
পিআর নির্বাচন পদ্ধতি: গণতন্ত্রের বিকাশ নাকি অস্থিরতার আশঙ্কা?

বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চ সবসময়ই উত্তপ্ত। নানা ঘটনা, বিরোধ, এবং ক্ষমতা দ্বন্দ্বে এই মঞ্চ কখনোই দীর্ঘসময় শান্ত থাকেনি। তবে সম্প্রতি যেটি রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে, সেটি হলো—নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার।
দেশে বহু বছর ধরে ‘একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা-ভিত্তিক’ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে, যেটি First-Past-The-Post (FPTP) নামে পরিচিত। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে—এই পদ্ধতি কি সময়োপযোগী? নাকি এটি বর্তমানে গণতন্ত্রের প্রকৃত চাহিদা পূরণে অক্ষম? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা Proportional Representation (PR) পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন।
কিন্তু এই পদ্ধতি কি সত্যিই বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও গভীর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে, না কি এটি রাজনৈতিক অস্থিরতার নতুন দরজা খুলে দেবে—এই প্রশ্ন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
পিআর পদ্ধতি: এটি আসলে কী?
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি এমন এক নির্বাচন ব্যবস্থা, যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট যে পরিমাণ ভোট পায়, সংসদেও সে অনুযায়ী আসন পায়। সহজভাবে বললে—‘যত ভোট, তত আসন।’
উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দল জাতীয় নির্বাচনে ২৫% ভোট পায়, তবে তারা মোট আসনের প্রায় ২৫% দখল করবে।
এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো—ভোটারদের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন যেন সংসদে ঘটে। যেখানে বর্তমান FPTP পদ্ধতিতে কোনো দল ৩৫% ভোট পেয়ে সংসদের ৮০% আসন পেয়ে যেতে পারে, সেখানে পিআর পদ্ধতি সেই বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ফলে ‘জনগণের শাসন’ নামক গণতন্ত্রের মূলনীতির বাস্তবায়নে পিআর পদ্ধতি অধিক ঘনিষ্ঠ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পিআর পদ্ধতির সম্ভাব্য সুবিধাসমূহ
১. ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা:
FPTP পদ্ধতিতে অনেক সময় এমনও হয়, কোনো দল ১০% ভোট পেয়েও সংসদে একটি আসনও পায় না। অথচ পিআর পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকে, কারণ আসন বণ্টন হয় ভোটের অনুপাতে। এতে ভোটারদের অংশগ্রহণে উৎসাহ বাড়ে, কারণ তারা জানে—তাদের ভোট আর বৃথা যাবে না।
২. ক্ষুদ্র দল ও সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব:
বর্তমান রাজনীতি বড় দুই দলকেন্দ্রিক হওয়ায় ক্ষুদ্র দল, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রায় অনুপস্থিত। পিআর পদ্ধতি কার্যকর হলে তাদের প্রতিনিধিত্ব সংসদে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়, যা সংসদকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
৩. জোট ও সংলাপের সংস্কৃতি:
একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে দলগুলোকে সরকার গঠনের জন্য জোট গঠন করতে হয়। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার নতুন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে—যা বাংলাদেশের মতো সংঘাতপ্রবণ রাজনীতির দেশে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
৪. নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ:
তালিকাভিত্তিক পদ্ধতিতে দলগুলো নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী হয়। এতে প্রতিনিধিত্বে বৈচিত্র্য আসে, যা সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।
৫. সমঝোতাভিত্তিক স্থিতিশীলতা:
যদিও জোট সরকারে ঝুঁকি থাকে, তবে দলগুলো যখন একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে বাধ্য হয়, তখন রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আরও সমন্বিত পদক্ষেপ সম্ভব হয়।
পিআর পদ্ধতির বাস্তব চ্যালেঞ্জ
১. জোট সরকারের অস্থিরতা:
পিআর পদ্ধতিতে জোট সরকার গঠন অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেখানে সংলাপ ও বিশ্বাসের বড় অভাব রয়েছে, সেখানে এই পদ্ধতি কার্যকরভাবে স্থিতিশীল সরকার গঠনে কতটা সক্ষম হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
২. ক্ষুদ্র দলের অতিরিক্ত প্রভাব:
কম ভোট পেয়েও কিছু দল জোট গঠনের সময় বড় দলের ওপর অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা রাজনীতিকে সুবিধাবাদী ও নীতিহীন করে তুলতে পারে।
৩. জটিল ভোট প্রক্রিয়া:
তালিকাভিত্তিক বা STV পদ্ধতিতে ভোটদান অপেক্ষাকৃত জটিল। গ্রামীণ বা কম শিক্ষিত ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, যা ভোটার উপস্থিতি হ্রাসের আশঙ্কা সৃষ্টি করে।
৪. নীতিহীন আপসের সংস্কৃতি:
ক্ষমতায় আসতে বড় দলগুলো ক্ষুদ্র দলের অযৌক্তিক দাবিও মানতে পারে। এর ফলে আদর্শহীন রাজনৈতিক আপস ও সুবিধাবাদ বাড়তে পারে।
৫. প্রশাসনিক ও আইনি চ্যালেঞ্জ:
এই পদ্ধতি চালু করতে হলে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা, আইনি কাঠামো, ও প্রযোজ্য প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক অবকাঠামো কতটা প্রস্তুত, সেটি এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতির সম্ভাবনা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা দুটি প্রধান দলের আধিপত্যে আবদ্ধ। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস ও সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতি কার্যকর করতে হলে প্রয়োজন—ন্যূনতম রাজনৈতিক সমঝোতা, আন্তরিকতা এবং জনগণের সমর্থন। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে, তবুও পিআর পদ্ধতি আমাদের রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।
এতে সংসদে তরুণ, নারী, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে পারে। তবে এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর:
ক. রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমঝোতা,
খ. প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও সক্ষমতা,
গ. ভোটারদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ।
পিআর পদ্ধতির ইতিহাস: সংক্ষিপ্ত রূপরেখা
১৮ শতক:
ফরাসি ও আমেরিকান বিপ্লবের সময় গণতন্ত্রের ধারণা জোরালো হয়। এ সময় থেকেই FPTP পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে।
১৯ শতক:
ব্রিটিশ দার্শনিক থমাস হেয়ার STV পদ্ধতির ধারণা দেন। ১৮৫০-এর দশকে এটি প্রথম আলোচনায় আসে।
২০ শতক:
সুইডেন, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ বহু দেশ পিআর পদ্ধতি গ্রহণ করে। বর্তমানে প্রায় ৮০টির বেশি দেশে পিআরের কোনো না কোনো রূপ চালু রয়েছে।
বিভিন্ন রূপ:
তালিকাভিত্তিক (List PR): যেমন সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকা,
STV: যেমন আয়ারল্যান্ড,
মিশ্র পদ্ধতি (MMP): যেমন জার্মানি, নিউজিল্যান্ড।
আমরা কি প্রস্তুত?
পিআর পদ্ধতি কোনো জাদুকাঠি নয়, যা রাতারাতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধান করে দেবে। আবার, বর্তমান FPTP ব্যবস্থাও নিখুঁত নয়।
সুতরাং, যদি আমরা পিআর পদ্ধতির বাস্তবায়ন চাই, তাহলে প্রয়োজন—রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা, এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
এই পদ্ধতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক করতে পারে। তবে এর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো অস্বীকার করা চলবে না।
পাঠকের প্রতি প্রশ্ন:
আপনার মতে, বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালু হলে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে, না কি অস্থিরতা বাড়বে?
মতামত জানাতে ভুলবেন না।