
দেশটা যাচ্ছে রসাতলে, আর আমরা ঠাঁই নিচ্ছি বাসার তলে! –হেঁটে চলা এক হতাশ নাগরিকের আর্তি
“দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে”—এই বাক্যটি এখন এতটাই পরিচিত এক প্রচারণায় পরিণত হয়েছে যে ঘুমের মধ্যেও শুনতে পাই। এতবার, এতভাবে বলা হয়েছে যে এখন মনে হয়—এ যেন সরকারের মুখে বাজতে থাকা একটি পুরোনো ক্যাসেটমাত্র। অথচ বাস্তব চিত্র কী? চলার মতো একটি সাইকেলও যেন এখন নাগালের বাইরে! যার গাড়ি আছে, সে ছুটছে হরিণের গতিতে; আর যার কিছুই নেই, সে বসে থাকে রাস্তার পাশের ফাটলে। এই বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে বলা যায়—দেশ কোনো মহাসড়কে নয়, বরং ধাবিত হচ্ছে রসাতলের দিকেই।
আমরা সাধারণ মানুষ। দিন গুনে, কষ্ট গুনে বেঁচে থাকি। আমাদের নেই ঝকঝকে গাড়ি, নেই সুগন্ধময় নীতিমালা। ঘাম ঝরাই, মাথা খাটাই, আর প্রতিদিন বাস্তবতার কাছে হেরে যাই। আমাদের স্বপ্ন ভাঙে, ব্যবসা ধসে পড়ে, তবুও থেমে থাকি না। কারণ কষ্ট আমাদের জীবনের রুটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। আর দেশের যাঁরা ‘বিলিয়নিয়ার’, তাঁদের জীবন আবর্তিত হয় গলফ কোর্স, কফিশপ আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুম ঘিরে। আমাদের হাঁচি-কাশিও তাঁদের কাছে যেন একধরনের শব্দদূষণ।
আর প্রধান উপদেষ্টার কথা কী বলব? তাঁর দিনরাত কাটে উন্নয়নের অঙ্ক কষে। কোন প্রকল্পে কত কোটি টাকা যাবে, কোন বিদেশিকে কোন রঙের গালিচায় অভ্যর্থনা জানানো হবে—এসব নিয়েই তাঁর ব্যস্ততা। অথচ দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কীভাবে বাঁচছে, আদৌ বাঁচছে কি না—সেই খোঁজ তাঁর এজেন্ডায় নেই। তাঁর কাছে উন্নয়ন মানে শুধু টাকা-পয়সার হিসাব।
আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা এখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি। দোকানের ভাড়া বাকি, কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না, পণ্য স্টকে জমে আছে—বিক্রি নেই। এমনকি পিঁপড়েও যদি দোকানে ঢুকে পড়ে, মনে হয়—চিনিটা অন্তত কেউ খেয়ে গেল! এটাই বা কম কী?
ব্যাংকে গেলেও আশার আলো নিভে যায়। ঋণের আবেদন করলেই বলা হয়—“ফাইন্যান্সিয়াল রিস্ট্রাকচারিং চলছে, স্যার।” অর্থাৎ—এখন কিছুই পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নিজেই বলছেন—দশটিরও বেশি ব্যাংক দেউলিয়ার পথে। তাহলে প্রশ্ন উঠে—আমরা যাব কোথায়? কোথায় সেই আশ্বাস, সেই নিরাপদ সঞ্চয়ের ভরসা?
এই দেশের আরেক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো—প্রত্যেকে যেন একেকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী! চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কিংবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দেশ ও উন্নয়ন নিয়ে বড় বড় তত্ত্ব দেন। কিন্তু বাস্তবায়নের সময় পাশে থাকেন না কেউ। উন্নয়নের ট্রেন কখনোই প্ল্যাটফর্মে আসে না—আমরা শুধু দাঁড়িয়ে থাকি আর চুল পাকতে দেখি। এমনকি মনে হয়, মেট্রোরেল ফরিদপুরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমরা কবরে চলে যাব।
আর পুঁজিবাজার? সেখানে এখন যা চলছে, তা দিয়ে একটি ‘হরর-ট্র্যাজেডি’ সিনেমা বানানো সম্ভব! সূচক পড়ছে, আর বিনিয়োগকারীরা একে একে ফাঁদে পড়ছেন। এই বাজারের ভিত্তি কী? উত্তর আসে—“আস্থা।” আমরা বলি—“আস্থার স্টকটা কোথায়?”
এই বিপর্যয়ের অন্যতম রচয়িতা বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তাঁর একটি মাউস ক্লিকেই সূচক যেন তলানিতে নেমে যায়! পুঁজিবাজারের পতন এমনভাবে হচ্ছে, যেন আকাশে না-ওড়া ঘুড়িকেও কেউ গুলি করে নামিয়ে দিচ্ছে! অফিসের দরজায় নাকি লেখা থাকে—“Investor beware: Survival not guaranteed.”
অন্যদিকে অর্থ উপদেষ্টা সালেউদ্দিন আহমেদের ভাবনা এমন—উন্নয়নের প্রসঙ্গ উঠলেই বলেন, “দেখা যাবে, ভাবা যাবে; না হলেও সমস্যা নেই।” তাঁর এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উন্নয়ন নয়, বরং হতাশার এক করুণ চিত্রপটই আঁকা যায়।
আমরা যাঁদের জন্য দিনরাত খেটে যাচ্ছি, তাঁরা আমাদের কণ্ঠ শোনেন না। বড়লোকেরা কফির কাপ হাতে ভাবেন—“গরিব মানেই অলস।” তাঁরা জানেন না, আমরা প্রতিদিন সকালে দোকানের ঝাঁপ তুলি, বিক্রি না হলে রাতে স্ত্রীর চোখের জবাব দিই, সন্তানের স্কুল ফি বাকি রাখি—তবুও মন থেকে চেষ্টা থামাই না।
উন্নয়ন মানে শুধু বড় বড় প্রকল্প নয়। উন্নয়ন মানে হচ্ছে—একজন দোকানদার যেন দিনের শেষে হাঁফ ছেড়ে ঘুমাতে পারেন; একজন মা-বাবা যেন সন্তানের স্কুলের বেতন দিতে পারেন; একজন কর্মচারী যেন মাসের শেষে বেতন হাতে পান। এটাই উন্নয়নের মৌলিক রূপ।
আশার কথা হলো, এখনো কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা হার মানেননি। ঝড় এলেও তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন, কান্না গিলে হাসেন। তাঁরা দেশ ছাড়েন না, কারণ বিশ্বাস করেন—এই দেশ আমাদের, সাধারণ মানুষের। এই দেশ সরকারের নয়, উপদেষ্টাদের নয়, ধনীদেরও নয়—এই দেশটা আমাদের, যাঁরা কোনো ব্যালান্সশিটে নেই, কিন্তু কাঁধে করে দেশটাকে টেনে নিয়ে চলেছেন।
একদিন যদি এই দেশ ঘুরে দাঁড়ায়, তাহলে ইতিহাসে লেখা থাকবে—“এই দেশকে এগিয়ে নিয়েছিলেন সেই মানুষগুলো, যাঁদের গায়ে ঘাম ছিল, কিন্তু নাম ছিল না খবরে।”
আর যদি কিছুই না হয়, যদি সত্যিই দেশ রসাতলে যায়—তবুও অন্তত বলতে পারব, আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। যেমন ফুটপাতে বসে থাকা এক শিশুটি বলে—“আমরা তো খাটছি ভাই। যারা উপরে আছেন, তাঁরা যদি একটু নিচে তাকান, তাহলে হয়তো আমরাও বাঁচার একটা রাস্তা পাব।” আর যদি তাঁরা না তাকান, তাহলে আমাদেরই গড়তে হবে সেই পথ—হোক বাঁশের সাঁকো, হোক কাঁধে তুলে নেওয়া—আমরা চলতেই থাকব।