img

আসিম মুনিরের লিগ্যাল ইমিউনিটি: পাকিস্তানের অন্ধকার ভবিষ্যৎ

প্রকাশিত :  ১৮:৪১, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৯:১১, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

আসিম মুনিরের লিগ্যাল ইমিউনিটি: পাকিস্তানের অন্ধকার ভবিষ্যৎ

সাইফুল খান 

জেনারেল আসিম মুনিরকে দেওয়া আজীবন লিগ্যাল ইমিউনিটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভূমিকম্পের মতো একটি ঘটনা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্রে সেনাবাহিনী আগেই ছিল সবল, কিন্তু এবার সামরিক ক্ষমতার ওপর যে “অভিশাপহীনতা” ও “বিচার-বহির্ভূত নিরাপত্তা” দেওয়া হলো। তা শুধু একটি দেশের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; বরং নতুন আঞ্চলিক জটিলতার প্রতিচ্ছবি।অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই ইমিউনিটি শুধু অভ্যন্তরীণ শক্তি‑রাজনীতির ফল নয়; এটি সৌদি আরব‑মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র‑ট্রাম্প অক্ষের নতুন জিওস্ট্র্যাটেজিক সমীকরণের পুরস্কার। যার মূল লক্ষ্য আফগানিস্তান শাসনব্যবস্থাকে চাপের মুখে রাখা, তালেবানের বিপরীতে পাকিস্তানকে ব্যবহার করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন সামরিক খেলা শুরু করা।

১. সৌদি–ট্রাম্প অক্ষ: কেন আসিম মুনিরকে প্রয়োজন

সৌদি আরবের সাম্প্রতিক কৌশল লক্ষ্য করলে দেখা যায়। তারা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সামরিক পার্টনারশিপ গড়ে তুলছে। ইরানের প্রভাব মোকাবিলা, ইয়েমেনের সামরিক প্রতিরোধ এবং ভবিষ্যতের আঞ্চলিক ব্লক তৈরি সব মিলিয়ে সৌদি আরব পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাদের ‘এক্সটেনশন ফোর্স’ হিসেবে বিবেচনা করে আসছে বহুদিন। এখন সেটা নতুন স্ট্র্যাটেজিক চুক্তির কারনে আরো ঘনিষ্ট।

অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য‑কৌশল বরাবরই ছিল দুই স্তরে:

ক ইস্রায়েলের সুরক্ষা, 

খ.আফগানিস্তান‑পাকিস্তান বেল্টে ‘প্রক্সি’ শক্তি তৈরি।

এই দুই উদ্দেশ্যের মিলনস্থল হলো পাকিস্তান আর্মি।

আসিম মুনির সৌদির পছন্দের মানুষ হিসেবে পরিচিত; একই সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকে ওয়াশিংটনের কিছু নিরাপত্তা চক্র তাঁকে “বিশ্বস্ত সামরিক পার্টনার” হিসেবে দেখেছে বলে বহু বিশ্লেষকের ধারনা। তাই তাঁর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে এই অক্ষ লাভবান হবে।

২. কেন লিগ্যাল ইমিউনিটি এই অক্ষের জন্য সুবিধাজনক

লিগ্যাল ইমিউনিটির অর্থ হলো:

ভবিষ্যতে কোনো জবাবদিহিতা নেই।

সামরিক অভিযান বা গোয়েন্দা অপারেশন প্রশ্নহীনভাবে চালানো সম্ভব।বিদেশি শক্তির সাথে সামরিক সহযোগিতায় বাধা কম।দেশের রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে সামরিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ। এই অবস্থায় আসিম মুনির এমন একটি পূর্ণ ক্ষমতাধর সামরিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন, যাঁর সাহায্যে:

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে নতুন স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করতে পারবে

তালেবান সরকারকে চাপে রাখতে পাকিস্তানের ভৌগোলিক সুবিধা ব্যবহারের জন্য এমন সামরিক নেতৃত্ব দরকার। যিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ঝামেলা ছাড়াই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

