img

নুরের ওপর হামলা: হাসনাতের বিতর্কিত মন্তব্যে রাজনৈতিক মহলে নতুন মেরুকরণ!

প্রকাশিত :  ০৫:৫৭, ৩০ আগষ্ট ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:০৮, ৩০ আগষ্ট ২০২৫

নুরের ওপর হামলা: হাসনাতের বিতর্কিত মন্তব্যে রাজনৈতিক মহলে নতুন মেরুকরণ!

রাজধানীতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হা'ম'লা এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহর কড়া প্রতিক্রিয়া কেবল একটি নিন্দা নয়, বরং এটি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সম্পর্কের গভীরে থাকা অবিশ্বাস ও কৌশলগত বিভাজনকে সামনে এনেছে। হাসনাত তাঁর ফেসবুক মন্তব্যে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে উদ্দেশ্য করে 'ভণ্ডামি'র অভিযোগ এনেছেন এবং এই হা'ম'লাকে 'ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে' আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার একটি 'খেলা'র অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই বিস্ফোরক অভিযোগ ঘটনাটিকে নিছক একটি রাজনৈতিক সংঘাতের বাইরে এনে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

সংঘর্ষের আদ্যোপান্ত: সহিংসতার একটি টাইমলাইন

শুক্রবার (২৯ আগস্ট, ২০২৫) বিকেলে রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও গণঅধিকার পরিষদের (গোপ) নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান অভিযোগ করেন, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাসীরা’ অতর্কিতভাবে তাদের মিছিলে হা'ম'লা চালায়। অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে পাল্টা দাবি করা হয় যে গণঅধিকার পরিষদের কর্মীরাই প্রথমে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে চলা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট ছোড়ার ঘটনায় সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

প্রাথমিক সংঘর্ষের রেশ কাটতে না কাটতেই রাত সাড়ে ৮টার দিকে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে আবারও দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এ সময় গণঅধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের ঘটনাস্থল ত্যাগ করার জন্য ১০ মিনিটের একটি সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, এই সময়ের মধ্যে কর্মীরা সরে না গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ওপর ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। এই লাঠিচার্জের মাঝেই নুরুল হক নুর গুরুতর আহত হন। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাঁর মাথা ফেটে গেছে এবং তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়।

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান তাঁর ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, “নুর মুমূর্ষু অবস্থায়, বাঁচবে কি মরবে জানি না”। ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা-কর্মীরা বাংলামোটর মোড়ে বিক্ষোভ করে এবং গণঅধিকার পরিষদ শনিবার (৩০ আগস্ট) সারা দেশে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দেয়।

হাসনাতের বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়া: রাজনৈতিক ভণ্ডামির অভিযোগ

নুরের ওপর হা'ম'লার পর তাৎক্ষণিকভাবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তাঁর ফেসবুক পেজে হা'ম'লার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তাঁর এই পোস্টের মন্তব্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানান, যা ঘটনাটিকে নতুন মাত্রা দেয়। হাসনাত লেখেন, “প্রতিবাদের কাজ আপনার? ভণ্ডামি বাদ দেন স্যার। যেই জন্য বসানো হইছে সেটা না করে কী কী করছেন এসবের হিসাব দিতে হবে। কে কোথায় কীভাবে কোন কাজে বাধা দিছে এসব খবর আমাদের কাছে আছে। এসব প্রতিবাদের ভং না ধরে কাজটা করেন”।

এই মন্তব্যটি কোনো সাধারণ ব্যক্তিগত বাকবিতণ্ডা নয়; বরং এটি রাজনৈতিক সম্পর্কের এক গভীর বিভাজনকে তুলে ধরে। হাসনাত আবদুল্লাহ, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ছিলেন, আসিফ নজরুলকে তাঁর ভূমিকার জন্য জনসমক্ষে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। 'বসানো হইছে' শব্দটির ব্যবহার একটি গোপন ক্ষমতা-কাঠামোর দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে আসিফ নজরুলের ভূমিকা কেবল প্রকাশ্যে নিন্দা জানানো নয়, বরং নেপথ্যে সুনির্দিষ্ট কাজ করার। হাসনাতের বক্তব্য অনুযায়ী, আসিফ নজরুলের মতো বুদ্ধিজীবী ও উপদেষ্টাদের কাছ থেকে যে ধরনের দৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশিত, তা না করে তাঁরা কেবল লোক-দেখানো প্রতিবাদ করছেন। এটি এক ধরনের কৌশলগত দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে, যেখানে আন্দোলন-কেন্দ্রিক তরুণ নেতৃত্ব এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যে গভীর অবিশ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে। হাসনাতের এই প্রতিক্রিয়া সামগ্রিক আন্দোলনটির লক্ষ্যের প্রতি তাঁদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে এনেছে।

হাসনাত আবদুল্লাহর আরও একটি উল্লেখযোগ্য পোস্ট হলো, যেখানে তিনি নুরের ওপর হা'ম'লাকে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক খেলার অংশ বলে অভিহিত করেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, “ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ব্যাক করানোর এই খেলায় প্রথম রক্ত দিলেন আমাদের নুর ভাই”। তিনি আরও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, বিপ্লবীদের রক্ত ঝরিয়ে আওয়ামী লীগকে ফেরানোর এই চেষ্টা সফল হতে দেবেন না। হাসনাত দাবি করেন, গত ১১ মার্চ তিনি একটি রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছিলেন, যা ভেস্তে গেলেও একই গোষ্ঠী এবার জাতীয় পার্টিকে ব্যবহার করে নিজেদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: জটিল সম্পর্কের জাল

নুরের ওপর হা'ম'লার ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া এসেছে। এই প্রতিক্রিয়াগুলো বিশ্লেষণ করলে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি জটিল চিত্র পাওয়া যায়। গণঅধিকার পরিষদ হা'ম'লার জন্য সরাসরি জাপা ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছে এবং জাপা নিষিদ্ধ করার জন্য তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই হা'ম'লার নিন্দা জানিয়েছেন। তাঁদের বিবৃতিতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অধিকার এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী এই হা'ম'লাকে অতীতের ফ্যাসিবাদী শাসনের দিকে ইঙ্গিত বলে উল্লেখ করে এবং জাপা-কে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর বলে সরাসরি অভিযুক্ত করে। অন্যদিকে, জাপা পাল্টা অভিযোগ করে যে, গণঅধিকার পরিষদের কর্মীরাই প্রথমে তাঁদের কার্যালয়ে হা'ম'লা চালিয়েছে।

প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব: কেন এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ

নুরুল হক নুর ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্রনেতা হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিতি লাভ করেন। এরপর থেকে তিনি বহুবার হা'ম'লা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক দল গণঅধিকার পরিষদ গঠনের পর থেকে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই প্রেক্ষাপটে তাঁর ওপর হা'ম'লা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

এই ঘটনাটির গভীর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে। নুরের ওপর হা'ম'লাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংঘাতকে একটি নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। গণঅধিকার পরিষদ, জামায়াত ও ছাত্র আন্দোলন জাপা-কে কেবল একটি বিরোধী দল হিসেবে দেখছে না, বরং তাদের আওয়ামী লীগের দোসর বা বি-টিম হিসেবে চিহ্নিত করছে। এই বর্ণনার উদ্দেশ্য হলো, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় পার্টির মতো পুরোনো দলগুলোকে প্রান্তিকীকরণ করা এবং তাদের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখনো একটি স্থিতিশীল বহুদলীয় গণতন্ত্রের দিকে এগোতে পারেনি। বরং, এখানে জুলাই বিপ্লবের আদর্শিক মানদণ্ডে রাজনৈতিক দলগুলোর যোগ্যতা যাচাই করা হচ্ছে এবং যারা এই মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে তীব্র অবিশ্বাস ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

হাসনাত আবদুল্লাহর মন্তব্য সেই গভীর অবিশ্বাস ও মেরুকরণেরই প্রতিচ্ছবি। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, এই খেলার মাধ্যমে ভারতের মদদে একটি 'রিফাইন্ড আওয়ামী লীগকে' আবার ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এটি প্রকাশ্য রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ফ্যাক্টরকে টেনে এনেছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

ভবিষ্যৎ পথ: বিক্ষোভ ও দাবি

নুরের ওপর হা'ম'লার ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। গণঅধিকার পরিষদ শনিবার (৩০ আগস্ট) দুপুর ১২টায় দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ময়মনসিংহে গণঅধিকারের বিক্ষুব্ধ কর্মীরা জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে ভাঙচুর করেছে। এছাড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হা'ম'লার নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে।

নুরের ওপর হা'ম'লা এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংঘাতগুলো কীভাবে পরিচালিত হবে তার একটি নজির স্থাপন করবে। বিভিন্ন পক্ষ থেকে হা'ম'লায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার এবং জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, সেগুলোর প্রতি নতুন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি এই দাবিগুলোর প্রতি যথাযথ সাড়া না দেওয়া হয়, তবে এটি আরও সহিংসতাকে উৎসাহিত করতে পারে। পক্ষান্তরে, যদি হা'ম'লায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে তা নতুন রাজনৈতিক জবাবদিহিতার একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে। এই ঘটনাটি তাই শুধুমাত্র একটি সংঘাতের খবর নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক রূপান্তরের স্থিতিশীলতার একটি ব্যারোমিটার।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হা'ম'লার ঘটনাটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভঙ্গুরতা এবং অন্তর্নিহিত উত্তেজনাকে স্পষ্ট করেছে। এই ঘটনাটি শুধুমাত্র দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যেকার সংঘর্ষ ছিল না, বরং এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যেকার গভীর অবিশ্বাস, আদর্শিক বিভাজন এবং রাজনৈতিক কৌশলগত ভিন্নতাকে উন্মোচন করেছে। হাসনাত আবদুল্লাহর বিস্ফোরক মন্তব্য এই ঘটনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা এবং একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

এই আক্রমণ এবং এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলি ইঙ্গিত দেয় যে, যদিও একটি রাজনৈতিক আধিপত্যের যুগের অবসান ঘটেছে, তবে তার নিচে চাপা পড়া উত্তেজনা, গভীর অবিশ্বাস এবং আদর্শিক সংঘাতগুলো এখনো বিদ্যমান। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা এখনো অনেক দূরের পথ এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে এই ধরনের ঘটনাগুলির প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে।


মতামত এর আরও খবর

img

আগামী নির্বাচনের আগাম পূর্বাভাস

প্রকাশিত :  ১৫:২৮, ২৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৭:২২, ২৫ নভেম্বর ২০২৫

সাইফুল খান 

বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক রোগে আক্রান্ত, যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। এই রোগের নাম "ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা"। আর এই রোগের উপসর্গ অন্ধত্ব। আমরা সবাই এই অন্ধত্বে আক্রান্ত। নেতা, কর্মী, বুদ্ধিজীবী এমনকি সেই সাধারণ মানুষটিও, যে প্রতি পাঁচ বছর পরপর ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবে সে কিছু একটা পরিবর্তন করবে। অথচ পরিবর্তনের নামে সে কেবল সেই পুরনো অসুখটাকেই বুকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। সেটার নাম হতাশা।

বিএনপি এই দেশে বিরোধী রাজনীতির বৃহত্তম শক্তি। এ কথা যে মিথ্যা নয়, তা সমীক্ষার সংখ্যাই বলে দেয়। Innovision-এর “People’s Election Pulse Survey (PEPS)”–এ ১০,৪১৩ জন নাগরিকের সাক্ষাতে উঠে এসেছে— ৪১.৩% ভোটার বিএনপিকে ভোট দিতে প্রস্তুত।

আর যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না থাকে তাহলে সেই সমর্থন লাফিয়ে গিয়ে ৪৫.৬%।

৩৯.১% মানুষ মনে করে তারা “আগামী সরকারের যোগ্য দল”। খুলনায় ৪৩.৩%, ময়মনসিংহে ৪৫.৭% সমর্থন এগুলো কোনো সাধারণ সংখ্যা নয়।

কিন্তু শক্তির শিখরে দাঁড়িয়ে যে বিভাজন শুরু হয়েছে, সেটিই BNP-এর সবচেয়ে বড় শত্রু।

শত্রু আওয়ামী লীগ নয়; শত্রু গণতন্ত্র নয়; শত্রু সামরিক বা অ-সামরিক কোনো শক্তিও নয়। তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু নিজেদের ভেতরের মানুষগুলো।

২৩৭টি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলো, আর দলটি মুহূর্তেই ডুমুরের পাতার মতো কাঁপতে লাগলো। মনোনয়ন বঞ্চিতদের ত্যাগী নেতাদের চোখে ক্ষোভ, কথায় ব্যঙ্গ, বুকে প্রতিহিংসা। তারা ভাবলো “দল আমাকে দেয়নি, দেশ আমাকে অবশ্যই দেবে।” ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঢল দেখার অপেক্ষা করতেই পারে জনগন। 

রাজনীতির এই কান্না, এই আক্রোশ, এই আত্মপরাজয়ের গল্প এমন সময় ঘটছে যখন বিরোধী ভোট তিনটি ধারায় ভেঙে সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছে।

প্রথম ধারাটি হলো- জামায়াত–ই–ইসলামি।

জামায়াত বিরোধী পোক্ত রাজনৈতিক ন্যারেটিভের কারনে অনেকে তাদের অপছন্দ করে। আবার অনেকেই ভালোও বাসে। কিন্তু সংখ্যার গাণিতিক সত্যকে কোনো দার্শনিক লেকচার দিয়ে বদলানো যায় না। জামায়াত জাতীয়ভাবে ৩০.৩% সমর্থন পাচ্ছে এই একই সমীক্ষায়।  রংপুরে তারা ৪৩.৪% যেখানে বিএনপিকেও তারা ছুঁয়ে ফেলে।

এই দলের সঙ্গে এখন আরও ৮টি সমমনা দল যুক্ত হয়েছে৷ একটি জোট, যার উদ্দেশ্য রাজনীতিকে পুনরায় এক বৈশিষ্ট্যময় রূপ দেওয়া।

বিএনপি কি এই বাস্তবতা দেখে?

হ্যাঁ, দেখে।

কিন্তু তারা দেখে ঠিক যেভাবে সূর্যাস্তের দিকে তাকালে মানুষ চোখ বুজে ফেলে।

তারপর আসে তৃতীয় লাইন NCP, জাতীয় নাগরিক পার্টি।  এটি নতুন প্রজন্মের দল।

PEPS-এ এদের সমর্থন ৪.১%। BIGD রিপোর্টে ২.৮%। কিন্তু যুবসমাজে SANEM-এর হিসাব বলছে ১৫.৮৪% সম্ভাবনা।

এই সংখ্যা হয়তো ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু “রাজনীতি” নামের যে মৃগয়ায় আসন দখল করতে হয় তার জন্য এই পরিমাণ ভোটই কখনো কখনো সরকার পরিবর্তনের কাঁটা ঘুরিয়ে দেয়।

এনসিপি এমন সময়ে জোট করছে যখন বিএনপি নিজ ঘর সামলাতে ব্যস্ত। জামায়াত তার সমর্থনকে শক্ত জোটে রূপ দিচ্ছে, আর আওয়ামী লীগ নীরব কিন্তু সতর্ক। এনসিপি যেভাবে তরুণ ভোটারের মনস্তত্ত্বে ঢুকেছে BNP তা পারেনি। এনসিপির এই উত্থানই বিশ্লেষকদের মুখে এক নতুন সত্য তুলে এনেছে। জামায়াত যতটা নয়, এনসিপির জোট বিএনপির ভোটকে আরও বেশি ক্ষয় করতে পারে।

এবার জনগণের দিকে তাকাই। PEPS বলছে-

৫৭.৫% মানুষ আইন-শৃঙ্খলাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে করে। দ্বিতীয় সমস্যা মূল্যস্ফীতি।

দুর্নীতি ও আইনি সংস্কারও শীর্ষ তালিকায়।

আর সবচেয়ে বড় কথা ৪৮.৫% ভোটার এখনও অনির্ধারিত।

এই অনির্ধারিত মানুষের দলটাই আসল নাটকের মূল চরিত্র। তারা এমন জনগোষ্ঠী যারা রাষ্ট্রের অস্থিরতার মাপ দেখে সিদ্ধান্ত নেয়, দলের পতাকা দেখে নয়। এই অনির্ধারিত মানুষদের ভোট BNP হারাবে কিনা, তা ঠিক করবে তাদের ভেতরের বিভাজন, জামায়াতের জোটগত শক্তি এবং এনসিপির আগ্রাসী নতুন-রাজনীতির ভাষা।

বিএনপি হয়তো সমীক্ষায় এগিয়ে আছে, কিন্তু রাজনীতি কেবল সমীক্ষার খেলাও নয়।এটি সময়ের নির্মম ব্যঙ্গ। যে দল নিজের ঘরে শান্তি রাখতে পারে না, সে কি দেশের শান্তি রাখতে পারবে? প্রশ্ন অবান্তর নয়, যৌক্তিক।

বিএনপির ভেতরের ক্ষয়, জামায়াতের আলাদা শক্তি, এনসিপির যুব-স্রোত এই তিনটি মিলিয়ে বিএনপির সম্ভাব্য ভোট উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে এমনটাই সমীক্ষা, বিশ্লেষক এবং মাঠের বাস্তবতা একসঙ্গে নির্দেশ করছে। সময়ের সাথে বিএনপির ভোট কমার আশংকাই নির্দেশ করছে।

রাজনীতি শেষ পর্যন্ত মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপর দাঁড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি দাঁড়ায় মানুষের ক্ষোভের ওপর। আর যে দেশে ক্ষোভই প্রধান চালিকাশক্তি। সেখানে বিভাজনই প্রকৃত নিয়ন্তা।

বিএনপি কি এই বিভাজন সামলাতে পারবে?

জামায়াত কি তাদের জোটকে সত্যিকারের শক্তিতে রূপ দিতে পারবে? এনসিপি কি নতুন প্রজন্মের বিশ্বাসকে ভোটে পরিণত করতে পারবে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা পেতে পারি।

কিন্তু রাজনীতি? রাজনীতি কখনো সরাসরি উত্তর দেয় না। সে দেয় সংকেত, দেয় ইঙ্গিত, আর মাঝেমধ্যে দেয় নির্মম হাসি।

শেষ পর্যন্ত মনে হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন শুধু একটি গণতান্ত্রিক অনুষ্ঠান নয়; এটি ক্ষমতার মনস্তত্ত্বের এক বিশাল মানসিক-নাট্যমঞ্চ, যেখানে প্রত্যেক দল নিজের ট্র্যাজেডি নিজেই রচনা করে, নিজেই অভিনয় করে, আর শেষে বিস্ময়করভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত করতালি দাবি করে!


লেখক-ইতিহাস,রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর