img

ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক নীতি আসলে কী!

প্রকাশিত :  ১৬:০৬, ০২ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৭:২৫, ০২ নভেম্বর ২০২৫

ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক নীতি আসলে কী!

সাইফুল খান

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন এক চরিত্র, যিনি একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ভেঙেছেন, অন্যদিকে বৈশ্বিক কূটনীতির রীতি-নীতি উল্টে দিয়েছেন। ট্রাম্পের নীতিকে একক শব্দে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। কিন্তু বিশ্লেষকরা একে বলেন “Transactional Nationalism”, অর্থাৎ আদর্শ নয়, বরং প্রতিটি পদক্ষেপের কেন্দ্রে ছিল বাণিজ্যিক লাভ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হিসাব এবং জাতীয় স্বার্থের নিরেট বাস্তববাদ।

তার নীতি গুলো আলোচনা সবিস্তারে আসা জরুরী। 

 “America First” নীতির মূল দর্শন

ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক নীতির ভিত্তি ছিল তার নির্বাচনী স্লোগান “America First”।

এই নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বনেতা হিসেবে নয়, বরং একটি স্বার্থান্বেষী রাষ্ট্র হিসেবে আচরণ করে।

ট্রাম্প বিশ্বাস করতেন, অতীতের প্রেসিডেন্টরা মার্কিন অর্থনীতি, সামরিক ব্যয় ও প্রযুক্তিকে অন্য দেশের জন্য “সস্তায়” বিলিয়ে দিয়েছে।

তাই তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা, সামরিক জোট ও বৈশ্বিক চুক্তির প্রতি প্রকাশ্য সন্দেহ প্রকাশ করেন।

তার বক্তব্য ছিল সরল কিন্তু তীক্ষ্ণ:  “আমরা কারো পুলিশ না, কারো দাতা না। আমেরিকা নিজের ঘর আগে ঠিক করবে।”

বহুপাক্ষিকতার পরিবর্তে একক সিদ্ধান্তবাদ

ট্রাম্প জাতিসংঘ, ন্যাটো, ডব্লিউএইচও, এমনকি প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে “অকার্যকর” বলে আখ্যা দেন।

তিনি বিশ্বাস করেন, এই সংস্থাগুলো মার্কিন করদাতাদের অর্থে চলে, কিন্তু আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করে না। ফলে তার প্রশাসন এসব সংস্থা থেকে বেরিয়ে আসে বা অর্থ কমিয়ে দেয়।

এমনকি ইউরোপীয় মিত্রদের সাথেও ট্রাম্প আচরণ করেন যেন তারা “ক্লায়েন্ট” দেশ।

বারবার বলেন-  “আমরা তোমাদের রক্ষা করছি, তাই বিল দাও।”

এই মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের নৈতিক অবস্থান দুর্বল করে দেয়। কিন্তু ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ছিল ঠান্ডা বাস্তববাদের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।

চীনের সাথে “Trade War”  বাস্তববাদ না রক্ষণশীল আতঙ্ক?

ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায় হলো চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ। তিনি চীনের পণ্য আমদানিতে শত শত বিলিয়ন ডলারের শুল্ক আরোপ করেন। প্রযুক্তি খাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং হুয়াওয়ের মতো কোম্পানিকে “নিরাপত্তা হুমকি” ঘোষণা করেন।

তবে এ যুদ্ধ কেবল অর্থনীতির ছিল না।

এ ছিল এক ধরণের টেকনো-ন্যাশনালিস্ট যুদ্ধ, যেখানে প্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর, 5G এবং AI সবই আমেরিকার প্রাধান্য রক্ষার অস্ত্র হয়ে ওঠে।

চীনের “Made in China 2025” প্রকল্পকে ট্রাম্প দেখেছিলেন আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে।

মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প-একদিকে শান্তি, অন্যদিকে আগুন

ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে ঘিরে নেয় “Maximum Pressure” নীতিতে। তিনি ইরান পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) থেকে বেরিয়ে যান। কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন এবং কুদস বাহিনীর প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে শান্তিকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে নির্লজ্জভাবে  হত্যা করেন। যা বিশ্ব কূটনীতিতে ছিল এক ঐতিহাসিক ধাক্কা।

অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন একতরফা ও সীমাহীন। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে নেন। যা আরব বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তবু ট্রাম্প গর্ব করেন “Abraham Accords” এর জন্য, যেখানে কয়েকটি আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। এখানেই দেখা যায়, ট্রাম্পের নীতি দ্বিমুখী। একদিকে সংঘাত সৃষ্টি, অন্যদিকে শান্তির ব্যবসায়িক চুক্তি।

দক্ষিণ এশিয়া: পাকিস্তান ও ভারতের ভারসাম্য

ট্রাম্পের সময় পাকিস্তানের প্রতি কড়া অবস্থান দেখা যায়। তিনি পাকিস্তানকে “terror safe haven” আখ্যা দেন এবং সহায়তা বন্ধ করেন।

কিন্তু আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রয়োজনে তিনি আবার পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় ফেরেন। এরপর আবার তিনি পাকিস্তানের প্রশংসা শুরু করেন। 

ভারতের ক্ষেত্রে, ট্রাম্প ব্যক্তিগত সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন। মোদি ও ট্রাম্পের বন্ধুত্বমূলক শো “Howdy Modi” ও “Namaste Trump”ছিল রাজনীতির চেয়ে বেশি “দৃশ্যনির্ভর কূটনীতি।”

কিন্তু বাস্তবে, ভারতের বাণিজ্যিক সুবিধা কাটছাঁট হয় এবং H-1B ভিসা কঠোর হয়। সোজা কথা সম্পর্কের গনেশ উল্টে যায়। 

ইউক্রেন ও রাশিয়া - নীরব মিত্রতা?

রাশিয়ার প্রতি ট্রাম্পের নরম অবস্থান বরাবরই বিতর্কিত। তিনি ন্যাটোকে দুর্বল বলেন, কিন্তু পুতিনকে কখনো প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন না। অনেকে বলেন, ট্রাম্পের কূটনীতিতে রাশিয়া একপ্রকার ‘অদৃশ্য মিত্র’ হয়ে উঠেছিল।

এই নীরব মিত্রতাই বাইডেন প্রশাসনের সময় ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে। ট্রাম্প আসলে শক্তের ভক্ত।

বিশ্ব নেতৃত্বের ধারণা বদলে দেওয়া

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি একধরনের নৈতিক কর্তৃত্বের ধারণার ওপর দাঁড়িয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুগে আমেরিকা নিজেকে কেবল একটি রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং বিশ্বের নৈতিক দিশারি হিসেবে উপস্থাপন করত। “Democracy”, “Human Rights” এবং “Global Leadership” ছিল সেই ঐতিহ্যবাহী পররাষ্ট্রনীতির স্তম্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা নিজেদের দায়িত্ব ভাবতেন বিশ্বে গণতন্ত্র রক্ষা করা, মানবাধিকার নিশ্চিত করা আর দারিদ্র্য বা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকে পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দেওয়া। এই আদর্শিক কাঠামোর ভেতরেই তৈরি হয়েছিল ‘আমেরিকান এক্সসেপশনালিজম’ অর্থাৎ আমেরিকা ভিন্ন, শ্রেষ্ঠ এবং বিশ্বের নৈতিক দিকনির্দেশক।

কিন্তু ট্রাম্পের আগমনে সেই দৃষ্টিভঙ্গি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। তিনি রাষ্ট্রনেতা হিসেবে আচরণ করেননি ; বরং আচরণ করেন একজন কঠিন ব্যবসায়ীর মতো। তাঁর কাছে পররাষ্ট্রনীতি ছিল একপ্রকার “ডিল-মেকিং প্রক্রিয়া”।যেখানে প্রতিটি সম্পর্ক, প্রতিটি জোট, এমনকি মানবিক সহায়তাও একটি চুক্তির মতো।  “আমরা কত দিচ্ছি, তার বিনিময়ে আমরা কী পাচ্ছি?”

এই দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহ্যবাহী কূটনীতির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। পূর্বতন নেতারা “অঙ্গীকার” বা “দায়িত্ব” এর ভাষায় কথা বলতেন, সেখানে ট্রাম্প ব্যবহার করেন দরকষাকষির ভাষা। তিনি বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোনো নৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, বরং একটি লেনদেন। তাঁর কাছে ন্যাটো বা জাতিসংঘ কোনো “মূল্যবোধভিত্তিক জোট” নয়, বরং এমন প্রতিষ্ঠান যা আমেরিকার অর্থে টিকে আছে, অথচ আমেরিকার যথাযথ সুবিধা দেয় না।

এই “লেনদেনমূলক কূটনীতি” (Transactional Diplomacy) একদিকে বৈশ্বিক রাজনীতিকে বাস্তববাদী করে তুলেছে। অন্যদিকে নৈতিক নেতৃত্বের ধারণাকে সংকুচিত করেছে। ট্রাম্প বলেন, “আমরা কারো জন্য যুদ্ধ করব না, যদি আমাদের কোনো লাভ না থাকে।” তাঁর এই বক্তব্যে যেন ফুটে ওঠে ২১ শতকের “নিউ রিয়ালিজম”। যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কেবল শক্তি ও স্বার্থের গণিত।

তবে, এই নীতির কিছু ইতিবাচক দিকও ছিল। উদাহরণস্বরূপ, অনেক আমেরিকান নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে মনে করতেন যে তাদের করের অর্থ বিদেশে অপচয় হচ্ছে। ট্রাম্প সেই হতাশ মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে মনে করিয়ে দিলেন আমেরিকার ট্যাক্সদাতা প্রথমে আমেরিকার জন্যই। তাঁর এই “America First” দর্শন ছিল জনতার অর্থনৈতিক ক্ষোভকে রাজনৈতিক ভাষা দেওয়ার এক উপায়। ফলে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জনপ্রিয়তাই তার কূটনৈতিক বাস্তববাদকে খাদ্য জুগিয়েছে।

তবে বিপরীতে, এই মনোভাব বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার নেতৃত্বের ঐতিহ্যকে ধাক্কা দেয়। ইউরোপীয় মিত্ররা ট্রাম্পের নীতিতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে; তারা হঠাৎ বুঝতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র আর “বড় ভাই” নয় বরং “লেনদেনকারী পার্টনার”। কানাডা, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশগুলো প্রকাশ্যে আমেরিকার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে শুরু করে। এর ফলে তৈরি হয় এক ধরনের “Post-American Order”, যেখানে আমেরিকার নৈতিক নেতৃত্বের জায়গা নিয়ে নেয় সন্দেহ ও অবিশ্বাস।

অন্যদিকে, চীন ও রাশিয়া এই সুযোগকে কৌশলে কাজে লাগায়। ট্রাম্প যখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করছিলেন, তখন বেইজিং ও মস্কো সেই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে। ট্রাম্প নিজে হয়তো মনে করেন, তিনি আমেরিকাকে রক্ষা করছেন; কিন্তু বাস্তবে, তাঁর আচরণ বৈশ্বিক নেতৃত্বের কেন্দ্রকে বিভক্ত করেছে এবং নতুন শক্তিগুলোর জন্য ক্ষেত্র উন্মুক্ত করেছে।

বাস্তবতা হলো, ট্রাম্পের সময় থেকে বিশ্ব নেতৃত্বের ধারণা একেবারে বদলে গেছে। আগে যেখানে নেতৃত্ব মানে ছিল নৈতিক অবস্থান, কূটনৈতিক পরিপক্বতা এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতা। এখন নেতৃত্ব মানে হয়েছে, কে বেশি দরকষাকষি করতে পারে, কে নিজের স্বার্থে সবচেয়ে নির্দয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

তবুও, ইতিহাস হয়তো ট্রাম্পকে একদিক থেকে নতুন বাস্তববাদের প্রবর্তক হিসেবেই মনে রাখবে। তিনি হয়তো নৈতিকতার মুখোশ সরিয়ে দেখিয়েছেন, আধুনিক বিশ্ব আসলে “মূল্যবোধে” নয়, “স্বার্থে” চলে। সেই অর্থে, ট্রাম্প বৈশ্বিক নেতৃত্বকে ধ্বংস করেননি, বরং তাকে এক নির্মম বাস্তবতার আয়নায় দাঁড় করিয়েছেন।

পরিশেষ 

ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক নীতি কেবলই যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক, স্বল্পমেয়াদি এবং প্রভাবশালী।

তিনি বিশ্বের কাছে এক ভিন্ন যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়েছেন। যে দেশ নেতৃত্ব দিতে নয়, বরং “বিনিময় করতে” চায়।

এর ফল - মিত্রদের মধ্যে অনাস্থা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে বিভ্রান্তি এবং বিশ্ব রাজনীতিতে এক অনিশ্চয়তার স্থায়ী ছায়া।

তবে, সমর্থকরা বলেন ট্রাম্প অন্তত আমেরিকার স্বার্থে সোজাসাপট। তিনি কূটনৈতিক ভণ্ডামি ভেঙেছেন, প্রশাসনিক মুখোশ সরিয়েছেন।

আর বিরোধীরা বলেন, তিনি বিশ্বের ভারসাম্য নষ্ট করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে একাকী করে তুলেছেন।

এক কথায় বলা যায়-

ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক নীতি হলো আদর্শের নয়, বরং প্রভাব ও মুনাফার রাজনীতি।

যেখানে কূটনীতি এক ধরনের “ডিল”, আর বিশ্ব নেতৃত্ব একপ্রকার “ব্র্যান্ডিং”।

লেখক - ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক। 



মতামত এর আরও খবর

img

দুর্লভ খনিজ উপাদান: কেন যুক্তরাষ্ট্রের এগুলো প্রয়োজন এবং কেন এগুলো যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্যযুদ্ধে কৌশলগত অস্ত্র হয়ে উঠেছে

প্রকাশিত :  ১১:২৪, ০৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৩১, ০৫ নভেম্বর ২০২৫

অনুপম সাহা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ ও ‘রেয়ার আর্থ’-এর গুরুত্ব

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে দুর্লভ খনিজ উপাদানসমূহ (Rare Earth Elements – REEs)। এই ১৭টি রাসায়নিক উপাদান আধুনিক প্রযুক্তির মূলভিত্তি — এগুলো ব্যবহার হয় ইলেকট্রিক গাড়ি, কম্পিউটার চিপ, জেট ইঞ্জিন, উইন্ড টারবাইন, স্মার্টফোন, এমনকি উন্নত সামরিক অস্ত্র তৈরিতে।

যদিও প্রকৃতিতে এগুলো তুলনামূলকভাবে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, কিন্তু বিশুদ্ধভাবে আলাদা করা কঠিন এবং পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দীর্ঘ কয়েক দশকের বিনিয়োগ ও রাষ্ট্রীয় সহায়তায় চীন আজ এই খনিজগুলোর খনন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রায় একচেটিয়া কর্তৃত্ব অর্জন করেছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীন রেয়ার আর্থ রপ্তানিতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে—যা যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাতে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি বেইজিংয়ের সচেতন কৌশল, যাতে তারা এই খনিজ আধিপত্যকে বাণিজ্য আলোচনায় ‘বাঁধা কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

রেয়ার আর্থ কী এবং কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

রেয়ার আর্থ হলো ১৭টি রাসায়নিকভাবে মিল থাকা উপাদান, যা উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পে অপরিহার্য। নামগুলো যেমন— নিওডিমিয়াম (Neodymium), ইট্রিয়াম (Yttrium), ইউরোপিয়াম (Europium)—শুনতে অপরিচিত লাগলেও, এগুলোর ব্যবহারে তৈরি পণ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

নিওডিমিয়াম: শক্তিশালী চুম্বক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়, যা ইলেকট্রিক মোটর, হার্ড ড্রাইভ, স্পিকার ও উইন্ড টারবাইনে অপরিহার্য।

ইট্রিয়াম ও ইউরোপিয়াম: টেলিভিশন ও কম্পিউটার স্ক্রিনে উজ্জ্বল রঙ তৈরি করে।

ল্যান্থানাম: ক্যামেরা লেন্স ও আলোক সরঞ্জামে ব্যবহৃত হয়।

সেরিয়াম: গাড়ির ক্যাটালাইটিক কনভার্টারে ব্যবহৃত হয় যা দূষণ কমায়।

প্রাসিওডিমিয়াম ও গ্যাডোলিনিয়াম: বিমান ইঞ্জিন, এমআরআই যন্ত্র ও নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়।

জিঞ্জার ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের পরিচালক টমাস ক্রুমার বলেন,

“যে কোনো জিনিস যা অন-অফ করা যায়—সেগুলো কোনো না কোনোভাবে রেয়ার আর্থের ওপর নির্ভরশীল।”

 কেন রেয়ার আর্থ চীন–যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় এক বড় ‘বাণিজ্য হাতিয়ার’

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখনো “হেভি” রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা নেই, অথচ চীন নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্বের প্রায় ৯০% প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতা। ফলে বেইজিং শক্তিশালী কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। 

২০২৫ সালের ৯ অক্টোবর চীন নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করে—এটি আসে ঠিক কয়েক সপ্তাহ আগে, যখন APEC সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ইচ্ছাকৃত সময়-নির্বাচন—যেন আলোচনায় চীন অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। 

রেয়ার আর্থের ব্যবহার সামরিক সরঞ্জাম, সেমিকন্ডাক্টর ও উন্নত প্রযুক্তিতে হওয়ায় এটি কেবল বাণিজ্যিক নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নেও পরিণত হয়েছে।

চীনের বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনের নিয়ন্ত্রণ

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (IEA) তথ্য অনুযায়ী, চীন ৬১% রেয়ার আর্থ উৎপাদন এবং ৯২% প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এই আধিপত্য এসেছে বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি, কম উৎপাদন খরচ ও দুর্বল পরিবেশনীতির কারণে।

চীনের সাবেক নেতা দেং শিয়াওপিং ১৯৯২ সালে বলেছিলেন,

“মধ্যপ্রাচ্যের কাছে তেল আছে, আর চীনের কাছে আছে রেয়ার আর্থ।”

আজ তার সেই ভবিষ্যদ্বাণীই বিশ্ব অর্থনীতির বাস্তব চিত্রে রূপ নিয়েছে।

রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও উত্তেজনার বৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্র নতুন শুল্ক আরোপের পর চীন সাতটি “হেভি” রেয়ার আর্থে রপ্তানি সীমাবদ্ধতা জারি করে। এখন এই খনিজ বা সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি রপ্তানিতে বিশেষ অনুমতি লাগে।

অক্টোবর ২০২৫-এ চীন আরও পাঁচটি উপাদান ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ তালিকায় যোগ করে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে এটি “অর্থনৈতিক জবরদস্তি” এবং “বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খল দখলের চেষ্টা।”

এই উপাদানগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পে — যেমন F-35 যুদ্ধবিমান, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র, ও রাডার সিস্টেম তৈরিতে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জ

২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭০% রেয়ার আর্থ আমদানি এসেছে চীন থেকে। দেশে একটি খনি থাকলেও এর আকরিক এখনো চীনে পাঠাতে হয় প্রক্রিয়াকরণের জন্য।

ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেন ও গ্রীনল্যান্ডের সঙ্গে খনিজ সরবরাহ চুক্তির চেষ্টা করছে, কিন্তু রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও পরিবেশগত বাধা অগ্রগতিকে ধীর করছে।

ব্রিটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. গ্যাভিন হার্পার সতর্ক করেছেন,

“এই ঘাটতি অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপ্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা শিল্পে উৎপাদন বিলম্ব ও খরচ বৃদ্ধি পাবে।”

সাম্প্রতিক অগ্রগতি: এক বছরের অস্থায়ী সমঝোতা

রয়টার্স জানিয়েছে, ২০২৫ সালের ৩০ অক্টোবর চীন ও যুক্তরাষ্ট্র এক বছরের একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে—চীন রপ্তানি অব্যাহত রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কিছু শুল্ক কমাবে।

দ্য গার্ডিয়ান এটিকে চীনের “শক্তিশালী বাণিজ্য অস্ত্র” বলে উল্লেখ করেছে, আর পলিটিকো জানায়, কানাডা নেতৃত্বাধীন জি৭ দেশগুলো এখন চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।

তবে আল জাজিরার মতে, চীনের নতুন রপ্তানি নিয়ম—যা ট্রাম্প–শি বৈঠকের ঠিক আগে কার্যকর হয়—ইঙ্গিত দেয় যে বেইজিং ভবিষ্যতেও এই খনিজ আধিপত্যকে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে।

শি–ট্রাম্প বৈঠকের তাৎপর্য

বিশ্ব অর্থনীতির দৃষ্টি ছিল এই বৈঠকের দিকে। ট্রাম্প বলেছিলেন, “চীনের আর কোনো বাধা নেই”, কিন্তু বেইজিং এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। যেহেতু বিশ্বে রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াজাতকরণের ৯০% চীনের হাতে, তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক বাজারে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।

যদি এই চুক্তি স্থায়ী হয়, তাহলে তা বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনকে কিছুটা স্থিতিশীল করতে পারে। কিন্তু ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিকল্প উৎস তৈরির চেষ্টা ত্বরান্বিত করবে—যা ভবিষ্যতে বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা কাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করতে পারে।

সারসংক্ষেপ

রেয়ার আর্থ কেবল খনিজ নয় — এটি আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি এবং এখন এক নতুন ভূরাজনৈতিক মুদ্রা। চীনের এই খনিজ নিয়ন্ত্রণ তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় অসাধারণ প্রভাবশালী করেছে। ফলে, এই উপাদানগুলো কেবল শিল্প বা বাণিজ্যের বিষয় নয়, বরং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য নির্ধারণের অন্যতম উপাদান হয়ে উঠেছে।


অনুপম সাহা: একাউন্টেন্ট, কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর