পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত: স্বাধীনতার অমর যোদ্ধা ও জননেতা
সংগ্রাম দত্ত
কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, “ ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সংগ্রামের নক্ষত্রেরা কারা ছিলেন?”, তবে পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্তের নাম প্রথম সারিতেই আসে। তিনি কেবল একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি একজন সমাজসেবী, শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের নেতা, গণমানুষের আশ্রয়স্থল, এবং এক অনন্য বীর যিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর জীবন ছিল সংগ্রাম, সেবা এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার অদম্য যাত্রা।
প্রারম্ভিক জীবন: বীজ বপন:
১৮৯৫ সালে ঢাকার বানারীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পূর্ণেন্দু কিশোর। তাঁর পিতা শ্যামকিশোর সেনগুপ্ত ছিলেন সিলেট জজ কোর্টের একজন সুপরিচিত আইনজীবী। ছোটবয়েসেই পূর্ণেন্দু বিপ্লবী নগেন দত্ত কর্তৃক সিলেটে গঠিত অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি পড়ার সময় তিনি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সংস্পর্শে এসে রাজনৈতিক চেতনার বীজ বপন করেন। এমএসসি পড়াকালীন অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি পরীক্ষাও বর্জন করেন—একজন সত্যিকারের স্বাধীনচেতা যুবকের পরিচয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনে পথপ্রদর্শক:
১৯২২ সালে ঢাকার অভয় আশ্রম শাখায় যোগ দিয়ে তিনি বিক্রমপুরের বানারী গ্রামে ধীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাশ্রমের সম্পাদক হন। স্বাধীনতার জন্য তাঁর অবদান শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তিনি জনকল্যাণমূলক কাজ, দাঙ্গা প্রতিরোধ, ত্রাণ কার্যক্রম এবং সামাজিক সেবায়ও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
পদ্মা নদীর ভাঙনের পর তিনি বিদ্যাশ্রমটি শ্রীহট্টে ( সিলেটে) স্থানান্তর করেন এবং নাম দেন রঙ্গীরকুল বিদ্যাশ্রম । যা\' তৎকালীন শ্রীহট্ট জেলার দক্ষিণ শ্রীহট্ট (বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলা) মহকুমার কুলাউড়া থানার অন্তর্গত। এই আশ্রম পরবর্তীতে গান্ধীবাদী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
১৯৩০ সালের লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণের জন্য জেলে যান, ১৯৩২ সালে শ্রীহট্ট মহিলা সংঘ গঠন করেন এবং কমলগঞ্জ থানার ভানুবিল পরগনার মনিপুরী কৃষকদের ঐতিহাসিক সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেন। তাঁর এই সংগ্রামের ফলে সরকার প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নে বাধ্য হয়।
সেবা ও ত্রাণে অগ্রদূত:
পূর্ণেন্দু কিশোরের হৃদয় ছিল দারিদ্র ও দুঃখ-দারিদ্র্যের প্রতি অমায়িক। ১৯২৯ সালের সিলেট ও কাছাড়ের বন্যায় তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন ত্রাণ কাজে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা থেকে আগত উদ্বাস্তুদের সেবা করেন। ১৯৩৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সুবর্ণ জয়ন্তীতে শিল্প প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেন।
রঙ্গীরকুল বিদ্যাশ্রম ছিল তাঁর কর্মের এক জীবন্ত প্রতীক—যেখানে শিক্ষা, শিল্প, সমাজসেবা ও রাজনৈতিক চেতনা একত্রে বিকশিত হয়।
রাজনীতিতে উজ্জ্বল চরিত্র:
১৯৪৬ সালের ব্রিটিশ ভারতের শেষ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসাম ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে থেকে চা শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে নিবেদিত হন।
১৯৪৮ সালের ৩ জুন কুলাউড়ায় তিনি শ্রীহট্ট চা শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন তিনি, সহসভাপতি এমএলএ জীবন সাওতাল, সাধারণ সম্পাদক নিকুঞ্জ বিহারী চৌধুরী এবং সাংগঠনিক সম্পাদক দর্গেশ দেব। এই সংগঠন পরবর্তীতে “বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন” নামে পরিচিত হয়। বর্তমানে তাঁরই হাতে গড়া সংগঠন কুলাউড়া হতে স্থানান্তরিত হয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন-এর প্রধান কার্যালয় \"লেবার হাউজ\" মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহরের মৌলভীবাজার রোডে অবস্থিত।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি মৌলভীবাজার থেকে পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে কুলাউড়া-রাজনগর আসনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। আইয়ুব খান শাসনকালে তাঁর চা-শ্রমিক ইউনিয়ন নিষিদ্ধ হলেও, তিনি থেমে থাকেননি।
মুক্তিযুদ্ধ ও শেষ সময়:
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা চালায়, তিনি ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান করেন। ১৭ নভেম্বর ১৯৭৮ সালে কুলাউড়া থানার রঙ্গীরকুল আশ্রমে তিনি মৃত্যুবরন করেন।
পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্তের জীবন ছিল সংগ্রাম ও ত্যাগের এক মহাকাব্য। রাজনৈতিক চেতনা, জনকল্যাণমূলক কাজ, শিক্ষার প্রসার, শ্রমিক ও কৃষকের অধিকার—সব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অদম্য।
উপসংহার:
পূর্ণেন্দু কিশোর সেনগুপ্ত ছিলেন এক অমর নেতা, যার নাম ইতিহাসে চিরদিন উজ্জ্বল থাকবে। তাঁর জীবন প্রমাণ করে, সত্যিকারের নেতৃত্ব শুধু ক্ষমতায় থাকার নয়—এটি হলো সংগ্রাম, সেবা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানুষের কল্যাণে আত্মনিবেদন। রঙ্গীরকুল আশ্রম ও শ্রীহট্ট চা শ্রমিক ইউনিয়ন আজও তাঁর আদর্শ ও চেতনার জীবন্ত সাক্ষ্য।


















