img

ইলন মাস্ক: ৫০০ বিলিয়ন ডলারের পথে অস্তিত্বের সংকট ও নবজাগরণের উপাখ্যান

প্রকাশিত :  ১১:২৯, ০৩ অক্টোবর ২০২৫

ইলন মাস্ক: ৫০০ বিলিয়ন ডলারের পথে অস্তিত্বের সংকট ও নবজাগরণের উপাখ্যান

✍️ রেজুয়ান আহম্মেদ 

​ইলন মাস্কের নাম এখন আর শুধু প্রযুক্তি বা উদ্ভাবনের সমার্থক নয়, বরং মানব ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব আর্থিক সাফল্যের প্রতীক। সম্প্রতি মাস্ক বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন। এই বিপুল অঙ্কটি নিছক একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং চরম ঝুঁকি, বহুস্তরীয় বিপর্যয় এবং অস্তিত্বের সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এক অবিস্মরণীয় উপাখ্যানের চূড়ান্ত পরিণতি। তাঁর এই উত্থান শুধু রকেট তৈরি বা বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির গল্প নয়; এটি এক অসাধারণ মানসিক স্থিতিস্থাপকতা এবং কৌশলগত বুদ্ধিমত্তার বিশ্লেষণ, যা তাঁকে প্রতিবার প্রায়-পতন থেকে আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসতে সাহায্য করেছে।

​তাঁর এই ৫০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ মূলত টেসলা, স্পেসএক্স এবং তাঁর নতুন এআই ভেঞ্চার xAI-এর বাজার মূল্যায়নের ওপর নির্ভরশীল। এই সম্পদ প্রথাগত স্থির অর্থের মতো নয়, বরং চরম বাজারের ঝুঁকি এবং প্রযুক্তিনির্ভর অস্থিরতার ফল। ‘দ্য ভোলাটিলিটি অফ হাইপার-ওয়েলথ’ (The Volatility of Hyper-Wealth) এই সত্যটি উন্মোচন করে যে, তিনি যে শিল্পগুলোতে নেতৃত্ব দেন—মহাকাশ ভ্রমণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বৈদ্যুতিক যানবাহন—সেগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

​এই সম্পদের বৃদ্ধি একটি কারণ-ফলাফল চেইন অনুসরণ করে: উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগুলোতে (AI, স্পেস ট্র্যাভেল) বিনিয়োগ করার ফলেই তাদের দ্রুত এবং চরম মূল্যায়ন বৃদ্ধি ঘটে। ফলস্বরূপ, মাস্কের ব্যক্তিগত সম্পদ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়: মাস্কের সংগ্রাম কেবল আর্থিক সংস্থানের জন্য ছিল না; তাঁর প্রতিটি চ্যালেঞ্জ সময়ের সাথে সাথে স্কেল করেছে। এখনকার লড়াই ছোট কোম্পানির দেউলিয়াত্ব এড়ানোর নয়, বরং ট্রিলিয়ন-ডলার মূল্যের সংস্থার ধারাবাহিক পারফরম্যান্স এবং মহাজাগতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বজায় রাখার চাপ সামলানো।

জীবনের প্রারম্ভিক সংগ্রাম: ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন

​ইলন মাস্ক দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের সামাজিক ও জাতিগত বিভাজনে প্রভাবিত এক সমাজে বেড়ে উঠেছিলেন। এই পরিবেশে শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবন কঠোর জাতিগত বিভাজন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। মাস্ক শৈশব থেকেই কম্পিউটার এবং উদ্যোক্তা কাজে প্রতিভা দেখিয়েছিলেন; মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি একটি ভিডিও গেম তৈরি করে একটি কম্পিউটার ম্যাগাজিনের কাছে বিক্রি করেছিলেন।

​তবে, তাঁর জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন সিদ্ধান্তটি আসে ১৭ বছর বয়সে। ১৯৮৮ সালে, তিনি কানাডিয়ান পাসপোর্ট ব্যবহার করে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে চলে যান। এই অভিবাসনের দুটি মূল কারণ ছিল: প্রথমত, বাধ্যতামূলক সামরিক পরিষেবা এড়িয়ে বর্ণবৈষম্য নীতি কার্যকর করতে সরকারকে সহায়তা না করা; এবং দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৃহত্তর অর্থনৈতিক সুযোগের সন্ধানে যাওয়া। এই সিদ্ধান্তটি তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা এবং নৈতিক অবস্থানের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ছিল।

​কানাডায় অভিবাসনের পর মাস্কের জীবন সহজ ছিল না। উন্নত সুযোগের সন্ধানে এসে তাঁকে কঠিন শারীরিক শ্রমের মুখোমুখি হতে হয়। জীবনী অনুসারে, তিনি ভ্যানকুভারে কাঠ কাটার কাজ নিয়েছিলেন, যেখানে তাঁকে চেইনস চালানো এবং কাঠ কাটা শিখতে হয়েছিল।

​কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে চরম শারীরিক কষ্টকর অভিজ্ঞতা ছিল একটি কাঠকলের বয়লার রুম পরিষ্কারের কাজ। এই কাজটিকে তাঁর করা সবচেয়ে অদ্ভুত কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তাঁকে একটি ছোট টানেলের মধ্য দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করতে হতো, বেলচা দিয়ে বালি এবং অবশিষ্ট পদার্থ পরিষ্কার করে বের করে আনতে হতো। এই কাজের মাধ্যমে তিনি প্রতি ঘণ্টায় ১৮ ডলার উপার্জন করতেন। এই কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল: প্রথম সপ্তাহে শুরু করা ৩০ জন শ্রমিকের মধ্যে মাত্র দুজন টিকে ছিলেন—মাস্ক ছিলেন তাঁদের একজন। এই ঘটনাটি তাঁর চরম শারীরিক সহনশীলতা, অদম্য নিষ্ঠা এবং কাজের প্রতি অবিচল দৃঢ়তার প্রমাণ দেয়।

​এই প্রাথমিক সংগ্রামগুলো থেকে একটি গভীর শিক্ষা পাওয়া যায়। মাস্কের শৈশবের আর্থিক সংগ্রাম কেবল \"টাকা না থাকা\" নয়, বরং \"অস্তিত্বের জন্য কঠোর শ্রম\" ছিল। বয়লার রুমের কাজ শারীরিক ও মানসিক চাপের এক কঠিন প্রশিক্ষণ ছিল, যা তাঁর মানসিকতার ভিত্তি তৈরি করে। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে পরবর্তীতে ‘প্রোডাকশন হেল’ বা ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের মতো চরম পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল। যখন একজন ব্যক্তি ন্যূনতম স্তর থেকে জীবন শুরু করার দৃঢ়তা অর্জন করেন এবং সামান্য পারিশ্রমিকের জন্য চরম শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে পারেন, তখন কোটি কোটি ডলারের ঝুঁকি নেওয়া তাঁর কাছে তুলনামূলকভাবে কম ভয়ংকর মনে হয়।

প্রথম উদ্যোক্তা সাফল্য: জিপ২ ও পেপ্যাল

​১৯৯৫ সালে, ক্যালিফোর্নিয়ার পালো অল্টোতে, মাস্ক তাঁর ভাই কিম্বল এবং গ্রেগ কৌরিকে নিয়ে গ্লোবাল লিংক ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে Zip2 কর্পোরেশন নামে পরিচিত হয়। এটি ছিল সংবাদপত্রগুলিকে অনলাইন \'সিটি গাইড\' সফটওয়্যার লাইসেন্স করার একটি উদ্যোগ। Zip2 দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, নাইট রিডার এবং হার্স্ট কর্পোরেশনের মতো বড় সংবাদপত্রের সাথে চুক্তি করে, যা দ্রুত একে মার্কিন সংবাদপত্র শিল্পের অনলাইন প্রতিক্রিয়ার একটি প্রধান অংশে পরিণত করে।

​এই প্রাথমিক উদ্যোগের সময় তিনি আরও একটি ঝুঁকির সম্মুখীন হন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক অধ্যয়ন পরিত্যাগ করার পর, তিনি অল্প সময়ের জন্য Zip2 নিয়ে কাজ করার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সঠিক অনুমোদন ছাড়া অবৈধভাবে কাজ করেছিলেন বলে একটি প্রতিবেদনে জানা যায়। তাঁর প্রাথমিক জীবনের এই পর্যায়টি স্পষ্ট করে যে, নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য তিনি শুরু থেকেই চরম ব্যক্তিগত ও আইনি ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন।

​Zip2 প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে সংবাদপত্রগুলিকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে স্থান দিতে সাহায্য করেছিল। এটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৯৮ সালের মধ্যে প্রায় ১৬০টি সংবাদপত্রের সাথে অংশীদারিত্ব স্থাপন করে। এই সফলতার ফলস্বরূপ, ১৯৯৯ সালে কম্প্যাক কম্পিউটার ৩০৫ মিলিয়ন ডলারে Zip2 অধিগ্রহণ করে। এই অধিগ্রহণের ফলে ইলন মাস্ক তাঁর প্রথম বড় আর্থিক সাফল্য অর্জন করেন, যেখানে তাঁর ব্যক্তিগত লাভ ছিল ২২ মিলিয়ন ডলার।

​Zip2 বিক্রির পর মাস্কের সামনে সুযোগ ছিল নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করার। কিন্তু তিনি তা না করে আরও বড় ঝুঁকিতে ঝাঁপ দেন। তিনি অর্থ শিল্পে বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে, তিনি তাঁর নিজের অর্জিত ১২ মিলিয়ন ডলার X.com-এ ঢেলে দেন। এই উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ অনলাইন ব্যাংক তৈরি করা যা প্রথাগত ব্যাংকিংয়ের ফি এবং অদক্ষতা দূর করবে।

​X.com-এর যাত্রা অবশ্য মসৃণ ছিল না। X.com যখন কনফিনিটির (যারা পেপ্যাল নামে পেমেন্ট সিস্টেম চালাত) সাথে একীভূত হয়, তখন অভ্যন্তরীণ সংঘাত শুরু হয়। মাস্ক X.com ব্র্যান্ডিং এবং মাইক্রোসফ্ট প্ল্যাটফর্মের পক্ষে ছিলেন, অন্যদিকে কনফিনিটির দল পেপ্যাল নাম এবং ইউনিক্স প্ল্যাটফর্ম পছন্দ করত। এই সাংস্কৃতিক এবং প্রযুক্তিগত সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে।

​২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে মাস্ক যখন তাঁর হানিমুনে ছিলেন, তখন পিটার থিয়েল এবং ম্যাক্স লেভচিনের নেতৃত্বে একটি বোর্ডরুম ক্যু হয়। মাস্ককে সিইও পদ থেকে সরিয়ে থিয়েলকে বসানো হয়। এটি মাস্কের উদ্যোক্তা জীবনে প্রথম বড় ব্যক্তিগত এবং পেশাদার ধাক্কা ছিল। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলেও, তিনি কোম্পানির প্রধান শেয়ারহোল্ডার হিসেবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই অদম্য সংকল্পের ফলস্বরূপ, ২০০২ সালে ইবে যখন ১.৫ বিলিয়ন ডলারে পেপ্যাল অধিগ্রহণ করে, তখন মাস্ক আনুমানিক ১৭৫.৮ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ১৬০–১৮০ মিলিয়ন কর পরবর্তী) লাভ করেন।

​পেপ্যাল থেকে অর্জিত এই বিশাল সম্পদ তিনি ভোগবিলাসে ব্যয় করেননি। বরং, মাস্ক এটি তাঁর পরবর্তী তিনটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ভেঞ্চারে পুনর্বিনিয়োগ করার এক অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত নেন: স্পেসএক্সে ১০০ মিলিয়ন, টেসলায় ৭০ মিলিয়ন, এবং সোলারসিটিতে ১০ মিলিয়ন। তাঁর এই চরম ব্যক্তিগত বিনিয়োগের সিদ্ধান্তই পরবর্তীতে ২০০৮ সালের বিপর্যয়ের সময় তাঁকে ব্যক্তিগত দেউলিয়াত্বের মুখে ঠেলে দিয়েছিল।

​এই ঘটনা থেকে একটি গভীর উপলব্ধি তৈরি হয়: পেপ্যাল ক্যু মাস্ককে শিখিয়েছিল যে শুধুমাত্র উচ্চাভিলাষী প্রযুক্তিগত দিক ঠিক থাকলেই হয় না, কর্পোরেট রাজনীতি এবং সংস্কৃতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্যু তাঁকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিলেও, তা তাঁকে বিপুল মূলধন এনে দেয়, যা তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, পুঁজিবাদী ঝুঁকিতে (স্পেসএক্স, টেসলা) বিনিয়োগ করেন। এই ব্যর্থতাটি কৌশলগতভাবে ভবিষ্যতের সাফল্যের জন্য পুঁজির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।

২০০৮ সালের সংকট ও মানসিক ট্রমা: দ্য ফাইনাল টেস্ট

​২০০৮ সাল ইলন মাস্কের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার সময় চিহ্নিত করে। তিনি তাঁর সমস্ত ব্যক্তিগত সম্পদ তাঁর দুই প্রধান ভেঞ্চার—স্পেসএক্স এবং টেসলা—এ ঢেলে দিয়েছিলেন, এবং উভয় কোম্পানিই একই সঙ্গে পতনোন্মুখ ছিল। স্পেসএক্সের ফ্যালকন ১ রকেটের একাধিক উৎক্ষেপণে ব্যর্থ হয়। বিশেষত তৃতীয় উৎক্ষেপণ ব্যর্থ হওয়ার পর, কোম্পানি দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। একই সময়ে, টেসলা ‘উৎপাদন নরক’ (production hell) এবং মান নিয়ন্ত্রণের সমস্যায় ভুগছিল, যার কারণে ব্যাপক বিলম্ব এবং আর্থিক ক্ষতি হচ্ছিল।

​এই চরম সংকটের সময়ে, মাস্কের হিসাবে, দুটি কোম্পানির মধ্যে কেবল একটিকে বাঁচানোর মতো টাকাই তাঁর কাছে অবশিষ্ট ছিল। তবুও, তিনি তাঁর শেষ ২০ মিলিয়ন ডলার দুটি কোম্পানিতেই ঢেলে দেওয়ার সাহসী, প্রায় মরিয়া সিদ্ধান্ত নেন। ব্যবসায়িক ব্যর্থতার প্রভাব তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের উপরও পড়ে। এই সংকটের সময় মাস্কের ব্যক্তিগত আর্থিক অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেছিলেন যে তাঁকে বাড়ি ভাড়া পরিশোধের জন্য ধার করতে হয়েছিল।

​কিন্তু এই সময়ের সবচেয়ে বড় মূল্য ছিল মানসিক যন্ত্রণা। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে, যখন সংকট চরম আকার ধারণ করে, তখন তিনি প্রচণ্ড মানসিক চাপে ছিলেন। তিনি স্বীকার করেন, “আমার মনে আছে বড়দিনের আগের সেই রবিবার আমি জেগে উঠেছিলাম, এবং ভাবছিলাম, ‘আমি কখনো কাঁদি না, কিন্তু আজ কাঁদতে পারি’।”। তিনি তাঁর কোম্পানিগুলোকে নিজের সন্তানের মতো মনে করতেন। যখন উভয়ই প্রায় ধসে পড়ছিল, তিনি অনুভব করেন, “যন্ত্রণা ছিল অসহনীয়... আমার মনে হচ্ছিল যেন আমি আমার সন্তানদের মরতে দেখছি।”। উচ্চ-চাপের এই আর্থিক ঝুঁকি অস্তিত্বমূলক ভয়ের জন্ম দেয়। গবেষণায় দেখা যায় যে উচ্চ-স্টেক আর্থিক চাপ দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার সাথে তুলনীয় কর্টিসল স্পাইক তৈরি করে। মাস্ক স্বীকার করেছেন যে এই ট্রমা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল, যা তিনি বহু বছর পরেও টুইটে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

​বিপর্যয়ের মুখে মাস্ক আতঙ্কিত হননি, বরং স্থির থেকে সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। তাঁর অবিচল নেতৃত্বই মোড় ঘুরিয়ে দেয়। স্পেসএক্স আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য নাসার আনুষ্ঠানিক সরবরাহকারী হওয়ার চুক্তি জিতে নেয়। এই চুক্তিটি ছিল কোম্পানির জন্য অস্তিত্ব রক্ষার লাইফলাইন।

​সংকট কেবল ২০০৮ সালেই থেমে থাকেনি। ২০১৩ সালে টেসলা আবারও দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে গুগলকে বিক্রির একটি প্রাথমিক চুক্তিও হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে টেসলার বিক্রয় দল প্রত্যাশিত লক্ষ্যের চেয়ে ভালো পারফর্ম করায় কোম্পানিটি পুনরুত্থিত হয় এবং শেয়ারের দাম দ্রুত বেড়ে যায়, যার ফলে গুগলকে বিক্রির প্রয়োজন হয়নি।

​মাস্কের এই গল্পটি নিছক সাফল্যের নয়, বরং উচ্চাভিলাষী সাফল্যের জন্য ধার্য করা চরম মানসিক মূল্যের। ২০০৮ সালের সংকট দেখায় যে ঝুঁকি শুধুমাত্র আর্থিক নয়; এটি অস্তিত্বমূলক। তাঁর এই মানসিক চাপ এবং পরবর্তীকালে ট্রমা (PTSD) তাঁর তীব্র, হাতে-কলমে (hands-on) এবং মাইক্রোম্যানেজিং নেতৃত্ব শৈলীর উৎস হিসেবে কাজ করে।

ফার্স্ট প্রিন্সিপল থিংকিং: সাফল্যের কৌশলগত অস্ত্র

​মাস্কের উত্থানের অন্যতম কৌশলগত অস্ত্র হলো ‘ফার্স্ট প্রিন্সিপল থিংকিং’। এই পদ্ধতিটি প্রাচীন গ্রিক দর্শন থেকে এসেছে, কিন্তু মাস্ক এটিকে আধুনিক ব্যবসায়িক সমস্যা সমাধানে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। এর মূল কথা হলো—জটিল সমস্যাগুলোকে তাদের সবচেয়ে মৌলিক এবং অপরিহার্য অংশে ভেঙে ফেলা। এই প্রক্রিয়াটি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত অনুমান এবং প্রচলিত রীতিনীতিগুলোকে বাতিল করতে উৎসাহিত করে। এর বদলে, এটি মৌলিক সত্যগুলি আবিষ্কার করে শূন্য থেকে নতুন সমাধান তৈরি করার পথ দেখায়। প্রচলিত পদ্ধতিতে কাজ করলে মাস্ক কখনোই প্রতিষ্ঠিত শিল্প নেতাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারতেন না; তাঁকে টিকে থাকার জন্য ব্যয় কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন আনতে এই দর্শন ব্যবহার করতে হয়েছিল।

​মাস্ক যখন ২০০২ সালে মহাকাশ ভ্রমণে প্রবেশ করেন, তখন প্রথাগত অনুমান ছিল যে রকেট তৈরি করা ব্যয়বহুল। একটি রকেট কিনতে ৬৫ মিলিয়ন ডলার খরচ হতো। মাস্ক এই প্রথাগত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি প্রশ্ন করেন: একটি রকেটের কাঁচামাল (কার্বন, অ্যালুমিনিয়াম, ইত্যাদি) কিনতে আসলে কত খরচ হয়?

​উত্তরটি ছিল চমকপ্রদ: কাঁচামালের খরচ মোট দামের মাত্র প্রায় ২%। ফলস্বরূপ, তিনি কাঁচামাল কিনে নিজেই রকেট তৈরি করা শুরু করেন। এই কৌশল রকেট উৎক্ষেপণের খরচ ১০ গুণ কমিয়ে এনেছিল এবং লাভজনকতা এনে দিয়েছিল। এটি স্পেসএক্সকে ২০২১ সাল নাগাদ ৭৪ বিলিয়ন মূল্যের কোম্পানিতে পরিণত করে।

​\'ফার্স্ট প্রিন্সিপল থিংকিং\' টেসলাতেও প্রয়োগ করা হয়, বিশেষ করে ব্যাটারির উচ্চ খরচ কমানোর ক্ষেত্রে। প্রথাগতভাবে মনে করা হতো যে ব্যাটারি প্যাক সহজাতভাবে ব্যয়বহুল। মাস্ক এখানেও মৌলিক প্রশ্নটি তোলেন: একটি ব্যাটারি প্যাকের মৌলিক উপাদানগুলির (কার্বন, নিকেল, অ্যালুমিনিয়াম) খরচ কত?

​তাঁর সমাধান ছিল: এই উপাদানগুলিকে ব্যাটারি সেলের আকারে নিয়ে আসার চতুর উপায় খুঁজে বের করতে হবে, যা প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অনেক বেশি সাশ্রয়ী হতে পারে। এই কৌশল টেসলাকে ইভি শিল্পে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দিয়েছে, কারণ এটি ব্যাটারি উৎপাদনের মৌলিক ব্যয় কাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করেছে।

​\'ফার্স্ট প্রিন্সিপল\' চিন্তা কেবল একটি প্রকৌশল পদ্ধতি নয়; এটি আর্থিক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একজন উদ্যোক্তার জন্য একটি বাধ্যতামূলক ব্যবসায়িক কৌশল। প্রচলিত ব্যয় কাঠামো অনুসরণ করলে মাস্কের কোম্পানিগুলোর অস্তিত্ব সম্ভব হতো না। তাঁর অস্তিত্বের সংকটই তাঁকে এই পদ্ধতি প্রয়োগে বাধ্য করেছিল, যা নতুন, সাশ্রয়ী উৎপাদন প্রক্রিয়া তৈরি করে শিল্পে বিপ্লব ঘটায় এবং তাঁকে আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সাহায্য করে। এটি সংগ্রাম থেকে কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

ভবিষ্যতের সাম্রাজ্য: স্কেলিং অফ রিস্ক

​২০০৮ সালের সংকট থেকে বেঁচে ফেরার পর, মাস্কের সাম্রাজ্য কেবলমাত্র স্থিতিশীলতা অর্জন করেনি, বরং উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। স্পেসএক্স পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাকাশ ভ্রমণের ধারণাকে বদলে দিয়েছে। বর্তমানে তারা পৃথিবীর প্রথম সম্পূর্ণরূপে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উৎক্ষেপণ যান (স্টারশিপ) তৈরির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

​স্টারশিপের অগ্রগতি মাস্কের *‘স্কেলিং অফ রিস্ক’* (The Scaling of Risk)-এর একটি নিখুঁত উদাহরণ। প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শেখা এবং দ্রুত নকশা উন্নত করা তাঁর পদ্ধতির মূল চাবিকাঠি। আগস্ট ২০২৫-এ অনুষ্ঠিত স্টারশিপের দশম ফ্লাইট টেস্ট ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যা মূল্যবান ডেটা সরবরাহ করে। এই যানটি সফলভাবে অবতরণের কৌশল সম্পন্ন করে এবং ভারত মহাসাগরে একটি \'সফট স্প্ল্যাশডাউন\' করে। যদিও পূর্বে একাধিক ব্যর্থতা হয়েছে, প্রতিটি ফ্লাইট টেস্টের সাফল্য কোম্পানিটির ৪০০ বিলিয়ন মূল্যায়নের জন্য অপরিহার্য।

​মাস্ক তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা মহাকাশ এবং ইভি শিল্পের বাইরেও বিস্তৃত করেছেন। নিউরালিংক মানব মস্তিষ্কের সাথে ডিজিটাল ডিভাইসের সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এছাড়াও, তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন তাঁর এআই স্টার্টআপ xAI-এর মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই xAI ৭৫ বিলিয়ন মূল্যায়নে পৌঁছেছে এবং ২০০ বিলিয়ন মূল্যায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। মাস্কের সাম্রাজ্য প্রমাণ করে যে ঝুঁকি গ্রহণ বন্ধ হয় না; এটি কেবল স্কেল করে। স্টারশিপের প্রতিটি সফল পরীক্ষা এবং xAI-এর উচ্চাকাঙ্ক্ষী মূল্যায়ন প্রমাণ করে যে তাঁর বর্তমান লড়াই ট্রিলিয়ন-ডলার অর্থনীতিতে আধিপত্য বজায় রাখার।

​ইলন মাস্ক বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ৫০০ বিলিয়ন নেট ওয়ার্থে পৌঁছান। এই অর্জনের প্রধান কারণ ছিল টেসলার শেয়ারের প্রত্যাবর্তন (তিনি কোম্পানিটির ১২.৪% এর বেশি শেয়ারের মালিক) এবং তাঁর বেসরকারি সংস্থাগুলির—স্পেসএক্স এবং xAI—দ্রুত মূল্যায়নের বৃদ্ধি। একদিনে টেসলার শেয়ার ৩.৩% বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁর সম্পদে ৬ বিলিয়ন যুক্ত হয়েছিল। এই অস্থিরতা মাস্কের প্রভাব এবং বাজারের আস্থাকে প্রতিফলিত করে, যেখানে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করে।

​মাস্কের এই অস্বাভাবিক সম্পদ এবং প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে টেসলার বোর্ড তাঁকে ধরে রাখার জন্য একটি ১ ট্রিলিয়ন ক্ষতিপূরণ পরিকল্পনার প্রস্তাব দিয়েছে। এই বিশাল পুরস্কারটি উচ্চাভিলাষী পারফরম্যান্স লক্ষ্য এবং একটি বৃহত্তর ইক্যুইটি স্টেকের সাথে সংযুক্ত। এই পরিকল্পনার অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে মাস্কের সংগ্রাম এখন আর আর্থিক অভাবের নয়, বরং অপসারণযোগ্যতা (Irreplaceability) বজায় রাখার।

সংগ্রামই সাফল্যের মূলধন

​ইলন মাস্কের ৫০০ বিলিয়ন ডলারের পথে উত্থান একটি মোটিভেশনাল আখ্যানের চেয়েও বেশি কিছু—এটি আধুনিক পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ ঝুঁকি এবং মানসিক দৃঢ়তার একটি কেস স্টাডি। তাঁর যাত্রা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলো উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোক্তা এবং পেশাদারদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

​প্রথমত, তাঁর যাত্রা দেখায় যে চরম ঝুঁকি ব্যক্তিগতভাবে ট্রমাটিক হতে পারে। সাফল্য অর্জনের জন্য শুধু মূলধন নয়, বরং মানসিক স্থিতিস্থাপকতা এবং ২০০৮ সালের মতো বিপর্যয় থেকে শেখার ক্ষমতা অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, \'ফার্স্ট প্রিন্সিপল থিংকিং\' প্রমাণ করে যে প্রচলিত জ্ঞান বা প্রথাগত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতাই শিল্পে বিপ্লব ঘটায়। যখন সবাই বলে কোনো লক্ষ্য \'অসম্ভব\' বা \'অত্যন্ত ব্যয়বহুল\', তখন মাস্ক জিজ্ঞেস করেন, \'কেন নয়, মৌলিক উপাদান কী?\'।

​সবশেষে, তাঁর সাফল্যের মূলে রয়েছে পুঁজির সচেতন ব্যবহার। জিপ২/পেপ্যাল থেকে অর্জিত পুঁজি তিনি ভোগবিলাসে নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যত পরিবর্তনের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ভেঞ্চারে পুনর্বিনিয়োগ করেন। এই চরম পুনর্বিনিয়োগের সিদ্ধান্তই তাঁকে ২০০৮ সালের সংকটে ফেলেছিল, কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্যের পথও তৈরি করেছিল। ইলন মাস্কের গল্প নিছক ভাগ্য বা সুযোগের গল্প নয়। এটি সেই ব্যক্তির গল্প, যিনি বয়লার রুমের কঠোর শ্রমের মধ্য দিয়ে এসে, বোর্ডরুমের রাজনীতিতে ক্ষমতাচ্যুত হয়েও, নিজের সব সঞ্চয় বাজি রেখেছিলেন। ৫০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক কেবল একটি সংখ্যা নয়; এটি অগণিত ব্যর্থতা, মানসিক যন্ত্রণা এবং চরম ঝুঁকির পর ঘুরে দাঁড়ানোর এক অবিস্মরণীয় উপাখ্যান। সংগ্রামই এখানে সাফল্যের মূলধন।

মতামত এর আরও খবর

img

উন্মুক্ত বিবেক, মুক্ত ফিলিস্তিন!!

প্রকাশিত :  ০৭:৩৬, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:৫২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

নুজহাত নূর সাদিয়া

আহা ! বুকের পাঁজর ভাঙা গগনবিদারী আর্তনাদ , নাহ-কোন নিরব জঠর যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাওয়া গর্ভবতী মায়ের নবজাতক জন্ম দেওয়ার অবিস্মরণীয় ক্ষণটি উদযাপনের আনন্দচ্ছোস নয়, এ যে সহস্র দিনের গ্লানি শেষে এক নিকষ কালো আঁধার পেরিয়ে মাতৃভূমির বুকে নির্ভীক পা রাখা । আবার সেই চিরপরিচিত সবুজ দুর্বা ঘাসে ছুঁটে বেড়ানো , বাড়ন্ত স্কোয়াশের পূর্ণ ঝুঁড়ি, মাংসের রসাল স্যুপ, হাতে বানানো গমের রুটি সহযোগে উদর পূর্তির সেই পারিবারিক সুখস্মৃতি , মায়ায় জড়ানো বছর পার করে দেওয়া সংগ্রামী পরিবারগুলো ফিরে কি পাবে তাদের সেই প্রাণোচ্ছল ফিলিস্তিন । বহু চর্চিত এই প্রশ্নটির উত্তর অজানা আশংকা আর অনিশ্চয়তার অদৃশ্য গেরোতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকলে ও বিপরীত শিবিরে ও বহু দিনের ঘরবন্দী প্রিয়মুখগুলো স্বজনদের বাহুডোরে ফেরার অপেক্ষায় । আগ্রাসী ইসরায়েলের ধূলো উড়ানো পথ ও যে আজ শান্তিকামী মানুষের স্বতস্ফূর্ত হাসিতে ভরপুর। 

আনুষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী, মোট হতাহতের সংখ্যা  ৬৬,০০০ হাজার ছাঁড়িয়ে গেছে, জীবন-ভর পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে ২,৫০,০০০ জন হতভাগ্যকে , বেঁচে যাওয়া অসংখ্য দুরন্ত শৈশব বাকিটা জীবন সম্ভবত এক দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবে, আকাশ ছোঁয়া দালান , সুসজ্জিত স্থাপনা আর পুরাকীর্তির শহর ফিলিস্তিন আজ এক মৃতপ্রায় ভুতুড়ে নগরী ।

এই যে  ক্ষতি , তা সন্দেহাতীতভাবেই অপূরণীয় ক্ষতি । নেতানিয়াহু নামের এক বিকট দানবের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর অপরিণামদর্শী যুদ্ধ কৌশলের খেস ারত দিতে হল ফোরাত নদীর তীরবর্তী নিরীহ প্রাণগুলোর। বিশ্ব মানচিত্র হতে ফিলিস্তিন নামক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটি ( গাজা প্রায়২১ লক্ষ লোকের আবাস) মাত্র মাসখানিক আগে ও নিরবে মুছে যাচ্ছিল ধনী রাষ্ট্রের তাবেদার মুসলিম বিশ্বের অলস শাসনকর্তাদের নির্লিপ্ত আচরণের কারণে । মুসলমান ভাই -ভাই, জুলুমবাজের নিস্তার নাই, বিপন্ন মানবতা বহুল চর্চিত প্রবাদগুলো নিতান্তই খাঁচায় বন্দি তোতাপাখির মুখস্থ বুলির মত আউড়ে চলছিল বিশ্বরাজনীতির মোড়লরা । তবে কি, আমজনতার পরম আরাধ্য পার্থিব জীবনের ও সমাপ্তি আছে, আর সেই সমাপ্তি বরাবরই ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়েছে স্রষ্টার একান্ত ইচ্ছেয়, অসহায়ের পূর্ণ সমর্থনে আর দিনশেষে সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ে ।

গৃহকোণের শান্তি গৃহকর্ত্রীর পরম প্রিয়, আর সেই শান্তির সুশীতল পরশ এ ভূগোলকের পরতে পরতে ছঁড়িয়ে দিতে যে উদ্যোগী মানুষগুলো অনন্য সাধারণ কাজগুলোকে বাস্তবতার আলো দেখান সে মানুষগুলোই কর্মকুশলতায় অর্জন করে নেন সর্ব্বোচ সম্মান -নোবেল । এ নোবেল প্রাপ্তি, কার ও দারিদ্র্য বিমোচনে, চলতি ‘২৫ সালে বিতর্কিত মারিয়া কোরিয়া মাচানো -যার রাষ্ট্রীয় নীতি বহু অসহায় মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে, প্রাক্তন  যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক সহ শান্তিতে নোবেল পাওয়া আলোচিত মানুষগুলো পুরষ্কারের কোঠা না মানদন্ড না তাদের কাজের বিষয় এ সূক্ষèাতিসূক্ষè বিষয়গুলো

রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, আর স্বেচ্ছাচারী কর্তা যখন নিজ খেয়াল-খুশি মত আইন -কানুন তৈরি করে অসহায়দের উপর তা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন তখন তা ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা জায়ানবাদীদের  আধিপত্য আর কতৃর্ত্ববাদের নির্মমতার করুণ পুনরাবৃত্তি বই আর কিছুই নয় । আর ও নির্মম কৌতুক, একদা জায়ানবধের রাজ্য বলে খ্যাত , হিটলারের জার্মান, মাঁখোর  ফ্রান্স , কূটনৈতিক ব্রিটেন সহ দু‘মুখো আরব বিশ্ব সকলে এ নির্মম রসিকতায় সামিল ! দুনিয়া যে ক্ষমতা আর অর্থের পূজারী - পড়ন্ত বেলার প্রাজ্ঞ প্রবীণদের গভীর হতাশার সুরে তা সুস্পষ্ট ।

রুপকথার গল্পের চেয়ে ও বাস্তব জীবনের গল্প অনেকসময় অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠে , হয়ে উঠে প্রকৃত রুপক নতুবা তার চেয়ে ও শক্তিশালী আখ্যান । বিশ টি বছর ধরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর নানা প্রতিকুলতায় অবরুদ্ধ হামাস , ঠিক জিতে গেল সাহস আর দেশের প্রতি ভালবাসাকে হৃদয়ে লালন করে।

আর, সেই ছোট্ট গেরিলা সদস্যের দলটি আজ কত বড়! মানচিত্র ছাঁড়িয়ে , সীমানা ছাঁড়িয়ে নব প্রজন্মের অকুতোভয় হামাসরা আজ দুয়ারে দাঁড়ানো দৃঢ় দ্বাররক্ষী । তারাই পারে ,তথাকথিত অজেয় পশ্চিমা শক্তিকে শান্তিচুক্তি নামক সে নাটকীয় ঘটনার অন্যতম যোগানদার করতে। মার্কিন সরকার প্রধান উপযাচক মাত্র-পরিস্থিতি বুঝেই হয়তবা বন্ধুর পথে হাঁটতে চাইছেন, ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বর্মটি যে ভিষণ শক্তপোক্ত ও একরোখা ।

তবে, মধ্যপ্রাচ্যে ছঁড়ি ঘুরানোর দীর্ঘদিনের শক্তলাঠিটি কে যে এবার বাঁকাতেই হয় ।  সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙবে না, হায় বেনিয়ামিন  কি অসম্মানের এক পরাজয় ! কি অপেক্ষা করছে দুর্নীতি মামলায় জর্জরিত বুড়ো নেকড়েটির কপালে -বিধ্বস্ত চেহারায় কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো দীর্ঘতর হচ্ছে বৈকি।

প্রতিরোধ, যুদ্ধের নামে আগ্রাসন আর বসতি স্থানান্তরের নামে বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক শরণার্থী , আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় হয়তবা এখন পর্যন্ত বিজয় উদযাপনে ব্যস্ত । তবে নারীর প্রতি সম্মান রক্ষার্থে ট্রাম্প তার প্রাক্তন রাজনৈতিক প্রতিদন্বী বারাকের উপর সম্ভবত সচেতনভাবেই তার রাষ্ট্র পরিচালনার মেয়াদকালে বিতর্কিত সন্ত্রাসী বনাম ইসলামিক সেনাবাহিনী মতানৈক্যের বিষয়টির উপর  ইঙ্গিত দিয়েছেন । আর , ব্রিটিশ সংসদে চিত্রিত ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে পুরনো বন্ধু ব্লেয়ারের পদাংক অনুসরিত কিনা, তাই আপনমনে যাচাই-বাছাই করে চলেছেন। 

পরিস্থিতির পরিবর্তিত মোড় , কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন লিখিত শান্তি  চুক্তির যে ভিন্ন ভিন্ন ২০টি শর্ত শোভা পাচ্ছে  তার সুচারু বাস্তবায়ন খোদ ট্রাম্পের পক্ষেই যথেষ্ট দুরুহ । পেন্ডুলামের কাঁটা চলমান, হঠকারী ছোটভাই একবার নয় বেশ ক‘বার বড় ভাইয়ের অবাধ্য হয়েছেন , আস্ত উড়োজাহাজ উপহার আর বন্ধুপ্রতীম কাতারের উপর অর্তকিত আক্রমণ । রক্তে যার খুনে নেশা সে পাগলা ঘোড়া কি আদৌ থামবে ? বিলুপ্ত হিজবুল্লা, হুতির হারিয়ে যাওয়া হামাসের নেতৃত্বের শক্তি ক্ষয় , সিরিয়ায় ভাঙ্গন, ইরানের সফল প্রতিরক্ষার ব্যুহ ভেদ- আপাত , দ্বিধাগ্রস্থ ইসরাইল প্রধান সফলতার মাপকাঠিতে আত্নতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন হয়তবা ।  তবে,গাজামুখি সারি সারি ত্রাণবাহী গাড়ির বহরের দী¦প্ত যাত্রা কি তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় নি, নিশ্চিতভাবেই উত্তরটি হ্যা ।

কাঁকচক্ষু দৃষ্টিতে , দৃঢ়তা আর ন্যায়ের বিজয় তবে, অসম এ যুদ্ধে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের চড়া মূল্য দিতে হল  হামাসকে। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়  হামাস , নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক , প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। এই যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ সেই জীবননাশের মূল্য দিতে হল চরমভাবে-গত দু‘বছরে ৬৭,০০০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত । শক্তিশালী শত্রুর সাথে টক্কর লাগানো  কি এত সোজা!  লোকবল আর সামরিক শক্তিতে তুলনামূলক ভাবে পিঁছিয়ে, তবে কিনা নীতি আর ঈমানের শক্তিতে বরাবরি বলীয়ান হামাসিয়ানরা । তাই , এ ক্রান্তিকালে ও ধাপে ধাপে অধিকাংশ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল তারা, সর্বশেষ গাজায় ৪৮ জন বন্দী ছিলেন , বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবান ২০ জন। আর্ন্তজাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে দু‘ধাপে জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় হামাস গত ১৩ই অক্টোবর । মৃতদের মাঝে চার জনের মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা ও জানিয়েছে তারা।অপরদিকে, প্রতিপক্ষ ইসরাইলের আচরণ রুঢ়তার সীমা আকাশ  ছুঁয়েছে  বহু আগেই-কারাগারে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা এবং নিপীড়ন করা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যৌন হয়রানির খবর ও পাওয়া গেছে । আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আল-রিমায়ি বলেন- এ দু‘টি বছরে তার ওজন কমেছে ৫০ কেজি ! হাড় সর্বস্ব শরীর জড়িয়ে কন্যার ব্যাকুল আর্তি, বাবা আমি ব্যাথা পাই ।

এখন আবার ট্রাম্পের নতুন চমক, ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপনাস্ত্র উপহার দিবেন এই পাগলাটে রাষ্ট্রপতি রাশান যুদ্ধ থামাতে ।  শুরু হওয়া আফগান -পাকিস্তান সংঘাতে ও তালেবান দের ভূমিকা নিয়ে এক নতুন চেহারার ব্যবসায়ীকে দেখা গেছে -জামাতা কুশনারের ব্যবসায়িক বুদ্ধির জুড়ি নেই রাজনৈতিক বুদ্ধিতে ও যে  শ্বশুরকে ভবিষ্যতে টেক্কা দিতে সমর্থ  হবেন  তা তার সাম্প্রতিক স্রোত বুঝে চলার ই পরিপক্ক রুপ ।

আজকের এই পার্থিব পৃথিবীতে  স্রোতস্বিনী টেমস নদী ব্যবহারের মাসকাবারি বিল পরিশোধের সময় ও যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি মগজে নিত্য গেঁথে থাকে -প্রতিটি পানিবিন্দু পরিশোধে পাওনা প্রাপ্য ! অর্থাৎ, জীবনের অপর নাম পানি ও বাতাস সেবনে ও মূল্য চুকাতে হয়, তা যদি হয় কেনসিংটন নামক অভিজাত এলাকার মনোরম ব্যালকনির মুক্ত হাওয়া । বিনামূল্যে    সেবা, সে তো অতীতের গাল গল্প । অথচ, নিঠুর ইসরাইলী বাহিনী    গাজায় ৩০০০ জলপাই গাছ  কেটে , অগণিত বন্য ও পোষা  প্রাণী মেরে আক্ষরিক অর্থেই প্রকৃতিকে বিপন্ন করে  তুলতে চাইছিল  । সেই প্রকৃতিই কিনা আপন মহিমায়  নতুন বোনা জলপাই গাছের পাশ দিয়ে ছুটন্ত শিশুদের  সাদরে বরণ করছে যাদের খাঁচা ভর্তি প্রিয় পোষা  পাখিটির  গুঞ্জন।   

ফিলিস্তিন বাসীদের প্রিয় ম্যান্ডেলা ‘ আল ফাত্তাহ ‘ এখন ও জায়ানবাদীদের জিম্মায় ,  ইসরাইলী সেনাবাহিনী তাকে যমের মত ভয় পায় -যার মুক্তির আলো দেখা এখন ও সংশয়ে ভরা । সন্দেহাতীতভাবেই, তিনিই প্যালেস্টাইনি জনগণের অবিস্বরণীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী আন্দোলনের দিকপাল ।

আজকের দিনের ফ্রি পত্রিকাগুলোর অন্যতম স্লোগান-মুক্ত খবর, মুক্ত চিন্তা । আর বিশ্বজুঁড়ে এই প্রবল বিজয় উদযাপনে মানবতাবাদীদের একটাই আশা মুক্ত হোক মানবতা , জয় হোক শুভ বুদ্ধির।



নুজহাত নূর সাদিয়া,
এলবিপিসি, লন্ডন ১৪ই অক্টোবর‘ ২৫ সাল ।

মতামত এর আরও খবর