img

পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত: স্বাধীনতার অমর যোদ্ধা ও জননেতা

প্রকাশিত :  ১০:৩৭, ০৫ অক্টোবর ২০২৫

পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত: স্বাধীনতার অমর যোদ্ধা ও জননেতা

সংগ্রাম দত্ত

কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, “ ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সংগ্রামের নক্ষত্রেরা কারা ছিলেন?”, তবে পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্তের নাম প্রথম সারিতেই আসে। তিনি কেবল একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি একজন সমাজসেবী, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের নেতা, গণমানুষের আশ্রয়স্থল, এবং এক অনন্য বীর যিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর জীবন ছিল সংগ্রাম, সেবা এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অদম্য যাত্রা।

প্রারম্ভিক জীবন: বীজ বপন:

১৮৯৫ সালে ঢাকার বানারীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পূর্ণেন্দু কিশোর। তাঁর পিতা শ্যামকিশোর সেনগুপ্ত ছিলেন সিলেট জজ কোর্টের একজন সুপরিচিত আইনজীবী। ছোটবয়েসেই পূর্ণেন্দু বিপ্লবী নগেন দত্ত কর্তৃক সিলেটে গঠিত অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি পড়ার সময় তিনি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সংস্পর্শে এসে রাজনৈতিক চেতনার বীজ বপন করেন। এমএসসি পড়াকালীন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি পরীক্ষাও বর্জন করেন—একজন সত্যিকারের স্বাধীনচেতা যুবকের পরিচয়।

স্বাধীনতা আন্দোলনে পথপ্রদর্শক:

১৯২২ সালে ঢাকার অভয় আশ্রম শাখায় যোগ দিয়ে তিনি বিক্রমপুরের বানারী গ্রামে ধীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাশ্রমের সম্পাদক হন। স্বাধীনতার জন্য তাঁর অবদান শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তিনি জনকল্যাণমূলক কাজ, দাঙ্গা প্রতিরোধ, ত্রাণ কার্যক্রম এবং সামাজিক সেবায়ও নেতৃত্ব দিয়েছেন।

পদ্মা নদীর ভাঙনের পর তিনি বিদ্যাশ্রমটি শ্রীহট্টে ( সিলেটে) স্থানান্তর করেন এবং নাম দেন রঙ্গীরকুল বিদ্যাশ্রম । যা\' তৎকালীন শ্রীহট্ট জেলার দক্ষিণ শ্রীহট্ট (বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলা) মহকুমার কুলাউড়া থানার অন্তর্গত। এই আশ্রম পরবর্তীতে গান্ধীবাদী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

১৯৩০ সালের লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণের জন্য জেলে যান, ১৯৩২ সালে শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ গঠন করেন এবং কমলগঞ্জ থানার ভানুবিল পরগনার মনিপুরী কৃষকদের ঐতিহাসিক সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেন। তাঁর এই সংগ্রামের ফলে সরকার প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নে বাধ্য হয়।

সেবা ও ত্রাণে অগ্রদূত:

পূর্ণেন্দু কিশোরের হৃদয় ছিল দারিদ্র ও দুঃখ-দারিদ্র্যের প্রতি অমায়িক। ১৯২৯ সালের সিলেট ও কাছাড়ের বন্যায় তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন ত্রাণ কাজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সেবা করেন। ১৯৩৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সুবর্ণ জয়ন্তীতে শিল্প প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেন।

রঙ্গীরকুল বিদ্যাশ্রম ছিল তাঁর কর্মের এক জীবন্ত প্রতীক—যেখানে শিক্ষা, শিল্প, সমাজসেবা ও রাজনৈতিক চেতনা একত্রে বিকশিত হয়।

রাজনীতিতে উজ্জ্বল চরিত্র:

১৯৪৬ সালের ব্রিটিশ ভারতের শেষ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসাম ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে থেকে চা শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে নিবেদিত হন।

১৯৪৮ সালের ৩ জুন কুলাউড়ায় তিনি শ্রীহট্ট চা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন তিনি, সহসভাপতি এমএলএ জীবন সাওতাল, সাধারণ সম্পাদক নিকুঞ্জ বিহারী চৌধুরী এবং সাংগঠনিক সম্পাদক দর্গেশ দেব। এই সংগঠন পরবর্তীতে “বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন” নামে পরিচিত হয়। বর্তমানে তাঁরই হাতে গড়া সংগঠন কুলাউড়া হতে স্থানান্তরিত হয়ে  বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন-এর প্রধান কার্যালয় \"লেবার হাউজ\" মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহরের মৌলভীবাজার রোডে অবস্থিত।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি মৌলভীবাজার থেকে পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে কুলাউড়া-রাজনগর আসনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। আইয়ুব খান শাসনকালে তাঁর চা-শ্রমিক ইউনিয়ন নিষিদ্ধ হলেও, তিনি থেমে থাকেননি।

মুক্তিযুদ্ধ ও শেষ সময়:

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা চালায়, তিনি ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান করেন। ১৭ নভেম্বর ১৯৭৮ সালে কুলাউড়া থানার রঙ্গীরকুল আশ্রমে তিনি মৃত্যুবরন করেন।

পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্তের জীবন ছিল সংগ্রাম ও ত্যাগের এক মহাকাব্য। রাজনৈতিক চেতনা, জনকল্যাণমূলক কাজ, শিক্ষার প্রসার, শ্রমিক ও কৃষকের অধিকার—সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অদম্য।

উপসংহার:

পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত ছিলেন এক অমর নেতা, যার নাম ইতিহাসে চিরদিন উজ্জ্বল থাকবে। তাঁর জীবন প্রমাণ করে, সত্যিকারের নেতৃত্ব শুধু ক্ষমতায় থাকার নয়—এটি হলো সংগ্রাম, সেবা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানুষের কল্যাণে আত্মনিবেদন। রঙ্গীরকুল আশ্রম ও শ্রীহট্ট চা শ্রমিক ইউনিয়ন আজও তাঁর আদর্শ ও চেতনার জীবন্ত সাক্ষ্য।


মতামত এর আরও খবর

img

আগামী নির্বাচনের আগাম পূর্বাভাস

প্রকাশিত :  ১৫:২৮, ২৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৭:২২, ২৫ নভেম্বর ২০২৫

সাইফুল খান 

বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক রোগে আক্রান্ত, যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। এই রোগের নাম "ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা"। আর এই রোগের উপসর্গ অন্ধত্ব। আমরা সবাই এই অন্ধত্বে আক্রান্ত। নেতা, কর্মী, বুদ্ধিজীবী এমনকি সেই সাধারণ মানুষটিও, যে প্রতি পাঁচ বছর পরপর ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবে সে কিছু একটা পরিবর্তন করবে। অথচ পরিবর্তনের নামে সে কেবল সেই পুরনো অসুখটাকেই বুকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। সেটার নাম হতাশা।

বিএনপি এই দেশে বিরোধী রাজনীতির বৃহত্তম শক্তি। এ কথা যে মিথ্যা নয়, তা সমীক্ষার সংখ্যাই বলে দেয়। Innovision-এর “People’s Election Pulse Survey (PEPS)”–এ ১০,৪১৩ জন নাগরিকের সাক্ষাতে উঠে এসেছে— ৪১.৩% ভোটার বিএনপিকে ভোট দিতে প্রস্তুত।

আর যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না থাকে তাহলে সেই সমর্থন লাফিয়ে গিয়ে ৪৫.৬%।

৩৯.১% মানুষ মনে করে তারা “আগামী সরকারের যোগ্য দল”। খুলনায় ৪৩.৩%, ময়মনসিংহে ৪৫.৭% সমর্থন এগুলো কোনো সাধারণ সংখ্যা নয়।

কিন্তু শক্তির শিখরে দাঁড়িয়ে যে বিভাজন শুরু হয়েছে, সেটিই BNP-এর সবচেয়ে বড় শত্রু।

শত্রু আওয়ামী লীগ নয়; শত্রু গণতন্ত্র নয়; শত্রু সামরিক বা অ-সামরিক কোনো শক্তিও নয়। তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু নিজেদের ভেতরের মানুষগুলো।

২৩৭টি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলো, আর দলটি মুহূর্তেই ডুমুরের পাতার মতো কাঁপতে লাগলো। মনোনয়ন বঞ্চিতদের ত্যাগী নেতাদের চোখে ক্ষোভ, কথায় ব্যঙ্গ, বুকে প্রতিহিংসা। তারা ভাবলো “দল আমাকে দেয়নি, দেশ আমাকে অবশ্যই দেবে।” ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঢল দেখার অপেক্ষা করতেই পারে জনগন। 

রাজনীতির এই কান্না, এই আক্রোশ, এই আত্মপরাজয়ের গল্প এমন সময় ঘটছে যখন বিরোধী ভোট তিনটি ধারায় ভেঙে সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছে।

প্রথম ধারাটি হলো- জামায়াত–ই–ইসলামি।

জামায়াত বিরোধী পোক্ত রাজনৈতিক ন্যারেটিভের কারনে অনেকে তাদের অপছন্দ করে। আবার অনেকেই ভালোও বাসে। কিন্তু সংখ্যার গাণিতিক সত্যকে কোনো দার্শনিক লেকচার দিয়ে বদলানো যায় না। জামায়াত জাতীয়ভাবে ৩০.৩% সমর্থন পাচ্ছে এই একই সমীক্ষায়।  রংপুরে তারা ৪৩.৪% যেখানে বিএনপিকেও তারা ছুঁয়ে ফেলে।

এই দলের সঙ্গে এখন আরও ৮টি সমমনা দল যুক্ত হয়েছে৷ একটি জোট, যার উদ্দেশ্য রাজনীতিকে পুনরায় এক বৈশিষ্ট্যময় রূপ দেওয়া।

বিএনপি কি এই বাস্তবতা দেখে?

হ্যাঁ, দেখে।

কিন্তু তারা দেখে ঠিক যেভাবে সূর্যাস্তের দিকে তাকালে মানুষ চোখ বুজে ফেলে।

তারপর আসে তৃতীয় লাইন NCP, জাতীয় নাগরিক পার্টি।  এটি নতুন প্রজন্মের দল।

PEPS-এ এদের সমর্থন ৪.১%। BIGD রিপোর্টে ২.৮%। কিন্তু যুবসমাজে SANEM-এর হিসাব বলছে ১৫.৮৪% সম্ভাবনা।

এই সংখ্যা হয়তো ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু “রাজনীতি” নামের যে মৃগয়ায় আসন দখল করতে হয় তার জন্য এই পরিমাণ ভোটই কখনো কখনো সরকার পরিবর্তনের কাঁটা ঘুরিয়ে দেয়।

এনসিপি এমন সময়ে জোট করছে যখন বিএনপি নিজ ঘর সামলাতে ব্যস্ত। জামায়াত তার সমর্থনকে শক্ত জোটে রূপ দিচ্ছে, আর আওয়ামী লীগ নীরব কিন্তু সতর্ক। এনসিপি যেভাবে তরুণ ভোটারের মনস্তত্ত্বে ঢুকেছে BNP তা পারেনি। এনসিপির এই উত্থানই বিশ্লেষকদের মুখে এক নতুন সত্য তুলে এনেছে। জামায়াত যতটা নয়, এনসিপির জোট বিএনপির ভোটকে আরও বেশি ক্ষয় করতে পারে।

এবার জনগণের দিকে তাকাই। PEPS বলছে-

৫৭.৫% মানুষ আইন-শৃঙ্খলাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে করে। দ্বিতীয় সমস্যা মূল্যস্ফীতি।

দুর্নীতি ও আইনি সংস্কারও শীর্ষ তালিকায়।

আর সবচেয়ে বড় কথা ৪৮.৫% ভোটার এখনও অনির্ধারিত।

এই অনির্ধারিত মানুষের দলটাই আসল নাটকের মূল চরিত্র। তারা এমন জনগোষ্ঠী যারা রাষ্ট্রের অস্থিরতার মাপ দেখে সিদ্ধান্ত নেয়, দলের পতাকা দেখে নয়। এই অনির্ধারিত মানুষদের ভোট BNP হারাবে কিনা, তা ঠিক করবে তাদের ভেতরের বিভাজন, জামায়াতের জোটগত শক্তি এবং এনসিপির আগ্রাসী নতুন-রাজনীতির ভাষা।

বিএনপি হয়তো সমীক্ষায় এগিয়ে আছে, কিন্তু রাজনীতি কেবল সমীক্ষার খেলাও নয়।এটি সময়ের নির্মম ব্যঙ্গ। যে দল নিজের ঘরে শান্তি রাখতে পারে না, সে কি দেশের শান্তি রাখতে পারবে? প্রশ্ন অবান্তর নয়, যৌক্তিক।

বিএনপির ভেতরের ক্ষয়, জামায়াতের আলাদা শক্তি, এনসিপির যুব-স্রোত এই তিনটি মিলিয়ে বিএনপির সম্ভাব্য ভোট উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে এমনটাই সমীক্ষা, বিশ্লেষক এবং মাঠের বাস্তবতা একসঙ্গে নির্দেশ করছে। সময়ের সাথে বিএনপির ভোট কমার আশংকাই নির্দেশ করছে।

রাজনীতি শেষ পর্যন্ত মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপর দাঁড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি দাঁড়ায় মানুষের ক্ষোভের ওপর। আর যে দেশে ক্ষোভই প্রধান চালিকাশক্তি। সেখানে বিভাজনই প্রকৃত নিয়ন্তা।

বিএনপি কি এই বিভাজন সামলাতে পারবে?

জামায়াত কি তাদের জোটকে সত্যিকারের শক্তিতে রূপ দিতে পারবে? এনসিপি কি নতুন প্রজন্মের বিশ্বাসকে ভোটে পরিণত করতে পারবে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা পেতে পারি।

কিন্তু রাজনীতি? রাজনীতি কখনো সরাসরি উত্তর দেয় না। সে দেয় সংকেত, দেয় ইঙ্গিত, আর মাঝেমধ্যে দেয় নির্মম হাসি।

শেষ পর্যন্ত মনে হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন শুধু একটি গণতান্ত্রিক অনুষ্ঠান নয়; এটি ক্ষমতার মনস্তত্ত্বের এক বিশাল মানসিক-নাট্যমঞ্চ, যেখানে প্রত্যেক দল নিজের ট্র্যাজেডি নিজেই রচনা করে, নিজেই অভিনয় করে, আর শেষে বিস্ময়করভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত করতালি দাবি করে!


লেখক-ইতিহাস,রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর