img

উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও সমাজ সংস্কারক ব্যারিষ্টার আনন্দ মোহন বসু

প্রকাশিত :  ০৮:৫০, ১৯ আগষ্ট ২০২৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি: ২০শে আগষ্ট মৃত্যুবার্ষিকী

উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও সমাজ সংস্কারক ব্যারিষ্টার আনন্দ মোহন বসু
সংগ্রাম দত্ত
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক, শিক্ষানুরাগী ও রাজনীতিবিদ  ব্যারিস্টার আনন্দ মোহন বসুর  স্থাপত্য-কীর্তির অনন্য নিদর্শন ও পূর্বসূরিদের বসতবাড়ি একশ্রেণীর প্রভাবশালী লোক দখল করে নিয়েছে। স্থানীয় লোকেরা এসব উদ্ধার করে হেরিটেজ বা মিউজিয়াম বানানোর দাবি জানাচ্ছে।

১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত তথা বর্তমান বাংলাদেশের  কিশোরগঞ্জ জেলা  ইটনা থানার জয়সিদ্ধি গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এক সময় পুর্ব পুরুষের পৈতৃক নিবাস ছিল হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানার জলসুখা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম পদ্মলোচন বসু, মাতার নাম উমা কিশোরী নন্দী মজুমদার। ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসুর মা উমাকিশোরী নন্দী মজুমদার হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার আন্দিউড়া গ্রামের বিখ্যাত নন্দী পরিবারের মেয়ে।আনন্দ বসুর মামার নাম হরনাথ মজুমদার।আনন্দমোহন বসুর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ময়মনসিংহে।

১৮৬২ সালে  ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় ৯ম স্থান অধিকার করে এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। আনন্দমোহন বসু বিয়ে করেন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভগবান চন্দ্র বসুর কন্যা স্বর্ণপ্রভা বসুকে। বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন হলেন স্বর্ণপ্রভা বসু।
১৮৬৪ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৮৬৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। বিএ পরীক্ষায়ই শীর্ষস্থান অধিকার করেন।
 ১৮৭০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত প্রেমচাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ইংল্যান্ড চলে যান। 
১৮৭৪ সালে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে উচ্চতর গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করেন। অনার্সসহ ডিগ্রী পরীক্ষা তথা ট্রাইপস পরীক্ষা প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। প্রথম ভারতীয় র‌্যাংলার বা গণিতবিদ হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ভারতবর্ষের তিনজন র‍্যাংলার ছিলেন। প্রথমজন হলেন ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু, দ্বিতীয়জন হলেন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার কিরন চন্দ্র দে,তৃতীয়জন হলেন নরসিংদী জেলার ভাটপাড়া গ্রামের কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত বা কেজি গুপ্ত।
১৮৭৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিষ্টার পাশ করেন।
১৮৭৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। 
১৮৭৫ সালে ক্যালকাটা স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন প্রতিষ্টা করেন।
১৮৭৬ সালে কলকাতায় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৮৭৮ সালের ১৫ মে ব্রাক্ষ সমাজ প্রতিষ্টা করেন। স্ত্রীসহ ব্রাক্ষ ধর্ম গ্রহন করেন।
১৮৭৯ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর সহযোগিতায় কলকাতায় সিটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । এটি এখন কলকাতা আনন্দমোহন কলেজ। 
১৮৮২ সালে ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিটির সদস্য হন।
১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহ শহরে ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন নামে বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা বর্তমানে আনন্দমোহন কলেজ। 
১৮৮৩ সালে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের একটি জাতীয় সভার আলোচনা সভার আহবান করেন।এই এসোসিয়েশনই \" ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস\" এ পরিনত হয়।
১৮৮৪ সালে ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন।
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্টার অন্যতম সদস্য ছিলেন। 
১৮৯০ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন।
১৮৯২ সালে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় Calcutta University Act of Incorporation সংশোধন করা হয়। যার কারনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গীয় আইন পরিষদে একজন সদস্য নির্বাচন করার অধিকার লাভ করেন।
১৮৯৫ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
১৮৯৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন।
১৯০৬ সালের ২০ আগষ্ট ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে  কলকাতায় মৃত্যুবরন করেন।
ময়মনসিংহ জেলা শহরের রামবাবু রোড এলাকায় অবস্থিত বর্তমান সিটি কলেজিয়েট স্কুলটি ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসুর পৈতৃক নিবাস।
গত ২৩ শে সেপ্টেম্বর ২০২১ জাতীয় দৈনিক যুগান্তর এ \"স্মরণীয় কীর্তির বিস্মৃত পুরুষ\" শীর্ষক এক প্রতিবেদনে
দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও  এডভোকেট
ফজলুর রহমান লিখেছেন যে আনন্দমোহন বসুর স্মৃতিবিজড়িত তাঁর জন্ম স্থান জয়সিদ্ধিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপত্য-কীর্তির অনন্য নিদর্শন, তাঁর পূর্বসূরিদের বসতবাড়িটি বর্তমানে বেদখল।
জানা গেছে, একটি ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলের মোহাম্মদ আব্দুল হাই নামের স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা আনন্দমোহন বসুর বিশাল আয়তনের এ বাড়িটিকে দখল করে রেখেছেন।
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমান যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো  লিখেছেন যে, র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসুর জন্ম ভিটার এখন বেহালদশা। বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি বিখ্যাত এ সমাজ সংস্কারকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি বেদখল হয়ে আছে। ফলে অরক্ষিত জন্মভিটায় অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন বসতবাড়িটি।
কয়েক একর আয়তনের বাড়িটিতে রয়েছে কয়েকটি বিশাল ভবন, খোলা মাঠ ও একাধিক পুকুর। বিশাল বসতবাড়িটি পরিণত হয়েছে পরগাছা উদ্ভিদের বাসস্থানে। চারদিকে নির্মিত প্রতিরক্ষা দেওয়ালের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দেওয়ালের অনেক জায়গার ইট-পাথর দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে। আনন্দমোহন বসুর আঁতুড়ঘরটিকে বানানো হয়েছে গোবরের গর্ত। এ অবস্থায় ঐতিহ্যের নিদর্শন এসব স্থাপনা বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী আনন্দমোহন বসুর জন্ম স্থান ও বসতবাড়ি দেখার জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রায়ই দর্শণার্থীরা আসেন। কিন্তু বসতবাড়িটি বেদখল হয়ে থাকায় বাড়িটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত পর্যায়ে চলে গেছে। এরপরও বসতবাড়িটি উদ্ধার কিংবা সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ বা আগ্রহ নেই প্রশাসন কিংবা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক এ স্থানটিকে সংরক্ষণ করে তাঁর পণ্য স্মৃতি ও স্থাপত্যকীর্তির প্রতি সম্মান জানাবে, এ প্রত্যাশা এলাকাবাসীসহ বসুর ঐতিহ্য।
গত ৩ মে ২০১৮ দেশের স্বনামধন্য ইংরেজি পত্রিকা দি ডেইলি স্টার ঐতিহ্য বাড়িটি সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান এর এক সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, “জয়সিদ্ধি গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে বসুর পূর্বপুরুষ জয়রাম ও সিদ্ধিরাম বসুর নামে।  “১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় বোস পরিবারকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।  তখনই আমির উদ্দিন জমি দখল করে নেন।
প্রায় আট বছর আগে মারা যাওয়া আমির উদ্দিন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব।  এই সম্পত্তির বর্তমান দখলদারদের পিতা।  বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফজলুর বলেন, বর্তমান দখলদারদের পিতা সংলগ্ন আলগাপাড়ার স্বাধীনতাবিরোধী নেতা ছিলেন।
 “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমির স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন বলে ইটনা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নজরুল ইসলাম ঠাকুর ডেইলি স্টারের প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
স্পষ্টভাষী রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমান বলেছেন প্রথমে আমির সম্পত্তিটি \'লিজ\' নিয়েছিলেন।  ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় সম্প্রদায় তাকে  উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে তিনি পুনরায় দখলে ফিরে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐতিহ্যবাহী এ বাড়ি থেকে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়েছিল। বোসের গ্রন্থাগারের শত শত বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়।  বাড়ির সামনে দুটি বড় পুকুর ছিল কিন্তু সেগুলি কয়েক বছর ধরে ভরাট হয়ে গেছে।”
সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ বোস সম্পত্তি দখল মুক্ত করে একটি পাবলিক হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করার দাবি জানান। 
আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি  মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল একমত হন, “কোনও ইজারা থাকলে তা বাতিল করা উচিত।  “বোসের সম্পত্তি দখলমুক্ত করা উচিত।  সেই জমি বৃহত্তর ময়মনসিংহের জন্য অমূল্য ঐতিহ্য এবং জনসাধারণের কাজে ব্যবহার করা উচিত।  আমরা শীঘ্রই এটি মুক্ত করার জন্য একটি আন্দোলন শুরু করব ।\"
কিশোরগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ আসাদ উল্লাহ একইভাবে সম্পত্তি উদ্ধার করে জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
স্থানীয় সংগঠন জাগোরিতো ইটনার আহ্বায়ক কামরুল হাসান খান জুয়েল বলেছেন, “গত বছর বসতবাড়ি ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল।
আমিরের ছেলে এবং জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাই তার বাবা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।  \"আমার বাবা ১৯৬৭ সালে বোস পরিবারের প্রায় দুই একর জমি লিজ নিয়েছিলেন তিনি বলেছেন।  “মুক্তিযুদ্ধের পর ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নবায়ন করা হয়।  আমার বাবা স্থানীয় শান্তি কমিটির সাথে জড়িত ছিলেন না।  এলাকায় এমন কোনো রিপোর্ট নেই।”
ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তৎকালীন ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মশিউর রহমান খান বলেন, ইজারার বৈধতা নিয়ে কোনো অভিযোগ ওঠেনি।  \"যতদূর আমি জানি দুই একর জমি লিজ নেওয়া হয়েছিল, তাই এটি জমি দখল নয়।  তিনি বলেছেন \"যেহেতু কোনো অভিযোগ করা হয়নি আমার তদন্ত করার সুযোগ নেই।\"
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখী রায় বলেন, সম্পত্তি অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত নয়।  “আমরা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য শীঘ্রই সাইটে একটি দল পাঠাব।  যদি জায়গাটিকে সংরক্ষণের যোগ্যতা বলে মনে করা হয় তবে আমরা সেই অনুযায়ী এগিয়ে যাব।\"


সংগ্রাম দত্ত: লেখক

মতামত এর আরও খবর

img

আগামী নির্বাচনের আগাম পূর্বাভাস

প্রকাশিত :  ১৫:২৮, ২৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৭:২২, ২৫ নভেম্বর ২০২৫

সাইফুল খান 

বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক রোগে আক্রান্ত, যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। এই রোগের নাম "ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা"। আর এই রোগের উপসর্গ অন্ধত্ব। আমরা সবাই এই অন্ধত্বে আক্রান্ত। নেতা, কর্মী, বুদ্ধিজীবী এমনকি সেই সাধারণ মানুষটিও, যে প্রতি পাঁচ বছর পরপর ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবে সে কিছু একটা পরিবর্তন করবে। অথচ পরিবর্তনের নামে সে কেবল সেই পুরনো অসুখটাকেই বুকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। সেটার নাম হতাশা।

বিএনপি এই দেশে বিরোধী রাজনীতির বৃহত্তম শক্তি। এ কথা যে মিথ্যা নয়, তা সমীক্ষার সংখ্যাই বলে দেয়। Innovision-এর “People’s Election Pulse Survey (PEPS)”–এ ১০,৪১৩ জন নাগরিকের সাক্ষাতে উঠে এসেছে— ৪১.৩% ভোটার বিএনপিকে ভোট দিতে প্রস্তুত।

আর যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না থাকে তাহলে সেই সমর্থন লাফিয়ে গিয়ে ৪৫.৬%।

৩৯.১% মানুষ মনে করে তারা “আগামী সরকারের যোগ্য দল”। খুলনায় ৪৩.৩%, ময়মনসিংহে ৪৫.৭% সমর্থন এগুলো কোনো সাধারণ সংখ্যা নয়।

কিন্তু শক্তির শিখরে দাঁড়িয়ে যে বিভাজন শুরু হয়েছে, সেটিই BNP-এর সবচেয়ে বড় শত্রু।

শত্রু আওয়ামী লীগ নয়; শত্রু গণতন্ত্র নয়; শত্রু সামরিক বা অ-সামরিক কোনো শক্তিও নয়। তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু নিজেদের ভেতরের মানুষগুলো।

২৩৭টি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলো, আর দলটি মুহূর্তেই ডুমুরের পাতার মতো কাঁপতে লাগলো। মনোনয়ন বঞ্চিতদের ত্যাগী নেতাদের চোখে ক্ষোভ, কথায় ব্যঙ্গ, বুকে প্রতিহিংসা। তারা ভাবলো “দল আমাকে দেয়নি, দেশ আমাকে অবশ্যই দেবে।” ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঢল দেখার অপেক্ষা করতেই পারে জনগন। 

রাজনীতির এই কান্না, এই আক্রোশ, এই আত্মপরাজয়ের গল্প এমন সময় ঘটছে যখন বিরোধী ভোট তিনটি ধারায় ভেঙে সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছে।

প্রথম ধারাটি হলো- জামায়াত–ই–ইসলামি।

জামায়াত বিরোধী পোক্ত রাজনৈতিক ন্যারেটিভের কারনে অনেকে তাদের অপছন্দ করে। আবার অনেকেই ভালোও বাসে। কিন্তু সংখ্যার গাণিতিক সত্যকে কোনো দার্শনিক লেকচার দিয়ে বদলানো যায় না। জামায়াত জাতীয়ভাবে ৩০.৩% সমর্থন পাচ্ছে এই একই সমীক্ষায়।  রংপুরে তারা ৪৩.৪% যেখানে বিএনপিকেও তারা ছুঁয়ে ফেলে।

এই দলের সঙ্গে এখন আরও ৮টি সমমনা দল যুক্ত হয়েছে৷ একটি জোট, যার উদ্দেশ্য রাজনীতিকে পুনরায় এক বৈশিষ্ট্যময় রূপ দেওয়া।

বিএনপি কি এই বাস্তবতা দেখে?

হ্যাঁ, দেখে।

কিন্তু তারা দেখে ঠিক যেভাবে সূর্যাস্তের দিকে তাকালে মানুষ চোখ বুজে ফেলে।

তারপর আসে তৃতীয় লাইন NCP, জাতীয় নাগরিক পার্টি।  এটি নতুন প্রজন্মের দল।

PEPS-এ এদের সমর্থন ৪.১%। BIGD রিপোর্টে ২.৮%। কিন্তু যুবসমাজে SANEM-এর হিসাব বলছে ১৫.৮৪% সম্ভাবনা।

এই সংখ্যা হয়তো ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু “রাজনীতি” নামের যে মৃগয়ায় আসন দখল করতে হয় তার জন্য এই পরিমাণ ভোটই কখনো কখনো সরকার পরিবর্তনের কাঁটা ঘুরিয়ে দেয়।

এনসিপি এমন সময়ে জোট করছে যখন বিএনপি নিজ ঘর সামলাতে ব্যস্ত। জামায়াত তার সমর্থনকে শক্ত জোটে রূপ দিচ্ছে, আর আওয়ামী লীগ নীরব কিন্তু সতর্ক। এনসিপি যেভাবে তরুণ ভোটারের মনস্তত্ত্বে ঢুকেছে BNP তা পারেনি। এনসিপির এই উত্থানই বিশ্লেষকদের মুখে এক নতুন সত্য তুলে এনেছে। জামায়াত যতটা নয়, এনসিপির জোট বিএনপির ভোটকে আরও বেশি ক্ষয় করতে পারে।

এবার জনগণের দিকে তাকাই। PEPS বলছে-

৫৭.৫% মানুষ আইন-শৃঙ্খলাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে করে। দ্বিতীয় সমস্যা মূল্যস্ফীতি।

দুর্নীতি ও আইনি সংস্কারও শীর্ষ তালিকায়।

আর সবচেয়ে বড় কথা ৪৮.৫% ভোটার এখনও অনির্ধারিত।

এই অনির্ধারিত মানুষের দলটাই আসল নাটকের মূল চরিত্র। তারা এমন জনগোষ্ঠী যারা রাষ্ট্রের অস্থিরতার মাপ দেখে সিদ্ধান্ত নেয়, দলের পতাকা দেখে নয়। এই অনির্ধারিত মানুষদের ভোট BNP হারাবে কিনা, তা ঠিক করবে তাদের ভেতরের বিভাজন, জামায়াতের জোটগত শক্তি এবং এনসিপির আগ্রাসী নতুন-রাজনীতির ভাষা।

বিএনপি হয়তো সমীক্ষায় এগিয়ে আছে, কিন্তু রাজনীতি কেবল সমীক্ষার খেলাও নয়।এটি সময়ের নির্মম ব্যঙ্গ। যে দল নিজের ঘরে শান্তি রাখতে পারে না, সে কি দেশের শান্তি রাখতে পারবে? প্রশ্ন অবান্তর নয়, যৌক্তিক।

বিএনপির ভেতরের ক্ষয়, জামায়াতের আলাদা শক্তি, এনসিপির যুব-স্রোত এই তিনটি মিলিয়ে বিএনপির সম্ভাব্য ভোট উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে এমনটাই সমীক্ষা, বিশ্লেষক এবং মাঠের বাস্তবতা একসঙ্গে নির্দেশ করছে। সময়ের সাথে বিএনপির ভোট কমার আশংকাই নির্দেশ করছে।

রাজনীতি শেষ পর্যন্ত মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপর দাঁড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি দাঁড়ায় মানুষের ক্ষোভের ওপর। আর যে দেশে ক্ষোভই প্রধান চালিকাশক্তি। সেখানে বিভাজনই প্রকৃত নিয়ন্তা।

বিএনপি কি এই বিভাজন সামলাতে পারবে?

জামায়াত কি তাদের জোটকে সত্যিকারের শক্তিতে রূপ দিতে পারবে? এনসিপি কি নতুন প্রজন্মের বিশ্বাসকে ভোটে পরিণত করতে পারবে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা পেতে পারি।

কিন্তু রাজনীতি? রাজনীতি কখনো সরাসরি উত্তর দেয় না। সে দেয় সংকেত, দেয় ইঙ্গিত, আর মাঝেমধ্যে দেয় নির্মম হাসি।

শেষ পর্যন্ত মনে হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন শুধু একটি গণতান্ত্রিক অনুষ্ঠান নয়; এটি ক্ষমতার মনস্তত্ত্বের এক বিশাল মানসিক-নাট্যমঞ্চ, যেখানে প্রত্যেক দল নিজের ট্র্যাজেডি নিজেই রচনা করে, নিজেই অভিনয় করে, আর শেষে বিস্ময়করভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত করতালি দাবি করে!


লেখক-ইতিহাস,রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর