প্রতিষ্ঠান রক্ষা’ না গণতন্ত্র রক্ষা’?— বাংলাদেশ এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে
✍️ আরমান ওয়াহিদ
দেশজুড়ে এখন যে বিতর্কটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত—তা হলো, রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি কোনটি: প্রতিষ্ঠান রক্ষা, নাকি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা? এই প্রশ্নটি কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পথরেখার সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত।
গত কয়েকদিনে দেশের গণমাধ্যম ও সচেতন মহলে দুটি সংকট বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। একদিকে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত ও আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, মামলা ও কারাবন্দী করার ঘটনাগুলো নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে—রাষ্ট্র আসলে কাকে রক্ষা করছে? প্রতিষ্ঠানকে, নাকি ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রকে?
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠে, তখন সেটি কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়—বরং সেই প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় নিরাপত্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু সেই বাহিনীর ভেতর থেকে কেউ যদি মানবাধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে, তবে তাকে রক্ষা করাই কি প্রতিষ্ঠান রক্ষা? নাকি জবাবদিহিতার মাধ্যমে অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করা প্রতিষ্ঠানকেই দীর্ঘমেয়াদে আরও মর্যাদাবান করে তুলবে?
প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি কোনো আড়াল নয়, এটি একটি নৈতিক প্রতীক। আর সেই নৈতিকতা রক্ষা পায় কেবল স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচারের চর্চার মধ্য দিয়ে।
যদি অপরাধী সদস্যদের শাস্তি না দিয়ে ‘প্রতিষ্ঠান রক্ষা’র নামে বিষয়টি আড়াল করা হয়, তবে সেটি অবচেতনে গোটা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিকেই দুর্বল করে। ইতিহাস সাক্ষী—কোনো প্রতিষ্ঠান কখনোই অপরাধ ঢেকে রেখে মহৎ হতে পারেনি।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক অঙ্গনের চিত্রটিও কম উদ্বেগজনক নয়। ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেই দেখা যায় পুরনো দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি—বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, মামলা কিংবা বিচারিক হয়রানি। যেন ক্ষমতা বদল মানেই প্রতিশোধের নতুন অধ্যায়।
রাজনীতি যদি প্রতিপক্ষ ধ্বংসের অস্ত্রে পরিণত হয়, তবে গণতন্ত্রের প্রাণই শুকিয়ে যায়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হলো সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা—কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই দুই গুণই আজ সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত।
এর ফলেই তৈরি হচ্ছে একটি বিপজ্জনক শূন্যতা—যেখানে জনগণের কণ্ঠস্বর ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে, আর তার জায়গা নিচ্ছে প্রশাসনিক প্রভাব ও সামরিক কিংবা আমলাতান্ত্রিক প্রাধান্য।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের ইচ্ছাই সর্বোচ্চ ক্ষমতা। কিন্তু যখন রাজনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে, তখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে শুরু করে অগণতান্ত্রিক শক্তি।
আজ বাংলাদেশ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিষ্ঠান রক্ষা ও গণতন্ত্র রক্ষা—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই জাতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থে কাজ করতে হবে। ক্ষমতা নয়, দায়িত্ববোধই হওয়া উচিত নেতৃত্বের মূল চেতনা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন নয়, বরং নীতিনিষ্ঠ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে।
অন্যদিকে, সামরিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মনে রাখতে হবে—তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, আইনের শাসন ও স্বচ্ছতার ওপর। অভ্যন্তরীণ অনিয়ম বা অপরাধকে আড়াল নয়, বরং কঠোর তদন্ত ও ন্যায্য শাস্তির মাধ্যমে প্রতিহত করতে হবে।
একইভাবে, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের ভূমিকা পালন করতে হবে নিরপেক্ষভাবে—কোনো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে।
প্রতিষ্ঠান রক্ষার নামে অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া এক ধরনের আত্মঘাতী রাজনীতি। এটি কেবল গণতন্ত্রকেই দুর্বল করে না, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতর নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করে।
রাজনৈতিক প্রতিশোধের সংস্কৃতি ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ—দু’টিই ধ্বংসাত্মক।
এই সংস্কৃতি টিকে থাকলে গণতন্ত্র থাকবে শুধু কাগজে, আর রাষ্ট্রে টিকে থাকবে ভয়, অবিশ্বাস ও অসহিষ্ণুতার রাজনীতি।
একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠান ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষিত থাকলে প্রতিষ্ঠান স্বয়ংক্রিয়ভাবে শক্তিশালী হয়; আর যখন প্রতিষ্ঠানগুলো স্বচ্ছভাবে কাজ করে, তখন গণতন্ত্রও শেকড় গেড়ে বসে।
বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে—যখনই জবাবদিহিতা হারিয়ে গেছে, তখনই রাষ্ট্র দুর্বল হয়েছে। আর যখন জনগণের কণ্ঠস্বর শোনা গেছে, তখনই দেশ এগিয়েছে।
অতএব, এখন সময় এসেছে ‘প্রতিষ্ঠান রক্ষা’র আড়ালে গণতন্ত্রকে আঘাত না করার; বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠানকেও রক্ষা করার।
বাংলাদেশ আজ যে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, সেখানে প্রতিটি নাগরিকের, প্রতিটি নেতার এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব রয়েছে নিজেদের নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করা।
কারণ একটি সভ্য রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকে থাকে না শক্তিতে—টিকে থাকে ন্যায়ে।
প্রতিষ্ঠান রক্ষা মানে অপরাধ ঢেকে রাখা নয়—বরং সেগুলোকে ন্যায়ের পথে ফিরিয়ে আনা।
আর গণতন্ত্র রক্ষা মানে ক্ষমতার প্রতিশোধ নয়—বরং মানুষের মর্যাদা, অধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ার জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি তিনটি শব্দ: স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সহনশীলতা।
এই তিন মূল্যবোধই পারে আমাদের রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান উভয়কেই রক্ষা করতে—একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে।


















