চকচকে ছবির আড়ালে নিঃসঙ্গ পিতা-মাতা— সমাজের আয়নায় লুকানো এক নির্মম বাস্তবতা
সংগ্রাম দত্ত
রাজনীতি কেবল ক্ষমতার খেলা নয়—এটি সমাজগঠনের অন্যতম চালিকাশক্তি।
কিন্তু রাজনীতির মঞ্চে যারা একসময় আলো ছড়িয়েছেন, জীবনের শেষ প্রান্তে তাদের অনেকে হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে।
জনতার ভালোবাসা, দলের পদ, কিংবা পরিবারের স্নেহ—সবকিছু যেন একসময় ফুরিয়ে যায়।
এই প্রতিবেদনটি এমন কিছু বাস্তব ঘটনার প্রতিচ্ছবি, যেখানে দেখা যায়—যে মানুষগুলো ছিলেন জনমানুষের আশ্রয়, তাঁরাই একসময় নিজ ঘরে হয়ে পড়েন পর।
প্রথম অধ্যায়: দাপুটে নেতার শেষ জীবনের নিঃসঙ্গতা
পঞ্চাশ থেকে আশির দশক—রাজনীতির উত্তাল সময়ে এক সাহসী, আপসহীন জননেতা ছিলেন তিনি।
পাকিস্তান আমলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর উচ্চকণ্ঠ তাকে বানিয়েছিল জনমানুষের প্রিয় মুখ। কিন্তু জীবনের শেষ অধ্যায়ে সেই নেতাকেই লড়তে হয়েছে এক নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে—নিজ পরিবারের অবহেলার।
বার্ধক্যে শারীরিক দুর্বলতা ও আর্থিক নির্ভরশীলতা তাঁকে করে তোলে অসহায়। সেই সুযোগে পরিবারের কিছু সদস্য তাঁকে ব্যবহার করে নিয়েছে নিজের স্বার্থে।
একদিন অর্থ না দেওয়ায় নিজের সন্তানের হাতেই লাঞ্ছিত হন তিনি। এমনকি একটি সাধারণ সাবান নিয়ে সংঘাতের জেরে মায়ের উপরও নেমে আসে নির্যাতন।
পরে সেই মায়ের মৃত্যুর পর সেই একই সন্তান জাঁকজমক করে করে “দুর্গা পূজার ঘট পূজা” আয়োজন করে।
কিন্তু এই ঘটনাই প্রশ্ন তোলে—পূজার প্রদীপ কি পারে অন্তরের অন্ধকার দূর করতে?
আজও সামাজিক মাধ্যমে পিতা-মাতার ছবি পোস্ট করা হয়, ক্যাপশনে লেখা থাকে ভালোবাসার বুলি। কিন্তু বাস্তবে সেই পিতা-মাতারা কাটান রাত অন্ধকারে—বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া, এক কোণে হারিকেনের আলোয় নিঃসঙ্গ জীবন।
একদিন প্রতিবেশীরা এসে দেখে—পিতা ঘুমিয়ে আছেন এমন এক ঘরে, যেখানে দু’মুখো সাপ কিলবিল করছে।
এ যেন কেবল এক পরিবারের গল্প নয়, পুরো সমাজেরই মুখোশ উন্মোচন।
দ্বিতীয় অধ্যায়: ভুলে যাওয়া জননেতা—অবহেলায় বিস্মৃত এক ইতিহাস
যিনি একসময় সরকারি দলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, জনতার নেতা হিসেবে যাঁর নাম উচ্চারিত হতো শ্রদ্ধার সঙ্গে—আজ তাঁর নাম খুঁজে পাওয়া যায় কেবল পুরনো সংবাদে।
দল তাঁকে ভুলে গেছে, দেয়নি প্রাপ্য সম্মান; পরিবারও ব্যস্ত হয়েছে নিজেদের জগতে।
তিনি পরলোকগমন করেছেন নিঃশব্দে, রেখে গেছেন এক বিশাল শূন্যতা—আর এক অদম্য কন্যাকে।
সেই একমাত্র কন্যা আজও পিতার স্মৃতিকে ধারণ করে আছেন হৃদয়ে। তিনি পুরনো পত্রিকা, গুগল সার্চ, ও অনলাইন আর্কাইভ ঘেঁটে খুঁজে দেখেন—তার পিতার কর্মজীবন নিয়ে কোথাও কোনো লেখা আছে কি না, কে বা কারা কখনও লিখেছে তাঁকে নিয়ে।
একদিন এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি জানান—“বাবা সম্পর্কে কিছু করার ইচ্ছে আমার সবসময়ই ছিল। কিন্তু আমি কন্যা সন্তান—অনেক কিছু করাই আমার পক্ষে সীমিত। তবু বাবার প্রতি আমার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা কখনো কমে না।”
সাংবাদিক বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর কণ্ঠের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক অদম্য মেয়ের মমতা ও বেদনার গল্প—যে সমাজ পিতাকে ভুলে গেছে, সেই সমাজে কন্যাই হয়ে উঠেছে তাঁর একমাত্র জীবন্ত স্মৃতি।
তৃতীয় অধ্যায়: যে নেতার ত্যাগে সমাজ পেল প্রতিষ্ঠা
অন্য এক জননেতা—যাঁর জীবনব্যাপী ত্যাগ ও কর্মের ফলেই তাঁর গোষ্ঠীর অসংখ্য মানুষ আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত, ধনী ও প্রভাবশালী।
তাঁর একনিষ্ঠ পরিশ্রমে তৈরি হয়েছিল শিক্ষা, ব্যবসা ও সামাজিক উন্নয়নের ভিত। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস—নিজ জীবনের শেষ প্রান্তে তাকেও সইতে হয়েছে একাকীত্ব ও বিস্মৃতি।
তিনি আজ নেই—তবু তাঁর কর্মফল বেঁচে আছে তাঁর গোষ্ঠীর প্রতিটি পরিবারের সাফল্যে।
তবে ইতিহাসে তাঁর নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেউ কোনো স্মৃতিচারণ করেনি, কেউ লেখেনি তাঁর জীবনের গল্প।
তাঁর মৃত্যুর পর এক প্রবাসী কন্যা—পিতার স্মৃতি ধরে রাখতে পাসপোর্টে লেখা জন্মতারিখ মিলিয়ে তাঁর জীবনের তথ্য এক সাংবাদিককে দেন।
উদ্দেশ্য একটাই—যেন অন্তত কোথাও পিতার অবদান লেখা থাকে, যেন ইতিহাসে তাঁর নাম মুছে না যায়।
সেই সাংবাদিকের কলমে পরে প্রকাশ পায় এক নিবন্ধ—যেখানে ফুটে ওঠে জননেতার সংগ্রাম, অবদান ও মানবিকতার অনন্য উদাহরণ।
এ যেন প্রমাণ করে—এক কন্যার ভালোবাসাই পারে বিস্মৃত ইতিহাসকে জীবিত করতে।
চতুর্থ অধ্যায়: ঘরের রুমে মানবিকতার পরীক্ষা
যে পিতা-মাতা সন্তানদের মানুষ করেছেন ত্যাগ ও কষ্টে, তাঁদের শেষ আশ্রয় আজ ঘরের এক কোণে।
পরিবারের বড় কন্যা একদিন বলেছিল, “তোরা বড় রুমটা পিতা-মাতাকে দিয়ে দে, যাতে তাঁরা অন্তত শেষ জীবনটা একটু আরামে কাটাতে পারেন।”
কিন্তু কথাটি থেকে যায় কথাতেই। বাস্তবে আজও পিতা-মাতা ছোট, স্যাঁতসেঁতে ঘরে, আর সন্তান ও বউ মোটামুটি ভালো রুমে উপভোগ করছে আয়েশী জীবন।
এ যেন মানবিকতার লজ্জাজনক প্রতিচ্ছবি—যেখানে শিক্ষায় আমরা আধুনিক, কিন্তু মননে এখনো মধ্যযুগীয়।
স্মার্ট সমাজ, আনস্মার্ট মন-মানসিকতা
আমরা আজ স্মার্ট যুগে বাস করি—প্রযুক্তিতে অগ্রগামী, যোগাযোগে দ্রুত।
কিন্তু হৃদয় কি ততটাই মানবিক হয়েছে?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভালোবাসার পোস্ট যত বাড়ছে, বাস্তবে তত কমছে স্নেহ, সহমর্মিতা ও কৃতজ্ঞতা।
প্রতিটি ঘরে আজ লুকিয়ে আছে এমন এক গল্প—যেখানে সন্তানরা ব্যস্ত নিজেদের সুখে, আর পিতা-মাতা হারিয়ে যাচ্ছেন নিঃশব্দে।
ভালোবাসা হোক মুখোশ নয়, বাস্তব জীবনের আচরণে
পিতা-মাতা কেবল জীবনের সূচনা নন—তাঁরা আমাদের ইতিহাসের মূল শিকড়।
তাঁদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের স্থান ফেসবুক নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের যত্নে, সম্মানে ও উপস্থিতিতে।
যেদিন আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়াব নিঃস্বার্থভাবে,
সেদিনই সমাজ সত্যিকার অর্থে আলোকিত হবে—
আর ইতিহাস তখন লিখবে:
“যে সমাজ পিতামাতাকে সম্মান দেয়, সেই সমাজই সত্যিকারের সভ্য।”



















