img

উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও সমাজ সংস্কারক ব্যারিষ্টার আনন্দ মোহন বসু

প্রকাশিত :  ০৮:৫০, ১৯ আগষ্ট ২০২৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি: ২০শে আগষ্ট মৃত্যুবার্ষিকী

উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও সমাজ সংস্কারক ব্যারিষ্টার আনন্দ মোহন বসু
সংগ্রাম দত্ত
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক, শিক্ষানুরাগী ও রাজনীতিবিদ  ব্যারিস্টার আনন্দ মোহন বসুর  স্থাপত্য-কীর্তির অনন্য নিদর্শন ও পূর্বসূরিদের বসতবাড়ি একশ্রেণীর প্রভাবশালী লোক দখল করে নিয়েছে। স্থানীয় লোকেরা এসব উদ্ধার করে হেরিটেজ বা মিউজিয়াম বানানোর দাবি জানাচ্ছে।

১৮৪৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত তথা বর্তমান বাংলাদেশের  কিশোরগঞ্জ জেলা  ইটনা থানার জয়সিদ্ধি গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এক সময় পুর্ব পুরুষের পৈতৃক নিবাস ছিল হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানার জলসুখা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম পদ্মলোচন বসু, মাতার নাম উমা কিশোরী নন্দী মজুমদার। ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসুর মা উমাকিশোরী নন্দী মজুমদার হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার আন্দিউড়া গ্রামের বিখ্যাত নন্দী পরিবারের মেয়ে।আনন্দ বসুর মামার নাম হরনাথ মজুমদার।আনন্দমোহন বসুর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় ময়মনসিংহে।

১৮৬২ সালে  ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় ৯ম স্থান অধিকার করে এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। আনন্দমোহন বসু বিয়ে করেন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ভগবান চন্দ্র বসুর কন্যা স্বর্ণপ্রভা বসুকে। বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন হলেন স্বর্ণপ্রভা বসু।
১৮৬৪ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এফএ পাশ করেন। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
১৮৬৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। বিএ পরীক্ষায়ই শীর্ষস্থান অধিকার করেন।
 ১৮৭০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত প্রেমচাঁদ রায় চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ইংল্যান্ড চলে যান। 
১৮৭৪ সালে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে উচ্চতর গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করেন। অনার্সসহ ডিগ্রী পরীক্ষা তথা ট্রাইপস পরীক্ষা প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। প্রথম ভারতীয় র‌্যাংলার বা গণিতবিদ হবার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ভারতবর্ষের তিনজন র‍্যাংলার ছিলেন। প্রথমজন হলেন ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু, দ্বিতীয়জন হলেন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার কিরন চন্দ্র দে,তৃতীয়জন হলেন নরসিংদী জেলার ভাটপাড়া গ্রামের কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত বা কেজি গুপ্ত।
১৮৭৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিষ্টার পাশ করেন।
১৮৭৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। 
১৮৭৫ সালে ক্যালকাটা স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন প্রতিষ্টা করেন।
১৮৭৬ সালে কলকাতায় বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৮৭৮ সালের ১৫ মে ব্রাক্ষ সমাজ প্রতিষ্টা করেন। স্ত্রীসহ ব্রাক্ষ ধর্ম গ্রহন করেন।
১৮৭৯ সালে শিবনাথ শাস্ত্রীর সহযোগিতায় কলকাতায় সিটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন । এটি এখন কলকাতা আনন্দমোহন কলেজ। 
১৮৮২ সালে ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিটির সদস্য হন।
১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহ শহরে ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন নামে বিদ্যালয় স্থাপন করেন যা বর্তমানে আনন্দমোহন কলেজ। 
১৮৮৩ সালে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশনের একটি জাতীয় সভার আলোচনা সভার আহবান করেন।এই এসোসিয়েশনই \" ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস\" এ পরিনত হয়।
১৮৮৪ সালে ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন।
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্টার অন্যতম সদস্য ছিলেন। 
১৮৯০ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন।
১৮৯২ সালে তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় Calcutta University Act of Incorporation সংশোধন করা হয়। যার কারনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গীয় আইন পরিষদে একজন সদস্য নির্বাচন করার অধিকার লাভ করেন।
১৮৯৫ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
১৮৯৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন।
১৯০৬ সালের ২০ আগষ্ট ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে  কলকাতায় মৃত্যুবরন করেন।
ময়মনসিংহ জেলা শহরের রামবাবু রোড এলাকায় অবস্থিত বর্তমান সিটি কলেজিয়েট স্কুলটি ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসুর পৈতৃক নিবাস।
গত ২৩ শে সেপ্টেম্বর ২০২১ জাতীয় দৈনিক যুগান্তর এ \"স্মরণীয় কীর্তির বিস্মৃত পুরুষ\" শীর্ষক এক প্রতিবেদনে
দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও  এডভোকেট
ফজলুর রহমান লিখেছেন যে আনন্দমোহন বসুর স্মৃতিবিজড়িত তাঁর জন্ম স্থান জয়সিদ্ধিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপত্য-কীর্তির অনন্য নিদর্শন, তাঁর পূর্বসূরিদের বসতবাড়িটি বর্তমানে বেদখল।
জানা গেছে, একটি ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলের মোহাম্মদ আব্দুল হাই নামের স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা আনন্দমোহন বসুর বিশাল আয়তনের এ বাড়িটিকে দখল করে রেখেছেন।
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমান যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরো  লিখেছেন যে, র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসুর জন্ম ভিটার এখন বেহালদশা। বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি বিখ্যাত এ সমাজ সংস্কারকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি বেদখল হয়ে আছে। ফলে অরক্ষিত জন্মভিটায় অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংস হচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন বসতবাড়িটি।
কয়েক একর আয়তনের বাড়িটিতে রয়েছে কয়েকটি বিশাল ভবন, খোলা মাঠ ও একাধিক পুকুর। বিশাল বসতবাড়িটি পরিণত হয়েছে পরগাছা উদ্ভিদের বাসস্থানে। চারদিকে নির্মিত প্রতিরক্ষা দেওয়ালের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দেওয়ালের অনেক জায়গার ইট-পাথর দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে। আনন্দমোহন বসুর আঁতুড়ঘরটিকে বানানো হয়েছে গোবরের গর্ত। এ অবস্থায় ঐতিহ্যের নিদর্শন এসব স্থাপনা বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও উপমহাদেশে ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তনকারী আনন্দমোহন বসুর জন্ম স্থান ও বসতবাড়ি দেখার জন্য দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রায়ই দর্শণার্থীরা আসেন। কিন্তু বসতবাড়িটি বেদখল হয়ে থাকায় বাড়িটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকারও সংরক্ষিত পর্যায়ে চলে গেছে। এরপরও বসতবাড়িটি উদ্ধার কিংবা সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ বা আগ্রহ নেই প্রশাসন কিংবা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক এ স্থানটিকে সংরক্ষণ করে তাঁর পণ্য স্মৃতি ও স্থাপত্যকীর্তির প্রতি সম্মান জানাবে, এ প্রত্যাশা এলাকাবাসীসহ বসুর ঐতিহ্য।
গত ৩ মে ২০১৮ দেশের স্বনামধন্য ইংরেজি পত্রিকা দি ডেইলি স্টার ঐতিহ্য বাড়িটি সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান এর এক সাক্ষাৎকারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, “জয়সিদ্ধি গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে বসুর পূর্বপুরুষ জয়রাম ও সিদ্ধিরাম বসুর নামে।  “১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় বোস পরিবারকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।  তখনই আমির উদ্দিন জমি দখল করে নেন।
প্রায় আট বছর আগে মারা যাওয়া আমির উদ্দিন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব।  এই সম্পত্তির বর্তমান দখলদারদের পিতা।  বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ফজলুর বলেন, বর্তমান দখলদারদের পিতা সংলগ্ন আলগাপাড়ার স্বাধীনতাবিরোধী নেতা ছিলেন।
 “মুক্তিযুদ্ধের সময় আমির স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন বলে ইটনা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নজরুল ইসলাম ঠাকুর ডেইলি স্টারের প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
স্পষ্টভাষী রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমান বলেছেন প্রথমে আমির সম্পত্তিটি \'লিজ\' নিয়েছিলেন।  ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় সম্প্রদায় তাকে  উচ্ছেদ করা হয়েছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে তিনি পুনরায় দখলে ফিরে আসেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐতিহ্যবাহী এ বাড়ি থেকে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়েছিল। বোসের গ্রন্থাগারের শত শত বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়।  বাড়ির সামনে দুটি বড় পুকুর ছিল কিন্তু সেগুলি কয়েক বছর ধরে ভরাট হয়ে গেছে।”
সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ বোস সম্পত্তি দখল মুক্ত করে একটি পাবলিক হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করার দাবি জানান। 
আনন্দ মোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি  মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল একমত হন, “কোনও ইজারা থাকলে তা বাতিল করা উচিত।  “বোসের সম্পত্তি দখলমুক্ত করা উচিত।  সেই জমি বৃহত্তর ময়মনসিংহের জন্য অমূল্য ঐতিহ্য এবং জনসাধারণের কাজে ব্যবহার করা উচিত।  আমরা শীঘ্রই এটি মুক্ত করার জন্য একটি আন্দোলন শুরু করব ।\"
কিশোরগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোঃ আসাদ উল্লাহ একইভাবে সম্পত্তি উদ্ধার করে জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
স্থানীয় সংগঠন জাগোরিতো ইটনার আহ্বায়ক কামরুল হাসান খান জুয়েল বলেছেন, “গত বছর বসতবাড়ি ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল।
আমিরের ছেলে এবং জয়সিদ্ধি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাই তার বাবা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।  \"আমার বাবা ১৯৬৭ সালে বোস পরিবারের প্রায় দুই একর জমি লিজ নিয়েছিলেন তিনি বলেছেন।  “মুক্তিযুদ্ধের পর ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নবায়ন করা হয়।  আমার বাবা স্থানীয় শান্তি কমিটির সাথে জড়িত ছিলেন না।  এলাকায় এমন কোনো রিপোর্ট নেই।”
ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তৎকালীন ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মশিউর রহমান খান বলেন, ইজারার বৈধতা নিয়ে কোনো অভিযোগ ওঠেনি।  \"যতদূর আমি জানি দুই একর জমি লিজ নেওয়া হয়েছিল, তাই এটি জমি দখল নয়।  তিনি বলেছেন \"যেহেতু কোনো অভিযোগ করা হয়নি আমার তদন্ত করার সুযোগ নেই।\"
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখী রায় বলেন, সম্পত্তি অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত নয়।  “আমরা সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য শীঘ্রই সাইটে একটি দল পাঠাব।  যদি জায়গাটিকে সংরক্ষণের যোগ্যতা বলে মনে করা হয় তবে আমরা সেই অনুযায়ী এগিয়ে যাব।\"


সংগ্রাম দত্ত: লেখক

মতামত এর আরও খবর

img

উন্মুক্ত বিবেক, মুক্ত ফিলিস্তিন!!

প্রকাশিত :  ০৭:৩৬, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:৫২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

নুজহাত নূর সাদিয়া

আহা ! বুকের পাঁজর ভাঙা গগনবিদারী আর্তনাদ , নাহ-কোন নিরব জঠর যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাওয়া গর্ভবতী মায়ের নবজাতক জন্ম দেওয়ার অবিস্মরণীয় ক্ষণটি উদযাপনের আনন্দচ্ছোস নয়, এ যে সহস্র দিনের গ্লানি শেষে এক নিকষ কালো আঁধার পেরিয়ে মাতৃভূমির বুকে নির্ভীক পা রাখা । আবার সেই চিরপরিচিত সবুজ দুর্বা ঘাসে ছুঁটে বেড়ানো , বাড়ন্ত স্কোয়াশের পূর্ণ ঝুঁড়ি, মাংসের রসাল স্যুপ, হাতে বানানো গমের রুটি সহযোগে উদর পূর্তির সেই পারিবারিক সুখস্মৃতি , মায়ায় জড়ানো বছর পার করে দেওয়া সংগ্রামী পরিবারগুলো ফিরে কি পাবে তাদের সেই প্রাণোচ্ছল ফিলিস্তিন । বহু চর্চিত এই প্রশ্নটির উত্তর অজানা আশংকা আর অনিশ্চয়তার অদৃশ্য গেরোতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকলে ও বিপরীত শিবিরে ও বহু দিনের ঘরবন্দী প্রিয়মুখগুলো স্বজনদের বাহুডোরে ফেরার অপেক্ষায় । আগ্রাসী ইসরায়েলের ধূলো উড়ানো পথ ও যে আজ শান্তিকামী মানুষের স্বতস্ফূর্ত হাসিতে ভরপুর। 

আনুষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী, মোট হতাহতের সংখ্যা  ৬৬,০০০ হাজার ছাঁড়িয়ে গেছে, জীবন-ভর পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে ২,৫০,০০০ জন হতভাগ্যকে , বেঁচে যাওয়া অসংখ্য দুরন্ত শৈশব বাকিটা জীবন সম্ভবত এক দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবে, আকাশ ছোঁয়া দালান , সুসজ্জিত স্থাপনা আর পুরাকীর্তির শহর ফিলিস্তিন আজ এক মৃতপ্রায় ভুতুড়ে নগরী ।

এই যে  ক্ষতি , তা সন্দেহাতীতভাবেই অপূরণীয় ক্ষতি । নেতানিয়াহু নামের এক বিকট দানবের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর অপরিণামদর্শী যুদ্ধ কৌশলের খেস ারত দিতে হল ফোরাত নদীর তীরবর্তী নিরীহ প্রাণগুলোর। বিশ্ব মানচিত্র হতে ফিলিস্তিন নামক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটি ( গাজা প্রায়২১ লক্ষ লোকের আবাস) মাত্র মাসখানিক আগে ও নিরবে মুছে যাচ্ছিল ধনী রাষ্ট্রের তাবেদার মুসলিম বিশ্বের অলস শাসনকর্তাদের নির্লিপ্ত আচরণের কারণে । মুসলমান ভাই -ভাই, জুলুমবাজের নিস্তার নাই, বিপন্ন মানবতা বহুল চর্চিত প্রবাদগুলো নিতান্তই খাঁচায় বন্দি তোতাপাখির মুখস্থ বুলির মত আউড়ে চলছিল বিশ্বরাজনীতির মোড়লরা । তবে কি, আমজনতার পরম আরাধ্য পার্থিব জীবনের ও সমাপ্তি আছে, আর সেই সমাপ্তি বরাবরই ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়েছে স্রষ্টার একান্ত ইচ্ছেয়, অসহায়ের পূর্ণ সমর্থনে আর দিনশেষে সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ে ।

গৃহকোণের শান্তি গৃহকর্ত্রীর পরম প্রিয়, আর সেই শান্তির সুশীতল পরশ এ ভূগোলকের পরতে পরতে ছঁড়িয়ে দিতে যে উদ্যোগী মানুষগুলো অনন্য সাধারণ কাজগুলোকে বাস্তবতার আলো দেখান সে মানুষগুলোই কর্মকুশলতায় অর্জন করে নেন সর্ব্বোচ সম্মান -নোবেল । এ নোবেল প্রাপ্তি, কার ও দারিদ্র্য বিমোচনে, চলতি ‘২৫ সালে বিতর্কিত মারিয়া কোরিয়া মাচানো -যার রাষ্ট্রীয় নীতি বহু অসহায় মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে, প্রাক্তন  যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক সহ শান্তিতে নোবেল পাওয়া আলোচিত মানুষগুলো পুরষ্কারের কোঠা না মানদন্ড না তাদের কাজের বিষয় এ সূক্ষèাতিসূক্ষè বিষয়গুলো

রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, আর স্বেচ্ছাচারী কর্তা যখন নিজ খেয়াল-খুশি মত আইন -কানুন তৈরি করে অসহায়দের উপর তা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন তখন তা ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা জায়ানবাদীদের  আধিপত্য আর কতৃর্ত্ববাদের নির্মমতার করুণ পুনরাবৃত্তি বই আর কিছুই নয় । আর ও নির্মম কৌতুক, একদা জায়ানবধের রাজ্য বলে খ্যাত , হিটলারের জার্মান, মাঁখোর  ফ্রান্স , কূটনৈতিক ব্রিটেন সহ দু‘মুখো আরব বিশ্ব সকলে এ নির্মম রসিকতায় সামিল ! দুনিয়া যে ক্ষমতা আর অর্থের পূজারী - পড়ন্ত বেলার প্রাজ্ঞ প্রবীণদের গভীর হতাশার সুরে তা সুস্পষ্ট ।

রুপকথার গল্পের চেয়ে ও বাস্তব জীবনের গল্প অনেকসময় অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠে , হয়ে উঠে প্রকৃত রুপক নতুবা তার চেয়ে ও শক্তিশালী আখ্যান । বিশ টি বছর ধরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর নানা প্রতিকুলতায় অবরুদ্ধ হামাস , ঠিক জিতে গেল সাহস আর দেশের প্রতি ভালবাসাকে হৃদয়ে লালন করে।

আর, সেই ছোট্ট গেরিলা সদস্যের দলটি আজ কত বড়! মানচিত্র ছাঁড়িয়ে , সীমানা ছাঁড়িয়ে নব প্রজন্মের অকুতোভয় হামাসরা আজ দুয়ারে দাঁড়ানো দৃঢ় দ্বাররক্ষী । তারাই পারে ,তথাকথিত অজেয় পশ্চিমা শক্তিকে শান্তিচুক্তি নামক সে নাটকীয় ঘটনার অন্যতম যোগানদার করতে। মার্কিন সরকার প্রধান উপযাচক মাত্র-পরিস্থিতি বুঝেই হয়তবা বন্ধুর পথে হাঁটতে চাইছেন, ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বর্মটি যে ভিষণ শক্তপোক্ত ও একরোখা ।

তবে, মধ্যপ্রাচ্যে ছঁড়ি ঘুরানোর দীর্ঘদিনের শক্তলাঠিটি কে যে এবার বাঁকাতেই হয় ।  সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙবে না, হায় বেনিয়ামিন  কি অসম্মানের এক পরাজয় ! কি অপেক্ষা করছে দুর্নীতি মামলায় জর্জরিত বুড়ো নেকড়েটির কপালে -বিধ্বস্ত চেহারায় কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো দীর্ঘতর হচ্ছে বৈকি।

প্রতিরোধ, যুদ্ধের নামে আগ্রাসন আর বসতি স্থানান্তরের নামে বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক শরণার্থী , আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় হয়তবা এখন পর্যন্ত বিজয় উদযাপনে ব্যস্ত । তবে নারীর প্রতি সম্মান রক্ষার্থে ট্রাম্প তার প্রাক্তন রাজনৈতিক প্রতিদন্বী বারাকের উপর সম্ভবত সচেতনভাবেই তার রাষ্ট্র পরিচালনার মেয়াদকালে বিতর্কিত সন্ত্রাসী বনাম ইসলামিক সেনাবাহিনী মতানৈক্যের বিষয়টির উপর  ইঙ্গিত দিয়েছেন । আর , ব্রিটিশ সংসদে চিত্রিত ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে পুরনো বন্ধু ব্লেয়ারের পদাংক অনুসরিত কিনা, তাই আপনমনে যাচাই-বাছাই করে চলেছেন। 

পরিস্থিতির পরিবর্তিত মোড় , কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন লিখিত শান্তি  চুক্তির যে ভিন্ন ভিন্ন ২০টি শর্ত শোভা পাচ্ছে  তার সুচারু বাস্তবায়ন খোদ ট্রাম্পের পক্ষেই যথেষ্ট দুরুহ । পেন্ডুলামের কাঁটা চলমান, হঠকারী ছোটভাই একবার নয় বেশ ক‘বার বড় ভাইয়ের অবাধ্য হয়েছেন , আস্ত উড়োজাহাজ উপহার আর বন্ধুপ্রতীম কাতারের উপর অর্তকিত আক্রমণ । রক্তে যার খুনে নেশা সে পাগলা ঘোড়া কি আদৌ থামবে ? বিলুপ্ত হিজবুল্লা, হুতির হারিয়ে যাওয়া হামাসের নেতৃত্বের শক্তি ক্ষয় , সিরিয়ায় ভাঙ্গন, ইরানের সফল প্রতিরক্ষার ব্যুহ ভেদ- আপাত , দ্বিধাগ্রস্থ ইসরাইল প্রধান সফলতার মাপকাঠিতে আত্নতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন হয়তবা ।  তবে,গাজামুখি সারি সারি ত্রাণবাহী গাড়ির বহরের দী¦প্ত যাত্রা কি তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় নি, নিশ্চিতভাবেই উত্তরটি হ্যা ।

কাঁকচক্ষু দৃষ্টিতে , দৃঢ়তা আর ন্যায়ের বিজয় তবে, অসম এ যুদ্ধে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের চড়া মূল্য দিতে হল  হামাসকে। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়  হামাস , নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক , প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। এই যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ সেই জীবননাশের মূল্য দিতে হল চরমভাবে-গত দু‘বছরে ৬৭,০০০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত । শক্তিশালী শত্রুর সাথে টক্কর লাগানো  কি এত সোজা!  লোকবল আর সামরিক শক্তিতে তুলনামূলক ভাবে পিঁছিয়ে, তবে কিনা নীতি আর ঈমানের শক্তিতে বরাবরি বলীয়ান হামাসিয়ানরা । তাই , এ ক্রান্তিকালে ও ধাপে ধাপে অধিকাংশ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল তারা, সর্বশেষ গাজায় ৪৮ জন বন্দী ছিলেন , বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবান ২০ জন। আর্ন্তজাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে দু‘ধাপে জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় হামাস গত ১৩ই অক্টোবর । মৃতদের মাঝে চার জনের মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা ও জানিয়েছে তারা।অপরদিকে, প্রতিপক্ষ ইসরাইলের আচরণ রুঢ়তার সীমা আকাশ  ছুঁয়েছে  বহু আগেই-কারাগারে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা এবং নিপীড়ন করা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যৌন হয়রানির খবর ও পাওয়া গেছে । আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আল-রিমায়ি বলেন- এ দু‘টি বছরে তার ওজন কমেছে ৫০ কেজি ! হাড় সর্বস্ব শরীর জড়িয়ে কন্যার ব্যাকুল আর্তি, বাবা আমি ব্যাথা পাই ।

এখন আবার ট্রাম্পের নতুন চমক, ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপনাস্ত্র উপহার দিবেন এই পাগলাটে রাষ্ট্রপতি রাশান যুদ্ধ থামাতে ।  শুরু হওয়া আফগান -পাকিস্তান সংঘাতে ও তালেবান দের ভূমিকা নিয়ে এক নতুন চেহারার ব্যবসায়ীকে দেখা গেছে -জামাতা কুশনারের ব্যবসায়িক বুদ্ধির জুড়ি নেই রাজনৈতিক বুদ্ধিতে ও যে  শ্বশুরকে ভবিষ্যতে টেক্কা দিতে সমর্থ  হবেন  তা তার সাম্প্রতিক স্রোত বুঝে চলার ই পরিপক্ক রুপ ।

আজকের এই পার্থিব পৃথিবীতে  স্রোতস্বিনী টেমস নদী ব্যবহারের মাসকাবারি বিল পরিশোধের সময় ও যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি মগজে নিত্য গেঁথে থাকে -প্রতিটি পানিবিন্দু পরিশোধে পাওনা প্রাপ্য ! অর্থাৎ, জীবনের অপর নাম পানি ও বাতাস সেবনে ও মূল্য চুকাতে হয়, তা যদি হয় কেনসিংটন নামক অভিজাত এলাকার মনোরম ব্যালকনির মুক্ত হাওয়া । বিনামূল্যে    সেবা, সে তো অতীতের গাল গল্প । অথচ, নিঠুর ইসরাইলী বাহিনী    গাজায় ৩০০০ জলপাই গাছ  কেটে , অগণিত বন্য ও পোষা  প্রাণী মেরে আক্ষরিক অর্থেই প্রকৃতিকে বিপন্ন করে  তুলতে চাইছিল  । সেই প্রকৃতিই কিনা আপন মহিমায়  নতুন বোনা জলপাই গাছের পাশ দিয়ে ছুটন্ত শিশুদের  সাদরে বরণ করছে যাদের খাঁচা ভর্তি প্রিয় পোষা  পাখিটির  গুঞ্জন।   

ফিলিস্তিন বাসীদের প্রিয় ম্যান্ডেলা ‘ আল ফাত্তাহ ‘ এখন ও জায়ানবাদীদের জিম্মায় ,  ইসরাইলী সেনাবাহিনী তাকে যমের মত ভয় পায় -যার মুক্তির আলো দেখা এখন ও সংশয়ে ভরা । সন্দেহাতীতভাবেই, তিনিই প্যালেস্টাইনি জনগণের অবিস্বরণীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী আন্দোলনের দিকপাল ।

আজকের দিনের ফ্রি পত্রিকাগুলোর অন্যতম স্লোগান-মুক্ত খবর, মুক্ত চিন্তা । আর বিশ্বজুঁড়ে এই প্রবল বিজয় উদযাপনে মানবতাবাদীদের একটাই আশা মুক্ত হোক মানবতা , জয় হোক শুভ বুদ্ধির।



নুজহাত নূর সাদিয়া,
এলবিপিসি, লন্ডন ১৪ই অক্টোবর‘ ২৫ সাল ।

মতামত এর আরও খবর