সচেতনভাবেই তার রাষ্ট্র পরিচালনার মেয়াদকালে বিতর্কিত সন্ত্রাসী বনাম ইসলামিক সেনাবাহিনী মতানৈক্যের বিষয়টির উপর  ইঙ্গিত দিয়েছেন । আর , ব্রিটিশ সংসদে চিত্রিত ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে পুরনো বন্ধু ব্লেয়ারের পদাংক অনুসরিত কিনা, তাই আপনমনে যাচাই-বাছাই করে চলেছেন। 

পরিস্থিতির পরিবর্তিত মোড় , কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন লিখিত শান্তি  চুক্তির যে ভিন্ন ভিন্ন ২০টি শর্ত শোভা পাচ্ছে  তার সুচারু বাস্তবায়ন খোদ ট্রাম্পের পক্ষেই যথেষ্ট দুরুহ । পেন্ডুলামের কাঁটা চলমান, হঠকারী ছোটভাই একবার নয় বেশ ক‘বার বড় ভাইয়ের অবাধ্য হয়েছেন , আস্ত উড়োজাহাজ উপহার আর বন্ধুপ্রতীম কাতারের উপর অর্তকিত আক্রমণ । রক্তে যার খুনে নেশা সে পাগলা ঘোড়া কি আদৌ থামবে ? বিলুপ্ত হিজবুল্লা, হুতির হারিয়ে যাওয়া হামাসের নেতৃত্বের শক্তি ক্ষয় , সিরিয়ায় ভাঙ্গন, ইরানের সফল প্রতিরক্ষার ব্যুহ ভেদ- আপাত , দ্বিধাগ্রস্থ ইসরাইল প্রধান সফলতার মাপকাঠিতে আত্নতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন হয়তবা ।  তবে,গাজামুখি সারি সারি ত্রাণবাহী গাড়ির বহরের দী¦প্ত যাত্রা কি তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় নি, নিশ্চিতভাবেই উত্তরটি হ্যা ।

কাঁকচক্ষু দৃষ্টিতে , দৃঢ়তা আর ন্যায়ের বিজয় তবে, অসম এ যুদ্ধে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের চড়া মূল্য দিতে হল  হামাসকে। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়  হামাস , নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক , প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। এই যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ সেই জীবননাশের মূল্য দিতে হল চরমভাবে-গত দু‘বছরে ৬৭,০০০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত । শক্তিশালী শত্রুর সাথে টক্কর লাগানো  কি এত সোজা!  লোকবল আর সামরিক শক্তিতে তুলনামূলক ভাবে পিঁছিয়ে, তবে কিনা নীতি আর ঈমানের শক্তিতে বরাবরি বলীয়ান হামাসিয়ানরা । তাই , এ ক্রান্তিকালে ও ধাপে ধাপে অধিকাংশ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল তারা, সর্বশেষ গাজায় ৪৮ জন বন্দী ছিলেন , বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবান ২০ জন। আর্ন্তজাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে দু‘ধাপে জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় হামাস গত ১৩ই অক্টোবর । মৃতদের মাঝে চার জনের মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা ও জানিয়েছে তারা।অপরদিকে, প্রতিপক্ষ ইসরাইলের আচরণ রুঢ়তার সীমা আকাশ  ছুঁয়েছে  বহু আগেই-কারাগারে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা এবং নিপীড়ন করা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যৌন হয়রানির খবর ও পাওয়া গেছে । আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আল-রিমায়ি বলেন- এ দু‘টি বছরে তার ওজন কমেছে ৫০ কেজি ! হাড় সর্বস্ব শরীর জড়িয়ে কন্যার ব্যাকুল আর্তি, বাবা আমি ব্যাথা পাই ।

এখন আবার ট্রাম্পের নতুন চমক, ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপনাস্ত্র উপহার দিবেন এই পাগলাটে রাষ্ট্রপতি রাশান যুদ্ধ থামাতে ।  শুরু হওয়া আফগান -পাকিস্তান সংঘাতে ও তালেবান দের ভূমিকা নিয়ে এক নতুন চেহারার ব্যবসায়ীকে দেখা গেছে -জামাতা কুশনারের ব্যবসায়িক বুদ্ধির জুড়ি নেই রাজনৈতিক বুদ্ধিতে ও যে  শ্বশুরকে ভবিষ্যতে টেক্কা দিতে সমর্থ  হবেন  তা তার সাম্প্রতিক স্রোত বুঝে চলার ই পরিপক্ক রুপ ।

আজকের এই পার্থিব পৃথিবীতে  স্রোতস্বিনী টেমস নদী ব্যবহারের মাসকাবারি বিল পরিশোধের সময় ও যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি মগজে নিত্য গেঁথে থাকে -প্রতিটি পানিবিন্দু পরিশোধে পাওনা প্রাপ্য ! অর্থাৎ, জীবনের অপর নাম পানি ও বাতাস সেবনে ও মূল্য চুকাতে হয়, তা যদি হয় কেনসিংটন নামক অভিজাত এলাকার মনোরম ব্যালকনির মুক্ত হাওয়া । বিনামূল্যে    সেবা, সে তো অতীতের গাল গল্প । অথচ, নিঠুর ইসরাইলী বাহিনী    গাজায় ৩০০০ জলপাই গাছ  কেটে , অগণিত বন্য ও পোষা  প্রাণী মেরে আক্ষরিক অর্থেই প্রকৃতিকে বিপন্ন করে  তুলতে চাইছিল  । সেই প্রকৃতিই কিনা আপন মহিমায়  নতুন বোনা জলপাই গাছের পাশ দিয়ে ছুটন্ত শিশুদের  সাদরে বরণ করছে যাদের খাঁচা ভর্তি প্রিয় পোষা  পাখিটির  গুঞ্জন।   

ফিলিস্তিন বাসীদের প্রিয় ম্যান্ডেলা ‘ আল ফাত্তাহ ‘ এখন ও জায়ানবাদীদের জিম্মায় ,  ইসরাইলী সেনাবাহিনী তাকে যমের মত ভয় পায় -যার মুক্তির আলো দেখা এখন ও সংশয়ে ভরা । সন্দেহাতীতভাবেই, তিনিই প্যালেস্টাইনি জনগণের অবিস্বরণীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী আন্দোলনের দিকপাল ।

আজকের দিনের ফ্রি পত্রিকাগুলোর অন্যতম স্লোগান-মুক্ত খবর, মুক্ত চিন্তা । আর বিশ্বজুঁড়ে এই প্রবল বিজয় উদযাপনে মানবতাবাদীদের একটাই আশা মুক্ত হোক মানবতা , জয় হোক শুভ বুদ্ধির।



নুজহাত নূর সাদিয়া,
এলবিপিসি, লন্ডন ১৪ই অক্টোবর‘ ২৫ সাল ।

মতামত এর আরও খবর