সৌদি আরব পাকিস্তানকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা পার্টনার হিসেবে আরও দৃঢ়ভাবে ব্যবহার করতে পারবে। বিশেষত ইরানের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সহযোগিতা ও কনফ্লিক্ট থিয়েটার ব্যবস্থাপনায়।

৩. পাকিস্তানের গণতন্ত্রে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব

জেনারেল আসিম মুনিরের আজীবন লিগ্যাল ইমিউনিটি শুধু একজন সেনাপ্রধানকে আইনি সুরক্ষা দিচ্ছে না; এটি পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে তিন স্তরে মারাত্মক আঘাত করছে।

ক. বিচার বিভাগের নির্জীবতা

একজন সেনাবাহিনী প্রধানকে আজীবন মামলাহীন করা মানে:

১. সুপ্রীম কোর্টের ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হওয়া

সুপ্রিম কোর্ট বা নিম্ন আদালত এখন সেনাবাহিনী প্রধানকে তদন্ত বা অভিযুক্ত করতে পারবে না।

দীর্ঘমেয়াদে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নষ্ট হবে এবং বিচারালয় শুধুই প্রশাসনিক কার্য সম্পাদন করবে, ন্যায়বিচারের রক্ষক হিসেবে নয়।

২. আইনের সমতা ধ্বংস

সাধারণ নাগরিক, সাংবাদিক বা রাজনৈতিক নেতা যে আইন অনুসারে দায়ী, সেই সমতার ধারণা সেনাপ্রধানের ক্ষেত্রে আর থাকবে না।

এটি জনগণের মধ্যে আইনের প্রতি আস্থা হ্রাস করবে।

৩. সেনাবাহিনী-আদালত সম্পর্কের আধিপত্য

বিচার বিভাগ এখন সেনাবাহিনীকে সমর্থন বা অনুমোদনের জন্য কাজ করবে।

সেনাবাহিনীকে এক ধরনের “অ্যাডজান্ট বিভাগ” হিসেবে দেখা হবে। যেখানে আদালত সিদ্ধান্তে স্বাধীন নয়, বরং সামরিক প্রভাবের অধীন থাকবে।

খ. সংসদ এবং নির্বাচনী রাজনীতি অচল

লিগ্যাল ইমিউনিটি স্পষ্টভাবে একটি বার্তা দেয়:

 “রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা জনগণের ভোটে নয়, বুটের আওয়াজে।”

১. নির্বাচিত সরকার এবং সংসদের কার্যক্ষমতা সীমিত। রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে সেনাবাহিনীর অনুমোদন নিতে হবে।

সেনা-নেতৃত্বের অগ্রাধিকার সংবিধানগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সংসদকে কার্যত ফর্মালিটি হিসেবে দেখা হবে।

২. রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিকূল পরিবেশ:

বিরোধী দলগুলো সেনাবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা নীতিগত চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। ভোট ও জনমতের প্রভাব কমে যাবে, কারণ সামরিক ক্ষমতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপরে দখল করবে।

৩. রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধ্বংস:

দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আত্মসংশয় তৈরি হবে। সরকার শুধু “সামরিক স্বার্থ রক্ষা করে টিকে থাকা”র ওপর নির্ভরশীল হবে।

গ. বেসামরিক প্রশাসনের ‘সিস্টেমিক দাসত্ব’

লিগ্যাল ইমিউনিটি বেসামরিক প্রশাসনকে বাধ্য করে সামরিক স্বার্থ রক্ষা করতে। এর ফলে:

১. স্বাধীন নীতিনির্ধারণের সীমাবদ্ধতা

অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কূটনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসন সেনাবাহিনীর দিকনির্দেশনা মেনে চলবে। সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা নেই, সবকিছু সামরিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে।

২. গণতান্ত্রিক কাঠামোর ফরমালিটি

সরকার এবং সংসদ এখন কেবল প্রশাসনিক ফর্মালিটি। আসলে দেশের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, সেনাবাহিনী ও তার নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করে।

৩. দীর্ঘমেয়াদী সংস্কৃতিগত প্রভাব

সাধারণ নাগরিক ও সরকারি কর্মকর্তা অনুপ্রেরণা হারাবে। সামাজিক ও প্রশাসনিক মানসিকতা হবে “সেনার নির্দেশ পালনের ওপর নির্ভরশীল”।

৪. পাকিস্তানে সামরিকতন্ত্রের নতুন অধ্যায়

লিগ্যাল ইমিউনিটি দিয়ে এমন একজন সামরিক প্রধানকে “অতিমানবিক আইনি ক্ষমতা” প্রদান করা হলো, যার প্রভাব সরাসরি তিন ভাবে দেখা যাবে:

১. সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সর্বশক্তি

এখন আর তারা পর্দার আড়ালে নয় সংবিধানে, আইনে, বাস্তবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।

২. ভবিষ্যতের সামরিক শাসকদের প্রণোদনা

আজ আসিম মুনির; কাল অন্য কেউ।

এই নজির ভবিষ্যতের যে কোনো সামরিক প্রধানকে “অভিযুক্তহীন রাজা” বানিয়ে দিতে পারে।

৩. রাষ্ট্রের ভেতরে দ্বিতীয় রাষ্ট্র

সামরিক গোয়েন্দা, সাইবার, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, কূটনীতি সবকিছুতেই সেনাবাহিনীর আলাদা সিস্টেম তৈরি হবে।

৪. ভারতের জন্য কেন উদ্বেগজনক

ভারতের জন্য এটি তিন কারণে দুশ্চিন্তার বিষয়:

ক. পাকিস্তানে ক্ষমতা সম্পূর্ণ সামরিক হাতে গেলে সীমান্ত পরিস্থিতি অনিশ্চিত হবে।সেনাবাহিনী রাজনৈতিক হিসাব কম করে মাঠের সিদ্ধান্ত বেশি নেবে।

খ.আফগানিস্তানে মার্কিন‑পাকিস্তানি অপারেশন হলে আঞ্চলিক ব্যালান্স বদলে যাবে। এর প্রভাব ভারতের উত্তর সীমান্তেও পড়বে।

গ.চীন–পাকিস্তান–সৌদি–আমেরিকা চতুর্মুখী জটিলতা নতুন আঞ্চলিক জোট তৈরি করবে। যা ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থানকে চাপে ফেলতে পারে।

উপসংহার:  আসিম মুনিরের লিগ্যাল ইমিউনিটি শুধু পাকিস্তানের আইনগত সিদ্ধান্ত নয়।এটি একটি নতুন আঞ্চলিক শক্তি বিন্যাসের সিগন্যাল।সৌদি আরব একটি নিরাপত্তা‑অক্ষ তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান নীতিতে পুনরায় প্রবেশের চেষ্টা করছে।ট্রাম্প–ইস্রায়েল–গালফ অক্ষ আবার সক্রিয় হচ্ছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই অক্ষের “নতুন গিয়ার” হিসেবে প্রস্তুত হচ্ছে। এর মাশুল দেবে পাকিস্তানের জনগণ। গণতন্ত্র, রাজনীতি, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা সবকিছু আরো দুর্বল হবে। আর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি প্রবেশ করবে এক অনিশ্চিত, অস্থিতিশীল, সামরিকতান্ত্রিক ভবিষ্যতে।


লেখক- ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর

img

আগামী নির্বাচনের আগাম পূর্বাভাস

প্রকাশিত :  ১৫:২৮, ২৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৭:২২, ২৫ নভেম্বর ২০২৫

সাইফুল খান 

বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক রোগে আক্রান্ত, যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রের কোনো গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। এই রোগের নাম "ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা"। আর এই রোগের উপসর্গ অন্ধত্ব। আমরা সবাই এই অন্ধত্বে আক্রান্ত। নেতা, কর্মী, বুদ্ধিজীবী এমনকি সেই সাধারণ মানুষটিও, যে প্রতি পাঁচ বছর পরপর ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভাবে সে কিছু একটা পরিবর্তন করবে। অথচ পরিবর্তনের নামে সে কেবল সেই পুরনো অসুখটাকেই বুকে নিয়ে বাড়ি ফেরে। সেটার নাম হতাশা।

বিএনপি এই দেশে বিরোধী রাজনীতির বৃহত্তম শক্তি। এ কথা যে মিথ্যা নয়, তা সমীক্ষার সংখ্যাই বলে দেয়। Innovision-এর “People’s Election Pulse Survey (PEPS)”–এ ১০,৪১৩ জন নাগরিকের সাক্ষাতে উঠে এসেছে— ৪১.৩% ভোটার বিএনপিকে ভোট দিতে প্রস্তুত।

আর যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না থাকে তাহলে সেই সমর্থন লাফিয়ে গিয়ে ৪৫.৬%।

৩৯.১% মানুষ মনে করে তারা “আগামী সরকারের যোগ্য দল”। খুলনায় ৪৩.৩%, ময়মনসিংহে ৪৫.৭% সমর্থন এগুলো কোনো সাধারণ সংখ্যা নয়।

কিন্তু শক্তির শিখরে দাঁড়িয়ে যে বিভাজন শুরু হয়েছে, সেটিই BNP-এর সবচেয়ে বড় শত্রু।

শত্রু আওয়ামী লীগ নয়; শত্রু গণতন্ত্র নয়; শত্রু সামরিক বা অ-সামরিক কোনো শক্তিও নয়। তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু নিজেদের ভেতরের মানুষগুলো।

২৩৭টি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হলো, আর দলটি মুহূর্তেই ডুমুরের পাতার মতো কাঁপতে লাগলো। মনোনয়ন বঞ্চিতদের ত্যাগী নেতাদের চোখে ক্ষোভ, কথায় ব্যঙ্গ, বুকে প্রতিহিংসা। তারা ভাবলো “দল আমাকে দেয়নি, দেশ আমাকে অবশ্যই দেবে।” ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঢল দেখার অপেক্ষা করতেই পারে জনগন। 

রাজনীতির এই কান্না, এই আক্রোশ, এই আত্মপরাজয়ের গল্প এমন সময় ঘটছে যখন বিরোধী ভোট তিনটি ধারায় ভেঙে সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছে।

প্রথম ধারাটি হলো- জামায়াত–ই–ইসলামি।

জামায়াত বিরোধী পোক্ত রাজনৈতিক ন্যারেটিভের কারনে অনেকে তাদের অপছন্দ করে। আবার অনেকেই ভালোও বাসে। কিন্তু সংখ্যার গাণিতিক সত্যকে কোনো দার্শনিক লেকচার দিয়ে বদলানো যায় না। জামায়াত জাতীয়ভাবে ৩০.৩% সমর্থন পাচ্ছে এই একই সমীক্ষায়।  রংপুরে তারা ৪৩.৪% যেখানে বিএনপিকেও তারা ছুঁয়ে ফেলে।

এই দলের সঙ্গে এখন আরও ৮টি সমমনা দল যুক্ত হয়েছে৷ একটি জোট, যার উদ্দেশ্য রাজনীতিকে পুনরায় এক বৈশিষ্ট্যময় রূপ দেওয়া।

বিএনপি কি এই বাস্তবতা দেখে?

হ্যাঁ, দেখে।

কিন্তু তারা দেখে ঠিক যেভাবে সূর্যাস্তের দিকে তাকালে মানুষ চোখ বুজে ফেলে।

তারপর আসে তৃতীয় লাইন NCP, জাতীয় নাগরিক পার্টি।  এটি নতুন প্রজন্মের দল।

PEPS-এ এদের সমর্থন ৪.১%। BIGD রিপোর্টে ২.৮%। কিন্তু যুবসমাজে SANEM-এর হিসাব বলছে ১৫.৮৪% সম্ভাবনা।

এই সংখ্যা হয়তো ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু “রাজনীতি” নামের যে মৃগয়ায় আসন দখল করতে হয় তার জন্য এই পরিমাণ ভোটই কখনো কখনো সরকার পরিবর্তনের কাঁটা ঘুরিয়ে দেয়।

এনসিপি এমন সময়ে জোট করছে যখন বিএনপি নিজ ঘর সামলাতে ব্যস্ত। জামায়াত তার সমর্থনকে শক্ত জোটে রূপ দিচ্ছে, আর আওয়ামী লীগ নীরব কিন্তু সতর্ক। এনসিপি যেভাবে তরুণ ভোটারের মনস্তত্ত্বে ঢুকেছে BNP তা পারেনি। এনসিপির এই উত্থানই বিশ্লেষকদের মুখে এক নতুন সত্য তুলে এনেছে। জামায়াত যতটা নয়, এনসিপির জোট বিএনপির ভোটকে আরও বেশি ক্ষয় করতে পারে।

এবার জনগণের দিকে তাকাই। PEPS বলছে-

৫৭.৫% মানুষ আইন-শৃঙ্খলাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে করে। দ্বিতীয় সমস্যা মূল্যস্ফীতি।

দুর্নীতি ও আইনি সংস্কারও শীর্ষ তালিকায়।

আর সবচেয়ে বড় কথা ৪৮.৫% ভোটার এখনও অনির্ধারিত।

এই অনির্ধারিত মানুষের দলটাই আসল নাটকের মূল চরিত্র। তারা এমন জনগোষ্ঠী যারা রাষ্ট্রের অস্থিরতার মাপ দেখে সিদ্ধান্ত নেয়, দলের পতাকা দেখে নয়। এই অনির্ধারিত মানুষদের ভোট BNP হারাবে কিনা, তা ঠিক করবে তাদের ভেতরের বিভাজন, জামায়াতের জোটগত শক্তি এবং এনসিপির আগ্রাসী নতুন-রাজনীতির ভাষা।

বিএনপি হয়তো সমীক্ষায় এগিয়ে আছে, কিন্তু রাজনীতি কেবল সমীক্ষার খেলাও নয়।এটি সময়ের নির্মম ব্যঙ্গ। যে দল নিজের ঘরে শান্তি রাখতে পারে না, সে কি দেশের শান্তি রাখতে পারবে? প্রশ্ন অবান্তর নয়, যৌক্তিক।

বিএনপির ভেতরের ক্ষয়, জামায়াতের আলাদা শক্তি, এনসিপির যুব-স্রোত এই তিনটি মিলিয়ে বিএনপির সম্ভাব্য ভোট উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে এমনটাই সমীক্ষা, বিশ্লেষক এবং মাঠের বাস্তবতা একসঙ্গে নির্দেশ করছে। সময়ের সাথে বিএনপির ভোট কমার আশংকাই নির্দেশ করছে।

রাজনীতি শেষ পর্যন্ত মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপর দাঁড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি দাঁড়ায় মানুষের ক্ষোভের ওপর। আর যে দেশে ক্ষোভই প্রধান চালিকাশক্তি। সেখানে বিভাজনই প্রকৃত নিয়ন্তা।

বিএনপি কি এই বিভাজন সামলাতে পারবে?

জামায়াত কি তাদের জোটকে সত্যিকারের শক্তিতে রূপ দিতে পারবে? এনসিপি কি নতুন প্রজন্মের বিশ্বাসকে ভোটে পরিণত করতে পারবে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা পেতে পারি।

কিন্তু রাজনীতি? রাজনীতি কখনো সরাসরি উত্তর দেয় না। সে দেয় সংকেত, দেয় ইঙ্গিত, আর মাঝেমধ্যে দেয় নির্মম হাসি।

শেষ পর্যন্ত মনে হয়, বাংলাদেশে নির্বাচন শুধু একটি গণতান্ত্রিক অনুষ্ঠান নয়; এটি ক্ষমতার মনস্তত্ত্বের এক বিশাল মানসিক-নাট্যমঞ্চ, যেখানে প্রত্যেক দল নিজের ট্র্যাজেডি নিজেই রচনা করে, নিজেই অভিনয় করে, আর শেষে বিস্ময়করভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত করতালি দাবি করে!


লেখক-ইতিহাস,রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর