img

বাংলাদেশের জন্মঃ শরণার্থীদের মহাসমুদ্র

প্রকাশিত :  ০৯:১৫, ২১ নভেম্বর ২০২১
সর্বশেষ আপডেট: ০৯:১৮, ২১ নভেম্বর ২০২১

বাংলাদেশের জন্মঃ শরণার্থীদের মহাসমুদ্র


ইমরান চৌধুরী  বি.ই.এম

পর্ব – ৫
আসছে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ  করে একান্ন বছরে পদার্পণ করবে,  ছুটে চলবে শত বর্ষ পূর্তির মাইল ফলক আহরণের উদ্দীপনায় । শত বর্ষ আসার আগেই হয়ত স্বাধীনতা আহরণকারী প্রজন্ম বিদায় নিবে উদযাপন না দেখেই । আজকের যে যুবক, তরুণ কিংবা মধ্যবয়সী তাদের অনেকেই হয়ত ভুলে যেতে বসেছে – বাংলাদেশের জন্মটি কিভাবে হয়েছিল এবং ১৯৭১ সালের সেই কালোদিন গুলো কেমন ছিল ! কি পরিমাণ ত্যাগ শিকার এর মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল – বাংলাদেশ । আমি  ১৯৭১ সালের একজন ১১ বয়সী রিফ্যুজি ( শরণার্থী )  কিশোর আজ ৫০ বছর পর ১৯৭১ সালের সেই ত্রিপার্শ্ব ( প্রিজমের) কাঁচ এর  ভিতর দিয়ে অবলোকন করে বর্ণনা করতে চেষ্টা করছি সেই বাংলাদেশের জন্ম । বাংলা পড়ুয়া  জনগোষ্ঠী  প্রবাসে দিন দিন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে – বাংলাদেশের জন্ম আর আমাদের বাংলা ভাষা একে অপরের সাথে যুক্ত সম্পূরক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে । তাই, আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াসঃ
১৯৭১ সাল  আর আজ ২০২১ মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে বাংলাদেশ আজ পঞ্চাশ বছরের পথ অতিক্রম করে ফেলেছে – ১৯৭১ এর যুবকরা আজ ষাট থেকে সত্তর দশকের বয়স্ক, ৭১ এর তরুণরা আজ পঞ্চাশ এর  বেশী বয়স্ক – নতুন প্রজন্ম আজ কি ভাবতে পারে আমরা যারা স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেছি তারা কি পরিমাণ অসহায়ত্ব এবং কি পরিমাণ মানসিক, শারীরিক মূল্য দিতে হয়েছিল ১৯৭১ এ । নতুন প্রজন্মের সকলকে তাই আহ্বান করছি তারা যেন জানে বা জানতে চেষ্টা করে কি ভীষণ ত্যাগ স্বীকার করে ছিল তাদের অগ্রজরা ।
শহর , বন্দর, নগরী, মফস্বল, থানা, ইউনিয়ন থেকে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ ঘর বাড়ি সহায় সম্পত্তি ফেলে প্রাণ বাঁচাবার জন্য আশ্রয় নিতে সুরু করলো গ্রামে গ্রামে – শহর লোকালয়, প্রধান সড়ক, জাতীয় হাইওয়ে, প্রধান রেল লাইন থেকে কিন্তু কোন কিছুই এবং কোন ভাবেই রোখা যাচ্ছিল না ঐ বর্বর, পিশাচ, র্যাপিস্ট পাকিস্তানি পাঠান এবং পাঞ্জাবী নরপশু আর্মির অগ্রসর – গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে সকল জায়গায় ঐ নরপশু গুলো একের পর এক আঘাত হানতে শুরু করল নিরীহ, অস্ত্রহীন, সাধারণ মানুষের উপর । বাঙ্গালী নিধনই  তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য – ওরা শুধু চেয়েছিল বাংলার জমিন – বাঙ্গালী মানুষ নয়, ওরা পৃথিবীর বুক থেকে বাঙ্গালী জাতি গোষ্ঠীকে চিরতরে উৎপাটন করতে – ওরা বাঙ্গালী জাতি নিপাত করে ঐ জমিনে বিহারী মসুলামান, কাশ্মীরি মুসলমান, করাচীর মোহাজির মুসলমান দের দিয়ে বাঙ্গালী বিহীন বাংলাকে আবার জনবহুল করবে – তাই বাঙ্গালী নিধন এবং বাঙ্গালী মহিলাদের কে রেপ করে মুছে দিতে চেয়েছিল বাঙ্গালী জাতিসত্তাকে চিরতরে । আগুনের লেলিহানে লেলিহানে জ্বলতে সুরু করল গ্রাম গুলো প্রতি রাতেই পাকিস্তানি পাঠান এবং পাঞ্জাবী আর্মি হামলা চালাতে আরম্ভ করল ঐ সব নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ী তে । শিশু, বাচ্চা, বৃদ্ধ, আবাল বনিতারা রাতের পর রাত কাটাতে শুরু করল ধানের খেতে, আখ এর জমিতে, পাহাড়ে, জংগলে, পাটক্ষেতে ভয়ে তটস্থ, জীবন হারানোর ভয়ে প্রকম্পিত একেকটা শিশু । সে যে কি এক ভীষণ দুরবস্থা তা প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই । সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী অবরুদ্ধ তার নিজের দেশে আগ্রাসী সন্ত্রাসী বর্বর পাকিস্তানি পাঠান এবং পাঞ্জাবী বাহিনীর হাতে । গ্রামের কৃষকরা না কাটতে পারছে তার জমির ফসল, না বুনতে পারছে নতুন ফসল, আমদানি রফতানি সব বন্ধ, সবজি ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিস শূন্য বাজার, হাট, দোকান, মুদিখানা, বাচ্চাদের জন্য নাই দুধ, শিশু খাদ্য, কাপড়ের দোকানে নাই শাড়ি, লুঙ্গি নাই পাজামার কাপড়। লক্ষ কোটি সরকারি, বেসরকারি চাকরিজীবীরা বেতন বিহীন কর্মক্ষেত্র থেকে পলাতক কপর্দকহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করতে শুরু করল আগন্তক হিসাবে অন্যত্র অন্যের বাড়িতে অযাচিত অতিথি হিসেবে । দ্বিধাগ্রস্থ, উপায়ান্তর না দেখে মানুষ পালাতে শুরু করল দেশ থেকে, ক্ষুদার জালায়, প্রাণের ভয়ে, নিরাপত্তার জন্য, শিশু, সন্তান সন্ততি, পরিবার,  মাতা পিতা, আত্মীয়স্বজনের জীবন রক্ষা করতে । মানুষের এক মহা সমুদ্রএ পরিণীত হল সারা বাংলা, পলায়নপর, ভীতসন্ত্রস্ত্র বাঙ্গালিদের ঢলে । দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এই প্রথম পৃথিবী দেখতে পেলো সবচে বড়  শরণার্থী ( রিফ্যুজি ) ক্রাইসিস ।

দিকবিহীন ভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনুপ্রবেশ করতে শুরু করল আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্ডিয়াতে – ইন্ডিয়ার ত্রিপুরা প্রদেশ যা কিনা – ঢাকা, ফরিদপুর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, সিলেট,  নোয়াখালী, চট্টগ্রাম সংলগ্ন, মেঘালয় যা নাকি সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, কিশোরগঞ্জ সংলগ্ন, আসাম যা সিলেট, সুনামগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, হাওর এলাকা, কিশোরগঞ্জ এবং নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চল এর নিকটে, কুষ্টিয়া, খুলনা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, নাতোর, পাবনা, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, রংপুর, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, বরিশাল, সাতক্ষিরা এই সব এলাকার মানুষ উপচে পরতে শুরু করল ভারতের পশ্চিমবংগে – রাত দিন সকাল সন্ধ্যায় প্রতিদিন । চলবে...

মতামত এর আরও খবর

img

বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের উত্থান বি এন পির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ!

প্রকাশিত :  ১৯:৫৬, ২১ অক্টোবর ২০২৫

কামরুল হাসান 

বাংলাদেশের রাজনীতি আবারও এক নতুন মোড়ে দাঁড়িয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বড় দুটি বিরোধী শক্তি—বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জামায়াতে ইসলামি—নতুনভাবে নিজেদের অবস্থান পুনর্নির্মাণ করছে। তবে সাম্প্রতিক ডাকসু, চকসু, রাকসু সহ দেশের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নিরুংকুশ বিজয় এবং মাঠের বাস্তবতায় এখন এক প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে: জামায়াতে ইসলামি কেন ধীরে ধীরে বিএনপির চেয়ে বেশি সক্রিয় ও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে রয়েছে জামায়াতের শক্তিশালী তৃণমূল সংগঠন, ধারাবাহিক প্রস্তুতি এবং কার্যকর প্রচার কৌশল। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শেখ হাসিনার পতনের পর বিএনপি যখন দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্ব সংকটে পড়েছিল, তখন জামায়াত দ্রুত মাঠে নামে। তারা ইতিমধ্যে প্রায় ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে এবং দেশজুড়ে ভোটার সংযোগ ও প্রচারণা চালাচ্ছে।

অন্যদিকে বিএনপি এখনো মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিধায় রয়েছে। দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা বিদেশে বা মামলার জটিলতায় নিষ্ক্রিয়, আর স্থানীয় পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে নেতৃত্বকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব ও ভাঙন। এতে করে অনেক কর্মী ও সমর্থক নতুন বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে জামায়াতে ইসলামি।

দলটি এখন কেবল ধর্মীয় পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নয়; তারা নিজেদের “নৈতিক রাজনীতি” ও “পরিষ্কার প্রশাসন” এর প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে। স্থানীয় পর্যায়ে শিক্ষা, দরিদ্র সহায়তা ও সামাজিক সেবামূলক কর্মসূচি চালিয়ে তারা জনগণের কাছে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। এর ফলে জামায়াতের প্রভাব শুধু গ্রামীণ এলাকায় নয়, শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটারদের মধ্যেও বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামায়াতের জনপ্রিয়তা বাড়ার অন্যতম কারণ তাদের আধুনিক যোগাযোগ কৌশল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা অত্যন্ত সক্রিয়, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করে প্রচারণা চালাচ্ছে। ফেসবুক, ইউটিউব ও টেলিগ্রামে তাদের সংগঠিত প্রচারণা বিএনপির তুলনায় অনেক বেশি দৃশ্যমান। বিএনপির প্রচারণা এখনও পুরনো ধাঁচের, যেখানে দলীয় নেতৃত্বকেন্দ্রিক বার্তা বেশি এবং তরুণ ভোটারদের প্রতি যোগাযোগ কম।

এছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় যখন আদর্শিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে—আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায়, বিএনপি দুর্বল ও বিভক্ত—তখন জামায়াত অনেক ভোটারের কাছে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠছে। বিশেষ করে ধর্মনিষ্ঠ ও রক্ষণশীল ভোটারদের একটি বড় অংশ এখন জামায়াতের দিকে ঝুঁকছে।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ সতর্ক করে বলছেন, জামায়াতের অতীত ইতিহাস এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এখনো অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য। তাই দলটির জন্য চূড়ান্ত জনপ্রিয়তা অর্জন সহজ হবে না। তবুও তারা ধৈর্য ধরে ধাপে ধাপে প্রভাব বিস্তারের কৌশল নিয়েছে—স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ, তৃণমূল সংগঠন শক্ত করা এবং তরুণদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা।

অন্যদিকে বিএনপির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের অভ্যন্তরীণ ঐক্য পুনর্গঠন এবং ভোটারদের আস্থা পুনরুদ্ধারের ওপর। যদি তারা দ্রুত সংগঠন পুনর্গঠন করতে না পারে, তাহলে আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামি দেশের অন্যতম বড় বিরোধী শক্তি হিসেবে নিজেদের জায়গা সুসংহত করতে পারে।

রাজনীতির এই নতুন বাস্তবতা অনেকের কাছে এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্য। একসময় বিএনপির ছায়ায় থাকা জামায়াতে ইসলামি এখন নিজস্ব শক্তিতে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে—আর সেটিই আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত পরিবর্তন হয়ে উঠতে পারে।


কামরুল হাসান 
লন্ডন

মতামত এর আরও খবর