
দক্ষিণ কোরিয়া: অদম্য ঘুরে দাঁড়ানোর এক অনুপ্রেরণার ইতিহাস

সাইফুল খান
বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত-প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলোর তালিকায় আজ দক্ষিণ কোরিয়ার নাম গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। অথচ মাত্র কয়েক দশক আগেও দেশটি ছিল চরম দারিদ্র্যপীড়িত, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বৈশ্বিক সাহায্যনির্ভর একটি এলাকা। সীমিত আয়তন, প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝেও তারা যেভাবে নিজেদের ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ (Miracle on the Han River) এ রূপান্তর করেছে তা ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
আয়তন ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যঃ দক্ষিণ কোরিয়ার আয়তন মাত্র ১ লাখ ৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের চেয়েও ছোট (বাংলাদেশ: ১ লাখ ৪৭ হাজার)। এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডটি মূলত পর্বত ও পাহাড়ে ভরা। ফলে কৃষির জন্য উপযোগী জমিও সীমিত। জনসংখ্যা প্রায় ৫ কোটির মতো হলেও, তারা ঘনবসতিপূর্ণ শহর ও আধুনিক নগরায়ণের মাধ্যমে জায়গার সর্বোত্তম ব্যবহার করেছে।
প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতাঃ দক্ষিণ কোরিয়ায় খনিজ সম্পদ প্রায় নেই বললেই চলে। নেই পর্যাপ্ত তেল, গ্যাস কিংবা কয়লার মজুদ। কৃষি ও খনিজ সম্পদের অভাবের কারণে তারা শুরু থেকেই শিল্প, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দেয়। এটি ছিল তাদের \"নেতিবাচক বাস্তবতা থেকে ইতিবাচক কৌশল\" গড়ার দৃষ্টান্ত।
দারিদ্রতার ইতিহাসঃ ১৯৫০-৫৩ সালের কোরিয়ান যুদ্ধ দক্ষিণ কোরিয়ার অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়। লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়, অগণিত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। যুদ্ধশেষে দেশটি ছিল আন্তর্জাতিক সাহায্যনির্ভর ও দরিদ্র, যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৭০ ডলার।
১৯৬০ সালে তারা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি।বিশ্ব ব্যাংক পর্যন্ত তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে “বাঁচার সম্ভাবনাহীন” তালিকায় রেখেছিল!
ফিরে দেখা-ঐতিহ্য, যুদ্ধ ও অগ্রগতির এক ইতিহাসঃ কোরীয় উপদ্বীপের ইতিহাস একদিকে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষাগত ঐক্যের দলিল, অপরদিকে বিভাজন, রক্তপাত এবং রাজনৈতিক প্রতিকূলতার প্রতিফলন। কোরীয় জাতির প্রাচীন শিকড় খ্রিস্টপূর্ব যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। গোজোসন ছিল উপদ্বীপের প্রথম ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র, যার সূত্র ধরে একের পর এক রাজবংশ যেমন-গোগুরিও, বাকজে, শিলা এবং পরবর্তীতে গোরিও এবং চোসন গড়ে ওঠে। এই দীর্ঘ ধারায় কোরীয় জাতি গড়ে তোলে নিজস্ব ভাষা, হাংগুল লিপি, বৌদ্ধ ও কনফুসিয়ান মূল্যবোধে ভিত্তিক সমাজ এবং অভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিচয়।
এই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ২০শ শতকের গোড়ায় এক ভয়াবহ বাঁক নেয়। ১৯১০ সালে জাপান কোরিয়া দখল করে কলোনিতে পরিণত করে। প্রায় ৩৫ বছর ধরে কোরীয় জনগণকে শোষণ, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও জাতিগত অবমাননার শিকার হতে হয়। কোরিয়ান ভাষা, পোশাক, নাম পর্যন্ত নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ কোরিয়ান নারীকে জাপানি সেনাদের জন্য \'কমফোর্ট উইমেন\' হিসেবে জোরপূর্বক ব্যবহার করা হয়। জাপানিরা চীনের সাথেও একই কাজ করেছে। এই দুঃসময়ের মাঝে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের
পরাজয়ের মাধ্যমে কোরিয়ার স্বাধীনতা আসে। কিন্তু সেই মুক্তি এক নতুন সংকটের জন্ম দেয়। যুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের শীতল যুদ্ধের বাস্তবতায় কোরিয়াকে অস্থায়ীভাবে ৩৮তম অক্ষরেখা ধরে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। উত্তরে সোভিয়েত-সমর্থিত প্রশাসন এবং দক্ষিণে মার্কিন-সমর্থিত প্রশাসনের মাধ্যমে কোরিয়া অনিচ্ছাকৃতভাবে দুই মতাদর্শিক ব্লকে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
১৯৪৮ সালে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। উত্তর অংশে কিম ইল-সুং-এর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়া (DPRK) এবং দক্ষিণে সিনমান রির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দক্ষিণ কোরিয়া (ROK)। এই বিভক্তির পেছনে যে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব কাজ করছিল, তা কয়েক বছরের মধ্যেই রক্তাক্ত সংঘাতে রূপ নেয়।
১৯৫০ সালের ২৫ জুন, উত্তর কোরিয়া হঠাৎ দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়। দ্রুতই তারা সিউলসহ অধিকাংশ দক্ষিণ কোরিয়ান অঞ্চল দখল করে নেয়। এই আগ্রাসন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জাতিসংঘ বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়াকে সহায়তা দেয় এবং যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পাল্টা আক্রমণে দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর দিকে অগ্রসর হলে চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে যুদ্ধে প্রবেশ করে। ফলাফল হয় ভয়াবহ: তিন বছরের যুদ্ধে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, অগণিত পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, শহর-জনপদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।
১৯৫৩ সালে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে অস্ত্রবিরতি হলেও কোনো শান্তিচুক্তি হয়নি। দুই কোরিয়া আজও আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধরত। সীমান্তে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি অদ্ভুত বাস্তবতা Demilitarized Zone (DMZ), যা বিশ্বের সবচেয়ে সামরিকভাবে রক্ষিত অঞ্চলগুলোর একটি এবং একইসঙ্গে মানবিক বেদনার প্রতীক।
যেখানে এই যুদ্ধ একটি জাতিকে চিরতরে ভেঙে দিয়েছিল, দক্ষিণ কোরিয়া সেখান থেকে এক বিস্ময়কর ঘুরে দাঁড়ানোর নজির স্থাপন করে। ১৯৬০-৭০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং-হি-এর নেতৃত্বে পরিকল্পিত শিল্পায়ন, রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারিত রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি এবং কৌশলগতভাবে কিছু বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী (Samsung, Hyundai, LG) গড়ে তোলার মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া ‘Asian Miracle’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণা, প্রযুক্তি খাত এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পদক্ষেপ এতটাই সফল হয় যে, মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া এক উন্নয়নশীল কৃষিনির্ভর দেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হয়।
একই সময়ে উত্তর কোরিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হেঁটেছে। একনায়কতন্ত্র, সামরিকীকরণ, তথ্যনিয়ন্ত্রণ এবং পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশটি আজ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র। ১৯৯০-এর দশকে দুর্ভিক্ষে প্রায় ২০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, কিন্তু তথাপি দেশের শাসকগোষ্ঠী পরমাণু অস্ত্রে বিনিয়োগ এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছে। কিম ইল-সুং থেকে কিম জং-উন পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতা উত্তরাধিকার সূত্রে চলে এসেছে, যা রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে।
আজকের দিনে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্ববাজারে প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী এক শক্তি। K-pop, K-drama, গেমিং ইন্ডাস্ট্রি, হাই-টেক পণ্য ইত্যাদিতে তাদের সাফল্য এক নতুন কূটনৈতিক শক্তিতে রূপ নিয়েছে, যাকে বলা হয় ‘Soft Power’। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া রয়ে গেছে এক রহস্যঘেরা, নিয়ন্ত্রিত ও নিঃসঙ্গ ভূখণ্ড হিসেবে, যার সঙ্গে বাকি বিশ্বের সম্পর্ক শুধুই উদ্বেগ ও কূটনৈতিক উত্তেজনার।
এই ভিন্নমুখী ইতিহাস দেখায়, এক জাতি যদি আলাদা নীতির দ্বারা চালিত হয়।তাদের ভবিষ্যৎ কতটা বিপরীত হতে পারে। কোরিয়ার ইতিহাস আমাদের শেখায়, কেবল জাতিগত ঐক্য নয়, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, নেতৃত্ব, এবং বৈশ্বিক বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা একটি রাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যায়।
ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু: নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
১৯৬১ সালে জেনারেল পার্ক চুং-হি ক্ষমতায় এসে “রপ্তানিনির্ভর শিল্পায়ন” নীতি গ্রহণ করেন।
তিনটি স্তম্ভ ছিল তার পরিকল্পনার মূলভিত্তি:
মানবসম্পদে বিনিয়োগ: শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও উন্নত করে এক নতুন প্রজন্ম তৈরি করা হয় যারা প্রযুক্তি ও শিল্পে দক্ষ।
প্রযুক্তি গ্রহণ ও উদ্ভাবন: বিদেশি প্রযুক্তি আমদানি করে নিজেদের প্রয়োজনে মানিয়ে নেয়া এবং পরে সেগুলোকেই উন্নত করে এক্সপোর্টে ব্যবহার।
রাষ্ট্রীয় কৌশলগত সহায়তা: কিছু নির্দিষ্ট শিল্প খাতে রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও সাবসিডি দিয়ে বড় বড় চোবল (Chaebol) যেমন Samsung, Hyundai, LG গড়ে তোলা হয়।
“Miracle on the Han River” অর্থনৈতিক বিস্ফোরণঃ ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ মাত্র ৩০ বছরে দক্ষিণ কোরিয়া মাথাপিছু আয় ৭০ ডলার থেকে ১০,০০০ ডলারে উন্নীত করে।শিল্প উৎপাদন, প্রযুক্তি, গাড়ি, ইলেকট্রনিক্স, শিপ বিল্ডিং প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করে।
আজ দক্ষিণ কোরিয়ার GDP প্রায় ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু আয় প্রায় ৩৫,০০০ ডলার। Samsung, LG, Hyundai এসব শুধু কোম্পানি নয়, বরং তাদের জাতীয় সক্ষমতার প্রতীক।
শিক্ষার বিপ্লবঃ দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত যুবক রয়েছে এই দেশে। তাদের গবেষণায় জিডিপির ৪.৮% বরাদ্দ করা হয়, যা বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ।
সংস্কৃতি ও নরম শক্তির উত্থানঃ ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও “কোরিয়ান ওয়েভ” বা হালিউ (Hallyu) আজ বিশ্বজুড়ে বিস্তার লাভ করেছে—K-pop, K-drama, সিনেমা, বিউটি প্রোডাক্ট সব কিছুতেই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রভাব। এটি তাদের ব্র্যান্ডিং কৌশলের একটি বড় অংশ।
বর্তমান অবস্থান ও আন্তর্জাতিক ভূমিকাঃদক্ষিণ কোরিয়া এখন G20 ভুক্ত একটি শক্তিশালী দেশ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তাদের পাসপোর্ট বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী পাসপোর্টগুলোর একটি।
দক্ষিণ কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য করে
দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চ প্রযুক্তি ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের বিশ্বশক্তি।স্যামসাং, হুন্ডাই, LG-এর মতো কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকট্রনিক্স, গাড়ি, আধুনিক যন্ত্রাংশ রপ্তানি করে।তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য পণ্য তৈরি করে মানে প্রোডাক্ট কাস্টমাইজড, মার্কেট-অরিয়েন্টেড।
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (KORUS FTA): ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র-দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (FTA) হয়। এতে অনেক ট্যারিফ উঠে যায়, ফলে দুই দেশের মধ্যে পণ্য ও সেবা বিনিময় সহজ হয়।
টেকনোলজি ও গবেষণায় বিনিয়োগ: দক্ষিণ কোরিয়া R&D-তে জিডিপির ৪.৫% পর্যন্ত ব্যয় করে (বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে)। ফলে তারা cutting-edge পণ্য তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে সক্ষম হয়
দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে অটোমোবাইল (Hyundai, Kia), সেমিকন্ডাক্টর (Samsung, SK Hynix) টেলিভিশন, স্মার্টফোন,শিপিং ভেসেল ও মেশিনারি। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি করে
বিমান ও সামরিক সরঞ্জাম (Boeing)
কৃষিপণ্য (ভুট্টা, গম, সয়াবিন)
সফটওয়্যার ও সার্ভিস (Microsoft, Amazon)
প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG)
বাংলাদেশ কেন দক্ষিণ কোরিয়ার মত যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল বাণিজ্যিক অংশীদার হতে পারে না?
১৯৭০-এর দশকে দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ তিন দেশই উন্নয়নশীল, দারিদ্র্যপীড়িত এবং রাজনৈতিকভাবে অস্থির ছিল। কিন্তু আজ দক্ষিণ কোরিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, ভিয়েতনামের প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশ সেখানে মাত্র ১১ বিলিয়ন ডলারে সীমাবদ্ধ। কেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হলে আমাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতা, আন্তর্জাতিক অবস্থান, ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করতে হবে।
উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা ও বহুমুখীকরণের ঘাটতি কেবল গার্মেন্টসে নির্ভরতা:
বাংলাদেশে ৮৪% রপ্তানি আয় আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে (EPB, 2023)। এর বাইরে নতুন পণ্যে প্রবেশ নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া বা ভিয়েতনাম বিভিন্ন খাতে রফতানি বাড়িয়েছে যেমন- ইলেকট্রনিক্স, কৃষিপণ্য, সেমিকন্ডাক্টর, হ্যান্ডসেট, জাহাজ, গাড়ি ইত্যাদি।
ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যের ঘাটতি:গার্মেন্টস পণ্যের অধিকাংশই Low-end (কম দামের)। অথচ ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য যেমন প্রযুক্তিনির্ভর গ্যাজেট, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, বা সফটওয়্যার তৈরিতে আমরা পিছিয়ে।ফলে একদিকে রপ্তানি আয় কম, অন্যদিকে বাজারের পরিধিও সংকুচিত।
রিসার্চ, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি খাতে দুর্বলতা:
R&D-তে শূন্য বিনিয়োগ: বাংলাদেশের গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে জিডিপির মাত্র ০.০৩% ব্যয় হয় (UNESCO, 2022)। যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪.৮%, ইসরায়েলে ৫.৪%, এমনকি ভিয়েতনামেও ০.৫৫%।প্রযুক্তি ছাড়াই হাইটেক পণ্য তৈরি সম্ভব নয়।
আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়া বিচ্ছিন্ন। এখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা শিল্পে ব্যবহার হয় না। আর ইন্ডাস্ট্রি নিজেরাও গবেষণার দিকে আগ্রহী নয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি আর চাঁদাবাজির পথেই হাটে।
উদ্ভাবনে প্রতিবন্ধকতা: স্টার্টআপ পরিবেশ নেই বললেই চলে। তরুণ উদ্ভাবকদের জন্য সরকারি অনুদান, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, আইপি-রক্ষা ব্যবস্থা নেই।
রাষ্ট্রীয় কৌশল, নেতৃত্ব ও নীতিগত ঘাটতি:
টেকসই বাণিজ্য নীতির অভাব: দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সরকার এক্সপোর্টারদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে না। বাংলাদেশে নীতির স্থায়িত্ব নেই, বারবার পরিবর্তন হয়।
উদাহরণ: হঠাৎ কর রপ্তানি বাড়ানো, এলসি খোলা বন্ধ, নগদ সহায়তা বিলম্ব।
ব্যবসায়িক পরিবেশের দুর্বলতা:
“Ease of Doing Business” সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায়ও পিছিয়ে (WB, 2020: Bangladesh ranked 168 out of 190)।
আমলাতন্ত্র, ঘুষ, অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ব্যবসায়ীকে দিশেহারা করে ফেলে।
ব্র্যান্ডিং নেই, ব্র্যান্ড সচেতনতা নেই:
স্যামসাং বা LG-এর মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড তৈরি হয়নি। আমরা বিদেশে বাংলাদেশি পণ্যের পরিচয় দিই না, বরং অন্য দেশের ট্যাগ ব্যবহার করি।
আন্তর্জাতিক কৌশল ও চুক্তির অভাব
FTA বা সামরিক জোটভিত্তিক সুবিধা নেই:
দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মিত্র হওয়ায় বিশেষ বাণিজ্য সুবিধা পায়।
তারা KORUS FTA করে ৮০% পণ্যের উপর কর তুলে নেয়। বাংলাদেশ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো FTA করেনি, GSP সুবিধাও ২০১৩ সালে হারিয়েছে (Rana Plaza পরবর্তী ঘটনার জন্য)।
কূটনৈতিক দুর্বলতা: যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের জন্য রাজনৈতিক লবিং, অ্যাম্বাসি কার্যক্রম, ট্রেড রোড শো এসব কার্যক্রম দুর্বল।
ব্যবসায়ীদের সফর, মার্কেট স্টাডি, বিদেশি ক্রেতার সাথে সংযোগ এসব উদ্যোগ ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা নেই।
মানবসম্পদ ও দক্ষতা ঘাটতি মৌলিক দক্ষতার অভাব: বাংলাদেশের শ্রমিক কম মজুরিতে কাজ করলেও দক্ষতায় পিছিয়ে। অথচ ভিয়েতনাম দক্ষ শ্রমিকের জোগান দিয়ে টেক্সটাইল থেকে ইলেকট্রনিক অ্যাসেম্বলি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
ইংরেজি ও সফট স্কিল ঘাটতি:
আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা করতে ইংরেজি, যোগাযোগ দক্ষতা, মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি অপরিহার্য এগুলোতেও ঘাটতি রয়েছে।
অবকাঠামো ও লজিস্টিক দুর্বলতা পোর্ট ও কাস্টমস সমস্যা: চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে দেরি, দুর্নীতি, অনিয়ম এইসব কারণে শিপমেন্ট সময়মতো হয় না। দক্ষিণ কোরিয়া ও ভিয়েতনাম আধুনিক বন্দর, দ্রুত লজিস্টিক সাপ্লাই তৈরি করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সমস্যা: শিল্পকারখানায় বারবার লোডশেডিং, কম গতির ইন্টারনেট। এইগুলো নতুন প্রযুক্তি-ভিত্তিক পণ্য তৈরিতে বাধা।
সামাজিক মানসিকতা ও উদ্যোগের ঘাটতি
ঝুঁকি নিতে ভয়: উদ্যোক্তারা নতুন খাতে ঢুকতে চায় না। সরকারেরও সাহস নেই হাইটেক খাতে বড় প্রণোদনা দিতে।
অভ্যন্তরীণ বাজারেই সীমাবদ্ধ দৃষ্টি: আমাদের অনেক কোম্পানি শুধু দেশীয় বাজারে সফল হতে চায়, আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য প্রস্তুতি নেয় না।
প্রস্তাবনা: কী করলে বাংলাদেশও পারবে-
রপ্তানি বহুমুখীকরণ: হাইটেক, ওষুধ, অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট, সফটওয়্যার এসব খাতে পুঁজি ও নীতি দিতে হবে। বিশ্বমানের ব্র্যান্ড তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার ও বেসরকারি যৌথভাবে ব্র্যান্ডিং ফান্ড তৈরি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ বৃহৎ অর্থনীতির সাথে FTA ও GSP পুনরুদ্ধার: এর জন্য কূটনৈতিক চাপ ও প্রফেশনাল লবিয়িং দরকার। R&D-তে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো। একাডেমিয়া-ইন্ডাস্ট্রি সংযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
‘Ease of Doing Business’ সংস্কার করতে হবে। এক জানালায় ব্যবসা অনুমোদন, কর ছাড়, দ্রুত LC খোলা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে।
টেকনোলোজি ইনোভেশন হাব তৈরি করতে হবে। দক্ষিন কোরিয়া-ভিয়েতনামের মতো বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করে প্রযুক্তি নির্ভর পণ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে।
পরিশেষঃ দক্ষিণ কোরিয়া তাদের উৎপাদন দক্ষতা, প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং রাষ্ট্রীয় কৌশল দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী বাজারে জায়গা করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের উচিত দক্ষিন কোরিয়া, ভিয়েতনামের উদাহরনকে সামনে রেখে কাজ শুরু করা। এজন্য বানিজ্য বহুমুখীকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তি বিনিয়োগ এবং মার্কেট অরিয়েন্টেড প্রোডাক্ট তৈরি করা। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় অর্থনীতির সাথে কৌশলগত বাণিজ্য সম্পর্ক গড়া জরুরি।
সাইফুল খান: লেখক; ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।