img

নুরের ওপর হামলা: হাসনাতের বিতর্কিত মন্তব্যে রাজনৈতিক মহলে নতুন মেরুকরণ!

প্রকাশিত :  ০৫:৫৭, ৩০ আগষ্ট ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:০৮, ৩০ আগষ্ট ২০২৫

নুরের ওপর হামলা: হাসনাতের বিতর্কিত মন্তব্যে রাজনৈতিক মহলে নতুন মেরুকরণ!

রাজধানীতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হা'ম'লা এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর কড়া প্রতিক্রিয়া কেবল একটি নিন্দা নয়, বরং এটি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সম্পর্কের গভীরে থাকা অবিশ্বাস ও কৌশলগত বিভাজনকে সামনে এনেছে। হাসনাত তাঁর ফেসবুক মন্তব্যে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে উদ্দেশ্য করে 'ভণ্ডামি'র অভিযোগ এনেছেন এবং এই হা'ম'লাকে 'ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে' আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার একটি 'খেলা'র অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই বিস্ফোরক অভিযোগ ঘটনাটিকে নিছক একটি রাজনৈতিক সংঘাতের বাইরে এনে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

সংঘর্ষের আদ্যোপান্ত: সহিংসতার একটি টাইমলাইন

শুক্রবার (২৯ আগস্ট, ২০২৫) বিকেলে রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণঅধিকার পরিষদের (গোপ) নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান অভিযোগ করেন, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাসীরা’ অতর্কিতভাবে তাদের মিছিলে হা'ম'লা চালায়। অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে পাল্টা দাবি করা হয় যে গণঅধিকার পরিষদের কর্মীরাই প্রথমে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে চলা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট ছোড়ার ঘটনায় সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

প্রাথমিক সংঘর্ষের রেশ কাটতে না কাটতেই রাত সাড়ে ৮টার দিকে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে আবারও দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এ সময় গণঅধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের ঘটনাস্থল ত্যাগ করার জন্য ১০ মিনিটের একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, এই সময়ের মধ্যে কর্মীরা সরে না গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ওপর ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। এই লাঠিচার্জের মাঝেই নুরুল হক নুর গুরুতর আহত হন। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাঁর মাথা ফেটে গেছে এবং তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান তাঁর ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, “নুর মুমূর্ষু অবস্থায়, বাঁচবে কি মরবে জানি না”। ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা-কর্মীরা বাংলামোটর মোড়ে বিক্ষোভ করে এবং গণঅধিকার পরিষদ শনিবার (৩০ আগস্ট) সারা দেশে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দেয়।

হাসনাতের বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া: রাজনৈতিক ভণ্ডামির অভিযোগ

নুরের ওপর হা'ম'লার পর তাৎক্ষণিকভাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তাঁর ফেসবুক পেজে হা'ম'লার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তাঁর এই পোস্টের মন্তব্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানান, যা ঘটনাটিকে নতুন মাত্রা দেয়। হাসনাত লেখেন, “প্রতিবাদের কাজ আপনার? ভণ্ডামি বাদ দেন স্যার। যেই জন্য বসানো হইছে সেটা না করে কী কী করছেন এসবের হিসাব দিতে হবে। কে কোথায় কীভাবে কোন কাজে বাধা দিছে এসব খবর আমাদের কাছে আছে। এসব প্রতিবাদের ভং না ধরে কাজটা করেন”।

এই মন্তব্যটি কোনো সাধারণ ব্যক্তিগত বাকবিতণ্ডা নয়; বরং এটি রাজনৈতিক সম্পর্কের এক গভীর বিভাজনকে তুলে ধরে। হাসনাত আবদুল্লাহ, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন, আসিফ নজরুলকে তাঁর ভূমিকার জন্য জনসমক্ষে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। 'বসানো হইছে' শব্দটির ব্যবহার একটি গোপন ক্ষমতা-কাঠামোর দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে আসিফ নজরুলের ভূমিকা কেবল প্রকাশ্যে নিন্দা জানানো নয়, বরং নেপথ্যে সুনির্দিষ্ট কাজ করার। হাসনাতের বক্তব্য অনুযায়ী, আসিফ নজরুলের মতো বুদ্ধিজীবী ও উপদেষ্টাদের কাছ থেকে যে ধরনের দৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশিত, তা না করে তাঁরা কেবল লোক-দেখানো প্রতিবাদ করছেন। এটি এক ধরনের কৌশলগত দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে, যেখানে আন্দোলন-কেন্দ্রিক তরুণ নেতৃত্ব এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যে গভীর অবিশ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে। হাসনাতের এই প্রতিক্রিয়া সামগ্রিক আন্দোলনটির লক্ষ্যের প্রতি তাঁদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে এনেছে।

হাসনাত আবদুল্লাহর আরও একটি উল্লেখযোগ্য পোস্ট হলো, যেখানে তিনি নুরের ওপর হা'ম'লাকে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক খেলার অংশ বলে অভিহিত করেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, “ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ব্যাক করানোর এই খেলায় প্রথম রক্ত দিলেন আমাদের নুর ভাই”। তিনি আরও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, বিপ্লবীদের রক্ত ঝরিয়ে আওয়ামী লীগকে ফেরানোর এই চেষ্টা সফল হতে দেবেন না। হাসনাত দাবি করেন, গত ১১ মার্চ তিনি একটি রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছিলেন, যা ভেস্তে গেলেও একই গোষ্ঠী এবার জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করে নিজেদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: জটিল সম্পর্কের জাল

নুরের ওপর হা'ম'লার ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া এসেছে। এই প্রতিক্রিয়াগুলো বিশ্লেষণ করলে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি জটিল চিত্র পাওয়া যায়। গণঅধিকার পরিষদ হা'ম'লার জন্য সরাসরি জাপা ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছে এবং জাপা নিষিদ্ধ করার জন্য তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই হা'ম'লার নিন্দা জানিয়েছেন। তাঁদের বিবৃতিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অধিকার এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী এই হা'ম'লাকে অতীতের ফ্যাসিবাদী শাসনের দিকে ইঙ্গিত বলে উল্লেখ করে এবং জাপা-কে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর বলে সরাসরি অভিযুক্ত করে। অন্যদিকে, জাপা পাল্টা অভিযোগ করে যে, গণঅধিকার পরিষদের কর্মীরাই প্রথমে তাঁদের কার্যালয়ে হা'ম'লা চালিয়েছে।

প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব: কেন এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ

নুরুল হক নুর ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্রনেতা হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর থেকে তিনি বহুবার হা'ম'লা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদ গঠনের পর থেকে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই প্রেক্ষাপটে তাঁর ওপর হা'ম'লা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

এই ঘটনাটির গভীর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে। নুরের ওপর হা'ম'লাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংঘাতকে একটি নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। গণঅধিকার পরিষদ, জামায়াত ও ছাত্র আন্দোলন জাপা-কে কেবল একটি বিরোধী দল হিসেবে দেখছে না, বরং তাদের আওয়ামী লীগের দোসর বা বি-টিম হিসেবে চিহ্নিত করছে। এই বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় পার্টির মতো পুরোনো দলগুলোকে প্রান্তিকীকরণ করা এবং তাদের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখনো একটি স্থিতিশীল বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিকে এগোতে পারেনি। বরং, এখানে জুলাই বিপ্লবের আদর্শিক মানদণ্ডে রাজনৈতিক দলগুলোর যোগ্যতা যাচাই করা হচ্ছে এবং যারা এই মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তীব্র অবিশ্বাস ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

হাসনাত আবদুল্লাহর মন্তব্য সেই গভীর অবিশ্বাস ও মেরুকরণেরই প্রতিচ্ছবি। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, এই খেলার মাধ্যমে ভারতের মদদে একটি 'রিফাইন্ড আওয়ামী লীগকে' আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ফ্যাক্টরকে টেনে এনেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

ভবিষ্যৎ পথ: বিক্ষোভ ও দাবি

নুরের ওপর হা'ম'লার ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। গণঅধিকার পরিষদ শনিবার (৩০ আগস্ট) দুপুর ১২টায় দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ময়মনসিংহে গণঅধিকারের বিক্ষুব্ধ কর্মীরা জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে ভাঙচুর করেছে। এছাড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হা'ম'লার নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।

নুরের ওপর হা'ম'লা এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংঘাতগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে তার একটি নজির স্থাপন করবে। বিভিন্ন পক্ষ থেকে হা'ম'লায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার এবং জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, সেগুলোর প্রতি নতুন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি এই দাবিগুলোর প্রতি যথাযথ সাড়া না দেওয়া হয়, তবে এটি আরও সহিংসতাকে উৎসাহিত করতে পারে। পক্ষান্তরে, যদি হা'ম'লায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে তা নতুন রাজনৈতিক জবাবদিহিতার একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। এই ঘটনাটি তাই শুধুমাত্র একটি সংঘাতের খবর নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক রূপান্তরের স্থিতিশীলতার একটি ব্যারোমিটার।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হা'ম'লার ঘটনাটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভঙ্গুরতা এবং অন্তর্নিহিত উত্তেজনাকে স্পষ্ট করেছে। এই ঘটনাটি শুধুমাত্র দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যেকার সংঘর্ষ ছিল না, বরং এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যেকার গভীর অবিশ্বাস, আদর্শিক বিভাজন এবং রাজনৈতিক কৌশলগত ভিন্নতাকে উন্মোচন করেছে। হাসনাত আবদুল্লাহর বিস্ফোরক মন্তব্য এই ঘটনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা এবং একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

এই আক্রমণ এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, যদিও একটি রাজনৈতিক আধিপত্যের যুগের অবসান ঘটেছে, তবে তার নিচে চাপা পড়া উত্তেজনা, গভীর অবিশ্বাস এবং আদর্শিক সংঘাতগুলো এখনো বিদ্যমান। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা এখনো অনেক দূরের পথ এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে এই ধরনের ঘটনাগুলির প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে।


মতামত এর আরও খবর

img

উন্মুক্ত বিবেক, মুক্ত ফিলিস্তিন!!

প্রকাশিত :  ০৭:৩৬, ১৭ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:৫২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫

নুজহাত নূর সাদিয়া

আহা ! বুকের পাঁজর ভাঙা গগনবিদারী আর্তনাদ , নাহ-কোন নিরব জঠর যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাওয়া গর্ভবতী মায়ের নবজাতক জন্ম দেওয়ার অবিস্মরণীয় ক্ষণটি উদযাপনের আনন্দচ্ছোস নয়, এ যে সহস্র দিনের গ্লানি শেষে এক নিকষ কালো আঁধার পেরিয়ে মাতৃভূমির বুকে নির্ভীক পা রাখা । আবার সেই চিরপরিচিত সবুজ দুর্বা ঘাসে ছুঁটে বেড়ানো , বাড়ন্ত স্কোয়াশের পূর্ণ ঝুঁড়ি, মাংসের রসাল স্যুপ, হাতে বানানো গমের রুটি সহযোগে উদর পূর্তির সেই পারিবারিক সুখস্মৃতি , মায়ায় জড়ানো বছর পার করে দেওয়া সংগ্রামী পরিবারগুলো ফিরে কি পাবে তাদের সেই প্রাণোচ্ছল ফিলিস্তিন । বহু চর্চিত এই প্রশ্নটির উত্তর অজানা আশংকা আর অনিশ্চয়তার অদৃশ্য গেরোতে আটকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকলে ও বিপরীত শিবিরে ও বহু দিনের ঘরবন্দী প্রিয়মুখগুলো স্বজনদের বাহুডোরে ফেরার অপেক্ষায় । আগ্রাসী ইসরায়েলের ধূলো উড়ানো পথ ও যে আজ শান্তিকামী মানুষের স্বতস্ফূর্ত হাসিতে ভরপুর। 

আনুষ্ঠানিক হিসেব অনুযায়ী, মোট হতাহতের সংখ্যা  ৬৬,০০০ হাজার ছাঁড়িয়ে গেছে, জীবন-ভর পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বাঁচতে হবে ২,৫০,০০০ জন হতভাগ্যকে , বেঁচে যাওয়া অসংখ্য দুরন্ত শৈশব বাকিটা জীবন সম্ভবত এক দুর্বিসহ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবে, আকাশ ছোঁয়া দালান , সুসজ্জিত স্থাপনা আর পুরাকীর্তির শহর ফিলিস্তিন আজ এক মৃতপ্রায় ভুতুড়ে নগরী ।

এই যে  ক্ষতি , তা সন্দেহাতীতভাবেই অপূরণীয় ক্ষতি । নেতানিয়াহু নামের এক বিকট দানবের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর অপরিণামদর্শী যুদ্ধ কৌশলের খেস ারত দিতে হল ফোরাত নদীর তীরবর্তী নিরীহ প্রাণগুলোর। বিশ্ব মানচিত্র হতে ফিলিস্তিন নামক ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলটি ( গাজা প্রায়২১ লক্ষ লোকের আবাস) মাত্র মাসখানিক আগে ও নিরবে মুছে যাচ্ছিল ধনী রাষ্ট্রের তাবেদার মুসলিম বিশ্বের অলস শাসনকর্তাদের নির্লিপ্ত আচরণের কারণে । মুসলমান ভাই -ভাই, জুলুমবাজের নিস্তার নাই, বিপন্ন মানবতা বহুল চর্চিত প্রবাদগুলো নিতান্তই খাঁচায় বন্দি তোতাপাখির মুখস্থ বুলির মত আউড়ে চলছিল বিশ্বরাজনীতির মোড়লরা । তবে কি, আমজনতার পরম আরাধ্য পার্থিব জীবনের ও সমাপ্তি আছে, আর সেই সমাপ্তি বরাবরই ইতিহাসের পাতায় লিখিত হয়েছে স্রষ্টার একান্ত ইচ্ছেয়, অসহায়ের পূর্ণ সমর্থনে আর দিনশেষে সত্য ও ন্যায়ের বিজয়ে ।

গৃহকোণের শান্তি গৃহকর্ত্রীর পরম প্রিয়, আর সেই শান্তির সুশীতল পরশ এ ভূগোলকের পরতে পরতে ছঁড়িয়ে দিতে যে উদ্যোগী মানুষগুলো অনন্য সাধারণ কাজগুলোকে বাস্তবতার আলো দেখান সে মানুষগুলোই কর্মকুশলতায় অর্জন করে নেন সর্ব্বোচ সম্মান -নোবেল । এ নোবেল প্রাপ্তি, কার ও দারিদ্র্য বিমোচনে, চলতি ‘২৫ সালে বিতর্কিত মারিয়া কোরিয়া মাচানো -যার রাষ্ট্রীয় নীতি বহু অসহায় মানুষকে দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়েছে, প্রাক্তন  যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি বারাক সহ শান্তিতে নোবেল পাওয়া আলোচিত মানুষগুলো পুরষ্কারের কোঠা না মানদন্ড না তাদের কাজের বিষয় এ সূক্ষèাতিসূক্ষè বিষয়গুলো

রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে।

কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম, আর স্বেচ্ছাচারী কর্তা যখন নিজ খেয়াল-খুশি মত আইন -কানুন তৈরি করে অসহায়দের উপর তা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেন তখন তা ঐতিহাসিকভাবে চলে আসা জায়ানবাদীদের  আধিপত্য আর কতৃর্ত্ববাদের নির্মমতার করুণ পুনরাবৃত্তি বই আর কিছুই নয় । আর ও নির্মম কৌতুক, একদা জায়ানবধের রাজ্য বলে খ্যাত , হিটলারের জার্মান, মাঁখোর  ফ্রান্স , কূটনৈতিক ব্রিটেন সহ দু‘মুখো আরব বিশ্ব সকলে এ নির্মম রসিকতায় সামিল ! দুনিয়া যে ক্ষমতা আর অর্থের পূজারী - পড়ন্ত বেলার প্রাজ্ঞ প্রবীণদের গভীর হতাশার সুরে তা সুস্পষ্ট ।

রুপকথার গল্পের চেয়ে ও বাস্তব জীবনের গল্প অনেকসময় অনেক বেশি সুন্দর হয়ে উঠে , হয়ে উঠে প্রকৃত রুপক নতুবা তার চেয়ে ও শক্তিশালী আখ্যান । বিশ টি বছর ধরে ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর নানা প্রতিকুলতায় অবরুদ্ধ হামাস , ঠিক জিতে গেল সাহস আর দেশের প্রতি ভালবাসাকে হৃদয়ে লালন করে।

আর, সেই ছোট্ট গেরিলা সদস্যের দলটি আজ কত বড়! মানচিত্র ছাঁড়িয়ে , সীমানা ছাঁড়িয়ে নব প্রজন্মের অকুতোভয় হামাসরা আজ দুয়ারে দাঁড়ানো দৃঢ় দ্বাররক্ষী । তারাই পারে ,তথাকথিত অজেয় পশ্চিমা শক্তিকে শান্তিচুক্তি নামক সে নাটকীয় ঘটনার অন্যতম যোগানদার করতে। মার্কিন সরকার প্রধান উপযাচক মাত্র-পরিস্থিতি বুঝেই হয়তবা বন্ধুর পথে হাঁটতে চাইছেন, ঢাল হয়ে দাঁড়ানো বর্মটি যে ভিষণ শক্তপোক্ত ও একরোখা ।

তবে, মধ্যপ্রাচ্যে ছঁড়ি ঘুরানোর দীর্ঘদিনের শক্তলাঠিটি কে যে এবার বাঁকাতেই হয় ।  সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙবে না, হায় বেনিয়ামিন  কি অসম্মানের এক পরাজয় ! কি অপেক্ষা করছে দুর্নীতি মামলায় জর্জরিত বুড়ো নেকড়েটির কপালে -বিধ্বস্ত চেহারায় কপালের কুঞ্চিত রেখাগুলো দীর্ঘতর হচ্ছে বৈকি।

প্রতিরোধ, যুদ্ধের নামে আগ্রাসন আর বসতি স্থানান্তরের নামে বাস্তুচ্যুত লক্ষাধিক শরণার্থী , আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রাথমিক পর্যায় হয়তবা এখন পর্যন্ত বিজয় উদযাপনে ব্যস্ত । তবে নারীর প্রতি সম্মান রক্ষার্থে ট্রাম্প তার প্রাক্তন রাজনৈতিক প্রতিদন্বী বারাকের উপর সম্ভবত সচেতনভাবেই তার রাষ্ট্র পরিচালনার মেয়াদকালে বিতর্কিত সন্ত্রাসী বনাম ইসলামিক সেনাবাহিনী মতানৈক্যের বিষয়টির উপর  ইঙ্গিত দিয়েছেন । আর , ব্রিটিশ সংসদে চিত্রিত ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করে পুরনো বন্ধু ব্লেয়ারের পদাংক অনুসরিত কিনা, তাই আপনমনে যাচাই-বাছাই করে চলেছেন। 

পরিস্থিতির পরিবর্তিত মোড় , কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন লিখিত শান্তি  চুক্তির যে ভিন্ন ভিন্ন ২০টি শর্ত শোভা পাচ্ছে  তার সুচারু বাস্তবায়ন খোদ ট্রাম্পের পক্ষেই যথেষ্ট দুরুহ । পেন্ডুলামের কাঁটা চলমান, হঠকারী ছোটভাই একবার নয় বেশ ক‘বার বড় ভাইয়ের অবাধ্য হয়েছেন , আস্ত উড়োজাহাজ উপহার আর বন্ধুপ্রতীম কাতারের উপর অর্তকিত আক্রমণ । রক্তে যার খুনে নেশা সে পাগলা ঘোড়া কি আদৌ থামবে ? বিলুপ্ত হিজবুল্লা, হুতির হারিয়ে যাওয়া হামাসের নেতৃত্বের শক্তি ক্ষয় , সিরিয়ায় ভাঙ্গন, ইরানের সফল প্রতিরক্ষার ব্যুহ ভেদ- আপাত , দ্বিধাগ্রস্থ ইসরাইল প্রধান সফলতার মাপকাঠিতে আত্নতৃপ্তিতে ভুগতে পারেন হয়তবা ।  তবে,গাজামুখি সারি সারি ত্রাণবাহী গাড়ির বহরের দী¦প্ত যাত্রা কি তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয় নি, নিশ্চিতভাবেই উত্তরটি হ্যা ।

কাঁকচক্ষু দৃষ্টিতে , দৃঢ়তা আর ন্যায়ের বিজয় তবে, অসম এ যুদ্ধে উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের চড়া মূল্য দিতে হল  হামাসকে। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায়  হামাস , নিহত হন ১ হাজার ২০০ জন ইসরাইলি নাগরিক , প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। এই যে অপরিণামদর্শী পদক্ষেপ সেই জীবননাশের মূল্য দিতে হল চরমভাবে-গত দু‘বছরে ৬৭,০০০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত । শক্তিশালী শত্রুর সাথে টক্কর লাগানো  কি এত সোজা!  লোকবল আর সামরিক শক্তিতে তুলনামূলক ভাবে পিঁছিয়ে, তবে কিনা নীতি আর ঈমানের শক্তিতে বরাবরি বলীয়ান হামাসিয়ানরা । তাই , এ ক্রান্তিকালে ও ধাপে ধাপে অধিকাংশ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল তারা, সর্বশেষ গাজায় ৪৮ জন বন্দী ছিলেন , বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবান ২০ জন। আর্ন্তজাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে দু‘ধাপে জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় হামাস গত ১৩ই অক্টোবর । মৃতদের মাঝে চার জনের মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা ও জানিয়েছে তারা।অপরদিকে, প্রতিপক্ষ ইসরাইলের আচরণ রুঢ়তার সীমা আকাশ  ছুঁয়েছে  বহু আগেই-কারাগারে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা এবং নিপীড়ন করা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যৌন হয়রানির খবর ও পাওয়া গেছে । আর্ন্তজাতিক গনমাধ্যম আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আল-রিমায়ি বলেন- এ দু‘টি বছরে তার ওজন কমেছে ৫০ কেজি ! হাড় সর্বস্ব শরীর জড়িয়ে কন্যার ব্যাকুল আর্তি, বাবা আমি ব্যাথা পাই ।

এখন আবার ট্রাম্পের নতুন চমক, ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপনাস্ত্র উপহার দিবেন এই পাগলাটে রাষ্ট্রপতি রাশান যুদ্ধ থামাতে ।  শুরু হওয়া আফগান -পাকিস্তান সংঘাতে ও তালেবান দের ভূমিকা নিয়ে এক নতুন চেহারার ব্যবসায়ীকে দেখা গেছে -জামাতা কুশনারের ব্যবসায়িক বুদ্ধির জুড়ি নেই রাজনৈতিক বুদ্ধিতে ও যে  শ্বশুরকে ভবিষ্যতে টেক্কা দিতে সমর্থ  হবেন  তা তার সাম্প্রতিক স্রোত বুঝে চলার ই পরিপক্ক রুপ ।

আজকের এই পার্থিব পৃথিবীতে  স্রোতস্বিনী টেমস নদী ব্যবহারের মাসকাবারি বিল পরিশোধের সময় ও যে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটি মগজে নিত্য গেঁথে থাকে -প্রতিটি পানিবিন্দু পরিশোধে পাওনা প্রাপ্য ! অর্থাৎ, জীবনের অপর নাম পানি ও বাতাস সেবনে ও মূল্য চুকাতে হয়, তা যদি হয় কেনসিংটন নামক অভিজাত এলাকার মনোরম ব্যালকনির মুক্ত হাওয়া । বিনামূল্যে    সেবা, সে তো অতীতের গাল গল্প । অথচ, নিঠুর ইসরাইলী বাহিনী    গাজায় ৩০০০ জলপাই গাছ  কেটে , অগণিত বন্য ও পোষা  প্রাণী মেরে আক্ষরিক অর্থেই প্রকৃতিকে বিপন্ন করে  তুলতে চাইছিল  । সেই প্রকৃতিই কিনা আপন মহিমায়  নতুন বোনা জলপাই গাছের পাশ দিয়ে ছুটন্ত শিশুদের  সাদরে বরণ করছে যাদের খাঁচা ভর্তি প্রিয় পোষা  পাখিটির  গুঞ্জন।   

ফিলিস্তিন বাসীদের প্রিয় ম্যান্ডেলা ‘ আল ফাত্তাহ ‘ এখন ও জায়ানবাদীদের জিম্মায় ,  ইসরাইলী সেনাবাহিনী তাকে যমের মত ভয় পায় -যার মুক্তির আলো দেখা এখন ও সংশয়ে ভরা । সন্দেহাতীতভাবেই, তিনিই প্যালেস্টাইনি জনগণের অবিস্বরণীয় মুক্তি সংগ্রামের পরবর্তী আন্দোলনের দিকপাল ।

আজকের দিনের ফ্রি পত্রিকাগুলোর অন্যতম স্লোগান-মুক্ত খবর, মুক্ত চিন্তা । আর বিশ্বজুঁড়ে এই প্রবল বিজয় উদযাপনে মানবতাবাদীদের একটাই আশা মুক্ত হোক মানবতা , জয় হোক শুভ বুদ্ধির।



নুজহাত নূর সাদিয়া,
এলবিপিসি, লন্ডন ১৪ই অক্টোবর‘ ২৫ সাল ।

মতামত এর আরও খবর