সিলেটের আজীবন ত্যাগী সংগ্রামী জননেতা বিপ্লবী মফিজ আলী
সংগ্রাম দত্ত: সিলেট বিভাগের রাজনীতি, শ্রমিক আন্দোলন ও প্রগতিশীল সমাজচেতনার ইতিহাসে বিপ্লবী মফিজ আলী এক অনন্য নাম। তিনি একাধারে ভাষা সংগ্রামী, শ্রমিক নেতা, কৃষক নেতা, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, লেখক ও সাংবাদিক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর নির্লোভ জীবনযাপন, ত্যাগ, সংগ্রাম ও আদর্শ তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে করে তুলেছিল “বিপ্লবী মফিজ আলী”।
শিক্ষাজীবন ও প্রারম্ভিক ধাপ:
১৯২৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীসূর্য ধোপাটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মফিজ আলী। তাঁর পিতা আজফর আলী এবং মাতা নূরজাহান বিবি। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম সন্তান। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের জনক।
ছাত্রাবস্থাতেই ব্রিটিশবিরোধী চেতনা জাগ্রত হয় তাঁর মধ্যে। বিশেষ করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তাঁকে রাজনৈতিকভাবে আরও সচেতন করে তোলে। প্রথম জীবনে কট্টর ইসলামপন্থী থাকলেও প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনার সংস্পর্শে এসে তাঁর মধ্যে আমূল পরিবর্তন ঘটে।
তিনি এম.সি কলেজের ছাত্রনেতা হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৬ সালে ছাত্রদের ন্যায্য দাবিতে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তব্য রাখার কারণে সিলেটের এম.সি কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহিষ্কার করে। এর ফলে স্নাতক শেষ (চতুর্থ) বর্ষে পড়া অবস্থাতেই তাঁর শিক্ষা জীবন সমাপ্ত হয়।
রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ:
ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে তিনি প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, পরে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন। ফেঞ্চুগঞ্জে ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সম্মেলনের মাধ্যমে সিলেট জেলা কমিটিতে যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে ছাত্রনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৫৭ সালে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এ যোগ দেন তিনি। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি ও ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ শুরু করেন।
১৯৬০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।
শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে অবদান:
শৈশব থেকেই কমলগঞ্জের শমসেরনগর চা শ্রমিকদের দুঃখ-কষ্ট, নির্যাতন-নিপীড়ন তাঁর চোখে পড়ে। শ্রমিকদের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে শ্রমিকদের মাঝে কাজ শুরু করেন।
১৯৬৪ সালের ৫ এপ্রিল তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান চা শ্রমিক সংঘ। এরপর চা শ্রমিকদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে শক্তিশালী আন্দোলন। তাঁর নামে মামলা হলে প্রায় ১০ হাজার চা শ্রমিক শমসেরনগর থেকে মৌলভীবাজার পর্যন্ত মিছিল করে মামলা প্রত্যাহারে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করে।
শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি ১৯৬৩ সালে শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখানে বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাসের স্মরণীয় বালিশিরা কৃষক আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও বৃহত্তর সিলেটে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫৪,১৯৬০, ১৯৬৪, ১৯৬৫, ১৯৬৭, ১৯৬৯ ও ১৯৭২ সালে রাজনীতির কারণে জীবনে তিনি মোট ৭ বার কারাবরণ করেন এবং প্রায় ৬ বছর জেল খাটেন।
বামপন্থী আন্দোলন ও সংগঠক জীবন:
১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভক্তির সময় মফিজ আলী ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদের বিরোধিতা করে কমরেড আবদুল হক ও মোহাম্মদ তোহার নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম.এল)-এ যোগ দেন।
একই সময়ে ন্যাপ বিভক্ত হলে সিলেটে ভাসানী ন্যাপের নেতৃত্ব দেন তিনি। কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা জমিদার বাড়ির নবাব আলী ছবদরখান রাজা সাহেব ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা।
স্বাধীনতার পরও তিনি শ্রমিক-কৃষকের পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যান। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোঃ ইলিয়াসের কাছে পরাজিত হন।
১৯৯৩ সালে তিনি যোগ দেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে (এনডিএফ)। পরবর্তীতে তিনি মৌলভীবাজার জেলা শাখার সংগঠক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও জেলা সভাপতি হিসেবে চা, রাবার, হোটেল, রিকশা ও দর্জি শ্রমিকদের সংগঠিত করেন।
শিক্ষকতা, লেখালেখি ও সাংবাদিকতা:
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি শিক্ষক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন এবং অসংখ্য রাজনৈতিক নিবন্ধ রচনা করেছেন।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ছিল— “পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের নমুনা”। পাকিস্তান আমলে ডন, ইত্তেফাক, সংবাদ, জনতা, আজাদ, গণশক্তি প্রভৃতি পত্রিকায় লিখেছেন নিয়মিত। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলোর মধ্যে রয়েছে— “রাষ্ট্রভাষা ও আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন”, “মেদিবসের ইতিহাস” এবং ছোটগল্প “একটি গামছা”।
নব্বইয়ের দশকে সাপ্তাহিক সেবা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
শেষ জীবন ও মৃত্যু:
২০০৮ সালের ৩০ আগস্ট কুলাউড়ার এক কৃষক সভা থেকে তিনি ফেরার পথে ধোপাটিলার নিজ গ্রামের বাড়ির সামনের সড়কে রহস্যজনকভাবে আহত ও পরে ষ্টোকে আক্রান্ত হন । অনেকের ধারণা, হেডলাইটবিহীন একটি বাসের ধাক্কায় তিনি আহত হয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ এক মাস ১০ দিন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১০ অক্টোবর ২০০৮ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
উপসংহার:
বিপ্লবী মফিজ আলী ছিলেন এক অকৃত্রিম শ্রমিক-কৃষক নেতা, যিনি সারাজীবন আপসকামী ও সংশোধনবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তাঁর সংগ্রামী জীবন আমাদের জন্য এক অনন্য অনুপ্রেরণা।
আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ, শ্রমিক-কৃষকের মুক্তির সংগ্রাম এবং অসমাপ্ত কাজই আমাদের পথের দিশারী। রাজনীতিতে তাঁর আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম, শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিপ্লব এবং ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের কাছে চির জাগ্রত হয়ে থাকবে।
সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে তুলে মফিজ আলীর অসমাপ্ত স্বপ্ন— জাতীয় গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই হবে তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি।


















