
চাঁদা না দেওয়ার ‘অপরাধে’ খুন: পুরান ঢাকায় নিরীহ এক ব্যবসায়ীর রক্তে রঞ্জিত রাজপথ!

পুরান ঢাকার সরু গলি, দোকানপাটের স্বাভাবিক কর্মচাঞ্চল্য, রোজকার কোলাহলের মাঝে হঠাৎ ছন্দপতন। একটি গুলির শব্দ, তার পরপরই আরও কয়েকটি। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন এক ব্যবসায়ী। কেউ চিৎকার করেনি, কেউ দৌড়ে আসেনি পাশে। কারণ, পুরো এলাকা যেন আতঙ্কের শিকলে আবদ্ধ।
একজন সাধারণ মানুষ—রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই, কোনো দলীয় পরিচয় নেই; কেবল একজন খেটে খাওয়া দোকানদার। তার ‘অপরাধ’? তিনি চাঁদা দেননি। আর সেই ‘অপরাধের’ পরিণতি—মৃত্যু। প্রকাশ্য রাস্তায়, দিনের আলোয়, শত মানুষের চোখের সামনে।
এরপর যা ঘটেছে, তা শুধু মর্মান্তিক নয়—ভীতিকর, বিকৃত এবং মানবসভ্যতার বুকে এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। একটি নিথর দেহের ওপর দাঁড়িয়ে ঘৃণার নৃত্য পরিবেশন করেছে খুনি। এই দৃশ্য চোখে জল এনে দেয়, হৃদয়ে ঘৃণার আগুন জ্বালায়।
খুনের পর লাশের ওপর নৃত্য!
যিনি গুলি করেছেন, তিনি থেমে যাননি। মৃতদেহের ওপর পা রেখে উল্লাসে নেচেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভিডিও মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ দেখে আঁতকে উঠেছে, কেউ কেউ শেয়ার করেছে “লজ্জার বাংলাদেশ” বলে। কিন্তু তারপর? নিস্তব্ধতা। না আছে প্রতিবাদ, না আছে প্রতিরোধ।
খুনিকে ঘিরে রাজনীতি: “প্রভাবশালী যুবদল নেতার পদপ্রার্থী”
তদন্তে নেমে পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি একজন স্থানীয় যুবদল নেতার ঘনিষ্ঠ এবং নিজেও পদপ্রার্থী। তার বিরুদ্ধে অতীতেও সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র আইনে একাধিক মামলা রয়েছে। কিন্তু বিচার হয়নি, গ্রেপ্তারও হয়নি। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া তাকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে।
এবারও কি সেই পুনরাবৃত্তি ঘটবে? পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, “ঘটনাটি চিন্তার বাইরে।” কিন্তু প্রশ্ন হলো—চিন্তার বাইরে, নাকি দায়িত্ববোধের বাইরে?
রাজনীতির সন্ত্রাসে নিঃশেষ ন্যায়বিচার
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পেশিশক্তির ব্যবহার নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—যেখানে চাঁদা না দিলে প্রাণ যায়, সেখানে কী আদৌ কোনো আইনের শাসন বিদ্যমান? যেখানে খুনি প্রকাশ্যে গুলি করে, ভিডিও ভাইরাল হয়, তবুও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, সেখানে কি রাষ্ট্র কার্যকর?
পুরান ঢাকার এই ঘটনা কেবল একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়—এটা আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিবেকের ব্যর্থতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
“এই বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?”
এই কি সেই বাংলাদেশ, যার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? যেখানে জাতির পিতা স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন? আজকের বাংলাদেশে কি আমরা এতটাই নিঃস্ব, যেখানে রাজনৈতিক পরিচয়ই একমাত্র নিরাপত্তা, আর না বলার সাহস মানেই মৃত্যুদণ্ড?
৫ আগস্টের পর যারা নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন—‘আওয়ামী লীগমুক্ত’ কিংবা ‘হাসিনা-মুক্ত’ বাংলাদেশ গঠনের কথা বলেন—তাদের জন্য এই ঘটনা যেন এক আয়না। কারণ, কেবল সরকার বদলালেই রাষ্ট্র বদলায় না; মানসিকতা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি না বদলালে সবই অর্থহীন।
সমাজ যখন নীরব, অপরাধীরা তখন প্রভাবশালী হয়ে ওঠে
মানুষ খুন হলো, ভিডিও ছড়ালো, কিন্তু প্রতিবাদ হলো না। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মুখ খোলেননি। আশপাশের দোকানদাররা বলেন, “নাম নিলেই বিপদ, চাঁদা না দিলেই বিপদ!” এই কথায় লুকিয়ে আছে সমাজের গভীর অসহায়ত্ব।
নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের ফলে এমন ভয়াবহ বাস্তবতা গড়ে উঠেছে, যেখানে সৎ মানুষরা গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে, আর খুনিরা বুক ফুলিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অতীতেও ঘটেছে, এবার আরও ভয়ংকর রূপে
এই হত্যাকাণ্ড অনেক পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন, ত্বকী হত্যা, রাজনৈতিক সংঘর্ষে ছাত্রদের মৃত্যু—সবই আমাদের সামনে উদাহরণ হয়ে আছে। কিন্তু এবার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে নৃত্য—এটা এক নতুন স্তরের বর্বরতা, যেখানে মানবতা নয়, নিষ্ঠুরতাই মূলনীতি।
মানবাধিকার কমিশনের নীরবতা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিষ্ক্রিয়তা
এমন বর্বর ঘটনার পর মানবাধিকার কমিশন, সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের যেভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত ছিল, তেমনটা দেখা যায়নি। কেউ মুখ খুলছে না। কেউ কেউ এটিকে ‘দুই দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব’ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন—যেন হত্যাকাণ্ড একটি রাজনৈতিক ঘটনার সাধারণ উপাদান মাত্র।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ, বাস্তবে প্রতিরোধ নেই
ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব—সবখানেই ক্ষোভ। কেউ বলছেন, “আর কত?” কেউ লিখছেন, “বাংলাদেশে বাঁচা কঠিন হয়ে গেছে।” কিন্তু এই ক্ষোভ রাস্তায় নেমে প্রতিরোধে রূপ নিচ্ছে না। মানুষ হয়তো ভীত, হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গেছে—নাহ, এটিই যেন এখন ‘নতুন স্বাভাবিক’।
কী করতে হবে?
১. স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সুস্পষ্ট অবস্থান প্রয়োজন: দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে খুনিকে গ্রেপ্তার ও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
২. পুলিশ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে: রাজনৈতিক প্রভাবে তদন্তে হস্তক্ষেপ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে: প্রতিটি মহল্লা, বাজার ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রতিরোধ কমিটি গঠন জরুরি।
৪. চাঁদাবাজি রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে: যেন কেউ চাঁদা দাবি করার সাহস না পায়।
৫. রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন আনতে হবে: দলীয় পরিচয়ের আড়ালে অপরাধ করলে সংশ্লিষ্ট দলকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
আমরা সবাই দায়ী
এই ঘটনার জন্য দায়ী কেবল খুনি নয়—দায়ী রাষ্ট্র, দায়ী প্রশাসন, দায়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দায়ী আমাদের সকলের নীরবতা। একজন নিরীহ ব্যবসায়ী খুন হন, আর খুনি তার লাশের ওপর দাঁড়িয়ে নাচে—এই ঘটনা আমাদের মূল্যবোধের পতনের প্রতীক হয়ে রইল।
এই লজ্জা আমাদের, এই নীরবতা আমাদের। প্রশ্ন হলো—আমরা কি জেগে উঠব? না কি পরবর্তী হত্যাকাণ্ডের খবর লেখার জন্য শুধু আরেকটি নাম অপেক্ষা করছে?
(এই প্রতিবেদনটি সংগৃহীত সামাজিক মাধ্যম পোস্ট এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে। নিহত ব্যবসায়ীর পরিচয়, পরিবারের অনুরোধে গোপন রাখা হয়েছে। তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে পরবর্তী সংখ্যায় বিস্তারিত তুলে ধরা হবে।)