img

হাওরাঞ্চলের কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব গুরুদয়াল সরকার

প্রকাশিত :  ০৮:২৩, ০১ জুলাই ২০২৫

হাওরাঞ্চলের কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব গুরুদয়াল সরকার

সংগ্রাম দত্ত: বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের একটি অন্যতম জেলা কিশোরগঞ্জ। হাওর-বাঁওড়ঘেরা বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতির এক অনন্য জনপদ কিশোরগঞ্জ। ময়মনসিংহ গীতিকার চন্দ্রাবতী, মহুয়া-মলুয়ার দেশ এই কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নিদর্শন। শিল্প-সাহিত্য আর লোকসংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ও উর্বর জনপদ হিসেবে কিশোরগঞ্জ অসংখ্য কীর্তিমান মানুষের জন্ম হয়েছে, এদের মধ্যে একজন গুরুদয়াল সরকার।  তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি আলোকময় সমাজের। এ জন্য তিনি শিক্ষার মশাল জ্বালাতে উদারচিত্তে দান করেছিলেন তারই উপার্জিত ধন-সম্পদ। 

দেশের ভাটির গভীর হাওরাঞ্চল কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা থানার কাঠইর নামক এক অখ্যাত অজপাড়া গায়ে তাঁর জন্ম। তিনি ১২৬৯  বঙ্গাব্দের(১৮৬২ সাল) ১৬ ই আশ্বিন জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৩৬২ (১৯৫৫ সাল) বঙ্গাব্দের ৬ ই অগ্রহায়ণ ৯৩ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তাঁর পিতার নাম গোপীমোহন সরকার। গুরুদয়াল সরকারেরা ছিলেন তিন ভাই। কৃষ্ণদয়াল সরকার,গুরুদয়াল সরকার আর বিষ্ণুদয়াল সরকার। জন্মেছিলেন এক ধনাঢ্য কৈবর্ত পরিবারে। তাই কেউ কেউ তাঁকে কৈবর্ত রাজ হিসাবে ও উল্লেখ করেছেন। কৈবর্ত রাজ গুরুদয়াল সরকার পৈতৃক সুত্রে পেয়েছিলেন হাওর ভরা জমি আর তাঁদের ছিল পুরুষানুক্রমে বিল ইজারা নিয়ে মাছ ধরে মাছ বিক্রির ব্যবসা। সে আমলে ২০/৩০ গ্রামের মধ্যে ও কোন প্রাইমারি স্কুল ছিল না। তাই তাঁকে ঢোলে সামান্য  শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। কেউ বলে তিনি টোলে পড়েছিলেন আবার কেউ বলে একেবারেই নিরক্ষর ছিলেন। শিক্ষার সুযোগ না থাকায় গুরুদয়ালের বেশি দূর লেখাপড়া হয়নি। টোল পাস করা গুরুদয়াল সরকার রামায়ণ, পদ্মপুরাণ ইত্যাদি পড়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। উচ্চতর লেখাপড়ার অভাব ও অসুবিধা তিনি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

আঠারো শতকের শেষ বা উনিশ শতকের শুরুতে  হাওরাঞ্চলে এই ধীবর জনগোষ্ঠীর অনেক অর্থ জমি সম্পদ ছিল। কিন্ত স্কুলের অভাবে তাদের মধ্যে লেখাপড়ার আগ্রহ তেমন ছিল না।

খালিয়াজুরীর সর্ব দক্ষিণ সীমানায় ধনু নদীর পূর্ব পাড়ে ইটনা থানার ধনপুর ইউনিয়নের ধনপুর গ্রাম ও বাজার। সুনামগঞ্জের সুরম্য নদী থেকে একটি শাখা সুরমা নামেই দিরাই থানার রাজানগর,শ্যামারচর বাজার,খালিয়াজুরীর কৃষ্ণপুর হয়ে নদীটি পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ধনপুরে এসে ধনু নদীতে মিলিত হয়েছে। ধনপুর বাজারের পূর্ব পাশে গ্রামের একেবারে উত্তরে এই শাখা নদীর তীরে একটি বিশাল পাকা সাইড ওয়াল ও বাউন্ডারি করা একটি পুরানো বাড়ি। এটিই কাঠইর গুরুদয়াল সরকারের বাড়ি। কাঠইর একটি ছোট্ট গ্রাম। 

জানা যায় গুরুদয়াল সরকারের ছিল ৪০ টি হাল,৭০ টি নৌকা ছিল। গৃহস্থি থেকেই বছরে দুই হাজার মন ধান বিক্রি করতেন। জলমহালের মাছ ছাড়া ও ছিল ধনপুর বাজার ও রংপুরে শুটকির ব্যবসা। এখান থেকে রংপুরে শুঁটকি চালান দিতেন। বেতনভূক্ত কারিগর দিয়ে সারা বছর বাড়িতেই জাল তৈরি করতেন। অবশ্য সেই সময় ছিল জলমহাল ব্যবসায় ধীবর শ্রেণীভুক্ত কৈবর্ত জেলে ও মাঝি সম্প্রদায়ের অনুকূলে। জাল যার জল তাঁর। অন্ধ কুসংস্কার ও সামাজিক গোঁড়ামির কারণে উপরোক্ত তিন শ্রেণী ব্যতীত হিন্দু মুসলমান সবার মাছ ধরে বিক্রি করা বা জলমহালের ব্যবসা ছিল অঘোষিত ভাবে নিষিদ্ধ। এটি করলে তখনকার গৃহস্থ পরিবারের ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া সমস্যা হতো। তাই সামাজিক ও লোক নিন্দার ভয়ে মানুষ এ পেশায় জড়িত হতো না। পাকিস্তান আমলে ও হাওরাঞ্চলের বড় বড় জলমহাল ছিল এই কৈবর্ত সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে। মহানন্দ বাবু ও শ্যামবাবু নামে দুই ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন এসব জলমহালের ইজারাদার। গুরুদয়াল সরকারের বাড়িতে দুর্গাপূজা সহ অন্যান্য পূজা পার্বণ হতো। বাড়িতে পাকা দুর্গা মন্দির টি ১৯২৯ সালে নির্মিত। নিজে শিক্ষিত না হলে ও নিজ বাড়িতেই তাঁর  মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যশধাময়ী ফ্রি প্রাইমারি স্কুল। যা এখন সরকারী স্কুল। যে আমলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ সহ সিলেটের অনেক অঞ্চলে শিক্ষা  শুরুই হয়নি সেই আমলেই ইটনার জয়সিদ্ধির আনন্দ মোহন বসু ১৮৬৮ সালে ময়মনসিংহের প্রথম এমএ প্রথম বিলাতের ক্যামব্রিজ ডিগ্রি ও বাংলার প্রথম রেংলার। বসু পরিবার সারা বাংলায়তো বটেই গোটা ভারতবর্ষে এই পরিবারের পরিচিতি ছিল ।। কাঠইর থেকে দুই মাইল দূরের গ্রাম সহিলা থেকে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ডঃ নীহার রঞ্জন রায়,ইটনা থেকে ব্যারিস্টার ভূপেশ গুপ্ত সেই আমলেই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ভুপেশ গুপ্ত ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা। এই অঞ্চলের তিন জন বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে আছে তিনটি বিখ্যাত কলেজ। ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ,কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ ও হবিগঞ্জের বৃন্দাবন কলেজ। বৃন্দাবন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ইটনা থেকে ছয় মাইল দূরের হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের বিতঙ্গল গ্রামের বৃন্দাবন দাস। তিনি ও ছিলেন কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষ।

কিশোরগঞ্জ মহকুমা ( ১৯৮৪ সালে জেলা ঘোষণা করা হয় ) শহরে কলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুদয়াল বাবুর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জনশ্রুতি আছে। কিশোরগঞ্জের গন্যমান্য কিছু বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তি বর্গের উদ্যোগ ও মহকুমা প্রশাসকের প্রচেষ্টায় ১৯৪৩ সালে ,৬ অক্টোবর কিশোরগঞ্জ কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে অস্থায়ী ভাবে এর যাত্রা শুরু  হয়। তখনকার কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ও মঞ্জুরী পেতে গেলে দরকার কলেজের নিজস্ব জমি,অবকাঠামো ও নগদ অর্থ তহবিল। এতো বেশী পরিমাণ অর্থ কোন ভাবেই সংগ্রহ করা সম্ভবপর ছিল না। একটি জনশ্রুতি মতে বৈশাখে ফসল তোলার মৌসুমে কলেজের শিক্ষকেরা এসেছিলেন কলেজের জন্য চাঁদা হিসাবে ধান তুলতে। গুরুদয়াল বাবু তাদের নিকট থেকে যখন জানতে পারলেন কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে অনেক টাকার প্রয়োজন । তখন নাকি বলেছিলেন এক মন দুই মন করে ধান নিয়ে কি আর কলেজ করতে পারবেন। যদি কলেজ প্রতিষ্ঠার পুরো টাকাটাই আমি দিয়ে দেই। তখন শিক্ষক গন যেন হাতে আকাশ পেয়ে যান। একটি নির্দিষ্ট দিন তারিখে তাঁকে কিশোরগঞ্জ যেতে বলেন। সেই মোতাবেক তিনি কলেজ প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আর একটি জনশ্রুতি মতে ১৯৪৫ সালে কিশোরগঞ্জের এসিডও ছিলেন সাদত হোসেন চৌধুরী। তিনি ও কিশোরগঞ্জের গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। যাতে তিনি তাতে সারা দিয়ে এককালীন নগদ ৫০০০০ হাজার এক টাকা দান করেছিলেন। কথিত আছে কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁকে উৎসাহ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁর একমাত্র পুত্রবধু যোগমায়া। একমাত্র পুত্রের নাম ছিল মহানন্দ সরকার। যিনি কলিকাতায় মৃত্যু বরণ করেন। আরো জানা যায় যে এই ৪৮ হাজার এক টাকা ছিল ছান্দিনা বিলের প্রথম এক খেউয়ের ( জাল দিয়ে ঘেরাও করা এক বেড় বা এক টান) মাছ বিক্রির টাকা। এই টাকায় কলেজের জন্য সরকারী ভাবে দেওয়া ১৩ একর খাস জমির পাশে আরো জমি কিনে কলেজের নিজস্ব জায়গায় একতলা ভবন বিজ্ঞান ভবন তৈরি করে কলেজের তহবিল সহ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্ত পূরণ করে কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে। কলেজের নাম কিশোরগঞ্জ কলেজ পরিবর্তন করে নামকরণ হয় কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে। পাকিস্তান আমলে হিন্দু নামে স্হান ও প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের ঢেউয়ে গুরুদয়াল কলেজ নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্ত কিছূ শুভবুদ্ধির সন্পন্ন মানুষের বাধায় তা হতে পারেনি ।

তখনকার সময় কিশোরগঞ্জে জমিদার সহ আরো অনেক ধনী ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু কলেজের সূচনা লগ্নে গাংগাটিয়া জমিদারসহ কিছু বিদ্যুৎসাহী প্রমিনেন্ট ব্যক্তি বর্গের অর্থ সাহায্য ব্যতীত অন্যদের সাহায্য পাওয়া যায়নি। কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় একটি শর্ত ছিল তাঁর পরিবারের উত্তরাধিকারীদের সুপারিশে প্রতি বছর চারজন ছাত্র ছাত্রী বিনা বেতনে পড়তে পারবে। এই চুক্তি পত্রে স্বাক্ষর করার সময় কলেজ কর্তৃপক্ষ গুরুদয়াল সরকারকে জিজ্ঞাসা করেছিল কোন সম্প্রদায়ের চারজনকে আপনি বৃত্তি দিবেন। তাঁর সোজাসাপ্টা উত্তর ছিল \" সম্প্রদায় আবার কি? আমি কৈবর্ত মাছ বিক্রি করে খাই। আমার মাছ হিন্দু- মুসলিম,মালী- ঢুলি- চাড়াল,মেথর- ডোম সবাই কিনে খায়। বৃত্তি পেলে সব জাতের ছেলে মেয়েরা পাবে \" (তথ্য সুত্র কিশোরগঞ্জের ইতিহাস গ্রন্থ)। স্কুলে লেখাপড়া না করেও যে মানুষ অনেক মহৎ কাজ ও জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন গুরুদয়াল সরকার তার প্রমাণ। কলেজ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে তাঁকে আমন্ত্রণ জানালে কথিত আছে তিনি দুই নৌকা ভর্তি করে মিষ্টি,আম ও আনারস নিয়ে গিয়েছিলেন। তা দিয়েই অভ্যাগত অতিথি ও ছাত্র ছাত্রীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। একটা সময়ে কৈবর্ত জেলে মাঝি সহ ধীবর সম্প্রদায় ছিল সমাজে পিছে পড়া। এখন আর সেই অবস্থা নেই। শিক্ষা দীক্ষা সহ সব ক্ষেত্রে সমাধান তালে এগিয়ে যাচ্ছে এই সম্প্রদায়। এক সময় সুনামগঞ্জ মহাকুমার ধীরাইয়ের অক্ষয় কুমার দাস ছিলেন এই সম্প্রদায়ের শীর্ষ ব্যক্তি। যিনি  ছিলেন আসাম প্রাদেশিক মন্ত্রী ও পাকিস্তানে কয়েক  টার্ম মন্ত্রী। এছাড়া আছেন অদৈত্ব মল্ল বর্মণ যিনি তিতাস পাড়ের জেলেদের জীবন চিত্র নিয়ে লিখেছেন বিখ্যাত উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম। আরো আছে একুশে পদক প্রাপ্ত গুণীজন লেখক ও শিক্ষাবিদ হরি শংকর জলদাস।

কিশোরগঞ্জ খড়মপট্টি স-মিলের কাছে গুরুদয়াল বাবুর একটি নিজস্ব বাসা ছিল ( হলুদ রংয়ের)। যা পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রতিবেশী গ্রাম খালিয়াজুরীর আদমপুর গোয়ালবাড়ীর চেয়ারম্যান ক্ষেত্রমোহন ভৌমিক ও চেয়ারম্যান দ্বারিকনাথ ভৌমিকদের যৌথ পরিবারের কাছে বিক্রি করে দেন। গুরুদয়াল সরকারের বর্তমান উত্তরাধিকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে তাঁদের পূর্ব পুরুষ গুরুদয়াল সরকারের এই মহৎ কাজের সামাজিক সন্মান ও মর্যাদা তাঁরা অবশ্যই ভোগ করছে। যা তাঁদের প্রাপ্য।

মহাপ্রাণ এই ব্যক্তির উদার এই দানের স্বীকৃতিতে কলেজ প্রাঙ্গণে ২০০৯-এ স্থাপন করা হয় তাঁর আবক্ষ ভাষ্কর্য। 

অপ্রিয় সত্য হলেও দুঃখজনক এই যে ১৯৭৩ সালে সরকারীকরণের পর নাম পালটে যায় তাঁর বাড়ির প্রাঙ্গণে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করা \'যশোধাময়ী ফ্রি প্রাইমারি স্কুল’-এর। 

 সাধারণ মানুষের মনে করেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশে \'যমোধাময়ী\' নামটি রেখে সরকারিকরণ করা যেতো।

গুরুদয়াল সরকারের মতো মহৎ মানুষেরা কখনো হারিয়ে যান না। তাঁরা তাঁদের কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকেন কাল থেকে কালান্তরে প্রজন্মের পর প্রজন্মে। প্রাইমারি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে  শিক্ষার আলো ছড়িয়ে সমাজ পরিবর্তনে তাঁর ভূমিকা ও  অবদান সম্পর্কে তিনি আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

মতামত এর আরও খবর

img

উন্মুক্ত বিবেক, মুক্ত ফিলিস্তিন!!

প্রকাশিত :  ০৭:৩৬, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:৫২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

নুজহাত নূর সাদিয়া

আহা ! বুকের পাঁজর ভাঙা গগনবিদারী আর্তনাদ , নাহ-কোন নিরব জঠর যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাওয়া গর্ভবতী মায়ের নবজাতক জন্ম দেওয়ার অবিস্মরণীয় ক্ষণটি উদযাপনের আনন্দচ্ছোস নয়, এ যে সহস্র দিনের গ্লানি শেষে এক নিকষ কালো আঁধার পেরিয়ে মাতৃভূমির বুকে নির্ভীক পা রাখা । আবার সেই চিরপরিচিত সবুজ দুর্বা ঘাসে ছুঁটে বেড়ানো , বাড়ন্ত স্কোয়াশের পূর্ণ ঝুঁড়ি, মাংসের রসাল স্যুপ, হাতে বানানো গমের রুটি সহযোগে উদর পূর্তির সেই পারিবারিক সুখস্মৃতি , মায়ায় জড়ানো বছর পার করে দেওয়া সংগ্রামী পরিবারগুলো ফিরে কি পাবে তাদের সেই প্রাণোচ্ছল ফিলিস্তিন । বহু চর্চিত এই প্রশ্নটির উত্তর অজানা আশংকা আর অনিশ্চয়তার অদৃশ্য গেরোতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকলে ও বিপরীত শিবিরে ও বহু দিনের ঘরবন্দী প্রিয়মুখগুলো স্বজনদের বাহুডোরে ফেরার অপেক্ষায় । আগ্রাসী ইসরায়েলের ধূলো উড়ানো পথ ও যে আজ শান্তিকামী মানুষের স্বতস্ফূর্ত হাসিতে ভরপুর। 

আনুষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী, মোট হতাহতের সংখ্যা  ৬৬,০০০ হাজার ছাঁড়িয়ে গেছে, জীবন-ভর পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে ২,৫০,০০০ জন হতভাগ্যকে , বেঁচে যাওয়া অসংখ্য দুরন্ত শৈশব বাকিটা জীবন সম্ভবত এক দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবে, আকাশ ছোঁয়া দালান , সুসজ্জিত স্থাপনা আর পুরাকীর্তির শহর ফিলিস্তিন আজ এক মৃতপ্রায় ভুতুড়ে নগরী ।

এই যে  ক্ষতি , তা সন্দেহাতীতভাবেই অপূরণীয় ক্ষতি । নেতানিয়াহু নামের এক বিকট দানবের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর অপরিণামদর্শী যুদ্ধ কৌশলের খেস ারত দিতে হল ফোরাত নদীর তীরবর্তী নিরীহ প্রাণগুলোর। বিশ্ব মানচিত্র হতে ফিলিস্তিন নামক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটি ( গাজা প্রায়২১ লক্ষ লোকের আবাস) মাত্র মাসখানিক আগে ও নিরবে মুছে যাচ্ছিল ধনী রাষ্ট্রের তাবেদার মুসলিম বিশ্বের অলস শাসনকর্তাদের নির্লিপ্ত আচরণের কারণে । মুসলমান ভাই -ভাই, জুলুমবাজের নিস্তার নাই, বিপন্ন মানবতা বহুল চর্চিত প্রবাদগুলো নিতান্তই খাঁচায় বন্দি তোতাপাখির মুখস্থ বুলির মত আউড়ে চলছিল বিশ্বরাজনীতির মোড়লরা । তবে কি, আমজনতার পরম আরাধ্য পার্থিব জীবনের ও সমাপ্তি আছে, আর সেই সমাপ্তি বরাবরই ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়েছে স্রষ্টার একান্ত ইচ্ছেয়, অসহায়ের পূর্ণ সমর্থনে আর দিনশেষে সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ে ।

গৃহকোণের শান্তি গৃহকর্ত্রীর পরম প্রিয়, আর সেই শান্তির সুশীতল পরশ এ ভূগোলকের পরতে পরতে ছঁড়িয়ে দিতে যে উদ্যোগী মানুষগুলো অনন্য সাধারণ কাজগুলোকে বাস্তবতার আলো দেখান সে মানুষগুলোই কর্মকুশলতায় অর্জন করে নেন সর্ব্বোচ সম্মান -নোবেল । এ নোবেল প্রাপ্তি, কার ও দারিদ্র্য বিমোচনে, চলতি ‘২৫ সালে বিতর্কিত মারিয়া কোরিয়া মাচানো -যার রাষ্ট্রীয় নীতি বহু অসহায় মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে, প্রাক্তন  যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক সহ শান্তিতে নোবেল পাওয়া আলোচিত মানুষগুলো পুরষ্কারের কোঠা না মানদন্ড না তাদের কাজের বিষয় এ সূক্ষèাতিসূক্ষè বিষয়গুলো

রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, আর স্বেচ্ছাচারী কর্তা যখন নিজ খেয়াল-খুশি মত আইন -কানুন তৈরি করে অসহায়দের উপর তা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন তখন তা ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা জায়ানবাদীদের  আধিপত্য আর কতৃর্ত্ববাদের নির্মমতার করুণ পুনরাবৃত্তি বই আর কিছুই নয় । আর ও নির্মম কৌতুক, একদা জায়ানবধের রাজ্য বলে খ্যাত , হিটলারের জার্মান, মাঁখোর  ফ্রান্স , কূটনৈতিক ব্রিটেন সহ দু‘মুখো আরব বিশ্ব সকলে এ নির্মম রসিকতায় সামিল ! দুনিয়া যে ক্ষমতা আর অর্থের পূজারী - পড়ন্ত বেলার প্রাজ্ঞ প্রবীণদের গভীর হতাশার সুরে তা সুস্পষ্ট ।

রুপকথার গল্পের চেয়ে ও বাস্তব জীবনের গল্প অনেকসময় অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠে , হয়ে উঠে প্রকৃত রুপক নতুবা তার চেয়ে ও শক্তিশালী আখ্যান । বিশ টি বছর ধরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর নানা প্রতিকুলতায় অবরুদ্ধ হামাস , ঠিক জিতে গেল সাহস আর দেশের প্রতি ভালবাসাকে হৃদয়ে লালন করে।

আর, সেই ছোট্ট গেরিলা সদস্যের দলটি আজ কত বড়! মানচিত্র ছাঁড়িয়ে , সীমানা ছাঁড়িয়ে নব প্রজন্মের অকুতোভয় হামাসরা আজ দুয়ারে দাঁড়ানো দৃঢ় দ্বাররক্ষী । তারাই পারে ,তথাকথিত অজেয় পশ্চিমা শক্তিকে শান্তিচুক্তি নামক সে নাটকীয় ঘটনার অন্যতম যোগানদার করতে। মার্কিন সরকার প্রধান উপযাচক মাত্র-পরিস্থিতি বুঝেই হয়তবা বন্ধুর পথে হাঁটতে চাইছেন, ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বর্মটি যে ভিষণ শক্তপোক্ত ও একরোখা ।

তবে, মধ্যপ্রাচ্যে ছঁড়ি ঘুরানোর দীর্ঘদিনের শক্তলাঠিটি কে যে এবার বাঁকাতেই হয় ।  সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙবে না, হায় বেনিয়ামিন  কি অসম্মানের এক পরাজয় ! কি অপেক্ষা করছে দুর্নীতি মামলায় জর্জরিত বুড়ো নেকড়েটির কপালে -বিধ্বস্ত চেহারায় কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো দীর্ঘতর হচ্ছে বৈকি।

প্রতিরোধ, যুদ্ধের নামে আগ্রাসন আর বসতি স্থানান্তরের নামে বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক শরণার্থী , আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় হয়তবা এখন পর্যন্ত বিজয় উদযাপনে ব্যস্ত । তবে নারীর প্রতি সম্মান রক্ষার্থে ট্রাম্প তার প্রাক্তন রাজনৈতিক প্রতিদন্বী বারাকের উপর সম্ভবত সচেতনভাবেই তার রাষ্ট্র পরিচালনার মেয়াদকালে বিতর্কিত সন্ত্রাসী বনাম ইসলামিক সেনাবাহিনী মতানৈক্যের বিষয়টির উপর  ইঙ্গিত দিয়েছেন । আর , ব্রিটিশ সংসদে চিত্রিত ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে পুরনো বন্ধু ব্লেয়ারের পদাংক অনুসরিত কিনা, তাই আপনমনে যাচাই-বাছাই করে চলেছেন। 

পরিস্থিতির পরিবর্তিত মোড় , কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন লিখিত শান্তি  চুক্তির যে ভিন্ন ভিন্ন ২০টি শর্ত শোভা পাচ্ছে  তার সুচারু বাস্তবায়ন খোদ ট্রাম্পের পক্ষেই যথেষ্ট দুরুহ । পেন্ডুলামের কাঁটা চলমান, হঠকারী ছোটভাই একবার নয় বেশ ক‘বার বড় ভাইয়ের অবাধ্য হয়েছেন , আস্ত উড়োজাহাজ উপহার আর বন্ধুপ্রতীম কাতারের উপর অর্তকিত আক্রমণ । রক্তে যার খুনে নেশা সে পাগলা ঘোড়া কি আদৌ থামবে ? বিলুপ্ত হিজবুল্লা, হুতির হারিয়ে যাওয়া হামাসের নেতৃত্বের শক্তি ক্ষয় , সিরিয়ায় ভাঙ্গন, ইরানের সফল প্রতিরক্ষার ব্যুহ ভেদ- আপাত , দ্বিধাগ্রস্থ ইসরাইল প্রধান সফলতার মাপকাঠিতে আত্নতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন হয়তবা ।  তবে,গাজামুখি সারি সারি ত্রাণবাহী গাড়ির বহরের দী¦প্ত যাত্রা কি তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় নি, নিশ্চিতভাবেই উত্তরটি হ্যা ।

কাঁকচক্ষু দৃষ্টিতে , দৃঢ়তা আর ন্যায়ের বিজয় তবে, অসম এ যুদ্ধে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের চড়া মূল্য দিতে হল  হামাসকে। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়  হামাস , নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক , প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। এই যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ সেই জীবননাশের মূল্য দিতে হল চরমভাবে-গত দু‘বছরে ৬৭,০০০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত । শক্তিশালী শত্রুর সাথে টক্কর লাগানো  কি এত সোজা!  লোকবল আর সামরিক শক্তিতে তুলনামূলক ভাবে পিঁছিয়ে, তবে কিনা নীতি আর ঈমানের শক্তিতে বরাবরি বলীয়ান হামাসিয়ানরা । তাই , এ ক্রান্তিকালে ও ধাপে ধাপে অধিকাংশ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল তারা, সর্বশেষ গাজায় ৪৮ জন বন্দী ছিলেন , বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবান ২০ জন। আর্ন্তজাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে দু‘ধাপে জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় হামাস গত ১৩ই অক্টোবর । মৃতদের মাঝে চার জনের মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা ও জানিয়েছে তারা।অপরদিকে, প্রতিপক্ষ ইসরাইলের আচরণ রুঢ়তার সীমা আকাশ  ছুঁয়েছে  বহু আগেই-কারাগারে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা এবং নিপীড়ন করা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যৌন হয়রানির খবর ও পাওয়া গেছে । আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আল-রিমায়ি বলেন- এ দু‘টি বছরে তার ওজন কমেছে ৫০ কেজি ! হাড় সর্বস্ব শরীর জড়িয়ে কন্যার ব্যাকুল আর্তি, বাবা আমি ব্যাথা পাই ।

এখন আবার ট্রাম্পের নতুন চমক, ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপনাস্ত্র উপহার দিবেন এই পাগলাটে রাষ্ট্রপতি রাশান যুদ্ধ থামাতে ।  শুরু হওয়া আফগান -পাকিস্তান সংঘাতে ও তালেবান দের ভূমিকা নিয়ে এক নতুন চেহারার ব্যবসায়ীকে দেখা গেছে -জামাতা কুশনারের ব্যবসায়িক বুদ্ধির জুড়ি নেই রাজনৈতিক বুদ্ধিতে ও যে  শ্বশুরকে ভবিষ্যতে টেক্কা দিতে সমর্থ  হবেন  তা তার সাম্প্রতিক স্রোত বুঝে চলার ই পরিপক্ক রুপ ।

আজকের এই পার্থিব পৃথিবীতে  স্রোতস্বিনী টেমস নদী ব্যবহারের মাসকাবারি বিল পরিশোধের সময় ও যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি মগজে নিত্য গেঁথে থাকে -প্রতিটি পানিবিন্দু পরিশোধে পাওনা প্রাপ্য ! অর্থাৎ, জীবনের অপর নাম পানি ও বাতাস সেবনে ও মূল্য চুকাতে হয়, তা যদি হয় কেনসিংটন নামক অভিজাত এলাকার মনোরম ব্যালকনির মুক্ত হাওয়া । বিনামূল্যে    সেবা, সে তো অতীতের গাল গল্প । অথচ, নিঠুর ইসরাইলী বাহিনী    গাজায় ৩০০০ জলপাই গাছ  কেটে , অগণিত বন্য ও পোষা  প্রাণী মেরে আক্ষরিক অর্থেই প্রকৃতিকে বিপন্ন করে  তুলতে চাইছিল  । সেই প্রকৃতিই কিনা আপন মহিমায়  নতুন বোনা জলপাই গাছের পাশ দিয়ে ছুটন্ত শিশুদের  সাদরে বরণ করছে যাদের খাঁচা ভর্তি প্রিয় পোষা  পাখিটির  গুঞ্জন।   

ফিলিস্তিন বাসীদের প্রিয় ম্যান্ডেলা ‘ আল ফাত্তাহ ‘ এখন ও জায়ানবাদীদের জিম্মায় ,  ইসরাইলী সেনাবাহিনী তাকে যমের মত ভয় পায় -যার মুক্তির আলো দেখা এখন ও সংশয়ে ভরা । সন্দেহাতীতভাবেই, তিনিই প্যালেস্টাইনি জনগণের অবিস্বরণীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী আন্দোলনের দিকপাল ।

আজকের দিনের ফ্রি পত্রিকাগুলোর অন্যতম স্লোগান-মুক্ত খবর, মুক্ত চিন্তা । আর বিশ্বজুঁড়ে এই প্রবল বিজয় উদযাপনে মানবতাবাদীদের একটাই আশা মুক্ত হোক মানবতা , জয় হোক শুভ বুদ্ধির।



নুজহাত নূর সাদিয়া,
এলবিপিসি, লন্ডন ১৪ই অক্টোবর‘ ২৫ সাল ।

মতামত এর আরও খবর