img

ন্যাপ (মোজাফ্ফর): একসময়কার শক্তিশালী বিরোধীদলের উত্থান, অবদান ও হারিয়ে যাওয়া

প্রকাশিত :  ০৮:৪৬, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ন্যাপ (মোজাফ্ফর): একসময়কার শক্তিশালী বিরোধীদলের উত্থান, অবদান ও হারিয়ে যাওয়া

সংগ্রাম দত্ত

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ–মোজাফ্ফর) একসময় প্রধান বিরোধীদলের মর্যাদা রাখত। বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ নেতৃত্বে দলটি ছিল অসাম্প্রদায়িক, সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির এক স্বতন্ত্র শক্তি। তবে স্বাধীনতার পর পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশলগত ব্যর্থতা, সহযোগী দলের প্রভাব, ছাত্র সংগঠনের বিভাজন এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ন্যাপ ধীরে ধীরে রাজনীতির মঞ্চ থেকে হারিয়ে যায়। বিশিষ্ট লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও সোহরাব হাসান–এর প্রবন্ধের আলোকে ঐতিহ্যবাহী এ দল ও তার নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করা হলো।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ: এক মহানায়ক

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ঢাকা কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু ১৯৫৪ সালের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং শিক্ষকতার জীবন ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা হন।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার প্রবন্ধ “ইতিহাসের ক্রান্তিকালের এক মহানায়ক”–এ উল্লেখ করেছেন, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ রাজনৈতিক ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় পদ গ্রহণের কোনো প্রলোভন মানেননি। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান তাঁকে মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একই প্রস্তাব দেন। কিন্তু অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ নীতির প্রশ্নে দু’বারই সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। গাফ্ফার চৌধুরীর মতে, এ এক বিরল দৃষ্টান্ত, যা প্রমাণ করে তিনি ছিলেন ক্ষমতালোভী নন, বরং নীতিনিষ্ঠ ও আদর্শবান নেতা।

সোহরাব হাসান তার প্রবন্ধ “কুঁড়েঘরের মোজাফ্ফর আহমদ”–এ লিখেছেন, সাধারণ মানুষের কাছে তিনি কুঁড়েঘরের মোজাফ্ফর নামে পরিচিত ছিলেন। সরল জীবন, নৈতিক সততা এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস তাকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।

ন্যাপের উত্থান

ষাটের দশকে ন্যাপ সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী ছিল। বাম-মধ্যপন্থী রাজনীতির মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে তরুণ মেধাবীরা দলের প্রতি আকৃষ্ট হন। সোহরাব হাসান লিখেছেন, মণি সিংহ ও খোকা রায়ের মতো কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বাম চিন্তার সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে মেলাতে সক্ষম হন।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ সমর্থন প্রদান করে। অন্যদিকে ভাসানীর চীনপন্থী দল ছয় দফার বিরোধিতা করে। এতে ন্যাপ জনগণের মধ্যে দৃঢ় অবস্থান লাভ করে এবং আওয়ামী লীগকেও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথে প্রভাবিত করে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপের অবদান

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ন্যাপের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

সোহরাব হাসান লিখেছেন, একাত্তরের সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে যান। মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি স্বাধীনতার প্রথম জাতীয় সরকারের দাবি তুলেছিলেন—সব মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণকারী দলকে মিলিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা। কিন্তু রাজনৈতিক জটিলতার কারণে এটি সম্ভব হয়নি।

স্বাধীনতার পর ন্যাপের সংকট

স্বাধীনতার পর ন্যাপ রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় অবস্থানে থাকলেও কিছু কারণে তা দুর্বল হয়ে পড়ে:

১৯৭৩ সালের ভিয়েতনাম দিবস মিছিল: পুলিশের গুলিতে দু’জন কর্মী নিহত হন।  ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আক্রমণ ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। ন্যাপ মোজাফফর সারাদেশে আন্দোলনের আহ্বান জানালেও সহযোগী দলগুলোর আলাদা সিদ্ধান্তের কারণে তাদের উদ্যোগ সীমিত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে । পরবর্তীতে সিপিবি নীতি পরিবর্তন করে সরকারকে সহযোগিতা করতে থাকে। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বেও ন্যাপ স্বাধীন বিরোধী শক্তি হিসেবে শত চেষ্টা করেও দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়।

ছাত্র সংগঠন বিভাজন: স্বাধীনতার পর ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপ থেকে সরে গিয়ে সিপিবির সঙ্গে যুক্ত হয়। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি গড়ে তোলেন, কিন্তু তিনি সারাদেশে সফর করে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে তাঁর ছাত্র সংগঠন সর্বোপরি ন্যাপকে কার্যকরী গণতান্ত্রিক প্রধান বিরোধী দলে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হন।

আদর্শিক বিতর্ক: ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি “ধর্ম–কর্ম সমাজতন্ত্র” তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এতে বামপন্থী মহলে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছেন, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের লক্ষ্য ছিল ধর্ম এবং সমাজতন্ত্রকে সমন্বিত করা—একটি দূরদর্শী চিন্তা, যা পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক মূলধারায় প্রভাব ফেলে।

হারিয়ে যাওয়ার কারণ

ন্যাপ–মোজাফ্ফর রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণগুলো হলো:

বাম রাজনীতির অনৈক্য ও বিভাজন: সোভিয়েত–চীন দ্বন্দ্ব দলকে দুর্বল করে।

ছাত্রভিত্তির ক্ষতি: ছাত্র ইউনিয়নের বিচ্ছিন্নতা সংগঠনকে শক্তিশালীভাবে ধরে রাখতে ব্যর্থ করে।

বিরোধী শক্তি হিসেবে স্থিত হতে ব্যর্থতা: আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমর্থন গ্রহণে ন্যাপ স্বাধীন বিরোধী শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারেনি।

ক্ষমতার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করা: মন্ত্রীত্ব ও রাষ্ট্রীয় পদ প্রত্যাখ্যান রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগকে সীমিত করেছে।

উত্তরসূরি সংকট: অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের পরে কোনো যোগ্য নেতা দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেনি।

রুগ্ন রাজনীতি: স্বাধীনতার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ধীরে ধীরে অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রবণতা দেখা দিতে শুরু করে। বিশেষত বিপুল অর্থের প্রভাব, নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ভোট ক্রয়ের প্রবণতা এবং শক্তি নির্ভর অপসংস্কৃতির বিস্তারের কারণে ন্যাপের মতো আদর্শনিষ্ঠ ও সুস্থ ধারার রাজনৈতিক দল জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। গরিব ও মেহনতী মানুষের স্বার্থরক্ষায় গড়ে ওঠা এই দলে কোটিপতি, পুঁজিপতি কিংবা শিল্পপতির উপস্থিতি ছিল না। অর্থের প্রভাব কিংবা ক্ষমতার প্রদর্শনীকে অবলম্বন না করায় সাধারণ মানুষও ক্রমে তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী উল্লেখ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর ন্যাপের যে আদর্শ ও লক্ষ্য ছিল, তা কার্যকরভাবে দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের উত্তরাধিকার

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন রাজনৈতিক আদর্শ ও নৈতিকতার এক অনন্য উদাহরণ। তিনি কখনও ক্ষমতার লোভে বিভ্রান্ত হননি। ২০১৫ সালে স্বাধীনতা পদক গ্রহণের প্রস্তাবও তিনি গ্রহণ করেননি। বিশিষ্ট লেখক গাফফার চৌধুরী ও সোহরাব হাসান উভয়েই উল্লেখ করেছেন, এমন নেতৃত্ব আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল।

তবে ন্যাপ–মোজাফ্ফরের পতনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদকে দায়ী করা যায় না।  সহযোগী দলের প্রভাব,  সাংগঠনিক দুর্বলতা, সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ফলাফল।

সমাপ্তি

অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে ন্যাপ (মোজাফ্ফর) স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখে, সমাজতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রচার করে। কিন্তু স্বাধীনতার পর দলটি সাংগঠনিক ও কৌশলগত কারণে রাজনীতির মঞ্চ থেকে হারিয়ে যায়।

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদকে ইতিহাসের মহানায়ক এবং আদর্শনিষ্ঠ রাজনীতির দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণ করেছেন। সোহরাব হাসান বলেন, তিনি সাধারণ মানুষের কাছে “কুঁড়েঘরের মোজাফ্ফর”, যে রাজনীতির জন্য ব্যক্তিগত সুবিধা ছাড়েও সমাজের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন।

ন্যাপ (মোজাফ্ফর) হয়তো হারিয়ে গেছে, কিন্তু অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা ও সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিরকাল প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।


মতামত এর আরও খবর

img

আগামী নির্বাচনের আগাম পূর্বাভাস

প্রকাশিত :  ১৫:২৮, ২৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৭:২২, ২৫ নভেম্বর ২০২৫

সাইফুল খান 

বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক রোগে আক্রান্ত, যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। এই রোগের নাম "ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা"। আর এই রোগের উপসর্গ অন্ধত্ব। আমরা সবাই এই অন্ধত্বে আক্রান্ত। নেতা, কর্মী, বুদ্ধিজীবী এমনকি সেই সাধারণ মানুষটিও, যে প্রতি পাঁচ বছর পরপর ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবে সে কিছু একটা পরিবর্তন করবে। অথচ পরিবর্তনের নামে সে কেবল সেই পুরনো অসুখটাকেই বুকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। সেটার নাম হতাশা।

বিএনপি এই দেশে বিরোধী রাজনীতির বৃহত্তম শক্তি। এ কথা যে মিথ্যা নয়, তা সমীক্ষার সংখ্যাই বলে দেয়। Innovision-এর “People’s Election Pulse Survey (PEPS)”–এ ১০,৪১৩ জন নাগরিকের সাক্ষাতে উঠে এসেছে— ৪১.৩% ভোটার বিএনপিকে ভোট দিতে প্রস্তুত।

আর যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না থাকে তাহলে সেই সমর্থন লাফিয়ে গিয়ে ৪৫.৬%।

৩৯.১% মানুষ মনে করে তারা “আগামী সরকারের যোগ্য দল”। খুলনায় ৪৩.৩%, ময়মনসিংহে ৪৫.৭% সমর্থন এগুলো কোনো সাধারণ সংখ্যা নয়।

কিন্তু শক্তির শিখরে দাঁড়িয়ে যে বিভাজন শুরু হয়েছে, সেটিই BNP-এর সবচেয়ে বড় শত্রু।

শত্রু আওয়ামী লীগ নয়; শত্রু গণতন্ত্র নয়; শত্রু সামরিক বা অ-সামরিক কোনো শক্তিও নয়। তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু নিজেদের ভেতরের মানুষগুলো।

২৩৭টি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলো, আর দলটি মুহূর্তেই ডুমুরের পাতার মতো কাঁপতে লাগলো। মনোনয়ন বঞ্চিতদের ত্যাগী নেতাদের চোখে ক্ষোভ, কথায় ব্যঙ্গ, বুকে প্রতিহিংসা। তারা ভাবলো “দল আমাকে দেয়নি, দেশ আমাকে অবশ্যই দেবে।” ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঢল দেখার অপেক্ষা করতেই পারে জনগন। 

রাজনীতির এই কান্না, এই আক্রোশ, এই আত্মপরাজয়ের গল্প এমন সময় ঘটছে যখন বিরোধী ভোট তিনটি ধারায় ভেঙে সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছে।

প্রথম ধারাটি হলো- জামায়াত–ই–ইসলামি।

জামায়াত বিরোধী পোক্ত রাজনৈতিক ন্যারেটিভের কারনে অনেকে তাদের অপছন্দ করে। আবার অনেকেই ভালোও বাসে। কিন্তু সংখ্যার গাণিতিক সত্যকে কোনো দার্শনিক লেকচার দিয়ে বদলানো যায় না। জামায়াত জাতীয়ভাবে ৩০.৩% সমর্থন পাচ্ছে এই একই সমীক্ষায়।  রংপুরে তারা ৪৩.৪% যেখানে বিএনপিকেও তারা ছুঁয়ে ফেলে।

এই দলের সঙ্গে এখন আরও ৮টি সমমনা দল যুক্ত হয়েছে৷ একটি জোট, যার উদ্দেশ্য রাজনীতিকে পুনরায় এক বৈশিষ্ট্যময় রূপ দেওয়া।

বিএনপি কি এই বাস্তবতা দেখে?

হ্যাঁ, দেখে।

কিন্তু তারা দেখে ঠিক যেভাবে সূর্যাস্তের দিকে তাকালে মানুষ চোখ বুজে ফেলে।

তারপর আসে তৃতীয় লাইন NCP, জাতীয় নাগরিক পার্টি।  এটি নতুন প্রজন্মের দল।

PEPS-এ এদের সমর্থন ৪.১%। BIGD রিপোর্টে ২.৮%। কিন্তু যুবসমাজে SANEM-এর হিসাব বলছে ১৫.৮৪% সম্ভাবনা।

এই সংখ্যা হয়তো ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু “রাজনীতি” নামের যে মৃগয়ায় আসন দখল করতে হয় তার জন্য এই পরিমাণ ভোটই কখনো কখনো সরকার পরিবর্তনের কাঁটা ঘুরিয়ে দেয়।

এনসিপি এমন সময়ে জোট করছে যখন বিএনপি নিজ ঘর সামলাতে ব্যস্ত। জামায়াত তার সমর্থনকে শক্ত জোটে রূপ দিচ্ছে, আর আওয়ামী লীগ নীরব কিন্তু সতর্ক। এনসিপি যেভাবে তরুণ ভোটারের মনস্তত্ত্বে ঢুকেছে BNP তা পারেনি। এনসিপির এই উত্থানই বিশ্লেষকদের মুখে এক নতুন সত্য তুলে এনেছে। জামায়াত যতটা নয়, এনসিপির জোট বিএনপির ভোটকে আরও বেশি ক্ষয় করতে পারে।

এবার জনগণের দিকে তাকাই। PEPS বলছে-

৫৭.৫% মানুষ আইন-শৃঙ্খলাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে করে। দ্বিতীয় সমস্যা মূল্যস্ফীতি।

দুর্নীতি ও আইনি সংস্কারও শীর্ষ তালিকায়।

আর সবচেয়ে বড় কথা ৪৮.৫% ভোটার এখনও অনির্ধারিত।

এই অনির্ধারিত মানুষের দলটাই আসল নাটকের মূল চরিত্র। তারা এমন জনগোষ্ঠী যারা রাষ্ট্রের অস্থিরতার মাপ দেখে সিদ্ধান্ত নেয়, দলের পতাকা দেখে নয়। এই অনির্ধারিত মানুষদের ভোট BNP হারাবে কিনা, তা ঠিক করবে তাদের ভেতরের বিভাজন, জামায়াতের জোটগত শক্তি এবং এনসিপির আগ্রাসী নতুন-রাজনীতির ভাষা।

বিএনপি হয়তো সমীক্ষায় এগিয়ে আছে, কিন্তু রাজনীতি কেবল সমীক্ষার খেলাও নয়।এটি সময়ের নির্মম ব্যঙ্গ। যে দল নিজের ঘরে শান্তি রাখতে পারে না, সে কি দেশের শান্তি রাখতে পারবে? প্রশ্ন অবান্তর নয়, যৌক্তিক।

বিএনপির ভেতরের ক্ষয়, জামায়াতের আলাদা শক্তি, এনসিপির যুব-স্রোত এই তিনটি মিলিয়ে বিএনপির সম্ভাব্য ভোট উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে এমনটাই সমীক্ষা, বিশ্লেষক এবং মাঠের বাস্তবতা একসঙ্গে নির্দেশ করছে। সময়ের সাথে বিএনপির ভোট কমার আশংকাই নির্দেশ করছে।

রাজনীতি শেষ পর্যন্ত মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপর দাঁড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি দাঁড়ায় মানুষের ক্ষোভের ওপর। আর যে দেশে ক্ষোভই প্রধান চালিকাশক্তি। সেখানে বিভাজনই প্রকৃত নিয়ন্তা।

বিএনপি কি এই বিভাজন সামলাতে পারবে?

জামায়াত কি তাদের জোটকে সত্যিকারের শক্তিতে রূপ দিতে পারবে? এনসিপি কি নতুন প্রজন্মের বিশ্বাসকে ভোটে পরিণত করতে পারবে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা পেতে পারি।

কিন্তু রাজনীতি? রাজনীতি কখনো সরাসরি উত্তর দেয় না। সে দেয় সংকেত, দেয় ইঙ্গিত, আর মাঝেমধ্যে দেয় নির্মম হাসি।

শেষ পর্যন্ত মনে হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন শুধু একটি গণতান্ত্রিক অনুষ্ঠান নয়; এটি ক্ষমতার মনস্তত্ত্বের এক বিশাল মানসিক-নাট্যমঞ্চ, যেখানে প্রত্যেক দল নিজের ট্র্যাজেডি নিজেই রচনা করে, নিজেই অভিনয় করে, আর শেষে বিস্ময়করভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত করতালি দাবি করে!


লেখক-ইতিহাস,রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর