img

পিআর নির্বাচন পদ্ধতি: গণতন্ত্রের বিকাশ নাকি অস্থিরতার আশঙ্কা?

প্রকাশিত :  ১১:১০, ০৪ জুলাই ২০২৫

পিআর নির্বাচন পদ্ধতি: গণতন্ত্রের বিকাশ নাকি অস্থিরতার আশঙ্কা?

বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চ সবসময়ই উত্তপ্ত। নানা ঘটনা, বিরোধ, এবং ক্ষমতা দ্বন্দ্বে এই মঞ্চ কখনোই দীর্ঘসময় শান্ত থাকেনি। তবে সম্প্রতি যেটি রাজনৈতিক আলোচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছে, সেটি হলো—নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার।

দেশে বহু বছর ধরে ‘একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা-ভিত্তিক’ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে, যেটি First-Past-The-Post (FPTP) নামে পরিচিত। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে—এই পদ্ধতি কি সময়োপযোগী? নাকি এটি বর্তমানে গণতন্ত্রের প্রকৃত চাহিদা পূরণে অক্ষম? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা Proportional Representation (PR) পদ্ধতির পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন।

কিন্তু এই পদ্ধতি কি সত্যিই বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও গভীর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে, না কি এটি রাজনৈতিক অস্থিরতার নতুন দরজা খুলে দেবে—এই প্রশ্ন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

পিআর পদ্ধতি: এটি আসলে কী?

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি এমন এক নির্বাচন ব্যবস্থা, যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট যে পরিমাণ ভোট পায়, সংসদেও সে অনুযায়ী আসন পায়। সহজভাবে বললে—‘যত ভোট, তত আসন।’

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো দল জাতীয় নির্বাচনে ২৫% ভোট পায়, তবে তারা মোট আসনের প্রায় ২৫% দখল করবে।

এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো—ভোটারদের মতামতের যথাযথ প্রতিফলন যেন সংসদে ঘটে। যেখানে বর্তমান FPTP পদ্ধতিতে কোনো দল ৩৫% ভোট পেয়ে সংসদের ৮০% আসন পেয়ে যেতে পারে, সেখানে পিআর পদ্ধতি সেই বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ফলে ‘জনগণের শাসন’ নামক গণতন্ত্রের মূলনীতির বাস্তবায়নে পিআর পদ্ধতি অধিক ঘনিষ্ঠ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

পিআর পদ্ধতির সম্ভাব্য সুবিধাসমূহ

১. ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা:

FPTP পদ্ধতিতে অনেক সময় এমনও হয়, কোনো দল ১০% ভোট পেয়েও সংসদে একটি আসনও পায় না। অথচ পিআর পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকে, কারণ আসন বণ্টন হয় ভোটের অনুপাতে। এতে ভোটারদের অংশগ্রহণে উৎসাহ বাড়ে, কারণ তারা জানে—তাদের ভোট আর বৃথা যাবে না।

২. ক্ষুদ্র দল ও সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব:

বর্তমান রাজনীতি বড় দুই দলকেন্দ্রিক হওয়ায় ক্ষুদ্র দল, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর প্রায় অনুপস্থিত। পিআর পদ্ধতি কার্যকর হলে তাদের প্রতিনিধিত্ব সংসদে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়, যা সংসদকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।

৩. জোট ও সংলাপের সংস্কৃতি:

একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে দলগুলোকে সরকার গঠনের জন্য জোট গঠন করতে হয়। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতার নতুন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে—যা বাংলাদেশের মতো সংঘাতপ্রবণ রাজনীতির দেশে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

৪. নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ:

তালিকাভিত্তিক পদ্ধতিতে দলগুলো নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী হয়। এতে প্রতিনিধিত্বে বৈচিত্র্য আসে, যা সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক।

 ৫. সমঝোতাভিত্তিক স্থিতিশীলতা:

যদিও জোট সরকারে ঝুঁকি থাকে, তবে দলগুলো যখন একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করতে বাধ্য হয়, তখন রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আরও সমন্বিত পদক্ষেপ সম্ভব হয়।

পিআর পদ্ধতির বাস্তব চ্যালেঞ্জ

১. জোট সরকারের অস্থিরতা:

পিআর পদ্ধতিতে জোট সরকার গঠন অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেখানে সংলাপ ও বিশ্বাসের বড় অভাব রয়েছে, সেখানে এই পদ্ধতি কার্যকরভাবে স্থিতিশীল সরকার গঠনে কতটা সক্ষম হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।

২. ক্ষুদ্র দলের অতিরিক্ত প্রভাব:

কম ভোট পেয়েও কিছু দল জোট গঠনের সময় বড় দলের ওপর অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা রাজনীতিকে সুবিধাবাদী ও নীতিহীন করে তুলতে পারে।

৩. জটিল ভোট প্রক্রিয়া:

তালিকাভিত্তিক বা STV পদ্ধতিতে ভোটদান অপেক্ষাকৃত জটিল। গ্রামীণ বা কম শিক্ষিত ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে, যা ভোটার উপস্থিতি হ্রাসের আশঙ্কা সৃষ্টি করে।

৪. নীতিহীন আপসের সংস্কৃতি:

ক্ষমতায় আসতে বড় দলগুলো ক্ষুদ্র দলের অযৌক্তিক দাবিও মানতে পারে। এর ফলে আদর্শহীন রাজনৈতিক আপস ও সুবিধাবাদ বাড়তে পারে।

৫. প্রশাসনিক ও আইনি চ্যালেঞ্জ:

এই পদ্ধতি চালু করতে হলে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা, আইনি কাঠামো, ও প্রযোজ্য প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক অবকাঠামো কতটা প্রস্তুত, সেটি এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতির সম্ভাবনা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা দুটি প্রধান দলের আধিপত্যে আবদ্ধ। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস ও সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতি কার্যকর করতে হলে প্রয়োজন—ন্যূনতম রাজনৈতিক সমঝোতা, আন্তরিকতা এবং জনগণের সমর্থন। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে, তবুও পিআর পদ্ধতি আমাদের রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।

এতে সংসদে তরুণ, নারী, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে পারে। তবে এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন নির্ভর করবে তিনটি প্রধান বিষয়ের ওপর:

ক. রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমঝোতা,

খ. প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও সক্ষমতা,

গ. ভোটারদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ।

পিআর পদ্ধতির ইতিহাস: সংক্ষিপ্ত রূপরেখা

১৮ শতক:

ফরাসি ও আমেরিকান বিপ্লবের সময় গণতন্ত্রের ধারণা জোরালো হয়। এ সময় থেকেই FPTP পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে।

১৯ শতক:

ব্রিটিশ দার্শনিক থমাস হেয়ার STV পদ্ধতির ধারণা দেন। ১৮৫০-এর দশকে এটি প্রথম আলোচনায় আসে।

২০ শতক:

সুইডেন, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ বহু দেশ পিআর পদ্ধতি গ্রহণ করে। বর্তমানে প্রায় ৮০টির বেশি দেশে পিআরের কোনো না কোনো রূপ চালু রয়েছে।

বিভিন্ন রূপ:

তালিকাভিত্তিক (List PR): যেমন সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকা,

STV: যেমন আয়ারল্যান্ড,

মিশ্র পদ্ধতি (MMP): যেমন জার্মানি, নিউজিল্যান্ড।

আমরা কি প্রস্তুত?

পিআর পদ্ধতি কোনো জাদুকাঠি নয়, যা রাতারাতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সমাধান করে দেবে। আবার, বর্তমান FPTP ব্যবস্থাও নিখুঁত নয়।

সুতরাং, যদি আমরা পিআর পদ্ধতির বাস্তবায়ন চাই, তাহলে প্রয়োজন—রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা, এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

এই পদ্ধতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বমূলক করতে পারে। তবে এর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো অস্বীকার করা চলবে না।

পাঠকের প্রতি প্রশ্ন:

আপনার মতে, বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালু হলে গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে, না কি অস্থিরতা বাড়বে?

মতামত জানাতে ভুলবেন না।

মতামত এর আরও খবর

img

উন্মুক্ত বিবেক, মুক্ত ফিলিস্তিন!!

প্রকাশিত :  ০৭:৩৬, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:৫২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

নুজহাত নূর সাদিয়া

আহা ! বুকের পাঁজর ভাঙা গগনবিদারী আর্তনাদ , নাহ-কোন নিরব জঠর যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাওয়া গর্ভবতী মায়ের নবজাতক জন্ম দেওয়ার অবিস্মরণীয় ক্ষণটি উদযাপনের আনন্দচ্ছোস নয়, এ যে সহস্র দিনের গ্লানি শেষে এক নিকষ কালো আঁধার পেরিয়ে মাতৃভূমির বুকে নির্ভীক পা রাখা । আবার সেই চিরপরিচিত সবুজ দুর্বা ঘাসে ছুঁটে বেড়ানো , বাড়ন্ত স্কোয়াশের পূর্ণ ঝুঁড়ি, মাংসের রসাল স্যুপ, হাতে বানানো গমের রুটি সহযোগে উদর পূর্তির সেই পারিবারিক সুখস্মৃতি , মায়ায় জড়ানো বছর পার করে দেওয়া সংগ্রামী পরিবারগুলো ফিরে কি পাবে তাদের সেই প্রাণোচ্ছল ফিলিস্তিন । বহু চর্চিত এই প্রশ্নটির উত্তর অজানা আশংকা আর অনিশ্চয়তার অদৃশ্য গেরোতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকলে ও বিপরীত শিবিরে ও বহু দিনের ঘরবন্দী প্রিয়মুখগুলো স্বজনদের বাহুডোরে ফেরার অপেক্ষায় । আগ্রাসী ইসরায়েলের ধূলো উড়ানো পথ ও যে আজ শান্তিকামী মানুষের স্বতস্ফূর্ত হাসিতে ভরপুর। 

আনুষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী, মোট হতাহতের সংখ্যা  ৬৬,০০০ হাজার ছাঁড়িয়ে গেছে, জীবন-ভর পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে ২,৫০,০০০ জন হতভাগ্যকে , বেঁচে যাওয়া অসংখ্য দুরন্ত শৈশব বাকিটা জীবন সম্ভবত এক দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবে, আকাশ ছোঁয়া দালান , সুসজ্জিত স্থাপনা আর পুরাকীর্তির শহর ফিলিস্তিন আজ এক মৃতপ্রায় ভুতুড়ে নগরী ।

এই যে  ক্ষতি , তা সন্দেহাতীতভাবেই অপূরণীয় ক্ষতি । নেতানিয়াহু নামের এক বিকট দানবের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর অপরিণামদর্শী যুদ্ধ কৌশলের খেস ারত দিতে হল ফোরাত নদীর তীরবর্তী নিরীহ প্রাণগুলোর। বিশ্ব মানচিত্র হতে ফিলিস্তিন নামক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটি ( গাজা প্রায়২১ লক্ষ লোকের আবাস) মাত্র মাসখানিক আগে ও নিরবে মুছে যাচ্ছিল ধনী রাষ্ট্রের তাবেদার মুসলিম বিশ্বের অলস শাসনকর্তাদের নির্লিপ্ত আচরণের কারণে । মুসলমান ভাই -ভাই, জুলুমবাজের নিস্তার নাই, বিপন্ন মানবতা বহুল চর্চিত প্রবাদগুলো নিতান্তই খাঁচায় বন্দি তোতাপাখির মুখস্থ বুলির মত আউড়ে চলছিল বিশ্বরাজনীতির মোড়লরা । তবে কি, আমজনতার পরম আরাধ্য পার্থিব জীবনের ও সমাপ্তি আছে, আর সেই সমাপ্তি বরাবরই ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়েছে স্রষ্টার একান্ত ইচ্ছেয়, অসহায়ের পূর্ণ সমর্থনে আর দিনশেষে সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ে ।

গৃহকোণের শান্তি গৃহকর্ত্রীর পরম প্রিয়, আর সেই শান্তির সুশীতল পরশ এ ভূগোলকের পরতে পরতে ছঁড়িয়ে দিতে যে উদ্যোগী মানুষগুলো অনন্য সাধারণ কাজগুলোকে বাস্তবতার আলো দেখান সে মানুষগুলোই কর্মকুশলতায় অর্জন করে নেন সর্ব্বোচ সম্মান -নোবেল । এ নোবেল প্রাপ্তি, কার ও দারিদ্র্য বিমোচনে, চলতি ‘২৫ সালে বিতর্কিত মারিয়া কোরিয়া মাচানো -যার রাষ্ট্রীয় নীতি বহু অসহায় মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে, প্রাক্তন  যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক সহ শান্তিতে নোবেল পাওয়া আলোচিত মানুষগুলো পুরষ্কারের কোঠা না মানদন্ড না তাদের কাজের বিষয় এ সূক্ষèাতিসূক্ষè বিষয়গুলো

রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, আর স্বেচ্ছাচারী কর্তা যখন নিজ খেয়াল-খুশি মত আইন -কানুন তৈরি করে অসহায়দের উপর তা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন তখন তা ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা জায়ানবাদীদের  আধিপত্য আর কতৃর্ত্ববাদের নির্মমতার করুণ পুনরাবৃত্তি বই আর কিছুই নয় । আর ও নির্মম কৌতুক, একদা জায়ানবধের রাজ্য বলে খ্যাত , হিটলারের জার্মান, মাঁখোর  ফ্রান্স , কূটনৈতিক ব্রিটেন সহ দু‘মুখো আরব বিশ্ব সকলে এ নির্মম রসিকতায় সামিল ! দুনিয়া যে ক্ষমতা আর অর্থের পূজারী - পড়ন্ত বেলার প্রাজ্ঞ প্রবীণদের গভীর হতাশার সুরে তা সুস্পষ্ট ।

রুপকথার গল্পের চেয়ে ও বাস্তব জীবনের গল্প অনেকসময় অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠে , হয়ে উঠে প্রকৃত রুপক নতুবা তার চেয়ে ও শক্তিশালী আখ্যান । বিশ টি বছর ধরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর নানা প্রতিকুলতায় অবরুদ্ধ হামাস , ঠিক জিতে গেল সাহস আর দেশের প্রতি ভালবাসাকে হৃদয়ে লালন করে।

আর, সেই ছোট্ট গেরিলা সদস্যের দলটি আজ কত বড়! মানচিত্র ছাঁড়িয়ে , সীমানা ছাঁড়িয়ে নব প্রজন্মের অকুতোভয় হামাসরা আজ দুয়ারে দাঁড়ানো দৃঢ় দ্বাররক্ষী । তারাই পারে ,তথাকথিত অজেয় পশ্চিমা শক্তিকে শান্তিচুক্তি নামক সে নাটকীয় ঘটনার অন্যতম যোগানদার করতে। মার্কিন সরকার প্রধান উপযাচক মাত্র-পরিস্থিতি বুঝেই হয়তবা বন্ধুর পথে হাঁটতে চাইছেন, ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বর্মটি যে ভিষণ শক্তপোক্ত ও একরোখা ।

তবে, মধ্যপ্রাচ্যে ছঁড়ি ঘুরানোর দীর্ঘদিনের শক্তলাঠিটি কে যে এবার বাঁকাতেই হয় ।  সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙবে না, হায় বেনিয়ামিন  কি অসম্মানের এক পরাজয় ! কি অপেক্ষা করছে দুর্নীতি মামলায় জর্জরিত বুড়ো নেকড়েটির কপালে -বিধ্বস্ত চেহারায় কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো দীর্ঘতর হচ্ছে বৈকি।

প্রতিরোধ, যুদ্ধের নামে আগ্রাসন আর বসতি স্থানান্তরের নামে বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক শরণার্থী , আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় হয়তবা এখন পর্যন্ত বিজয় উদযাপনে ব্যস্ত । তবে নারীর প্রতি সম্মান রক্ষার্থে ট্রাম্প তার প্রাক্তন রাজনৈতিক প্রতিদন্বী বারাকের উপর সম্ভবত সচেতনভাবেই তার রাষ্ট্র পরিচালনার মেয়াদকালে বিতর্কিত সন্ত্রাসী বনাম ইসলামিক সেনাবাহিনী মতানৈক্যের বিষয়টির উপর  ইঙ্গিত দিয়েছেন । আর , ব্রিটিশ সংসদে চিত্রিত ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে পুরনো বন্ধু ব্লেয়ারের পদাংক অনুসরিত কিনা, তাই আপনমনে যাচাই-বাছাই করে চলেছেন। 

পরিস্থিতির পরিবর্তিত মোড় , কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন লিখিত শান্তি  চুক্তির যে ভিন্ন ভিন্ন ২০টি শর্ত শোভা পাচ্ছে  তার সুচারু বাস্তবায়ন খোদ ট্রাম্পের পক্ষেই যথেষ্ট দুরুহ । পেন্ডুলামের কাঁটা চলমান, হঠকারী ছোটভাই একবার নয় বেশ ক‘বার বড় ভাইয়ের অবাধ্য হয়েছেন , আস্ত উড়োজাহাজ উপহার আর বন্ধুপ্রতীম কাতারের উপর অর্তকিত আক্রমণ । রক্তে যার খুনে নেশা সে পাগলা ঘোড়া কি আদৌ থামবে ? বিলুপ্ত হিজবুল্লা, হুতির হারিয়ে যাওয়া হামাসের নেতৃত্বের শক্তি ক্ষয় , সিরিয়ায় ভাঙ্গন, ইরানের সফল প্রতিরক্ষার ব্যুহ ভেদ- আপাত , দ্বিধাগ্রস্থ ইসরাইল প্রধান সফলতার মাপকাঠিতে আত্নতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন হয়তবা ।  তবে,গাজামুখি সারি সারি ত্রাণবাহী গাড়ির বহরের দী¦প্ত যাত্রা কি তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় নি, নিশ্চিতভাবেই উত্তরটি হ্যা ।

কাঁকচক্ষু দৃষ্টিতে , দৃঢ়তা আর ন্যায়ের বিজয় তবে, অসম এ যুদ্ধে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের চড়া মূল্য দিতে হল  হামাসকে। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়  হামাস , নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক , প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। এই যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ সেই জীবননাশের মূল্য দিতে হল চরমভাবে-গত দু‘বছরে ৬৭,০০০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত । শক্তিশালী শত্রুর সাথে টক্কর লাগানো  কি এত সোজা!  লোকবল আর সামরিক শক্তিতে তুলনামূলক ভাবে পিঁছিয়ে, তবে কিনা নীতি আর ঈমানের শক্তিতে বরাবরি বলীয়ান হামাসিয়ানরা । তাই , এ ক্রান্তিকালে ও ধাপে ধাপে অধিকাংশ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল তারা, সর্বশেষ গাজায় ৪৮ জন বন্দী ছিলেন , বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবান ২০ জন। আর্ন্তজাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে দু‘ধাপে জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় হামাস গত ১৩ই অক্টোবর । মৃতদের মাঝে চার জনের মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা ও জানিয়েছে তারা।অপরদিকে, প্রতিপক্ষ ইসরাইলের আচরণ রুঢ়তার সীমা আকাশ  ছুঁয়েছে  বহু আগেই-কারাগারে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা এবং নিপীড়ন করা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যৌন হয়রানির খবর ও পাওয়া গেছে । আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আল-রিমায়ি বলেন- এ দু‘টি বছরে তার ওজন কমেছে ৫০ কেজি ! হাড় সর্বস্ব শরীর জড়িয়ে কন্যার ব্যাকুল আর্তি, বাবা আমি ব্যাথা পাই ।

এখন আবার ট্রাম্পের নতুন চমক, ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপনাস্ত্র উপহার দিবেন এই পাগলাটে রাষ্ট্রপতি রাশান যুদ্ধ থামাতে ।  শুরু হওয়া আফগান -পাকিস্তান সংঘাতে ও তালেবান দের ভূমিকা নিয়ে এক নতুন চেহারার ব্যবসায়ীকে দেখা গেছে -জামাতা কুশনারের ব্যবসায়িক বুদ্ধির জুড়ি নেই রাজনৈতিক বুদ্ধিতে ও যে  শ্বশুরকে ভবিষ্যতে টেক্কা দিতে সমর্থ  হবেন  তা তার সাম্প্রতিক স্রোত বুঝে চলার ই পরিপক্ক রুপ ।

আজকের এই পার্থিব পৃথিবীতে  স্রোতস্বিনী টেমস নদী ব্যবহারের মাসকাবারি বিল পরিশোধের সময় ও যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি মগজে নিত্য গেঁথে থাকে -প্রতিটি পানিবিন্দু পরিশোধে পাওনা প্রাপ্য ! অর্থাৎ, জীবনের অপর নাম পানি ও বাতাস সেবনে ও মূল্য চুকাতে হয়, তা যদি হয় কেনসিংটন নামক অভিজাত এলাকার মনোরম ব্যালকনির মুক্ত হাওয়া । বিনামূল্যে    সেবা, সে তো অতীতের গাল গল্প । অথচ, নিঠুর ইসরাইলী বাহিনী    গাজায় ৩০০০ জলপাই গাছ  কেটে , অগণিত বন্য ও পোষা  প্রাণী মেরে আক্ষরিক অর্থেই প্রকৃতিকে বিপন্ন করে  তুলতে চাইছিল  । সেই প্রকৃতিই কিনা আপন মহিমায়  নতুন বোনা জলপাই গাছের পাশ দিয়ে ছুটন্ত শিশুদের  সাদরে বরণ করছে যাদের খাঁচা ভর্তি প্রিয় পোষা  পাখিটির  গুঞ্জন।   

ফিলিস্তিন বাসীদের প্রিয় ম্যান্ডেলা ‘ আল ফাত্তাহ ‘ এখন ও জায়ানবাদীদের জিম্মায় ,  ইসরাইলী সেনাবাহিনী তাকে যমের মত ভয় পায় -যার মুক্তির আলো দেখা এখন ও সংশয়ে ভরা । সন্দেহাতীতভাবেই, তিনিই প্যালেস্টাইনি জনগণের অবিস্বরণীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী আন্দোলনের দিকপাল ।

আজকের দিনের ফ্রি পত্রিকাগুলোর অন্যতম স্লোগান-মুক্ত খবর, মুক্ত চিন্তা । আর বিশ্বজুঁড়ে এই প্রবল বিজয় উদযাপনে মানবতাবাদীদের একটাই আশা মুক্ত হোক মানবতা , জয় হোক শুভ বুদ্ধির।



নুজহাত নূর সাদিয়া,
এলবিপিসি, লন্ডন ১৪ই অক্টোবর‘ ২৫ সাল ।

মতামত এর আরও খবর